পুরনো ডায়েরি
Jul 20, 2025
Jul 4, 2022
'বিড়ম্বনা' - রণীতা দে
Edit Posted by নেট ফড়িং with No comments
বিড়ম্বনা
রণীতা দে
অরুপ ও রূপালী দুজনেই সিভিল
ইঞ্জিনিয়ার। ওরা ব্লকে চাকরি
করে। ওদের পরিচয় চাকরি করতে করতেই। দু’জনের বাড়ি থেকেই দু’জনকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে, রূপালী দেখতে মন্দ নয়। দু’জনেরই
দু’জনের প্রতি একটা ফিলিংস্ও আছে।
দু’জনে বাসেই যাতায়াত করে। অরুপ রোজ
রূপালীর ভাড়া দেয়। রূপালী কোনো আপত্তি করে না। মাঝে মাঝে রূপালী বাড়ি থেকে টিফিন
বানিয়ে আনে ওরা এক সাথে খায়। সিনিয়র দাদারা দেখলেই বলে এভাবে আর কতদিন চলবে এবার
রূপালীকে বাড়িতে নিয়ে আয়। কেউ কোনো উত্তর দেয় না শুধু মুচকি হাসে।
রেটিনা অরুপ ও রূপালীর সহকর্মী। হঠাৎই
একদিন রেটিনা রূপালীর বাড়িতে গিয়ে ওর বাবাকে বলল অরুপদা খুব বাজে ছেলে। এতদিন আমাকে
নিয়ে খেলেছে এখন ওর লক্ষ্য রূপালী।
রূপালী বাড়িতে এলেই ওর বাবা বললেন
তোমার দিদির কাকাতো দেওরের তোমাকে খুব পছন্দ। কাল ওরা তোমাকে দেখতে আসছেন। ছেলেটি
বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, আমার ছেলেটিকে মন্দ লাগে না, আমি চাই তুমি ওকেই
বিয়ে কর।
তিন দিন পর রূপালী নিজের গাড়িতে
অফিসে এল ওর ইস্তফা জমা দিতে। রূপালীকে দেখে অরুপ খুব খুশি। অরুপ রূপালীকে কিছু
একটা বলতে যাচ্ছিলো তখনই রূপালী একটা খুচরো পয়সা ভর্তি ছোট্ট বটুয়া অরুপের হাতে
দিয়ে বলল “অরুপদা এ জন্মে আমার আর তোমার বাড়ির
লক্ষ্মী হওয়া হল না। তোমার বাস ভাড়াগুলো ফেরত দিলাম”। এটা কি শুধুই রেটিনার ষড়যন্ত্র নাকি ভাগ্যের বিড়ম্বনা।
Mar 8, 2022
"একজন অতি পরিচিত প্রিয় মানুষ" - অরিত্র রায়
Edit Posted by নেট ফড়িং with No comments
একজন অতি পরিচিত প্রিয় মানুষ
অরিত্র রায়
কলেজটি ছিল আলিপুরদুয়ারে তাই বাসে ট্রেনে কোনো রকম ভীড়ভাট্টা দেখতে হয়নি
তবে চার পাঁচটে হকার ও ভিক্ষুকরা হাত পাততে দেখতাম সবার কাছে তবে আমার কাছে তারা কোনোদিন
সাহস পায়নি। আমি আগাগোড়াই ভীড়ভাট্টা কোনোদিন পছন্দ করতাম না তবে ভীড়ভাট্টা মধ্যে এক
বিশেষ সুবিধা ছিল অনেকদিনের অত্যন্ত পরিচিত মানুষটিকে অচেনার ভান করে সহজে এরিয়ে যাওয়া
যায়
এই তো দু আড়াই বছর আগেই আমি আলিপুরদুয়ার কলেজের অধ্যাপক হিসেবে ঢুকেছিলাম
তার কিছু মাস পরের আমার সঙ্গে একটা ঘটনা ঘটলো, কি বার? কতো তারিখ? সত্যিই আমার মনে
পরছে না সেইদিন কি আলিপুরদুয়ার যাওয়ার লোকাল ট্রেন ছিল ? না তাও মনে নেই! তবে এটা মনে
আছে যে একটি ফাঁকা compartment দেখে উঠে পড়েছিলাম তারপর যা হলো আরকি হঠাৎ করে দেখলাম
যে আমার বিপরীত সিটে আমার অতি পরিচিত প্রিয় মানুষটি বসে আছে । তার সঙ্গে B.SC পাশ
করার পর আর দেখা হয় নি । ভাবলাম জিজ্ঞেস করি একবার যে কেমন আছো? কি করছো? বা চাকরি
পেয়ে গেছো কি না? ইত্যাদি... তবে এই সব জিজ্ঞেস
করা কিছুই হয়নি আবার নতুন করে পরিচয় করতে
হলো নেহাত শুকনো হাসি বিনিময় আর আমার হাসি তো অত্যন্ত সস্তা সবসময় মুখে লেগেই থাকে,
এজন্য এত বড় হওয়ার পরও বাবা মা এখনো সবসময় বকাবকি করতেই থাকে।
যাইহোক ওদিকে ঠোঁটে কোনো হাসি ছিল
না খালি ঠোঁটটাই ফাঁক হয়ে ছিল
তারপর নানান রকমের প্রশ্ন করা শুরু করলাম তবে প্রশ্নাত্তর হ্যাঁ, ও, হাম, আচ্ছা এতে মন ভরছিল
না চাইছিলাম আরো কিছু বলুক অত্যন্ত জিজ্ঞেস করুক আমার ব্যাপারে কিন্তু না... সেই তখন থেকে কি যে
দেখে যারছিল জানলার বাইরে সত্যিই সেটা একমাত্র
ভগবান ছাড়া আর কেউ জানে না আমি মনে হয় তার মধ্যে অনেকবার প্রশ্ন করে ফেলেছি নিজেকে
বড্ড বোকা বোকা লাগছিল তারপর যে কখন জানি না আমিও জানলার বাইরে দেখলাম আর মাত্র কয়েক
ঘন্টা পর আমার স্টেশন তারপর কলেজের ডিউটি এবার আমাকে সত্যিই নেমে পড়তে হবে ভাবলাম
কিছু বলে যাই অত্যন্ত কিছু কি বলবো তুমি চলে গেছো, আমার মন গেছে নাকি বলবো চলে গেছিলে
কেনো, ভালো থাকো, আমিও ভালো আছি।
না না না... এই সব বলার কোনো
মানে নেই তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে আস্তে বললাম যে এতগুলো স্টেশন না গুনলেই চলতো গুনে কি লাভ
হল যা হয়েছে তোমার আর আমার দুজনই ভালোর জন্যই হয়েছে যা হবে ভালোর জন্যই হবে। নাহ্ প্রশ্নাত্তর আসা করি নি আমি কারন ওই যে হ্যাঁ,ও,হাম,আচ্ছা...।
"অভিনয়" - সমর্পিতা সরখেল
Edit Posted by নেট ফড়িং with 3 comments
অভিনয়
সমর্পিতা সরখেল
রাতের লাস্ট লোকাল টাও মিস হয়ে গেলো রিনির। একে বাড়ি ফেরার তাড়া তার
উপর যদি এহেন অবস্থা হয় কার না মাথা ঠিক থাকে। এখন যেতে হবে সেই অটো স্ট্যান্ড এ।
স্টেশন থেকে যা প্রায় হাফ কিমি মতন। কিন্তু অতটা সময় আজ হাতে নেই রিনির। ঘড়িতে সময়
দেখলো প্রায় আট টা চল্লিশ । এদিকে বাড়িতে কথা দিয়েছে আজ 9টায় ঢুকবেই। রিনিকার বাবার
বন্ধু রমেন বাবু আর ওনার স্ত্রী রীতা দেবী দিল্লি থেকে কলকাতা শিফট করেছেন দু সপ্তাহ
হলো। রিনিকার বাবার দেশের বাড়ির লোক রমেন বাবু। রমেন বাবুর ছেলে রনি বিদেশে পড়াশুনা করে এখন নামী বহুজাতিক সংস্থায়
কর্মরত। সেই বাল্যকালে নাকি দুই বন্ধু ঠিক করেছিল তারা আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হবেন
ছেলে মেয়ের বিয়ে দিয়ে। তারপর কাজের সূত্রে দিল্লি চলে যাওয়া।আজ বহু বছর পর রমেন
বাবু ও রীতা দেবী আসছেন রিনিকাদের বাড়ি। সাথে তাদের ছেলে। ডিনারের নিমন্ত্রন। তাই
রিনিকাকে পই পই করে বলেছিলেন রিনিকার বাবা
"আজ অন্তত তাড়াতাড়ি ফিরিস মা। "
কিন্তু পরিস্থিতি যা তাতে মনে হয়না আর সেটা হবে বলে।
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে হাঁটা দিল
রিনি। মনে মনে বস কে আচ্ছা গালি দিতে দিতে রিনি চললো অটো স্ট্যান্ড এর উদ্দেশ্যে। বাবার
কথা কোনদিন ফেলেনি রিনি। সেই ছোট থেকে দেখে আসছে মানুষটা কত পরিশ্রম করে আজ দুই ভাই
বোনকে মানুষ করেছে। সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে বি টেক করে ভালো এম এন সি তে জব
পেয়েছে রিনি আর রিনির ভাই ফিজিক্স এ পি এইচ ডি রিসার্চ স্কলার। সব তাই তো বাবার জন্যই।
তাই কলেজ ইউনিভার্সিটি তে প্রেমের প্রস্তাব নির্দ্বিধায় ফিরিয়ে দিয়েছে কতবার। কারণ
তার বাবা একটাই কথা বলেছেন ছোট থেকে ' দেখ মা আমরা সাধারণ মানুষ। মান সন্মানটাই আমাদের
সম্পদ ।" আজ বাবার কথা রাখতেই তো তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরতে চেয়েছিল রিনি। কিন্তু
ওই খারুস বস। প্রজেক্ট কমপ্লিট করার ডেড লাইন ছিল আগামী কাল । বসের নিজস্ব কিছু কারণে
আজই তা কমপ্লিট করতে হলো ওভার টাইম খেটে ! বস লোকটা কে ঠিক পছন্দ নয় রিনির। কেমন যেন
একটা গায়ে পরা ভাব। সব কিছুতেই যেন মনে হয় রিনির প্রতি অতিরিক্ত যত্ন বান। অফিসের
কলিগ অনিতাও সেদিন বলছিলো। এসব একদম পছন্দ নয় রিনির। অফিস এ ওকে নিয়ে গসিপ ভালোই চলছে। সেদিন তো শ্রীনন্তী একপ্রকার বলেই ফেললো
" কি করে বশ করলি রে রিনিকা । আমরাও তো দিন
রাত অফিস এর কাজ করে চলেছি কই special treatment তো তোর মতো পাইনা। আমাদের বার্থডে তো মনেই থাকে না
স্যার এর অথচ তোর বার্থডে তে হাফ ডে। কিছু লুকোচ্ছিস নাতো।" শুনে
লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছিল রিনির। সেদিন সটান গিয়ে বস এর রুম এ হাজির হয়ে দু কথা
শুনিয়েছিল। নিজেকে ঠিক রাখতে না পেরে বলেছিল,"দেখুন
স্যার। আমি একদম সাধারণ পরিবারের মেয়ে। অনেক সংগ্রাম করে আজ এই জায়গাটা পেয়েছি।
দয়া করে এমন কিছু করবেন না যাতে আমি বাধ্য হই চরম পদক্ষেপ নিতে।" কিন্তু কিসের
কি! অদ্ভুত একটা মুচকি হাসি। রাগে গা জ্বলে যাচ্ছিল
রিনির। এই অদ্ভুত আচরণ গুলোই রিনির সহ্য হয় না।
এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে অটো স্ট্যান্ড এ এসে পৌঁছল রিনি। কপাল জোরে একটা অটো তে ঠাসাঠাসি
করে বসে বাড়ি ফিরল। ঘড়িতে তখন সাড়ে নয়টা। এদিকে রমেনবাবু ও রীতাদেবীও অনেক ক্ষণ হলো এসেছেন। রিনিকার অপেক্ষায় সবাই। সাত তাড়াতাড়ি ফ্রেশ
হয়ে সালোয়ারটা পরেই ড্রইং রুম এ এসে রমেনবাবু-কে
প্রণাম করে পাশের সোফায় তাকাতেই চক্ষু চড়ক গাছ হবার জোগাড় রিনির। একি দেখছে রিনি।
রোহিত সেন !
এখানে !
সোজা বসের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন বাণ ছুড়ে দিল রিনি" আপনি এখানে কি মনে
করে?" পাশে থেকে রিনিকার মা সোমা দেবী মেয়ের হাত চেপে ধরে বলছেন " এসব কি
বলছিস রিনি? ওই তো রনি।
তোর মনে নেই ছোট বেলায় সারাবাড়ি জুড়ে হুট পুটি করতি দুটিতে মিলে। ওই
তো রমেন কাকুর ছেলে রে।" ঘটনার আকস্মিকতায় বাকরুদ্ধ হবার মত অবস্থা রিনির।
শুধু বেরোনোর সময় অস্ফুটে বললো
রিনি
" এতদিনের এই অভিনয়টা না না
করলেই কি হতো না?"
ওপাশ থেকে উত্তর এলো
" সব বলে দিলে কি আর রিনরিনের ওই মিষ্টি মুখের আড়ালে থাকা ঝাঁসির
রানীর তেজময় রূপ চাক্ষুষ করতে পেতাম ?"
Feb 24, 2022
"ইন্টারোগেশন" - মিলন পুরকাইত
Edit Posted by নেট ফড়িং with 1 comment
ইন্টারোগেশন
মিলন
পুরকাইত
ইন্সপেক্টার দেবেন্দ্র চৌধুরী থানায় ঢুকে প্রথমেই একবার লক-আপের দিকে দৃষ্টি দিলেন। সেখানে কাঁচুমাচু
মুখ করে বসে থাকা তিনজন লোকের দিকে ভালো করে তাকালেন। তিনজনকে দেখেই আপাতভাবে গোবেচারা
মনে হয়, কিন্তু সত্যিই কি তাই? দেবেন্দ্র চৌধুরী নিজের কেবিনের দিকে পা-বাড়ালেন। নিজের
চেয়ারে বসার কয়েক মুহুর্তের মধ্যেই মেজোবাবু সাব-ইনসপেকটার অমল দাস একটা ফাইলসহ এসে
তাকে স্যালুট করে দাঁড়ালো। দেবেন্দ্র চৌধুরী মুখ তুলে তাকাতেই অমল দাস বলল, ‘স্যার,
মদন সাহার খুনের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এসে গেছে স্যার। ডাক্তার লাহিড়ী যেটা মৌখিকভাবে
জানিয়েছিলেন রিপোর্টে লিখিতভাবে সেটাই কনফার্ম করেছেন স্যার। মদন সাহাকে গলা টিপে মারা
হয়েছে। তবে গলায় কোনও ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া যায়নি। বুকে ছোরাটা বসানো হয়েছে গলা টিপে
মারার পর। সম্ভবত ছোরা যে মেরেছে সে জানত না যে মদনবাবু আগেই মারা গেছেন। রাত এগারোটা
থেকে সাড়ে এগারোটার মধ্যে মদনবাবুকে ক্ষুন করা হয়েছে। বুকে ছোরাটা বসানো হয়েছে তার
কিছু পরেই। ডাক্তার লাহিড়ীর মতে গলা টিপে মারার মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই বুকে ছোরা বসানো
হয়েছে। বডি তখনও গরম ছিল তাই ব্লিডিং-ও বেশী হয়েছে। তবে ছোরাটাতেও কোনও ফিঙ্গার প্রিন্ট
পাওয়া যায় নি স্যার’।
দেবেন্দ্র
চৌধুরী ভালো করে রিপোর্ট শুনলেন। তারপর হাত বাড়িয়ে অমল দাসের কাছ থেকে ফাইলটা নিলেন,
ফাইলটা খুলে পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা বেশ কিছু সময় ধরে দেখে ফাইলটা বন্ধ করে অমল দাসকে
জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওই তিনজন কি বলছে?’
অমল
দাস বলল, ‘স্যার, আমি আর গনেশবাবু পালা করে গতরাতে সারা রাত ধরে নানাভাবে ওদের জেরা
করেছি। গনেশবাবু তো উদয়কে সঙ্গে নিয়ে তিনজনকে একসময় বেশ উত্তমমধ্যম দিয়েওছেন। কিন্তু
তিনজনে একই কথা বলে যাচ্ছে স্যার, যে তারা নির্দোষ, ওরা কেউ কিছু জানে না, ওরা কেউ
কিছু করেনি। ভোরবেলায় চা দিতে গিয়ে ওই জগু বলে বেয়ারাটা নাকি বিছানায় মদন সাহার লাশ
দেখতে পায়। তখনই সে চেঁচামেচি করে আর তাতেই বাকি দুজন গদাই আর রতন ওই ঘরে এসে পৌছায়
আর তারপর তিনজনে মিলে পুলিশে খবর দেয়’।
দেবেন্দ্রবাবু
একটু ভাবলেন। তারপর বললেন, ‘আমরা পৌছানোর পর ঘরে কি কি মিসিং ছিল বলত?’
অমল
দাস বলল, ‘স্যার কি মিসিং ছিল তা এই তিনচাকরের কেউ বলতে পারেনি। তবে ঘরের আলমারির চাবি
মিসিং ছিল। সেই চাবি কনস্টেবল উদয় বাড়ির পেছনের একটা ময়লার ভ্যাটের মধ্যে পায়। আমরা
সেই চাবি দিয়ে আলমারি খোলার পর তাতে কোনও টাকাপয়সা বা গয়নাগাটি কিছু পাইনি। এখন আদৌ
আলমারিতে সেসব কিছু ছিল কি না জানা যায়নি স্যার। কারণ আলমারিতে তাদের মনিব কি রাখতেন
তা তিনচাকরের কেউ বলতে পারছে না স্যার। আলমারির হাতলেও কোনও ফিঙ্গার প্রিন্ট পাওয়া
যায়নি স্যার। ফরেনসিক কনফার্ম করেছে। বাড়িতে মনিব আর তার তিন চাকর ছাড়া আর কারও ফুটপ্রিন্ট
বা অন্য কোনও প্রমাণের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি স্যার’।
দেবেন্দ্র
চৌধুরী এবার চেয়ার ছেড়ে উঠে পাছনের র্যাক একটা ফাইল নামিয়ে আনলেন। ফাইল খুলে মদন সাহার
ডেডবডির একটা ছবি বের করে ভালো করে দেখলেন। তারপর বললেন, ‘ছোরাটা মারা হয়েছে খুব নৃশংসভাবে।
খুব আক্রোশে। একেবারে বুকে সজোরে গেঁথে দেওয়া হয়েছে। আচ্ছা এই মদন সাহার চরিত্র সম্বন্ধে
খোঁজখবর করেছ?’
অমল
দাস বলল, ‘হ্যাঁ স্যার। পাড়ার লোকেদের অনেককেই ইন্টারোগেট করেছি। বিপত্নীক ছিল স্যার।
টাকা পিশাচ লোক ছিল স্যার। মারাত্মক কিপটে। একাই থাকত। খিটখিটে লোক ছিল স্যার। পাড়ার
ছেলেরা একাদশী বুড়ো নামে আড়ালে ডাকত। নিজের স্ত্রীর চিকিৎসা পর্যন্ত ভালো করে করায়নি।
ব্যাঙ্ক আকাউন্টও গণেশবাবু চেক করেছেন স্যার। বিস্তর টাকা রয়েছে কিন্তু পুজোর চাঁদা
থেকে শুরু করে বন্যাত্রাণ কোনও ব্যাপারেই একটা কড়ি পয়সাও পকেট থেকে বের করতেন না। পাড়ার
ক্লাবের ছেলেদের সঙ্গে এই নিয়ে বছরদেড়েক আগে একবার ঝগড়াও হয়েছিল। ব্যাপারটা থানা পুলিশ
পর্যন্ত এগিয়েছিল। ক্লাবের একটি ছেলের নামে এই থানায় এফআইআর পর্যন্ত করেছিলেন মদনবাবু’।
দেবেন্দ্রবাবু
জিজ্ঞেস করলেন, ‘সেই ছেলেটিকে ধরেছ? সে এখন কোথায়?’
অমল
দাস বলল, ‘সেই ছেলেটি আর বেঁচে নেই স্যার। ওই এফআইআরের ভিত্তিতে সেই সময় যিনি এই থানার
অফিসার-ইন-চার্জ ছিলেন তিনি ছেলেটিকে এরেস্ট করেছিলেন স্যার। ছেলেটির সেইসময় সদ্য একটি
সরকারী চাকরীর পরীক্ষায় পাশ করেছিল স্যার। এই এফআইআর আর গ্রেপ্তারির ফলে কেস কোর্টে
ওঠে পুলিশ ভেরিফিকেশনে এই বিষয়টি সামনে আসায় ছেলেটির চাকরী আর হয়নি স্যার। তার চাকরীতে
জয়েন করার আগেই প্যানেল থেকে তার নাম বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। ছেলেটি তারপরেই আত্মহত্যা
করে। ছেলেটির মা ছিল না স্যার। একমাত্র ছেলের মৃত্যুর পর ছেলেটির বাবাও পঙ্গু হয়ে বিছানা
নিয়েছেন। তার এখন চলশক্তি নেই। সম্পূর্ণ বেডরিডেন’।
‘এসব
কথা কে বলল?’ জানতে চাইলেন দেবেন্দ্র চৌধুরী।
অমল
দাস উত্তর দিল, ‘পাড়ার অনেকেই বলেছে স্যার। তবে বিস্তারিতভাবে জানিয়েছে অনিকেত বসু
নামে একজন মেডিকেল স্টুডেন্ট। অনিকেত ওই পাড়াতেই থাকে। যে ছেলেটি আত্মহত্যা করেছে সেই
জয়দীপের বেস্ট ফ্রেন্ড এই অনিকেত। কথা বলার সময় দেখলাম অনিকেতের মদন সাহার ওপর আক্রোশ
এখনও যায়নি। লোকটা মরার পরও বেশ ক্ষোভ রয়েছে দেখলাম। অবশ্য ক্লাবের ছেলেদের অনেকেরই
দেখলাম এই ব্যাপারে একইরকম মনোভাব। ও, আর একটা কথা স্যার, এই তিনজন চাকরের মধ্যে ঐ
রতন বলে ছোকরা চাকরটির সঙ্গে জয়দীপের বেশ বন্ধুত্ব ছিল আর জয়দীপের বাবাকেও নাকি ও মাঝেমধ্যে
দেখতে যায়। ওষুধপত্র কিছু দরকার হলে বা ডাক্তার ডাকতে হলে ওই রতনকেই ডাকা হয়, সেই ব্যবস্থা
করে দেয়। এই নিয়ে মদন সাহা বেশ কয়েকবার রতনকে বকাবকিও করেছিলেন। আর কিছুদিন আগে জগুর
সঙ্গে মদন সাহার কোনও ব্যাপার নিয়ে বচসা হয়েছিল। সেকথা পাশের বাড়ির রমাপদবাবু শুনতে
পেয়েছিলেন, কিন্তু কারণটা জানতে পারেননি। এদের তিনজনকে সেকথা জিজ্ঞেস করলে এরা কিছু
বলছে না। আরেকটা কথা স্যার, মদন সাহা প্রতি মাসে তার একাউন্ট থেকে বিশ হাজার টাকা একসাথে
আলাদাভাবে তুলতেন, সেটা তিনি কাকে দিতেন বা কি করতেন সেটা ঠিক পরিষ্কার নয়। এই বিশহাজার
টাকা একসাথে তোলা হত। এমনই ব্যবস্থা ছিল ব্যাঙ্কের সঙ্গে। যেরাতে মদন সাহা খুন হন তার
আগের দিনই তিনি ওই বিশহাজার টাকা তুলেছিলেন কিন্তু আমরা ওনার বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে
খুচরো দেড়হাজার টাকা ছাড়া আর কোনও টাকা খুঁজে পাইনি, কোনও গয়নাগাটিও পাইনি’।
‘হুম’,
বলেই দেবেন্দ্র চৌধুরী বললেন, ‘গণেশবাবুকে রেডি হতে বল, ওই তিনজনকে লক-আপ থেকে বের
করে পাশের ইন্টারোগেশন রুমে একসাথে নিয়ে এস। তুমি আর গণেশবাবু থাকলেই হবে। এই তিনজনকে
আমি নিজে একসাথে এখনই একবার ইন্টারোগেট করব, তুমি হবে ভালোমানুষ আর গণেশবাবু রাগীবাবু
আর আমি করব জেরা। দেখা যাক এদেরকে চাপ দিয়ে আসল সত্যিটা বের করতে পারি কি না। চল কুইক,
হারি-আপ’।
পনেরো
মিনিটের মধ্যেই সব ব্যবস্থা হয়ে গেল। লক-আপের পাশের ইন্টারোগেশন রুমে নিয়ে আসা হল তিনজনকে।
স্বল্প আলোর আলো-ছায়া যুক্ত ইন্টারোগেশন রুমের পরিবেশটাই রহস্যময় ভয়াবহ। তার মধ্যে
একটা টেবিলের একপাশে একটা বেঞ্চে তিনজনকে পাশপাশি বসানো হয়েছে। প্রথমেই গণেশবাবু ঢুকে
একটা মোটা রুল টেবিলের ওপর রেখে নিজের মোটা গোঁফে একটা দিয়ে কটমটে দৃষ্টিতে তিনজনের
দিকে তাকিয়ে দাঁড়ালেন। তারপর অমল দাস ঘরে ঢুকে টেবিলের ওপর একটা জলের জগ রাখল। সবশেষে
দেবেন্দ্র চৌধুরী ঘরে ঢুকে টেবিলের উল্টোদিকে রাখা একটা কাঠের চেয়ারে বসলেন। জুবুথুবু
হয়ে বসে থাকা তিনজনের প্রত্যেকের চোখের দিকে একবার করে সরাসরি তাকিয়ে জগুকে উদ্দেশ্য
করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কতবছর চাকরী করছ মদন সাহার বাড়িতে?’
জগু
ভয় মেশানো জড়ানো গলায় বলল, ‘আজ্ঞে প্রায় তিরিশ বছর’।
‘তোমার
বাবু লোক কেমন ছিলেন?’ জানতে চাইলেন দেবেন্দ্রবাবু।
জগু
চুপ করে রইল। গণেশবাবু জগুর ঘাড় পেছন থেকে ধরে বেশ করে ঝাঁকিয়ে দিয়ে বললেন, ‘মুখ না
খুললে, মেরে একদম আধমরা করে দেব, স্যার যা জিজ্ঞেস করছেন উত্তর দে’।
দেবেন্দ্রবাবু
জগুর চোখে চোখ রেখে বললেন, ‘তোমার সঙ্গে কি নিয়ে মদনবাবুর ঝগড়া হয়েছিল?'
গণেশবাবু
রদ্দা তুললেন, জগু গণেশবাবুর মূর্তি দেখে একটু যেন ঘাবড়ে গেল। অমল জলের জগটা জগুর সামনে
ধরে বলল, ‘জল খেয়ে নাও, জল খেয়ে সত্যি কথা বলে দাও স্যারকে, নইলে তুমি তো খুনের দায়ে
ফাঁসিতে চড়বেই, পুলিশ কিন্তু তোমার পরিবারের লোকজনদেরও ছেড়ে কথা বলবে না’।
জগু
যেন আরও ঘাবড়ে গেল, সে জগ থেকে কিছুটা জল ঢকঢক করে খেয়ে নিয়ে বলল, ‘দোহাই বাবু, আ-আমি
খুন করিনি। আমি খুন করিনি। গিন্নীমা বেঁচে থাকতে আমার মেয়ের বিয়ে হয়েছিল। বাবুকে বলতে
একটা টাকা দিয়েও আমাকে সাহায্য করেননি। গিন্নীমা আমাকে তার গয়নার থেকে দুটো সোনার চুড়ি
দিয়েছিলেন আমার মেয়েকে দেওয়ার জন্য। মেয়েকে বিয়ের সময় সেই চুড়ি আমি দিয়েছিলাম। সেদিন
হঠাত বাবু বললেন আমি নাকি তখন গিন্নীমার গয়নার বাক্স থেকে সেই চুড়ি চুরি করেছি। সেই
চুড়ি দুটো ফেরত না দিলে বাবু আমাকে পুলিশে দেবেন বলে ধমকালেন। আমিও তখন রেগে গিয়ে বলি
যে তিরিশ বছর আমি এই বাড়িতে চাকরী করছি। বাবুর কোনও কীর্তিই আমার অজানা নেই। মালতীর
সঙ্গে তিনি কি করেছিলেন সেকথা আমি সবাইকে বলে দেব। হরেন মন্ডলকে বাবু কেন এখনও মাসে
মাসে বিশ হাজার টাকা করে দেন সেকথাও সবাইকে জানিয়ে দেব। বাবু তারপরে আর একটা কথাও বলেননি।
চুপ করে গেছিলেন একদম’।
দেবেন্দ্র
চৌধুরী এবারে জগুর মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মালতী, হরেন মন্ডল এরা কারা?’
জগু
আবার চুপ করে রইল। গণেশবাবু এবার দেবেন্দ্র চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘স্যার, আপনি
একবার শুধু হুকুম করুন, এর মেয়ে-জামাইকে তুলে নিয়ে আসি। ওই চুড়ি এই ব্যাটাই চুরি করেছিল।
এর জামাইকে তুলে এনে রগড়ালেই সব সত্যি সুড়সুড় করে বেরিয়ে পড়বে’।
জগু
আঁতকে উঠল। অমল দাস তার পিঠে হাত রেখে বলল, ‘আরে করছ কি? গণেশবাবুকে চেন না? তোমার
জামাইকে তুলে এনে হয়ত পিটিয়েই মেরে ফেলবেন। এর জন্য গণেশবাবু কতবার সাসপেন্ড হয়েছেন
জানো? ওনার চরিত্রের বদল হবে না, তাই তোমার ভালোর জন্যই বলছি, স্যার যা জিজ্ঞেস করছেন
তার পরিষ্কার করে উত্তর দাও’।
জগু
একটা ঢোঁক গিলে বলতে শুরু করল, ‘প্রায় বছর পঁচিশেক আগের কথা বাবু। মালতী এই বাড়িতে
কাজ করত। সে ছিল আমার বন্ধু হরেন মন্ডলের বউ। হরেনটা চিরকালের পাঁড় নেশাখোর মাতাল।
কোনও কাজকম্ম করতে না। মালতী আমাকে দাদা বলে ডাকত। আমাকে একটা কাজ জোগাড় করে দেবার
কথা বলেছিল। আমি মালতীকে মদন সাহার বাড়িতে কাজে লাগিয়েছিলাম। গিন্নীমা সেইসময় তার বাবার
অসুখের খবর পেয়ে বাপের বাড়িতে গিয়েছিলেন। আমিই তাকে রেখে আসতে গিয়েছিলাম। সেসময় বাবু
মালতীর সাথে.........’। একটু চুপ করল জগু। তারপর আবার বলতে শুরু করল, ‘এরপর মালতীর
পেটে বাচ্চা আসে। হরেনের কোনওদিন নেশা ছাড়া অন্য কোনও দিকে নজর ছিল না। তার সাথে মালতীর
কোনও সেরকম সম্পক্ক তৈরিই হয়নি। মালতী ভয়ের চোটে ব্যাপারটা লুকিয়ে গিয়েছিল। পরে যখন
তার পেট......তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। বাচ্চা নষ্ট করার আর উপায় ছিল না। আমি মালতী
আর হরেনকে ওদের গাঁয়ে পাঠিয়ে দিই। মালতীর ওখানে একটা ছেলে হয়। তবে ছেলের জন্ম দিতে
গিয়ে মালতী মারা যায়। তখন সেই সদ্যজাত ছেলেকে নিয়ে এসে হরেন হল্লা শুরু করে। বাবু তখন
আমাকে এসে ধরেন। তিনিও জানতেন এ ছেলে তারই। কিন্তু গিন্নীমার সামনে তা স্বীকার করার
হিম্মত বাবুর ছিল না। আমিই তখন হরেনের সঙ্গে বাবুর রফাদফা করে দিই। ঠিক হয় ছেলেকে হরেন
নিজের পরিচয় দেবে আর বাবু তার জন্য তাকে প্রতিমাসে দুইহাজার টাকা করে দেবেন। সেই টাকা
পরে বাড়তে বাড়তে মাসে বিশ হাজারে এসে দাঁড়িয়েছিল। বাবুর জীবনের এই কালো দিকটা আমি জানতাম।
কিন্তু কোনওদিন তার জন্য বাবুকে আমি কোনওভাবেই লজ্জায় পড়তে দিইনি। সেই বাবুই কিনা আমাকে
চোর সাব্যস্ত করতে চাইলেন। তাই বাধ্য হয়েই আমি হুমকি দিয়েছিলাম। কিন্তু বিশ্বাস করুন
আমার বাবুকে, আমার অন্নদাতাকে আমি খুন করিনি। দোহাই আপনাদের আমার মেয়ে-জামাইকে এর মধ্যে
জড়াবেন না’।
হাউহাউ
করে কেঁদে উঠল জগু।
দেবেন্দ্র
চৌধুরী এবার তার দৃষ্টি দিলেন রতনের দিকে। রতন আর গদাই দুজনেই অল্পবয়সী। দুজনেই কুঁকড়ে
বসে রয়েছে। রতনকে উদ্দেশ্য করে দেবেন্দ্রবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুই কত বছর কাজ করছিস
ওই বাড়িতে?’
রতন
কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ‘বছর চারেক। জগুদা বাড়ির সবকাজ করে আর বেরোতে পারত না, তাই বাইরের
কাজ মানে বাজার করা, পোস্ট-অফিসে যাওয়া, বাড়ির নানারকম বিলটিল দেওয়া, লন্ড্রিতে যাওয়া
আরও নানা খুচখাচ কাজের জন্য মদনবাবু আমাকে রেখেছিলেন। আমি ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছি,
তাই এসব কাজ করতে পারতাম’।
দেবেন্দ্রবাবু
বললেন, ‘ওই জয়দীপ ছেলেটার সঙ্গে তোর কি সম্পর্ক ছিল?’
রতন
বলল, ‘উনি খুব ভালো ছিলেন। গরীব-দুঃখীর জন্য ওনার মন কাঁদত, বিপদে আপদে ঝাঁপিয়ে পড়তেন।
উনি আর অনিকেতদাদা, ওরা অনেক ভালো কাজ করত। আমাদের জন্য নাইট স্কুলে পড়ার ব্যবস্থা
করে দিয়েছিল। বন্যাত্রাণের চাঁদা তুলতে সেবার ক্লাবের থেকে ওরা এসেছিলেন। বাবু টাকা
তো দিলেনই না, উল্টে জয়দীপদাকে বাপ তুলে গালাগালি করলেন। জয়দীপদা মাথা ঠিক রাখতে না
পেরে বাবুর ফতুয়ার কলার চেপে ধরেছিল। তারপরেই তো বাবু পুলিশে জয়দীপদার নামে.........’।
দেবেন্দ্র
চৌধুরী এবার চাবুকের মত প্রশ্ন করলেন, ‘মদন সাহাকে খুন করলে কে? তুই?’
রতন
চুপ করে রইল। দেবেন্দ্র চৌধুরী গণেশবাবুকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘গণেশবাবু ওই অনিকেত
বলে ছেলেটিকে তুলে আনুন তো? মনে হচ্ছে এরা সব প্ল্যান করেই খুনটা করেছে। আমিও দেখব
ওই অনিকেত কি করে ডাক্তার হয়। জয়দীপের যেমন চাকরী গিয়েছিল তেমনি আমিও দেখব এই অনিকেত
কি করে ডাক্তার হয়...’
গণেশবাবু
কিছু বলার আগেই হাউমাউ করে উঠল রতন, ‘না স্যার না। না না। অনিকেতদাদাকে কিছু করবেন
না। উনি কিছু করেননি। উনি কিচ্ছু জানেন না। আমি শুধু উনার কাছ থেকে একটা ডাক্তারের
পড়ার গ্লাভস এনেছিলাম। শুনেছিলাম ওতে নাকি হাতের ছাপ পড়ে না। এছাড়া আর কিচ্ছু না। উনি
কিছু জানতেন না। এমনিই একটা কাজে লাগবে বলে চেয়ে এনেছিলাম। আমার মা খুব অসুস্থ বাবু।
বাবুর কাছে কিছু আগাম টাকা চাইতে উনি আমাকে টাকা তো দিলেনই না উল্টে ঠাঁটিয়ে চড় মারলেন।
আমার জয়দীপদার মুখটা মনে পড়ে গেল। তারপর সেদিন যখন দেখলাম যে বাবু বিশহাজার টাকা আলমারিতে
রাখলেন, তখন আর মাথার ঠিক রাখতে পারিনি। বাবুকে মেরে টাকা গয়না চুরি করার মতলব আসে।
ওইরকম একটা লোককে মারলে কোনও পাপ হবে না, এটা ভেবেই সেরাতে বাবুর ঘরে রাতের জলের জগ
রাখার অছিলাই ঢুকে দেখি খাটের ওপর বাবু ঘুমিয়ে রয়েছেন। আমি সাবধানে গিয়ে অতর্কিতে বাবুর
গলা টিপে ধরি। আমার হাতে অনেক জোর স্যার। বুড়ো মানুষ জেগে গেলেও সেভাবে নড়াচড়া করতে
পারেননি। আমি তাকে চেঁচাতে দিইনি। মদন সাহাকে মারতে আমাকে বেশী বেগ পেতে হয়নি। আলমারির
চাবি থাকত বালিশের নীচে। বাবুর লাশের চোখ বন্ধ করে দিয়ে দেহটাকে খাটে ঠিকঠাকভাবে শুইয়ে
দিয়ে আলমারি খুলে টাকা আর গয়নাগুলো বের করে চাবি জানালা দিয়ে নীচে পাশের গলিতে ফেলে
দিই। আর টাকা-গয়নার বাক্সও ওই জানালার শিক গলিয়েই নীচে ফেলে দিই। ক্লাবেরই লিটন বলে
একটা ছেলেকে আগে থেকে ফিট করে রেখেছিলাম। সে তখন ওখানেই দাঁড়িয়ে ছিল। সে সেগুলো প্ল্যানমাফিক
কুড়িয়ে নিয়ে চলে যায়। এখনও সেগুলো ওর কাছেই আছে। ওরও খুব টাকার দরকার। ওর বাবার কারখানা
বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে ওদের চারভাইবোনের রোজ দুবেলার সেদ্ধ ভাত পর্যন্ত জুটছে না’। কথা
শেষ করে মুখ ঢেকে হাউহাউ করে কাঁদতে শুরু করল রতন’।
এবারে
দেবেন্দ্র চৌধুরী তাকালেন গদাইয়ের দিকে। সে মাথা নীচু করে বসে রয়েছে। দেবেন্দ্র চৌধুরী
একবার ভালো করে গদাইয়ের দিকে দেখে নিয়ে জগুর দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি গদাইকে
চেনো?’
অবাক
দৃষ্টি নিয়ে জগু তাকালো দেবেন্দ্রবাবুর দিকে। দেবেন্দ্র চৌধুরী আবার বললেন, ‘গদাইকে
দেখে কিছু মনে হয়নি তোমার? আমার হাঞ্চ কিন্তু বলছে গদাইয়ের আসল পরিচয় তুমি জানো জগু।
আর সব জেনেও চুপ করে রয়েছ তুমি’।
জগু
চুপ করে রইল। গণেশবাবু টেবিল থেকে রুল তুলে জগুকে মারতে গেলেন। সবাইকে অবাক করে গদাই
উঠে দাঁড়িয়ে গণেশবাবুর হাত চেপে ধরল, চোখে তার আগুন ঝরছে। গণেশবাবুও রেগে গিয়ে এক ঝটকায়
নিজের হাত ছাড়িয়ে রুলের এক বাড়ি বসিয়ে দিলেন গদাইয়ের পিঠে। তিনি আবার গদাইকে মারতে
যাচ্ছিলেন জগু হাঁ হাঁ করে উঠল, ‘না না বাবু, ওকে মারবেন না, ওকে মারবেন না’।
দেবেন্দ্রবাবু
এবার জগুকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘গদাই কে ঠিক করে বল। আমি জানি তুমি জানো’।
জগু
বলে উঠল, ‘ওর মুখের আদল অনেকটা ওর মায়ের মত’।
‘মা
মানে মালতী, তাই তো?’ দেবেন্দ্রবাবু জানতে চাইলেন।
মুখে
কোনও কথা না বলে চোখের জল ফেলতে ফেলতে মাথা নাড়ল জগু।
এবারে
দেবেন্দ্রবাবু গদাইয়ের দিকে ফিরে তাকিয়ে বললেন, ‘তার মানে তুই এখানে চাকর সেজে এসেছিলি
মদন সাহাকে খুন করবি বলেই। তক্কে তক্কে ছিলিস লোকটা প্রবল কষ্ট দিয়ে মারবার জন্য। ছুরিটা
তুই মদনবাবুর বুকে বসিয়েছিস। কিন্তু মদন সাহাকে খাটে শুয়ে থাকতে দেখে তুই বুঝতে পারিসনি
তোর আগেই কেউ তাকে গলা টিপে মেরে রেখে গেছে। তুই শেষমেশ নিজের বাবাকেই......’।
দেবেন্দ্র
চৌধুরীকে কথা শেষ করতে দিল না গদাই, ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল, ‘বাবা নয়, অভিশাপ, অভিশাপ ওই
লোকটা আমার জীবনের। হরেন মন্ডল টাকার লোভে আমাকে তার কাছে রেখেছিল শুধু, ছেলে হিসাবে
বড় করেনি। বেজন্মা বলে ডাকত আমাকে। লাথি মেরে মেরে বড় করেছে আমাকে। ছোট বয়সে খুব কষ্ট
পেয়েছি আমি। মায়ের স্নেহ, বাবার ভালোবাসা কিচ্ছু পাইনি আমি। কুকুর-বেড়ালের চেয়েও খারাপ
জীবন পেয়েছি আমি। বেজন্মা তকমা জুড়ে গিয়েছিল আমার নামের সাথে। বড় হওয়ার পরে একরাতে
নেশার ঘোরে আমাকে লাথি মারতে মারতে হরেন মন্ডল আমার আসল পিতৃপরিচয় দিয়ে দেয়। সেইমুহুর্ত
থেকে ঠিক করি যে লোকটার জন্য আমার এই জন্ম তাকে আমি শেষ করে দেব। আমার জীবনের একটাই
লক্ষ্য ছিল মদন সাহাকে শেষ করা। ওর বুকে ছুরি বসানোয় আমার কোনও আফশোস নেই। শুধু আফশোস
একটাই আমি মারার আগেই এই রতন ওকে মেরে ফেলল। আমার হকের শিকারকে ছিনিয়ে নিল রতন। এখন
আপনাদের যা ইচ্ছে করতে পারেন। চাইলে আমাকে ফাঁসিতেও চড়াতে পারেন। আমার কিচ্ছু যায় আসে
না’।
দেবেন্দ্র
চৌধুরী গদাইয়ের ঘাড়ে হাত রেখে বললেন, ‘ফাঁসি তোমার হবে না। কারণ খুনটা তোমার হাতে হয়নি।
তবে খুনের চেষ্টাও অপরাধ তো বটেই। তবে তোমার আর রতনের সঙ্গে আমার সহানুভূতি রইল। কিন্তু
আইন চলবে আইনের পথে। অমল রতন আর গদাইকে লক-আপে নিয়ে যাও। আর এদের স্বীকারোক্তির বয়ান
রেকর্ড করে আজ বিকেলের মধ্যেই চার্জশিট রেডি করবে। আর জগুর ডিটেলস রেজিস্টারে এন্ট্রি
করে ওর টিপ সই নিয়ে ওকে ছেড়ে দাও’।
ইন্টারোগেশন
শেষে ওই রুম থেকে বেরিয়ে আবার নিজের কেবিনের চেয়ারে ফিরে এলেন অফিসার দেবেন্দ্র চৌধুরী।
Aug 20, 2021
সালটা ২০৮৫
Edit Posted by নেট ফড়িং with 2 comments
সালটা ২০৮৫
সম্রাট মণ্ডল
কালকেই আমার ৮৫ বছরের জন্মদিন পালন হল। কদিন ধরেই শরীরটা একটু খারাপ। তাই
আর দুপুরে ঘুম হচ্ছে না ঠিকঠাক। সেইজন্য বিছানা ছেড়ে উঠে নাতনিটার ঘরে গেলাম। আজকে
আমার স্ত্রী সুপর্ণার কথা খুব মনে পড়ছিল। যে ৫ বছর আগেই আমায় একা ফেলে চলে গেছে। একদম
সুপর্ণার মতন দেখতে আমার নাতনিটাকে। গেলাম গিয়ে দেখছি ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছে। আমি জিজ্ঞাস
করলাম “কি করছো দিদিভাই”। উত্তরে আমায় বলল “উফফ Grandpa! তোমায় না কতবার বলেছি আমাকে
ওসব দিদিভাই বলে ডাকবে না। You call me Grand-daughter”। কিন্ত কি করবো অভ্যাস হয়ে
গেছে। আমায় নাতনি বলল “তুমি একটু এখানে বসো আমি পড়তে যাবো এখনই খেয়ে আসছি” এই বলে চলে
গেলো। হাতের কাছে ল্যাপটপটা দেখে ভাবলাম একটু ফেসবুকটা খুলি। প্রায় ১০ বছর হয়ে গেলো
আর খুলি না। পাসওয়ার্ড ও User Id টা কোনোরকম কষ্ট করে মনে করলাম করে খুললাম। দেখি অনেক
গুলো Inbox এসছে। প্রথমেই এসছে আমার সব থেকে কাছের বন্ধু মৈনাকের। প্রায় ৪ বছর আগে
আমায় Message করেছে। লেখা আছে “ভাই তুই কোথায়? আমার শরীর ভালো নেই। আর মনে হয় বেশিদিন
বাঁচবো না। একবার একটু দেখা করে যা”। পরক্ষনেই মনে পড়লো ও মারা গেছে পাঁচ বছর আগে।
আর এই Message টা ছিল মারা যাওয়ার ২ দিন আগের। পরবর্তী Message ছিল ৪ বছর আগের, আমার
আর এক বন্ধু সৌরভের। লিখেছে “ভাই আজকে ছেলে ও তাঁর বৌ বাড়ি থেকে বার করে বৃদ্ধাশ্রমে
দিয়ে দিলো আমায় ও আমার স্ত্রীকে। এই দিনের জন্যই কি আমরা ছেলেকে বড়ো করি”? এই কথাটা
শুনে একটু খারাপ লাগলো। তাই Message box থেকে বেরিয়ে Search Bar এ গেলাম। ভাবলাম যে
মানুষটা ৬০ বছর আগে একসাথে থাকবে বলেছিল সেই মানুষটা কি কেমন আছে একবার দেখি।
Search করলাম Bela Bose। প্রথমেই ওর Profile টা খুললও। দেখলাম শেষ ছবি Post করেছে আজ
থেকে ২ বছর আগে, তাঁর স্বামী, ছেলে, বউমা ও নাতি কে নিয়ে। হ্যাঁ এই সেই Bela Bose যে
সাথে থাকার কথা দিয়েছিল। কিন্ত সম্পর্কটা আর পূর্ণতা পায়নি। নীচে ফোন নম্বর দেওয়া ছিল।
সেই ৬০ বছর আগের নম্বর। সেই নম্বরে নাতনির ফোনটা নিয়ে ফোন লাগালাম। অপরদিকে বলে উঠলো
এই নম্বরের কোন অস্তিত্ব নেই। খুব খারাপ লাগলো তাই চুপ করে বসেছিলাম। তখন হঠাৎ নাতনি
এসে বলল “Grandpa এবার চলো আমায় পড়তে বেরতে হবে”। আমি বললাম “হ্যাঁ তুই ব্যাগ গোছা
আমি যাচ্ছি”। ও হেঁসে বলল “কি যে বলো Grandpa এখন আর কি ব্যাগ গোছাবো। এখন সব
Online-এ”। আমি তাঁকে প্রশ্ন করলাম “মানে ! Online বলে কি খাতা বই নিবি না”? ও উত্তরে
আমায় বলল “কিসের খাতা বই? এখন সব কিছু Online, ল্যাপটপ, Computer, মোবাইল ছাড়া পড়াশোনা
আর হয় না বুঝলে। তুমি বড্ড Back Dated”। এই বলে সে চলে গেল। ও যাওয়ার পর আমি ভাবতে
লাগলাম আমি কি সত্যিই Back Dated? এসব জিনিস যখন প্রথম এসছিল আমরা সবার আগে ব্যাবহার
করেছিলাম। আমরা তো আমাদের বন্ধুত্বটাই ভুলে গেছিলাম এসবের পিছনে পরে। আমাদের প্রেম
হতো WhatsApp, Facebook, Instagram-এ। প্রথম Online Class এসব ল্যাপটপ, Computer, ফোন
ব্যবহার করে আমরাই শুরু করেছিলাম। আমরাই তো বলতাম যে যা হচ্ছে ঠিক হচ্ছে। সব কিছু
Online হোক এটা আমরাই তো চাইতাম। আসলে আমরা তখন বুঝিনি সব কিছু Online হয় না। তাই আজকে
আমার বন্ধুরা সবাই একে একে ছেড়ে চলে গেছে কিন্ত সেটা আমায় জানিয়েছে Facebook এর মাধ্যমে। আমরাও তো একসময় বলতাম বয়স্ক
মানুষদের যে তোমরা জোর করে Online জিনিস সম্পর্কে জানো। আমরা তো মাঝে মাঝে ভাইফোঁটাও
নিতাম Online-এ। নিজের ভালোবাসার মানুষের সাথে একটা কোন ছোট Gift কিনে অনেক দিন পর
দেখা করতে যাওয়া জিনিসটা তো আমরা ভুলেই গেছিলাম। ইচ্ছা হল Flipkart বা Amazon–এ
Order করে দিলাম। নিজের হাতে দেওয়ার ইচ্ছাটাই মরে গেছিলো। আমরা Facebook-এ Profile
Check করা পছন্দ করতাম কিন্ত সামনা সামনি দাঁড়িয়ে কথা বলাটা নয়। আমরা কোন ভালো জিনিস
নিজের চোখে দেখাটাই ভুলে গেছিলাম। কোন ভালো জিনিস দেখলে আগে ফোন বার করে ছবি তুলতে
ব্যস্ত ছিলাম। কোথাও ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান করলে আমরা একসাথে বসে করতাম না। ওই একটা
WhatsApp গ্রুপ খুলে দিলাম, হয়ে গেলো। আমরা তো নিজেই জানি না কতদিন হয়ে গেলো কারোর
সাথে সামনা সামনি ঠিক ভাবে দাঁড়িয়ে কথাই বলিনি। যা কথা বলার থাকতো সবই বলতাম
WhatsApp, Facebook, Instagram-এ। আর আজকে আমি Back Dated। আমরাও অনেক মানুষকে বলতাম
Back Dated মানুষ ওরা ওসব Online বোঝে না। কিন্ত Online-এ সুখি থাকার থেকে এই
Offline-এ সুখি থাকাটাই খুব বেশি জরুরি।
Aug 19, 2021
প্রেমের ছবিগুলো
Edit Posted by নেট ফড়িং with No comments
প্রেমের ছবিগুলো
কৌশিক পাল
মাঝখানে প্রেমটা এত উৎপাত শুরু করল, যে রোজ রাতে একবার
ওর বুকের গন্ধটা সারা মুখে না মাখলে ঘুম হত না। মাঝে মাঝে তো আমার সর্বাঙ্গ নিশপিশ
করে উঠত ওর দেহের ঝলকানিতে। গিলে ফেললে তো সব শেষই হয়ে যেত, নাহলে গিলেই ফেলতাম এতদিনে!
কতটা সুন্দর ও, তা জানি না। কার কাছে কেমন, তা'ও জানি না। কে কোন চোখে দেখে ওকে, তা
জানা তো একেবারেই অসম্ভব! যদিও খুব একটা বাড়ি থেকে বের হয় না ও। যতটুকু সময় শপিং-এ
বা দোকানে যেত,ততটুকুই যা বাইরে।আর আমার সঙ্গে ক-দিন যা ঘোরাফেরা- ততটুকুই বিয়ের পর।
প্রথমে একটু নতুন নতুন ভাব, দুজনকেই একটু লজ্জা আর
চরিত্রকে সঙ্গে নিয়ে সমঝে চলতে হত। তারপর, দুজনেরই একদিন প্রায় একসাথেই একরাতের মধ্যে
সব লজ্জা উধাও! তারপর কতকগুলো রাত যে এমনি ভাবে কাটতে লাগলো, যেন সেগুলোকে রসলীলা ছাড়া
আর কিছু বলা চলে না। খুব বেশিদিন হয়নি তখন। ষাট-সত্তর দিনের দাম্পত্য জীবন- আর তাতেই
এত...
আজ দাম্পত্য জীবনের পুরো দুশো একদিন। আমার লেখালেখির
ঘরটা এলোমেলো হয়ে পরে আছে। ঘরের একদিকে আমার লেখালেখির কাগজপত্র ও খাতার আলমারি। দু'দিন
হল, সেটাকে ফাঁকা করে দামী বিদেশি মদ এনে সাজিয়েছি। ও জানে না খবরটা। শুধু আমায় একব্যাগ
ভর্তি ফল আর ড্রাই ফ্রুটস আমার ঘরে নিয়ে যেতে দেখেছে। কিছুই বলেনি তেমন। মনে অবশ্যই
খটকা লেগেছে ওর, কারণ ফ্রিজ ভর্তি এত ফল সবকিছু থাকতে আবার আমি এত কিনে এনেছি! তাই
স্বাভাবিক একটা ব্যাপার।
গতকাল থেকে বন্যার স্রোতের মতো মদ আর ফল খেয়েছি।এ
ঘরে ওর আনাগোনা নেই বললেই চলে। আর এঘরে কারও ঢোকাটাও আমি পছন্দ করি না। আমার স্মার্ট
ফোনটা সারাক্ষণই প্রায় আমাদের শোবার ঘরে থাকে।খুব দরকার হলেই আমাকে ও ফোনটা এনে দেয়
এ ঘরে।তাতে আমি খুব একটা আপত্তি করি না। আমার বিশাল টেবিলটার, মাঝখানে রাখা টেলিফোন।
সারাদিন ওখানেই বেশি ফোন আসে। আর ও এঘরে আমাকে খাবার দিতে বা অন্য কোনো কাজ থাকলে টেলিফোনে
ফোন করে অনুমতি নিয়েই আসে। আমি ওকে অবশ্য অনুমতি নিতে বলিনি কোনোদিন, তবুও ও অনুমতি
নিয়েই আসে।
গত চারদিন ধরে একটা অচেনা গলা আমাকে বারে বারে ফোন
করে, আমার গলাকে তার গলার বন্ধু বানাতে চাইছে।আমার যে ঘরে স্ত্রী রয়েছে, সে হয়তো জানে
অথবা জানে না! নিজের পরিচয় তো দূরের কথা, নামটা পর্যন্ত বলেনি! তবুও একটা অদ্ভুদ জাদু
আছে ওর গলায়! আমার অনুরাধার দেহের টানের থেকেও যেন হাজার শক্তিশালী এই মেয়েটার গলা!
শুধু বলে ওর নাকী আমার লেখা খুব ভালো লাগে, একটা বইমেলায় আমাকে দেখেছে,আমার সাথে নাকি
একটা সেলফিও নিয়েছে! আমার সবকটা বই ওর কেনা। ঘরে নাকি প্রতিদিন ওই বইগুলোর গন্ধ শুকে
আমাকে অনুভব করে! আর এখন নাকি আমাকে বিয়ে করতে চায়!সবচেয়ে বিস্ময়কর এই শেষের বাক্যটা!
সে তো কত মেয়ে-গুরুজন-বন্ধু-মহিলা - হাজারটা লোকের
সাথে কথা হয় রোজ।কত লোক আমার সাথে সেলফি তুলেছে,কত বইমেলা করেছি-গিয়েছি,তাকে কি মনে
রাখা সম্ভব?কিন্তু ও যখনই ফোন করে কথা বলে, আমাকে যেন হিপ্নোটাইস করে দেয়!আমার যে স্ত্রী
রয়েছে সেটা বলতে গিয়েও, যেন কথা পালটে যায়! কী আশ্চর্যের ব্যাপার!
দু'দিন ধরে অজস্র ফোন এসেছে,একটাও ধরিনি। অনুরাধা
অনেকবার ফোন করেছে এমনকি দরজাও চাপড়েছে এই বলে যে,"কি গো কী হল?খাবার খাবে না?
ঘরেই থেকে যাবে নাকি?"
আমি শুধু একটামাত্র হ্যাঁ, না সাড়া দিয়ে চুপ করে যেতাম।
অনুরাধাও খায়নি বোধ হয় দু'দিন।কারণ আমি তো জানি যে ও আমাকে কতটা ভালোবেসে ফেলেছে;আর
আমিও কম নয়।
আবার আজ রাত আটটায়, ওই একই অচেনা গলাটা ফোনটা তুলতেই
কানে এল।যেন আমায় ওর গলায় গ্রাস করতে চায়! এত মদ খেয়েছি যে গলা বসে গেছে। কিন্তু ওই
মেয়েটার অভাবনীয় মধু মাখা মিষ্টি গলাটা কানে পড়তেই, যেন একনিমেষে সব নেশা কেটে গেল! শুধু
ওর কথা শুনে যাচ্ছিলাম নির্বিবাক হয়ে। তারপর ফোনটা ও কাটলো নাকি এমনিই কেটে গেল, তা
ঠিক বুঝতে পারলাম না। তাই ইতিমধ্যে দুটো ন্যাশপাতি,তিনটে আপেল, একবাটি কাজু আর দুবোতল
মদ খেয়ে এই এতটুকু লিখতে বসেছি।রাতে অনুরাধা শুধু দুবার দরজা ধাক্কা দিয়ে খাবার কথা
বলে গেল। আমি রীতিমতো সাড়া দিয়ে উঠতে পারিনি, তাই হয়তো ঘুমিয়েছি ভেবে রাগে ফোনও করেনি।
আজ তিনদিন। টেবিলের তলায় মদের প্যাকেট ও বোতলে ভরে
গেছে।টেবিলের উপর একটা বোতল ছিল, কিছুটা মদ ছিল তখনও।ঘুম থেকে উঠেই গেলাসে অর্ধেকটা
রেখে, ওটা শেষ করলাম আগে। কী যেন একটা পাখির ডাক শুনতে পেলাম।আর তাতেই হয়তো ঘর থেকে
বেরিয়ে দরজায় খিল দিয়ে দৌড়ে ছাদে গেলাম। বেশ একটা ফ্রেশ সকাল মনে হল। অনেকক্ষণ ছাদে কাটানোর
পর নীচে নেমে সোজা গেলাম শোবার ঘরে। দেখি বিছানা গোছানো। ফোনটা আমার বালিশের পাশে। বাথরুমে
গিয়ে বুঝলাম,অনুরাধা একটু আগেই বোধ হয় স্নান সেরে বের হল।তারপর হালকা হয়ে সকাল সকাল
স্নান সেরে রান্নাঘরে যেতেই দেখি ও চা বানাচ্ছে।প্রথমে একটাই কাপ ছিল,তারপর আমার জুতোর
আওয়াজ ও শ্যাম্পুর গন্ধ পেয়ে আরেকটা কাপ বের করতে করতে বলল-"চা-টা কি দরজা বন্ধ
করেই খাবে? নাকি বারান্দায় দেব?"
আমি বললাম-"বারান্দাতেই দাও, আর ঠাট্টা কোরো
না।" পাছে হয়তো কথা বাড়ে, তাই ও আর কিছু বললো না।আমি সোজা গিয়ে বারান্দায় বসলাম। ট্রেতে
দুটো এলাইচি দুধ চা ও সাথে আমার প্রিয় বিদেশি বিস্কুট। ও আর কিছু বলল না তখন।চা-টা শিগগির
শেষ করে ও সামনের বিরাট ফুল বাগানে চলে গেল,গাছে জল দিতে। আমি বারান্দায় বসে অনেকক্ষণ
ধরে অনুরাধাকে পর্যবেক্ষণ করলাম। ভারী মিষ্টি লাগছিল সালোয়ার কামিজে। বিয়ের পর একদিন
আমায় বলেছিল, যে বিয়ের আগে ও জিন্স পড়ত।বাবা সেসব পছন্দ করেন না জন্য আর পড়েনি। আমার
ওসবে আবার কোনোরকম আপত্তি নেই।কারণ নারীকে তাঁর পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া উচিত। আর তারপরই
তো সমাজকে চেনা যাবে।
সিগারেট বা তামাকের নেশা আমার নেই। এমনকি মদেরও না। তারপর
হঠাৎ দু'দিনের কথা সব মনে পড়ে গেল। ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে টেবিলে বসতেই একটা খুব পরিচিত
গন্ধ পেলাম। গেলাসের চারপাশে মদের ফোঁটা পরে আছে। গেলাসটা হাতে নিয়ে নাকের কাছে নিতেই
পুরোনো টাটকা গন্ধটা পেলাম। যে গন্ধের সাথে আমার কদিন আগে পর্যন্ত পরিচয় হত রোজ রাতে,
ঘনিষ্টভাবে, সেই গন্ধ-অনুরাধার বুকের গন্ধ। ওর গলার হিরেটা গ্লাসে পড়েছিল, নয়তো ও এই
দু'দিনের লেখাটা পড়েই হিরেটা গ্লাসে ডুবিয়েছিল। আমি একথা জোর দিয়ে বলতে পারি।আর তাই
টেবিলে মদের ফোঁটা পড়ে রয়েছে।
ওকে আমি হিরেটা ফুলশয্যার রাতে দিয়েছিলাম। সেকথা ভাবতে
ভাবতেই অনুরাধার বুকের গন্ধমিশ্রিত মদ খেয়ে শুয়ে পড়লাম বিছানায়।গা-টা মোচড় দিতেই যেন
একটু ঘুম ঘুম পেল।সেসময় শুধু অনুরাধার মুখটা আর রাতগুলো মনে পড়ছিল।
তারপর দেখি হঠাৎ অনুরাধা ঘরে খাবার ও ফোনটা একসাথে
এনে টেবিলে রেখে আমাকে ডাক দিচ্ছে,আর বলছে-"কী গো অনিরুদ্ধ ওঠো,দু'টো বাজে যে!খাবার
এনেছি আমাদের। আমি আর তুমি একসাথে খাব আজ এঘরে। ফোনটাও এনেছি। অ্যানা নামের ওই মেয়েটি
টেলিফোনে না পেয়ে এন্ড্রয়েডে ফোন করেছিল অনেকবার। মনে হয় তোমার 'প্রেমের ছবিগুলো' বইটি
আরও দুকপি নেবে।
"কী গো ওঠো; সেই যে রাতে বিনা গন্ধে ঘুমিয়েছো!"
Aug 13, 2021
রাজযোগ
Edit Posted by নেট ফড়িং with No comments
রাজযোগ
সোমনাথ বেনিয়া
জ্যোতিষী ঠিকুজি বিচার করে বললো, "এ তো রাজযোগ। ছত্রিশে আঠাশ এসেছে।
একটা গ্রহ শুধু মেলেনি। না হলে ছত্রিশে ছত্রিশই হতো। তবে চিন্তা নেই। এ বিয়ে হতে পারে।"
বিয়েতে পাত্র-পাত্রী সাতপাক ঘোরার পর সেখানে উপস্থিত অনেকেই বললো,
"আরও একপাক বাকি আছে। ভুল গোনা হয়েছে।" বিয়ে বাড়িতে যেমনটি হয় আর কী! পাত্র
ভাবলো সাতের বদলে এক্সট্রা একপাক দিয়ে আটপাক করে নিলে আঠাশ, ছত্রিশ হয়ে যাবে। রাজযোগ
! অসুবিধা কোথায়? যথারীতি আরও একপাক ঘোরা হলো। বন্ধন দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হলো।
ঘুম ভেঙে গেল পাত্রের ফোনের রিংটোন বাজতেই। হ্যালো বলতেই ওপারের কণ্ঠস্বর,
"আজকে ডিভোর্সের পিটিশন ফাইল করবেন তো !" পাত্র "ভাবছি" বলে ফোন
কেটে দিলো। এখন সে ভাবছে অতিরিক্ত একপাকের জন্য গ্রহ কীভাবে তার কক্ষপথ বদলে ফেললো
যে তাদের দৃঢ়তর বন্ধন নিমেষে এতটা আলগা হয়ে গেল...
"প্রথম চুম্বন" - বুদ্ধদেব মহন্ত
Edit Posted by নেট ফড়িং with No comments
প্রথম চুম্বন
বুদ্ধদেব মহন্ত
একদিন আষাঢ় মাসে আষাঢ়ের মেঘ ভেঙে ভেঙে আমার বাড়ির ছাদে ঝরছিল। বৃষ্টির সূত্রপাতটা
হয়েছিল সন্ধেবেলার অলস মুহূর্ত থেকে। সেই অলস মুহূর্তকে যেন আরো অলস, নীরব করে দিয়েছিল
সেই মুসুলধারে বৃষ্টি। সময়ের সাথে সাথে বৃষ্টির বেগও বেড়ে চলছিল। মাঝে মাঝে যে মেঘের
গুরুগুরু ও বজ্রের শব্দ শোনা যাচ্ছিল, সেটা আর মাঝে মাঝে রইল না, বরঞ্চ মাঝে মাঝে বজ্র
পড়াটা থামছিল।
তখন রাত্রি আটটা হবে। দেখি বাড়ির সামনের দরজাটা বন্ধ নয়। এই বৃষ্টিতে চোর-ডাকাত
না আসুক কিন্তু শেয়াল-কুকুরের আসাটা তো বন্ধ করতে হবে। দরজাটা খোলা রইলে একটা কিছু
ঘটাও অসম্ভব নয়। অতএব বৃষ্টির জলে ভিজেই সেটা বন্ধ করতে গেলাম।
বেশি ভিজতে হল না, খুব কম সময়েই দরজাটা লাগিয়ে এলাম। কিন্তু একটা প্রচন্ড
বাজ পরাতে লাইটগুলো সব বন্ধ হয়ে গেল। চারিদিক অন্ধকার, কেবল বৃষ্টির শব্দ আর হাওয়ার
উদ্দম চলাফেরা। কোনোমতে ঘরে এসে মাথা মোছার একটা কাপড় খুঁজছি হঠাৎ কার সাথে যেন একটা
ধাক্কা খেয়ে বিছানায় পড়ে গেলাম, সে আমার নিচে পরে রইল।
একমুহূর্ত বুঝলাম ইনি আর কেউ নন, আমারই স্ত্রী পূরবী। মাস ছয়েক হল আমাদের
দেখাশোনা করে বিয়ে হয়েছে। এখনো নব-পরিচয়ের সমস্ত আনন্দ আমাদের ফুরিয়ে যায়নি। এমনিতেই
পূরবী কম কথা বলে তার উপর বাড়িতে আমরা দুটি মাত্র প্রাণী, এতদিন ধরে সমস্ত আবেগ কেবল
সঞ্চিত হয়েছিল। একটা ভেজা শরীরের সুগন্ধে আমার কেমন যেন একটা নেশা লাগলো, আমি সেভাবেই
পড়ে রইলাম।
পূরবী বললো, "ওঠো!"
আমি বললাম, "হুম!"
পূরবী- "দেখতে পাইনি।"
আমি- "আমিও।"
পূরবীর চুলগুলো স্পর্শ করতে বুঝি সেগুলো ভিজে আছে। বললাম, "তোমার চুলগুলো
কি করে ভিজলো?"
সে একটুখানি চুপ করে থেকে বললো, "ছাদে কাপড় ছিল, তুলতে ভুলে গিয়েছিলাম।"
'তুমি তোমার চুলগুলো শুকিয়ে নাও' এই বলে আমি উঠতে যাচ্ছিলাম। দেখি সে আমায়
স্নিগ্ধ বাহুপাশে আবদ্ধ করলো। আমিও ওঠার চেষ্টা করলাম না।
বললাম, "পূর!"
পূরবী- "বলো!"
আমি- "আমায় একটা চুমু দেবে!"
পূরবী চুপ করে রইল, যেন কিছু শুনতে পায়নি। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দে ঘরটা
ভরে উঠেছিল। ঠিক তখনই ঘরের ভিতর সমস্ত আলো জ্বলে উঠলো। একটা অচেনা লজ্জায় আমার চোখদুটো
নুয়ে পড়লো পূরবীর চোখ থেকে।
পূরবী বললো, "ওঠো, চুলগুলো না শুকোতে পারলে কাল জ্বর আসবে।"
আমি উঠে পড়লাম কিন্তু সেই চুম্বন আমার ঠোঁটে লেগে রইল।
Jul 24, 2021
"কাউকে জিতিয়ে" - মিলন পুরকাইত
Edit Posted by নেট ফড়িং with 4 comments
কাউকে জিতিয়ে
মিলন পুরকাইত
কাউকে জিতিয়ে নিজের হারের মধ্যেও আনন্দ আছে। এটা
আমি খুব ভালো করেই উপলব্ধি করতে পারলাম। সুদীপ সেদিন এসেছিল
বাড়িতে। অনেকদিনের পর ওর সময় হয়েছে আসার। আসলে খেলাধূলা, গরীব মানুষকে সাহায্য করা
এইসব নিয়ে থাকাই ওর পছন্দ। সুদীপ আমার পিসির
ছেলে। অনেকটাই ছোটো আমার থেকে। ও এলে বাড়িতে একটা আনন্দের পরিবেশ তৈরি হয় যেন। কি
ভালোই না লাগে ওর কথা। আমার মেয়ে তো ওর খুব ফ্যান। খুবই পছন্দের সুদীপ মামা।
পাড়ায় মাঠে মাঝে মাঝে ফুটবলের টুর্নামেন্ট হয়। অনেক স্পনসর থাকে। যেহেতু
আমাদের পাড়ার ক্লাবের সভাপতি হলেন মি. অরূপ রায় মহাশয়। উনি রাজনৈতিক দলের বড় নেতা।
ওনার সুবাদেই অনেক ডোনেশন আসে। জেতার পুরস্কার মূল্যও
নেহাত কম নয় । তবে সুদীপ প্রতিবার খেলে না। থাকে না হয়তো ওই সময়।
ওর চাকরিও তো ঘুরে ঘুরে। আজ উত্তরবঙ্গ তো কাল গৌহাটি। তবে ও
খেললে প্রথম পুরস্কার ওকে দিতেই হবে। ওর পায়ে বল এলে কারোর সাধ্যি নেই সেটাকে আটকানোর।
গোল দেবেই। চেহারাও তেমনি । ছয় ফুট এক। পেটানো চেহারা। তবে মুখখানা একেবারে শিশুর মতো
সারল্যে মাখানো। তাই ও পাড়ার সবার প্রিয়।
"জানিস দিদিভাই, মিলন মন্দির
পাড়ার তরুন বলে এটা ছেলে আছে। আমাদের বন্ধু। আমিও যাই ও পাড়াতে অনেক সময়। দারুণ খেলে ও। ওর মায়ের
খুব শরীর খারাপ। এই মুহূর্তে অনেকগুলো টাকার দরকার। পাড়া
থেকে তোলা হচ্ছে চাঁদা। ওদের অবস্থা একেবারেই ভালো নয়। বাবা নেই। ও একটা মুদির দোকানে
সামান্য মাইনের কাজ করে। পড়াশোনাও করতে পারে
নি বেশি দূর। তিনটে বোন ওর। দুজনকে বিয়েও দিলো কদিন আগে। পুরস্কারটা
ও পেলে প্রপার কাজে লাগবে। আর ও জানে, শুধু ওইই না, সবাই জানে আমি খেললে প্রথম পুরস্কার
আমার হবেই। কিন্তু আমি খেলব না বলতেই কেউ ছাড়লো না। বিশেষ করে তরুণ। তরুনের অনুরোধেই
খেললাম । ওর খারাপ লেগেছে আমি খেলব না। ওর জন্যেই।
আমিও খেলেছি। কায়দা করে গোলটা দিতে গিয়েও দিলাম না। ব্যাস তরুণের গোলে
জিতলো আমাদের পাড়া। প্রথম পুরস্কার নেবার সময় ও আমার দিকে তাকিয়ে কেঁদে ফেলে। ব্যাটা
ঠিক আমার কারসাজি বুঝে গেছে। পরে বাড়িতে এসে আমাকে জড়িয়ে কি কান্না। একটা ছেলে কতটা
অসহায় হলে কাঁদে বলতো। "আমিও সুদীপের কথা শুনে কেঁদে ফেলেছি। ওইটুকু মেয়েটার
চোখটাও চিকচিক করছে। বুঝতে পারছি না কাকে
বাহবা দেব। প্রথম পুরস্কার যে পেল তাকে নাকি যে
পাইয়ে দিল তাকে।
"অনুপমা" - অনিকেত
Edit Posted by নেট ফড়িং with 2 comments
অনুপমা
অনিকেত
কিছু মানুষ যেমন জীবনকেই নিজের সঙ্গী বানিয়ে নেয়, ঠিক তেমনই কিছু মানুষ,
নিজের অজান্তেই নিজের কাছের মানুষকে নিজের জীবন বানিয়ে ফেলে। যেন তাঁকে ঘিরেই তাঁর
সমস্ত জীবন, সমস্ত উদ্দেশ্য আবর্তিত হয়। কে জানে হয়তো এটাকেই ভালোবাসা বলে !
অনুপমাও ঠিক এইভাবেই হয়তো ভালোবাসতো অরুণকে। ভালোবাসবে নাই বা কেন? কলেজের
অন্য বন্ধুরা যখন ওর গাড়ি দুর্ঘটনায় আধপোড়া বিকৃত মুখটা দেখে, ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল,
অনুপমার কাছে অরুণই হয়ে উঠেছিল একমাত্র বন্ধু, একমাত্র কথা বলার সঙ্গী। ওর একাকিত্বের
অন্ধকারে ডুবে থাকা মনটাকে ভরে তুলেছিল আনন্দে। অনুপমাও তাই একটু একটু করে, নির্ভর
করতে শুরু করেছিল অরুণের উপর।
বয়সে অনেকটা ছোট হলেও তাই, অরুণকে নিয়ে সত্যিকারের সংসারের স্বপ্ন দেখতো
অনুপমা। অরুণকে বলেও ফেললো সেই কথা একদিন। নিজের জীবনে প্রতিষ্ঠিত অরুণ সেদিন ফেরায়নি
তাঁকে। কথা দিয়েছিল, বাড়িতে সব জানিয়ে অনুমতি নিয়ে, শুরু করবে একসাথে পথ চলা।
সেইমতো দুইজনেরই বাড়িতে কথাটা উঠলো। বয়সের তফাতটা নিয়ে চিন্তা করলেও, দুই
পক্ষই রাজী হয়ে গেলো এক সময়।
কিন্তু হঠাৎ, এই সময়েই, কেমন একটা পরিবর্তন দেখল অনুপমা, অরুণের মধ্যে।
অনুপমার সমস্তকিছুতেই যেন সে বড্ড অসন্তুষ্ট। কোনওটাই যেন তাঁর পছন্দসই নয়, আর সেই
অপছন্দের তালিকা যেন ক্রমশ বাড়তে লাগলো।
হয়তো বন্ধু আর স্বামীর মধ্যে এই ফারাকটা থাকেই। অনুপমা আপ্রাণ চেষ্টা করতে
লাগলো নিজেকে ওর মনের মতো বানিয়ে ফেলার। কিন্তু সবই বৃথা।
এমনই একদিন, দু’জনে যখন বিয়ের কেনাকাটা করে ফিরছে, হঠাৎ ওদের দেখা হল অর্পণের
সাথে।
অর্পণ অনুপমার স্কুলজীবনের বন্ধু। বহুদিন বাদে যখন ছোটবেলার বন্ধুকে পেয়ে
অনুপমা উচ্ছ্বসিত হয়ে কথা বলতে লাগলো, অরুণের মনে বাসা বাঁধলো, এক অনিয়ন্ত্রিত রাগ।
অন্য পুরুষের সাথে এত কথা কিসের, ফেরার পথে, মনে পুঞ্জীভূত রাগটা ফেটে বেরোল চিৎকারে।
না, আজ আর আগের মতো মেনে নিলো না অনুপমা। ধরে থাকা হাতটা ছেড়ে, এগিয়ে যাওয়ার
পথে, একবার ফিরে তাকিয়ে শুধু বললো, “ভালোবাসা মানে বিশ্বাস আর ভরসা অরুণ, নিজেকে বিক্রি
করে দেওয়া নয়!!”
নিজের সম্মান, নিজের মর্যাদাকে সে আর বিকোবে না। সে নিজেই লড়বে তাঁর লড়াই,
নিজের পথ নিজেই গড়বে।
Jul 17, 2021
"ছায়া এবং একটা অস্বস্তি" - সায়নী দাস
Edit Posted by নেট ফড়িং with No comments
ছায়া এবং একটা অস্বস্তি
সায়নী দাস
একসপ্তাহ হলো রোহিণী সোনারপুরের এই নতুন ফ্ল্যাটে এসে উঠেছে। ফ্ল্যাটটা
বিলাসবহুল। দু’পাশে দুটো বেডরুম। মাঝে ডাইনিং স্পেস। একদিকে কিচেন। দুটো রুমে অ্যাটাচড্
ওয়াশরুম। ডাইনিংয়ের একপাশের দেওয়ালটা পুরো কাঁচের স্লাইডিং, ওটা পেরোলে একটা ব্যালকনি।
যেখানে দারুণ সুন্দর গার্ডেনিং করা হয়েছে। এক কথায় সিনেমায় দেখানো ফ্ল্যাটের মতো
সুন্দর রোহিণীর এই ফ্ল্যাটটা। কিন্তু এখানে আসার পর প্রতিরাতেই ও খেয়াল করে দেখছে
ঠিক রাত আড়াইটে বাজলেই ওর ঘুম ভেঙে যায়। যতই গভীর ঘুম হোক না কেনো ! একাই থাকে ও।
বুধবার অফিসের কাজে একটু চাপ ছিল। তাই ও রাত জেগে কাজ করছিল। হঠাৎ মনে হলো একটা ছায়া
সরে গেলো পেছন থেকে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো সেখানে অভিমন্যু আর ওর দেওয়াল ছবিটা ছাড়া
আর কিছুই নেই। রাশভারী মেয়েটা একটু যে ভয় পায়নি তা নয়, কিন্তু এসবে পাত্তা দিলেই
বাড়ি ফিরে যেতে হবে। আর বাড়ি ফিরলেই... ভাবলেই মাথার মধ্যে বিস্ফোরণ আর একটা ঠান্ডা
স্রোত বয়ে যাচ্ছে ওর শিরদাঁড়া বরাবর। ঠিক কি কারণে রোহিণী এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল
?
রোহিণী আর অভিমন্যু প্রেম করে বিয়ে করেছিল। অভিমন্যুর বাড়ি থেকে এই বিয়েটা
মেনে নেয়নি কারণ রোহিণীর মা ছিল মুসলিম, আর ওরা ব্রাহ্মণ। একে তো বিধর্মী, তার উপর
অব্রাহ্মণ ! ওরা ভেবেছিল একটা বাচ্চা এলে হয়তো সবটা ঠিক হয়ে যাবে। রোহিণী যখন তিন
সপ্তাহের প্রেগনেন্ট তখনই ঘটলো এই ভয়ঙ্কর ঘটনা। অভিমন্যুর ঠাকুমা শেষ বয়সে নাতিকে
না দেখতে পেয়ে দুঃখ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন। এটাই হলো কাল ! রোহিণীরা যে বাড়িতে থাকতো
সেই বাড়ির ছাদে ওঠার সিঁড়িটা ছিল প্যাঁচানো। পুরোনো দিনের সিঁড়ির মতো। অভির ঠাকুরদা
এটা বানিয়েছিলেন। বর্ধমানের এই বাড়িতে অভির ছোটবেলাটা কেটেছে। বড়ো হবার পর ওরা কলকাতায়
চলে যায়। আবার ফিরে আসে বিয়ের পর। মাঝে এই বাড়িতে কেউ থাকেনি। রোহিণীকে এই বাড়ির
গল্প বলতে বলতে একদিন ছাদে নিয়ে গেল ও। চারপাশে প্রায় ফাঁকাই, বাড়ি কম। রোহিণী একমনে
ঘুরে ঘুরে দেখছিল, পুরোনো বাড়ির গন্ধটা প্রাণ ভরে নিচ্ছিল। অভি সাথেই ছিল। হঠাৎ ওর
মনে হলো নীচে সদর দরজার বাইরে একটা গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে। ভাবলো হয়তো ওদের এখানে
আসার রোহিণীর প্রেগনেন্সির খবর পেয়ে বাড়ি থেকে দেখা করতে এসেছে। রোহিণীও মনে হয়
গাড়ির শব্দ শুনতে পেয়েছিল। ও বললো, "তুই দরজাটা খোল, আমি নীচে নামছি।"
ওকে আস্তে আস্তে নামার সাবধানবাণী শুনিয়ে অভি নীচে নামছে, ঠিক সেই মুহুর্তে ওর মনে
হলো ঠাকুমা সিঁড়ির নীচে দাঁড়িয়ে আছে। ও একমুহুর্তে ভুলে গেল ঠাকুমা আর বেঁচে নেই।
তরতরিয়ে নামতে গিয়ে পড়লো মুখ থুবড়ে। রক্তে ভেসে গেল চাতালটা। গোঙাতে গোঙাতে কোনোমতে
রোহিণীকে জানাতে পেরেছিল ওর পড়ে যাবার কথাটা। এই সমস্ত সিচুয়েশন রোহিণী খুব মাথা
ঠাণ্ডা করে সামলায়। একা হাতেই ওকে কাছের হসপিটালে নিয়ে গেল। অভির অবস্থা ক্রিটিক্যাল
থাকায় ডাক্তার বললেন ওকে এখন ভর্তি থাকতে হবে। রোহিণী ফিরে এলো। কমলাদি রাতের খাবার
করে দিয়ে গেছে। সেটা খেয়ে শুয়ে পড়লো। মাঝরাতে বাথরুমে যাবে বলে উঠে ওর মনে হলো
পাশে অভি শুয়ে। নাইট ল্যাম্পের আলোয় স্পষ্ট বুঝতে পারলো ওর মুখ। চমকে উঠলো ও ! অনেকগুলো
স্টিচ পড়েছে মুখে। স্বাভাবিক। মুখটা তো ফেটেই গেছিল। সেই নিয়েই অভি একটা ওষুধ আর
এক গ্লাস জল এগিয়ে দিল রোহিণীর দিকে। রোহিণী জিজ্ঞেস করলো, "তুই এলি কিভাবে এখানে
? তোকে তো ডাক্তার…"। ওকে শেষ করতে না দিয়ে অভি বলে উঠলো, "ডাক্তার ছেড়ে
দিয়েছে, আমি ভালো হয়ে গেছিলাম।" কিন্তু গলাটা একদমই অভির গলার মতো নয়। বরং
একসাথে দুটো গলার আওয়াজ যেমন শোনায়, অনেকটা সেরকম ! আর অভির গলা খুব একটা ভারী নয়,
তাহলে এটা কার সাথে কথা বলছে ও ? হাতটা এগিয়ে এলো ওকে ওষুধ খাওয়াতে। খেয়ে নিল ও।
ও ভাবলো ওকে ডাক্তার যে ওষুধগুলো খেতে দিয়েছিল সেটাই অভি খাওয়ালো ওকে।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলো হসপিটাল থেকে আসা ফোনে। ওরা জানালো অভি আজ ভোরে মারা
গিয়েছে। তিন ঘণ্টা অবজার্ভ করার পরে ওকে খবরটা দেওয়া হলো। তাহলে কাল রাতে যে ওকে
ওষুধ খাওয়ালো সেটা কে ?!
পাশের টেবিলে যেখানে ওষুধ, জল, টেবিল ল্যাম্প রাখা থাকে সেখানে চোখ পড়তেই
ও দেখলো যে ওষুধটা ওকে খাওয়ানো হয়েছে সেটা আসলে অ্যাবর্শনের ওষুধ ! গা গুলিয়ে উঠলো
ওর। বাথরুমে যেতেই দেখলো এক দলা রক্ত লেগে গেছে ওর জামাকাপড়ে ! ওর বুঝতে বাকি থাকলো
না আর কি হতে চলেছে! এক মুহুর্ত আর এখানে থাকা চলবেনা। অভির সৎকার করে সেদিনই কলকাতায়
ফিরে এলো ও। সোনারপুরের এই ফ্ল্যাটটা ওকে ওর বাবা দিয়ে গেছিল। সব হারিয়ে একাই এসে
উঠলো এখানে। ওর মা'ও গত হয়েছে এক বছর হলো। বিয়ের পর পর বাবাকেও হারিয়েছে। এখন স্বামীর
সাথে সন্তানকে হারিয়ে একদম একা হয়ে পড়েছে মেয়েটা। শুধু থেকে থেকে খেয়াল করে ফোনের
বা ল্যাপটপের স্ক্রিনে একজোড়া চোখ ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। কেউ যেন পেছন থেকে সরে যায়।
এই চোখজোড়া ওকে কোনোদিন একা থাকতে দেবে না। নতুন করে আর শুরু করতে দেবেনা। যে কদিন
বেঁচে থাকবে একটা অস্বস্তিতে রেখে দেবে ওকে !
Jun 18, 2021
"দেশের আজব নিয়ম" - ইয়াকুব হোসেন
Edit Posted by নেট ফড়িং with No comments
দেশের আজব নিয়ম
ইয়াকুব হোসেন
বৈশাখ মাস, প্রচণ্ড গরম দিনেরবেলা কোথাও বসে থাকা যায় না। তাই সবাই রাত্রিতে
আড্ডা দেই। সেখানে বয়স্ক থেকে ছোট-ছোট ছেলেরাও উপস্থিত থাকতো। হঠাৎ একদিন দাদুর (ঠাকুরদা)
মুখ থেকে এই কাহিনীটি শুনে আমি নিজের মতো করে লিখছি। এক গুরু তার শিষ্যকে নিয়ে ঘুরতে
গেছেন এক দেশে। সেই দেশে তেলের দাম আর ঘি-এর দাম সমান। শিষ্য গুরুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন,
কী দেশ গুরু তেলের দাম আর ঘি-এর দাম সমান। তার উওরে গুরু বলেছিলেন এই দেশের মানুষ সব
শয়তান, তাই তাদের তেলের দাম আর ঘি এর দাম সমান। শিষ্য ঘি খেতে খুব পছন্দ করতো। তাই
নিজের দেশে ফেরার সময় শিষ্য গুরুকে বলেছিলেন, ‘আপনি দেশে ফিরে যান, আমি যাবো না,’ গুরু
বললেন ‘কেন যাবি না?’ উওরে শিষ্য বললেন, ‘আমি ঘি খাবো ও মোটা হবো। গুরু অনেক বোঝানোর
পর একাই দেশে ফিরলেন।
কিছুদিন যাওয়ার পর সেই দেশে দু’জন চোর চুরি করতে গিয়ে দেওয়ালে চাঁপা পড়ে
মারা যায়। চোরের পিতা রাজার কাছে নালিশ জানায় যে, তার দুটি সন্তান চুরি করতে গিয়ে দেওয়ালে
চাঁপা পড়ে মারা যায়, আমি এর বিচার চাই। রাজা বললেন দেওয়ালটা কার বাড়ির ছিল। চোরের পিতা
বললো লেবুর বাড়ির দেওয়াল ছিল। রাজা বললেন লেবু-কে ধরে নিয়ে আয়, ওর ফাঁসি হবে।
রাজার কথা মতো লেবুকে ধরে নিয়ে আসা হল এবং বলা হল তোমার ফাঁসি হবে। লেবু
বললো ‘কেন?’, রাজা বললেন তোমার বাড়িতে চুরি করতে গিয়ে দেওয়ালে চাপা পড়ে দুটি ছেলের
প্রাণ গেছে, তাই তোমার ফাঁসি হবে। লেবু বললো দোষ তো আমার না, রাজা বললেন, ‘তাহলে কার
দোষ?’ লেবু বললো, ‘দোষ মিস্ত্রির, কারণ আমি সিমেন্ট, বালু, রড ইত্যাদি সবই তো ঠিক দিয়েছি।
মিস্ত্রি এখন হালকা করে দেওয়াল বানিয়েছে।’ রাজা বললেন, ‘তাহলে মিস্ত্রির ফাঁসি হবে।’
রাজার কথা মতো সেই মিস্ত্রিকে ধরে নিয়ে আসা হল এবং তাকে বলা হল তোমার ফাঁসি হবে। মিস্ত্রি
বলছে ‘কেন?’ রাজা বললো, ‘তুমি লেবুর যে দেওয়ালটা হালকা করে বানিয়েছ, সেই দেওয়ালে চাঁপা
পড়ে দুজন নাগরিকের প্রাণ গেছে তাই তোমার ফাঁসি হবে।’ মিস্ত্রি বলছে, ‘দোষ আমার না,
দোষ হচ্ছে জোগাইলের। আমি জোগাইলকে পানি (জল) কম দিতে বলেছি, ও বেশি দিয়ে ফেলেছে তাই
দেওয়াল হালকা হয়েছে।’ রাজা বললেন, ‘তাহলে জোগাইলকে ধরে নিয়ে আয় ওর ফাঁসি হবে।’ রাজার
কথা মতো জোগাইলকে ধরে নিয়ে আসা হল এবং বলা হল তুমি মশলায় পানি কেন বেশি দিয়েছিলে তোমার
ফাঁসি হবে। জোগাইলা বলছে, ‘ও দোষ আমার না, ও দোষ হাতি ওয়ালার। কারণ হাতি ওয়ালা হাতি
ছেড়ে দিয়েছিল। সেই হাতি দৌড়ে যাওয়ার সময় হাতির পা লেগে পানির বালতি পড়ে যায়, তাই মশলায়
পানি বেশি হয়েছিল, দোষ আমার না, দোষ হাতিওয়ালার।’ রাজা বললেন, ‘হাতিওয়ালাকে ধরে নিয়ে
আয় ওর ফাঁসি হবে।’ রাজার কথা মতো হাতিওয়ালাকে ধরে নিয়ে আসা হল এবং তাকে বলা হল তুমি
হাতি ছেড়ে দিয়েছিলে কেন, তোমার ফাঁসি হবে। হাতিওয়ালা বললো, ‘দোষ আমার না, দোষ হচ্ছে
মহিলার। মহিলাটি পায়ে ঘুঘরা পড়েছিল, সেই ঘুঘরার ঝনঝন আওয়াজ শুনে আমার হাতি দৌড় মেরেছিল।’
রাজা বললো তাহলে মহিলাটিকে ধরে নিয়ে আয়, মহিলার ফাঁসি হবে। রাজার কথা মতো মহিলাটিকে
ধরে নিয়ে আসা হল এবং মহিলাটি বললো, ‘দোষ আমার না, দোষ হচ্ছে বানিয়ার। কারণ বানিয়াই
আমাকে এই ঘুঘরা বানিয়েদিয়েছে।’ রাজা বললো, ‘তাহলে বানিয়াকে নিয়ে আয়, বানিয়ার ফাঁসি
হবে।’ রাজার কথা মতো বানিয়াকে ধরে নিয়ে আসা হল এবং বলা হল তোমার ফাঁসি হবে। বানিয়া
হতবাক হয়ে বলছে ‘কেন?’ তখন রাজা সব ঘটনা খুলে বললো কিন্তু বানিয়ার কাছে কোনো উপায় না
থাকায় ফাঁসি নিতে বাধ্য হয়।
বানিয়াকে ফাঁসি দেওয়ার জন্য বিদেশ থেকে দড়ি নিয়ে আসা হল এবং বানিয়াকে ফাঁসিতে
ঝোলানো হল, কিন্তু বানিয়ার গলা এতটাই চিকন যে দড়ি তার গলাকে ধরে রাখতে পারছেনা, সে
দড়ি থেকে খুলে পড়ে যাচ্ছে। জল্লাদ বললো, ‘রাজামশাই আপনার হুকুম তো কার্যকরী হচ্ছে না
!’ রাজা বললো ‘কেন?’ জল্লাদ বললো- ‘বানিয়ার ঘাড় খুব চিকন, দড়িতে আটকায় না।’ রাজা বললো,
“এই দড়িতে যার গলা মিলবে তাকেই নিয়ে আয়।’ খুঁজতে খুঁজতে সেই শিষ্যকে পাওয়া গেল এবং
তাকে ধরে নিয়ে আসা হল, তাকে বলা হল তোমার ফাঁসি হবে, শিষ্য বললো- ‘কেন আমি তো কোন অন্যায়
করিনি।’ রাজা বললো, ‘তোর ঘাড় মোটা এই জন্য তোর ফাঁসি হবে।’ শিষ্য তখন নিরুপায়, রাজা
তাকে বললেন, ‘তোমার কোন শেষ ইচ্ছে থাকলে বলো।’ শিষ্য বললেন ‘আমার শেষ ইচ্ছে হল আমি
আমার গুরুর সঙ্গে দেখা করতে চাই।’
শিষ্যের কথা মতো তার গুরুকে চিঠি দেওয়া হল, সেই চিঠি পেয়ে গুরু সেখানে তাড়াতাড়ি
পৌঁছে যায়। গুরুকে দেখে শিষ্য গুরুর পা জড়িয়ে ধরে বলে, ‘গুরু আমাকে বাচান।’ গুরু তখন
শিষ্যকে বললো ‘আমার বুদ্ধি মতো কাজ করবি...।’ শিষ্য বললো ‘ঠিক আছে।’ ফাঁসির দিন গুরু
বলছে ‘আমারে ফাঁসি দেন, আমার শিষ্যকে ছেড়ে দেন’ ; শিষ্য বলছে ‘আমাকে ফাঁসি দেন, আমার
গুরুকে ছেড়ে দেন।’ জল্লাদ বলছে ‘রাজা দু’জনকেই ফাঁসি দিয়ে দেই।’ রাজা বলছে ‘না, ফাঁসি
হবে একজনের। জল্লাদ তুমি একটু থেমে যাও, দুজনেই ফাঁসি নিতে চাচ্ছে এর মধ্যে রহস্য আছে।’
রাজা সেই রহস্য জানতে চাইলে তারা কেউ বলতে চাচ্ছিলেন না, অনেক অনুরোধের পর গুরু বলতে
শুরু করে যে আমি ওই দড়ির মধ্যে সব স্বর্গ (জান্নাত) দেখতে পাচ্ছি। এই দড়িতে যার ফাঁসি
হবে সে স্বর্গ (জান্নাত) লাভ করবে। রাজা মনে মনে বলছে আমি জীবনে কত পাপ করলাম, আমি
জানি আমি নরকে (জাহান্নামে) যাবো, আর যদি এই দড়িতে আমার ফাঁসি হয় তাহলে আমি স্বর্গ
(জান্নাত) লাভ করবো। এই ভেবে জল্লাদ-কে বলে ‘ওদের ছেড়ে দিয়ে আমার ফাঁসি দে।’
Jun 11, 2021
"তা সে যতই কালো হোক" - মিলন পুরকাইত
Edit Posted by নেট ফড়িং with 2 comments
তা সে যতই কালো হোক
মিলন পুরকাইত
আমাকে দেখতে বড্ড খারাপ ছিল। বেশ কালো আর মুখশ্রী... না না কালো মেয়ের রূপ
গুণের বিচার আলাদা দাঁড়ি পাল্লায় হয় তাই সে কথা থাক।
দুই বোন এক ভাই ছিলাম আমরা। দিদি রূপে গুণে একেবারে লক্ষী সরস্বতীর মতো
ছিল। দাদাই তো ছেলে তাও সে খুব ফর্সা খুব লেখাপড়ায় ভালো ছিল।
বাকি আমি !! তো সবাই বুঝিয়েই দিতো কিন্তু কি আর করা যায়।
একমাত্র বাবাই আমাকে বড্ড ভালোবাসতো। আমাদের সংসারটা মোটামুটি বাবার আয়েই
চলতো।
বাবার সব চেয়ে বড় দিদি বিধবা হবার পরে এ সংসারে তখন এসেছিল যখন আমি খুব
ছোট। জেঠু-জেঠিমা একতলায় থাকতো, আলাদা রান্না খাওয়া হলেও তাদের ভারও বাবার ওপরই বেশিটা
ছিল।
কারণ জেঠু যে কারখানায় ক্যাশিয়ারের কাজ করতেন সেটা বছরের ছ'মাস বন্ধ থাকতো
কেন কে জানে। পিসি নিঃসন্তান ছিল আর সারাদিন
সংসারের কাজে মার সাথেই লেগে থাকতো।
বাবা খুব গুরু গম্ভীর মানুষ ছিল। অফিস যাওয়া আর বাড়ি আসা আর ফিরেই খবরের
কাগজ বা বই মুখে বসে থাকা।
কেউ বিশেষ ঘেঁষতো না বাবার কাছে। অথচ আমি হা পিত্যেস করে বসে থাকতাম কখন
ফিরবে বাবাই। আমার সারাদিনের গল্প, স্কুলের, দিদি-দাদার নামে নালিশ, সব নিয়ে আমি বসে
থাকতাম বলবো বলে।
সব শুনে ডাক পড়তো তাদের।
কিছুই তেমন বলতো না বাবাই। শুধু যেদিন আমি লাল ফ্রক নেবার জন্য বায়না করেছিলাম
আর জেঠি হেসে বলেছিল "এখানে যা করছিস করে নে, বিয়ের পর যেন শাশুড়ির কাছে আবদার
করিস না আমাকে লাল শাড়ি কিনে দাও যেমন আমার কাছে করেছিলি" আর বলে খুব হেসেছিল
ওরা সবাই মিলে সেদিন বাবাকে সব বলার পরে কেমন থমকে গেছিলো বাবা।
আর একটু পরে নিজের স্বভাব-বিরুদ্ধ কাজ করেছিল। চটি পরে আমার হাত ধরে নিজের
বড় দাদার ঘরের দরজায় পৌঁছে গেছিলো।
জেঠিমা শাঁখ হাতে ঠাকুরের সামনে বসেছিল আর জেঠু কি জানি কি বলছিল। আমার
বুকের মাঝে ধড়াস ধড়াস করছিল আর মন বলছিল কিছু একটা খারাপ হতে চলেছে।
জেঠুর মেয়ে অনেক বড় ছিল আমার থেকে। কলেজের শেষ পড়া চলছিল তার তখন। কিন্তু
কে জানে কেন ঝুমদি আমাকে খুব ভালোবাসতো। আমাদের দেখে একলাফে বাইরে এসে আমার হাত ধরে
টেনে ভেতরে নিয়ে যেতে বললো "ও মা ও বাবা, কাকাই এসেছে আর তোমরা নিজেদের মধ্যে
কি জানি কি কথা বলে চলেছো"
জেঠু-জেঠিমা মনে মনে কতটা বাবাকে পছন্দ করতো তা জানতাম না কিন্তু সামনে
খুব ভালো ব্যবহার করতো।
বাবা কিন্তু এক পাও ভেতরে না রেখে খুব আস্তে আস্তে বললো "আচ্ছা বৌদি
কোনদিন কি আমি বা আমার ছেলে-মেয়েরা তোমাকে কোন অসম্মান করেছে। সত্যি করে বলো তো ! আর
মিতা ও তো তোমাকে নিজের বড় দিদির মতো ভালোবাসে। আজ তুমি মিমিকে যা বলেছো সেটা ও তোমার
মেয়ে নয় বলে তাই না! আর একটা কথা বৌদি তুমি যেদিন বিয়ে করে এ বাড়ি এসেছিলে আমার মাকে
তো সবাই বলেছিল, ওমন ফর্সা ছেলের এই এত শ্যামবর্ণ মেয়ে ! তোমার মনে আছে বৌদি আমার মা
কিন্তু তীব্র প্রতিবাদ করেছিল সেদিন "বলেছিল মানুষের রং রূপ কতদিন থাকে, থাকে
তার গুণ, তার স্বভাবের মিষ্টতা তাই না !
আজ বড্ড কষ্ট পেলাম তোমার ব্যবহারে"
দাঁড়ায়নি বাবাই আমার হাত ধরে ফিরে এসেছিল নিজের ঘরে।
জেঠি আর জেঠু তারপর অনেক কিছু বলেছিল যদিও কিন্তু বাবা তারপর থেকে আর কোনদিন
স্বাভাবিক হয়নি সেটা সবাই জানতো।
ধীরে ধীরে বড় হচ্ছিলাম আমরা আর ঝুমদি সবার বড় হওয়ায় বিয়ে হয়ে যখন শ্বশুরবাড়ি
চলে গেলো তখন আমি স্কুলের পড়া সবে শেষ করেছি।
রিয়া আমার দিদি আর ঝুমদি কিছু ছোট বড় ছিল বয়েসে।
জেঠিমা, জেঠু দু’জনেই ছেলেদের ভালোবাসতো। মেয়েরা যতই লেখাপড়া করে নিক আর
কত বড় বড় চাকরি করুক না কেন তবু মেয়েরা তো মেয়েই হয়, ছেলেদের সাথে তাদের তুলনা করা
একেবারে বৃথা এটাই মত ছিল দু’জনেরই।
আমার মা আর দিদি যদিও ওই আলোচনায় তেমন থাকতো না তবু কেমন যেন মনে হতো ওরা
ওটাকেই সমর্থন করছে।
ঝুমদি বিয়ে হয়ে চলে যাবার পরে জেঠিমা বড্ড একা হয়ে গেছিলো। আমার দিদি নিজের
পড়া আর আসন্ন বিয়ের কথা ভেবে নিজের রূপচর্চার পেছনেই বেশী সময় দিতো।
আমার কলেজে ভর্তির পরেও তখন ক্লাস তেমন শুরু না হওয়ায় আমি যখন তখন
"ও মামণি কি করছো" বলে পৌঁছে যেতাম। খুব ছোট থেকেই কেন জানি না আমি জেঠিকে
মামণি বলেই ডাকতাম।
ঝুমদি চলে যাওয়ার পরে কেমন যেন মনে হতো জেঠিমা আমার পথ চেয়ে বসে থাকতো।
প্রথম প্রথম যদিও তেমন কিছু বলতো না, নিজের মনে কাজ করতো, পরে একটু একটু
করে বদলে গেছিলো জেঠি।
আমার পছন্দের খাবার বানিয়ে রাখতো, কখনো বা আমি গেলেই বলতো "যা না তোর
মা আর দি'কেও ডেকে আন, আজ চা'টা সবাই মিলে এখানেই খাবো ভেবেছি !"
বাবা কিন্তু সেই সেদিনের পর থেকে মোটেই আর বদলায়নি। নিজের দায়িত্ব কর্তব্য
সব করলেও বাবা একটু দূরে দূরেই থাকতো নিজের বৌদির থেকে। এমন নয় যে কথা বলতো না, বলতো
কিন্তু তাতে প্রচ্ছন্ন অভিমান লুকিয়ে থাকতো।
বিয়ের পর ঝুমদির আসা যাওয়া একেবারেই ছিল না বললে চলে।
ফোনেও তেমন কথা হতো না কারো সাথে। আমাকে মাঝে মাঝে ফোন করে কথা বলতো দি।
যেই বলতাম "কবে আসবি 'দি !"
একটু চুপ করে থেকে বলতো
"মা-বাবা তো নিজের ছেলেকেই ভালোবাসে, কই আমাকে তো একবারও ফোন করে না
তারা !"
এমন দিনেই জেঠির বড্ড শরীর খারাপ হলো। কি যে হলো কেউ বুঝতে পারছিল না। ডাক্তার
ওষুধ সব চলছিল আর আমি সেই প্রথম দিন থেকেই জেঠির কাছে থেকে গেছিলাম।
মা, বাবা কোনদিন আমাদের কোন কাজে বাধা দেয়নি এবারও দিলো না।
ওপর থেকেই রান্না করে মা সব পাঠিয়ে দিতো। রিয়া'দি মাঝে মাঝেই আসতো কিন্তু
আমি নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে ওই জেঠির পাশেই থাকতাম।
দিন কাটছিল আর আমার কলেজ যাবার দিন এগিয়ে আসছিল। মা দেখা শোনা তেমন ভাবে
করতে পারবে না বলে পিসির ওপর জেঠিকে দেখার ভার এসে পড়লো।
ভালো ছিল পিসি কিন্তু দু'জনের একদম বনি-বনা হতো না।
হাঁড়ির মতো মুখ করে পাশ ফিরে শুয়ে থাকতো জেঠি, পিসিও অন্যমনে নিজের বই বা
সেলাই নিয়ে বসে থাকতো।
আমি কলেজ থেকে ফিরেই কিছু না খেয়েই পৌঁছে যেতাম জেঠির কাছে। পিসি যেন হাঁফ
ছেড়ে বাঁচতো। সোজা উঠে ওপরে নিজের ঘরে পৌঁছে যেত।
বছর ঘুরে আবার নতুন বছর আসার আগেই আমার বিয়েটা হঠাৎ ঠিক হয়ে গেলো।
আমি শুধু না আমার বাড়ির লোকেরাও খুব অবাক হলো যখন অভিমন্যুর মতো এত হ্যান্ডসাম
ছেলে রাজি হয়ে গেছিলো আমাকে বিয়ে করতে।
ছোট্ট পরিবারে অভিমন্যু ওর বাবা মা আর ওর ঠাকুমা থাকতো।
মেয়ে দেখতে ওর ঠাকুমা এসেছিল ওর বাবার সাথে।
সেদিন জেঠির শরীরটা বড্ড খারাপ ছিল। ঝুমদি এসেছিল আমাকে দেখতে আসবে শুনে।
মা আর রিয়া'দি বারবার তাড়া দিচ্ছিলো আমাকে
"মিমি চল, ফেসপ্যাকটা লাগিয়ে নে, আর সময় নেই, ওরা পাঁচটা বাজলেই এসে
পড়বে"
কিন্তু আমি যতবার জেঠিকে ঘুম পাড়িয়ে ঝুমদি আর পিসিকে বলে উঠতে যাচ্ছিলাম,
জেঠি আমার আঙ্গুল শক্ত করে ধরে বলে উঠছিলো
"যাস না আমাকে ছেড়ে মামণি"
জ্বরের ঘোরে ভুল বকছিলো জেঠি। আজকাল রাতে দিনে যখনই বেশি শরীর খারাপ হতো
জেঠি আমাকে মামণি বলেই ডাকতো কেন কে জানে !
একটু পরেই বাবাইকে দৌড়ে আসতে দেখেই বুঝে গেছিলাম, ওরা এসে গেছে কিন্তু আমার
তো কিছুই করার উপায় ছিল না।
আমি কোন মেকআপ ছাড়াই বসে ছিলাম জেঠির পাশে।
আমার কালো কোঁচকানো চুল এলোমেলো হয়ে আমার কপালকে প্রায় ঢেকে রেখেছিল। চান
করে সেদিন চার বছর আগে জন্মদিনে বাবাইয়ের দেওয়া লাল কুর্তি আর সাদা স্কার্ট পরেছিলাম
আমি।
মা আর ঝুমদি মিলে আমার জন্য রানী রঙের সিল্কের শাড়ি আর গয়নাগাটি বের করে
রেখেছিল পাত্রপক্ষের সামনে পড়ার জন্য। কিন্তু সেসব কিছুই আর পরা হয়ে ওঠেনি।
আমার কানে সব সময়ের পরে থাকা সেই লাল ডালিম পাথরের অল্প ঝোলা দুল আর গলায়
তেমনই পেন্ডেন্ট ছিল। হাতে সেই ঠাম্মির দেওয়া সরু সোনার বালা ব্যস আরেক হাত একেবারে
খালি।
বাবাইয়ের পেছনে এক এক করে সবাই ঢুকলো ঘরে। আমি জেঠির হাত ছাড়িয়ে উঠতে যাবার
আগেই অভির ঠাম্মি বারণ করলো আমায়
"না না উঠো না। ওনার ঘুম ভেঙে যাবে !'
অভি দেখলো আমায় এক পলক। কে জানে কেন আমাকে তো এর আগেও কেউ পছন্দ করেনি তাই
জানতাম এটাও তেমনই কিছু হবে।
আমি তো বড্ড কালো, আমি সাজতেও ভালোবাসি না।
তাই আমি নির্দ্বিধায় জেঠির হাতের থেকে হাত একটু ছাড়িয়ে হাত জুড়ে নমস্কার
করেছিলাম।
কিন্তু পরে জেনেছিলাম শেষ বিকেলের কনে দেখা আলো সেদিন জেঠির ঘরের পশ্চিমের
জানলার পর্দা ছুঁয়ে ছুঁয়ে আমার মুখে নাকি কি একটা অপরূপ আলো ছুঁইয়ে দিয়েছিল।
আমার খোলা এলোমেলো কোঁচকানো চুলের মাঝে অভির ঠাম্মি নাকি নিজের কমবয়সের
'আমি'টাকে খুঁজে পেয়েছিল।
বিয়েটা হলো আমার ঠিক একবছর পরে কারণ রিয়া'দির বিয়েটা অনেক বছর ধরেই ঠিক
ছিল ওর কলেজের বন্ধুর সাথে। বাবাই শেষ পর্যন্ত রাজি হতেই দি আর শুভাশিসদার বিয়েটা হয়ে
গেলো।
জেঠি সুস্থ হলেও আমাকে কাছ ছাড়া করতে চাইতো না তেমন করে ।
"আর কদিন পরেই তো চলে যাবি আমাদের ছেড়ে তোর ওই নতুন সংসারে, আর তো
এসে থাকবি না এমন করে, এই কটা দিন আর ওপর নীচ না করে আমার কাছেই থাক না হয় !"
সারাক্ষণ এটাই বলতো জেঠি।
বিয়ের কেনাকাটা দিদিরা আর বাবাই করেছিল। গয়না মা আগেই তৈরি রেখেছিল নিজের
দুই মেয়ের জন্য।
বিয়ের আগের দিন জেঠির ঘরেই আইবুড়ো ভাত খেয়েছিলাম আমি।
নিজে বসে সমস্ত রান্না করেছিল জেঠি আমার জন্য। কারোকে হাত লাগাতে দেয়নি
তাতে তেমন করে রিয়া'দি ছাড়া।
সবার খাবার শেষে বাবাইয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল জেঠি। হাতে মস্ত বড় দু
দুটো প্যাকেট দেখে বাবাই অবাক হয়ে সব ভুলে সেই আগের মতোই বলেছিল
"কি আছে গো বৌদি, আমার জন্য উপহার এনেছো তুমি !"
কেঁদে ফেলেছিল জেঠি আর প্যাকেট বাবাইয়ের হাতে ধরিয়ে বলে উঠেছিল
"ক্ষমা করে দিও ঠাকুরপো। সেই একদিনের কথা শূল হয়ে বিঁধে আছে তোমার
বুকে জানি। কিন্তু বৌদিরা তো মা হয় তাই না। ক্ষমা করে দিও আমাকে !'
প্যাকেটে কি ছিল তা বিয়ের দিন আমি জেনে ছিলাম...
লাল টুকটুকে বেনারসি শাড়ি আর অন্য প্যাকেটে জেঠির নিজের বিয়ের জড়োয়ার হার।
লাল ছোট ছোট পাথরে সাজানো সে হার আমার ছোট থেকেই খুব পছন্দ ছিল।পাশে এসে বলেছিল জেঠি
" মিমি পছন্দ হয়েছে তো !"
সাজাতে সাজাতে ঝুমদি ফিসফিস করে কানে কানে বললো
"ইশ এই হারটা মা তোকে দিয়ে দিলো, আমাকে দিলো না"
আমি গলা থেকে খুলতে যাচ্ছিলাম, মারলো দি আর ঝুম'দি আমার পিঠে।
"সব সময় খুব ভালো সাজতে ইচ্ছে হয় তাই নারে ! চুপ করে বসে থাক, বর এলো
বলে !'
বিয়ে করে চলে আসার আগে কাঁদিনি আমি, আসলে কোন মেয়েরাই কাঁদে না মনে হয়।
ওটা কান্না নয় আসলে...
একটা গাছকে নিজের চেনা চেনা জায়গা ছেড়ে শুধু একটা অচেনা জায়গায় নতুন মাটিতে
বসিয়ে দেওয়া !
একটা একটা করে শেকড় ছিঁড়ে যায় কেউ জানতে পারে না, কেউ স্পর্শ করতে পারে
না তার কষ্ট।
অন্য জায়গায় আলো হাওয়া ভালোবাসা পেয়ে কেউ কেউ খুব সুন্দর হয়ে যায় আর কেউ
বা কিছুদিন বেঁচে একটু একটু করে শুকিয়ে মরে যায়।
অভিকে প্রশ্ন করে ছিলাম বৈ কি
"এত সুন্দর সুন্দর মেয়ে থাকতে এই কালো মেয়েটাকে কেন পছন্দ করেছিলে
তুমি ! জানো সত্যি বলছি আমি খুব অবাক হয়েছিলাম "
অভির বাড়ির ছাদে, বারান্দায় গাছের ভিড়ে আমি নিজের একটা কোনা বানিয়ে নিয়েছিলাম
আমার মতো করে, শেকড় ধীরে ধীরে ছড়িয়ে আমি নাকি সুন্দর হয়ে উঠছিলাম...
গোধূলির আলো সেদিনও আমার মুখে পড়েছিল বোধহয়। আলতো হাতে আমার কপাল থেকে চুল
সরিয়ে অভি বলেছিল
"সেই ছোট থেকেই ঠাম্মির মুখে শুনে এসেছি রঙ রূপ সে তো মনের আয়না। অন্তরের
আলো যখন হৃদয়ে নিজের জলছবি আঁকতে থাকে, সেই আলো মানুষের চোখে মুখে তার ছাপ ফেলে , তুমি
যে কত সুন্দর তা তুমি আমার চোখে দেখে নিও !"
দূর ! আমি এত সব বুঝি না !
আমি শুধু জানি, নিজের মনের আলোয় অন্যকে একটু পথ দেখানো গেলে তাতে ক্ষতি
কি !
আমি কালো, বড্ড কালো কিন্তু কি করি ওই ভালো হবার ইচ্ছেটা যে সেই ছোটথেকেই।
এই দেখো না বলতেই ভুলে গেছি ওই লাল বেনারসি আর জড়োয়ার হার পরে জেঠির পা
ছুঁয়ে যখন বলেছিলাম " সাবধানে থেকো মামণি, আমি কিন্তু খুব চিন্তায় থাকবো তোমাকে
নিয়ে!"
জেঠি কেঁদেছিল খুব, খুব জোরে।
বলেছিল "মামণিকে ক্ষমা করে দিস সোনামা !"
আমি কিন্তু দেখছিলাম, তিন বছরের একটা কালো মেয়ে পুজোর অষ্টমীতে লাল বেনারসী
আর জড়োয়ার হার পরা জেঠির গলা জড়িয়ে কোলে বসে বলছে
"তুমি তো আমার মামণি, ঠিক এমন লাল শাড়ি আর হার দেবে গো আমাকে
"
বড় হয়ে সবার মুখে হাজার বার শুনেছিলাম সে কথা।
সব ভাবতে ভাবতে
আমি হাত ছাড়িয়ে ধীরে ধীরে চৌকাঠ ডিঙ্গিয়ে বাইরে বেরিয়ে বাগানের অনেক গাছের
মাঝখান দিয়ে আলতা পায়ে চলে গেছিলাম টুকটুকে লাল বেনারসী পরে অভিমন্যুর সাথে... অনেক
গুলো শেকড় নিঃশব্দে ছিঁড়তে ছিঁড়তে...
শত সহস্র হাজার হাজার মেয়েদের মতো... একটা ছায়া ছায়া মাটির সন্ধানে... বাকি
জীবনটার জন্য !