Oct 24, 2020
Oct 20, 2020
ফড়িং সাক্ষাৎ
Edit Posted by নেট ফড়িং with No comments
অতিথি- কিশোর মুজুমদার (কবি, লিরিসিস্ট, ইউটিউবার)
সাক্ষাৎকার ও অণুলিখন- দীপজ্যোতি গাঙ্গুলি
নেটফড়িং অনলাইন ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে একটি নতুন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কোচবিহার
তথা বাংলার বেশ কিছু মানুষ যারা নিজ নিজ কাজে অত্যন্ত পারদর্শী ও পরিচিত মুখ, তাদের
মুখে তাদের জার্নি শুনে সেটা নেটফড়িং এর পাঠকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। আজ আমাদের সাথে
যেই মানুষটি আছেন তার পরিচিতি সে নিজেই। আমাদের সাথে আজ আছেন, কোচবিহার শহরের সেরা
ইউটিউবার, দ্য ওয়ান এন্ড অনলি কিশোর মজুমদার।
দীপজ্যোতি- প্রথমেই জিজ্ঞেস করবো, লকডাউন কেমন কাটালেন?
কিশোর- সবার প্রথমে নেট ফড়িংকে ধন্যবাদ জানাই এত সুন্দর কাজ করছো তোমরা
তার জন্য । লক ডাউনে মিশ্রভাবে কাটালাম। আমি কাজ পাগল মানুষ । কাজে ডুবে থাকার চেষ্টা
করেছি। কিন্তু চারপাশের পরিস্থিতির জন্য মানসিকভাবে ভালো নেই।
দীপজ্যোতি- শিক্ষকতার পাশাপাশি কোচবিহার শহরের সেরা কবি তথা ইউটিউবারদের
মধ্যে একজন। মানে এটা কিভাবে ম্যানেজ করেন?
কিশোর- সেরা কবি তথা ইউটিউবারদের মধ্যে একজন - এ কথা ঠিক নয়। কোচবিহারে
বিখ্যাত কবি সাহিত্যিক রয়েছেন, যাদের আমি খুব শ্রদ্ধা করি । তাদের কাছে আমি তো নগণ্য।
আর ইউটিউবার ? বাঘা বাঘা ইউটিউবার আছেন আমাদের শহরে । আমার চ্যানেল সেখানে ছোট্ট চারাগাছ
মাত্র।
আর ম্যানেজ করার কথা বলছো । শিক্ষকতার পাশাপাশি আমি সবচেয়ে পড়তে ও লিখতে
ভালোবাসি । আর এখনকার পড়ার বেশিরভাগটাই হচ্ছে অনলাইনে । কিছু কিছু কোর্সও করে নিচ্ছি
। শিখতে বেশি ভালোবাসি বলে আমি নিজেকে এখনো ছাত্রই ভাবি। আর রুটিন করে পড়ি, কবিতা ও
গান লিখি। তিনটি ব্লগ চালাই, যেখানে নিয়মিত লিখে যেতে হয়। সপ্তাহে একটি করে ইউটিউবের
জন্য ভিডিও বানাতে চেষ্টা করি। পুরো কাজগুলি কেমন করে যেন হয়ে যায় । আসলে গভীর ভালোবাসা
থেকেই কাজগুলো আমাকে খুব আনন্দ দেয়।
দীপজ্যোতি- আমার বিগত ছয় বছর থেকে একটা প্রশ্ন আপনাকে জিজ্ঞাসা করার ইচ্ছে
ছিল। আজ সুযোগ পেয়ে করে ফেলি।সেটা হল, আপনি যেটাই করেন, সেটাতেই আপনি সেরা। মানে এই
'ফার্স্ট বয়' হওয়ার পেছনে কি স্ট্র্যাটেজি মেনে চলেন?
কিশোর- হাঃ হাঃ হাঃ । 'সেরা' ব'লো না আমাকে। কিন্তু আমি যে কাজই করি খুব
ভালোবেসেই করি। আর নিজের কাজে যখন পুরোটা উজার ক'রে দিয়ে তার ফল পাওয়া যায় । সেটা যত
যৎসামান্যই হোক না কেন, আমার কাছে ওটাই "সেরা' । বোঝোই তো নিজের সন্তান যেমনই
হোক না কেন সে-ই ভালো ।
দীপজ্যোতি- রাঘব চট্টোপাধ্যায়ের সাথে কাজ করে কেমন লেগেছিল? যদি একটু গল্পটা
শেয়ার করেন।
কিশোর- এই ব্যাপারে আমি একজনের নাম করতে চাই সে হল কোচবিহারের প্রবীর সরকার,
খুব ভালো গান লেখে । প্রবীর আমাকে প্রথম টলিউডে মিউজিশিয়ান শিবশঙ্করদার সঙ্গে পরিচিত
করায়। তারপর ইউফোনি মিউজিক থেকে আমার লিরিক এ রাঘবদা ( রাঘব চট্টোপাধ্যায়) আর অদিতি
মুখার্জীর অ্যালবাম 'আলোর চিঠি' বের হয়।
রেকর্ডিং এর জন্য নির্দিষ্ট তারিখে গেলাম স্টুডিও হারমনিতে । সারাদিন রাঘবদার
সঙ্গে আমরা খুব মজা করে খেলাম, কাজ করলাম । খুব মিশুকে প্রকৃতির মানুষ রাঘবদা। আমার
লিরিকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ । কি বলবো নিজের মুখে। যাকগে। তার আগে একদিন স্কুলে ছুটির
পর ক্যারাম খেলছিলাম । এমন সময় রাঘবদার ফোন পেয়ে চমকে উঠি । খুশিতে ডগমগ হয়ে সেদিনই
টিকিট কাটি। সেখানে গিয়ে বেশ কয়েকজন বিখ্যাত মিউজিশিয়ানের সঙ্গে মেশার সুযোগ পেয়েছি।
দীপজ্যোতি- কোচবিহারের এতো এতো শিল্পীদের সাথে কাজ করলেন। কার কার সাথে
কাজ করে সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে?
কিশোর- দ্যাখো । কোচবিহারে এখন বেশিরভাগ প্রফেশনাল কোয়ালিটির কাজ দিচ্ছে।
কার কথা বলবো । এভাবে বলতে চাই না। সবার সঙ্গেই কাজ করে আমি খুশি। কারণ সবাই আমার পাশে
দাঁড়িয়েছে। আবৃত্তিকার, সংগীতশিল্পী, অভিনয়শিল্পী, আর্টিস্ট, কোরিওগ্রাফার, D.O.P,
অডিও-ভিডিও কাজের সঙ্গে যুক্ত মানুষ সবাই আমার প্রিয়। স্টুডিও-র কথা যদি বলো তাহলে
nexxus studios, Jalsaghor, Audiogear এদের সঙ্গে কাজ করেছি ও করছি । এত এত মানুষের
প্রচেষ্টা আর আদর পেয়ে আমার চ্যানেলটা আমার একার আর নেই । সকলের আপন হয়ে উঠেছে। এখন
আমরা একটা টিমের মতো কাজ করে চলেছি।
দীপজ্যোতি- এই যে আপনার এতো সাকসেস এটা কি আপনার মধ্যে কখনো কোনো নেগেটিভ
প্রেসার তৈরি করে?
কিশোর- এটা খুব মজার প্রশ্ন করেছো । যে কোনো কাজে মাঝে মাঝেই খুব হতাশা
আসতে বাধ্য । কিন্তু আমি জীবনকে অন্যভাবে দেখি । আমার কাছে It's a game, কোনো কাজ একটা
করার পরেই আমার শুরু হয় পরের কাজটা নিয়ে চিন্তা । কীভাবে আগের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা
নিয়ে পরেরটা আরও বেটার করা যায় তার চেষ্টা করি । পুরো টিমকে আমি সর্বদা জাগিয়ে রাখতে
চেষ্টা করি। আমি কিন্তু প্রশংসার চেয়ে নিন্দা থেকেই বেশি শিখতে পারি । তাই প্রশংসা
আমার কাছে নেতিবাচক হয়ে ওঠে না। ভালো কাজের প্রশংসা আমার দায়িত্ব বাড়িয়ে দেয় । তাই
আরও বেশি কাজেই মনোযোগী হতে পারি। সাকসেস তাই আমার কাছে power booster.
দীপজ্যোতি- আজ যারা লেখালেখি করছে তাদের অনেকেরই ইনস্পিরেশন আপনি। ঠিক যেমন
আমার। কিন্তু আমার প্রশ্ন হল, আপনার ইন্সপিরেশন কে?
কিশোর- সেটা এককভাবে কেউই নয় । বিশ্ব জোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র ।
আমি সবার কাছে শিখতে চাই । তুমি দেখবে প্রত্যেকটা মানুষের কাছেই কিছু না কিছু শেখার
আছে । নেতিবাচক দিকগুলো ভুলে তাদের ইতিবাচক দিকগুলো থেকেই ইন্সপিরেশন নিতে চেষ্টা করি।
আর লেখার কথা বলছো । আমি আমার বাবার (স্বর্গীয় সুনীল মজুমদার) কাছে লেখালেখির
আগ্রহ পেয়েছি। বাবা নাটক, গান লিখতেন । আর অনেক বই পড়তেন । এখনো মনে হয় বাবা আমার পাশে
থেকে লিখতে প্রেরণা দিচ্ছেন । আমার " আমিও পারি" কাব্যটি সামনে প্রকাশিত
হবে । এই বইটা আমি বাবাকেই উৎসর্গ করছি ।
দীপজ্যোতি- ২০০৯ সালে আপনি দাদাগিরি সিজন ২ তে গিয়েছিলেন। স্টেজে দাদার
মুখোমুখি কেমন অনুভূতি হয়েছিল ?
কিশোর- ওরে বাবা সে এক অনুভূতি । স্টেজের অভিজ্ঞতার আগে বলে নি। সৌরভের
জ্বর হয়েছিল বলে আমাদের পুরো টিমকে ১৪ দিন থাকতে হয়েছিল । তখন, আমাদের গ্রুমার ছিলেন
মীরাক্কেলের কৃষ্ণেন্দু, সৌরভ পালধি ওরা। ওই ১৪ দিন জীবনে আমার দারুণ একটা প্রাপ্তি
ছিল । আর স্টেজে দাদার মুখোমুখি আমার স্বপ্ন মনে হয়েছিল । আসলে এত আলোর মাঝে, ক্যামেরার
সামনে, আমার অভিজ্ঞতাও কম । একটু নার্ভাস লাগছিল । দাদার সঙ্গে হাত মেলানোর পর কথা
বলার পরে একদম ফ্রি হয়ে গেলাম। এটা দারুণ স্মরণীয় দিন আমার কাছে ।
দীপজ্যোতি- এমন কোনো স্বপ্ন আছে জীবনে, যা কখনো পূরণ হবার মতো না?
কিশোর- মানুষ সব পারে । এমন কোনো স্বপ্ন আমি দেখি না যা পূরণ হবার নয়। আমি
স্বপ্ন যা দেখি সব পূরণ করেই ছাড়বো ।
দীপজ্যোতি- আগামীতে যারা কবি বা লিরিসিস্ট বা একজন সফল ইউটিউবার হতে চায়।
তাদের জন্য কি বার্তা দেবেন?
কিশোর- এটা ব্রড আনসার টাইপ কোশ্চেন । লিরিসিস্ট এর বিষয়ে আমি বিপরীত দুটি
দিক তুলে ধরতে পারি। শিক্ষককে যেমন সবার আগে ছাত্র হতে হয়, তেমনি গীতিকারকে সবার আগে
শ্রোতা হতে হয় । শচীনদেব বর্মণ থেকে শ্রীজাত সবার লেখাই আমি গভীরভাবে অনুভব করতে চেষ্টা
করি । LBW -র আপিল হলে যেমন রিপ্লে দেখে বোঝা যায় বলটা কোন দিকে যাচ্ছে। তেমনি প্রফেশনাল
লিরিসিস্টকেও গানের প্রবাহ অনুভব করতে হয়। আরেকটি দিক হল গীতিকার হবার কোনো গ্রামার
লেসন নেই । লালন ফকির আমার মতে অন্যতম শ্রেষ্ঠ গীতিকার। গান হল হৃদয়ের ছান্দিক অনুভূতির
প্রকাশ । শব্দের উর্ধে সুরের মূর্ছনাই সেখানে প্রধান । তাই নিজেকে ফিল করে যা বেরোবে
তাই গান হয়ে উঠবে । যদি সেই ব্যক্তিক বিষয়টি ব্যষ্টিক হয়ে ওঠার ক্ষমতা রাখতে পারে ।
আর ইউটিউবারদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ চারটি টিপস ।
১। সাফল্যের পেছনে ছুটলে হবে না।
১০০ টা ভিডিও করে তারপরে ফিরে দেখো কী হল । আর প্রতিটি ভিডিও এক একটা শিক্ষা দেবে ।
দুটো চারটা ভিডিও করেই বার বার ভিউজ কত হল দেখলে হবে না । অর্থাৎ চরম ধৈর্য রাখতে হবে
।
২। নিয়মিত ভিডিও আপলোড করতে হবে । নিয়মিত ভিডিও দিলে ইউটিউব তাকে rank দেয়
। আর নির্দিষ্ট দর্শক তৈরি হতে থাকে।
৩। কন্টেন্ট ভালো হতে হবে । যা মানুষের শিক্ষা বা বিনোদনের হবে ।
৪। আর টেকনিক্যাল বিষয়গুলো শিখে নিতে হবে । সেক্ষেত্রে ইউটিউবই হল বেস্ট
টিচার ।
নতুনদের জন্য রইল ভালোবাসা । আর বেস্ট অফ লাক।
দীপজ্যোতি- আপনাকে টলিউডে কাজ করতে আবার কবে দেখবো?
কিশোর- টলিউড বলতে আর কি । পুজোতে একটা কাজ হচ্ছে 'অবশেষে' শিরোনামের গান
। বিক্রম শীল এর গলায় । অভিনয়ে আছে "পরিণীতা" ছবিতে একটা রোল করেছিল সেই
পিহু । আর পুরোটাই প্রায় কলকাতায় কাজ । সিনেমায় কাজের কথা যদি বলো তাহলে বলা খুব মুশকিল
। দু'একটা কাজের কথা চলছে । হলে জানতেই পারবে । সিধুর একটা গানের কাজ শুরু হচ্ছে ।
সেটা Nexxus Studios তে কাজ শুরু হয়ে গেছে । পুজোর পর হয়তো শুনতে পাবে ।
দীপজ্যোতি- আগামীতে কি কি পরিকল্পনা আছে ? মানে আর কি কি নতুন চমক অপেক্ষা
করছে আমাদের জন্য ?
কিশোর- চমক কিনা জানি না । আমার প্রিয় বই এর কাজ শুরু হচ্ছে । ব্লগ এর কাজে
মন দিয়েছি । মানুষের ভালোবাসা পাচ্ছি ও ভবিষ্যতেও পাবো আশা করছি । কয়েকটা দারুণ দারুণ
কাজ আসছে সামনে । কিছু গান ও কবিতা । যারা পিয়াসি চক্রবর্তীর কণ্ঠে 'আমিও পারি' শুনেছেন
ও পছন্দ করেছেন, তাদের জন্য পিয়াসির কণ্ঠে দারুন একটা কবিতার ভিডিও আসছে পুজোর পর।
একটু নতুন ধরনের কাজ । আর নতুন নতুন বেশ কিছু এক্সপিরিমেন্ট চলছে । দেখতেই পাবে । যারা
আমার লেখা গানের ভক্ত তাদের জন্য বলি, শুনলে খুশি হবেন যে 'চিরকূট' নামে একটা গান আসছে
আয়ুব আলীর কণ্ঠে । এবস্ট্রাক্ট আর রিয়েলিটি মিলে অভিনব কাজ ।
এবার একটা র্যাপিড ফায়ার রাউন্ড।
১ কবি কিশোর মজুমদার নাকি লিরিসিস্ট কিশোর মজুমদার
-লিরিসিস্ট কিশোর মজুমদার
২ অডিও অ্যালবাম নাকি ভিডিও অ্যালবাম'
-ভিডিও অ্যালবাম
৩ ট্র্যাডিশনাল না ওয়েস্টার্ন
-ওয়েস্টার্ন
৪ ইউটিউব না ডিভিডি
-ইউটিউব
৫ অনুপম না রনজয়
-অনুপম
৬ ফেসবুক না ইন্সটাগ্রাম
-ফেসবুক
৭ সুবোধ সরকার নাকি শ্রীজাত
-শ্রীজাত
৮ সিনেমা নাকি ওয়েব সিরিজ
-ওয়েব সিরিজ
৯ রাঘব চট্টোপাধ্যায় নাকি অদিতি মুখোপাধ্যায়
-রাঘব দা
১০ কবিতা না গান।
-দুটোই
অনেক ধন্যবাদ জানাই তোমায় কিশোরদা নেট ফড়িং কে এতটা সময় দেওয়ার জন্য। তোমার
আগামী কাজগুলোর জন্য অনেক শুভেচ্ছা রইলো।
(ছবি সৌজন্যে- কোরক মুজুমদার)
Oct 18, 2020
নেট ফড়িং সংখ্যা- ১৬৩ (পূজা সংখ্যা- ২০২০)
Edit Posted by নেট ফড়িং with 2 commentsOct 11, 2020
নেট ফড়িং সংখ্যা- ১৬২
Edit Posted by নেট ফড়িং with No commentsOct 4, 2020
নেট ফড়িং সংখ্যা- ১৬১
Edit Posted by নেট ফড়িং with No commentsOct 3, 2020
"হৃদয় আনন্দে নেচে ওঠে" - আবদুস সাত্তার বিশ্বাস
Edit Posted by নেট ফড়িং with No commentsহৃদয় আনন্দে নেচে ওঠে
আবদুস সাত্তার বিশ্বাস
স্কুল করে এসে ফ্রেশ হয়ে এক কাপ চা
খেয়ে পুলক এখন বাড়িতে রয়েছে। একটা পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যায় তার একটা গল্প
বেরিয়েছে সেটা দেখছে।
এইসময় তার ফোনটা হঠাৎ বেজে ওঠে।ও
থেমে যায়। তারমানে মিসডকল!
পুলক তখন গল্পটা দেখা বন্ধ করে ওই
নম্বরটা বের করে কল করে। ওখান থেকে সে তখন একটা নারী কণ্ঠ শুনতে পায়,"হ্যালো!"
পুলক সরাসরি জিজ্ঞেস করে তাকে,"কে বলছেন?"
"আমি একটা নারী বলছি। আপনার পরিচিতা
একটা নারী। "নারী কণ্ঠটা বলে।
"কি নাম আপনার? নাম বলুন! নাহলে ওভাবে বললে তো চিনতে পারবো না।"
কিন্তু কণ্ঠটা নাম বলে না। পুলক তখন
ফোন রেখে দেওয়ার হুমকি দেয়।
কণ্ঠটা তখন পুলককে ফোন রাখতে নিষেধ
করে। তার সঙ্গে যে তার অনেক কথা আছে। অনেক দরকার আছে সেটা বলে।
তবু পুলক হুমকি দেয়।
কণ্ঠটা তখন পুলকের দোহাই দেয়।
"আপনার দোহাই লাগে ফোন রাখবেন না!"
পুলক আর ফোন রাখেনা, "বেশ,কি কথা আছে
বলুন!"
কণ্ঠটা তখন আর 'আপনি' নয়। 'আপনি' থেকে এক লাফে 'তুমি'তে নেমে চলে আসে।
"তুমি আমাকে চিনতে পারছো না, পুলক? আমি তোমার অতি পরিচিতা একটা নারী গো! তবু তুমি চিনতে পারছ
না...!"
পুলক তবু চিনতে পারে না।
কণ্ঠটা তখন বলে, "চিনতে না পারারই কথা। কেননা পঁচিশ বছর সময় তো আর কম নয়।
অনেক দীর্ঘ সময়। সুতরাং অত বছর আগের একটা মেয়েকে চিনতে না পারারই কথা।..."
কণ্ঠটার এখান থেকে পুলক তখন একটা
ক্লু পেয়ে যায়। আর সে সেই পঁচিশ বছর আগে চলে যায়। যখন সে ভগীরথপুর স্কুলের
উচ্চ-মাধ্যমিকের ছাত্র আর তার দৃপ্ত যৌবন সেই পঁচিশ বছর আগে।
অনেক দিন আগে এই ভগীরথপুরে জমিদারদের
বাস ছিল। সেই সূত্রে ভগীরথপুর খুব নাম করা জায়গা। এখানে যে জায়গাটায় তারা বাস করত
ওটা 'বাবুপাড়া'। জমিদারদের আরেক
নাম 'বাবু'। তাই 'বাবুপাড়া'।
পুলক একদিন ওই বাবুপাড়া ঘুরতে যায়।
গিয়ে বাবুদের বাড়িগুলো ঘুরে দেখে বাড়িগুলোর কি করুণ অবস্থা! পরিচর্যার অভাবে
বাড়িগুলো ভেঙে ভেঙে পড়ছে। জনমানবহীন বাড়িগুলো জঙ্গলে ভরে গেছে। পলেস্তারা খসে খসে
পড়ছে। ইটের পাঁজর বেরিয়ে গেছে। মানুষের বদলে বাড়িগুলো এখন সাপ খোপের আস্তানা। কিছু
কিছু বাড়ি আবার ভৈরবের ভাঙন ধারে পড়ে ভেঙে গেছে। ও কিছু বাড়ি ঝুলছে। যে বাড়ি গুলো
ভাঙেনি অর্থাৎ ভাঙন ধার থেকে কিছুটা দূরে রয়েছে সেগুলোও একদিন ভেঙে যাবে। নদীতে
পড়ে হারিয়ে যাবে। নদী গর্ভে তলিয়ে যাবে। বাবুপাড়া সেদিন আর বাবুপাড়া থাকবে না।
বাবুরা যেমন নেই বাবুদের পাড়াটাও নেই হয়ে যাবে।
এই বাবু পাড়াতেই পুলকের সেদিন একটা
মেয়ের সঙ্গে আলাপ হয়।
এখানে পরি ছাপানো একটা বাড়ি রয়েছে।
পুলকের লোক মুখে শোনা আছে, এই বাড়িটা বাবুদের
সেসময় রং মহল ছিল। অর্থাৎ নাচ, গান, আড্ডা, তামাশা এসবই এখানে
হতো।
পুলক বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে ছাপানো
পরিটা দেখে। কি সুন্দর পরিটা! যেন ডানা মেলে উড়ছে। ছাপানো তা মনে হয় না।
ঠিক এইসময় এখানেই পুলকের মেয়েটার
সঙ্গে আলাপ হয়।
সে-ও বাবুপাড়া ঘুরতে এসেছে এবং ঘুরতে
ঘুরতে এখানে এসে পুলকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে আলাপ হয়। মেয়েটার নাম পারুল। নদীর
পারে তুলসিপুর গ্রামে তার বাড়ি। সে-ও ভগীরথপুর স্কুলের ক্লাস টেনের ছাত্রী।
আলাপ সেরে পরে তারা বাড়িটির ভিতর
ঢুকে যায়। এই বাড়িটির ভিতর দেখলে তাদের সব দেখা হবে।
ভিতরে দেখবার মতো কোন জিনিসই নেই।
আগাছার জঙ্গল আর ভাঙা ইট, কাঠের টুকরো ছাড়া।
ঢুকেছে যখন সে সবই তারা ঘুরে দেখে। দেখতে দেখতে এক সময় একটা জায়গা থেকে পারুল হঠাৎ
দৌড়ে পালিয়ে আসে, "ও বাবা গো! মরেছি
গো!" চিৎকার করতে করতে এসেই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে পুলককে।
পুলক জিজ্ঞেস করে, "কি হল? কি দেখলে?"
পারুলের চোখ বন্ধ। মুখেও কোন কথা
নেই। কোন সাড়া না পেয়ে পুলক তাই ফের জিজ্ঞেস করে, "কি হল? কি দেখলে?"
তবু সাড়া মেলে না পারুলের। পুলক তাই
আবারও জিজ্ঞেস করে, "কি হল, কি দেখলে, বলো...."
পারুলের সাড়া মেলে এবার। "বিরাট
একটা সাপ দেখলাম!"
সাপের কথা শুনে পুলক আঁতকে উঠে, "সাপ দেখলে!"
"হ্যাঁ।"
"কোথায়?"
"ওখানে।"
"ওখানে কোথায়?"
"যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম ওখানে।"
পুলক অমনি পারুলের কাছ থেকে নিজেকে
ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। "ছাড়ো পারুল, কি সাপ দেখে আসি। ছাড়ো!"
পারুল ছাড়ে না। একই রকম ভাবে সে তাকে
ধরেই থাকে। পুলকেরও আর ওখানে সাপ দেখতে যাওয়া হয় না। কিন্তু সাপটা কি সাপ দেখার
আগ্রহে পুলক ওদিকে চেয়েই থাকে। ও তাই তো! এই মোটা আর এই বড় একটা সাপ ইটের ফাঁক
দিয়ে চলে যাচ্ছে। সাপটা দেখতে পেলেও সাপটা কি সাপ পুলক ভালো মতো চিনতে পারেনা। তবে
সাপটার গায়ের কালো রং আর ডোরাকাটা কালো দাগ দেখে সাপটা যে কাল খরিশ হবে পুলক সেটা
অনুমান করে নেয়। এই ধরনের সাপ খুব বিষধর আর বিষাক্ত হয়।মানুষকে কামড়ালে মানুষ
বাঁচে না। যাইহোক, সাপটাকে সঠিকভাবে
চেনার জন্য পুলক ছটফট করতে থাকে, "ছাড়ো পারুল, সাপটা চলে যাচ্ছে। কি সাপ একবার দেখে আসি। ছাড়ো....!"
কিসে কি! পারুল ছাড়ে না। ছাড়ে না তো
ছাড়ে না। বরং আগের থেকে আরও শক্ত করে চেপে ধরে।
তার ওই রূপ চেপে ধরা দেখে পুলক বলে, "কি হল,এত শক্ত করে ধরছ
কেন?"
পারুল চুপ থাকে।
পুলক শুধায়, "সাপে কামড়ায়নি তো তোমাকে?"
সাপে তাকে যে কামড়ায়নি সেটা বোঝাতে
পারুল দুই দিকে মাথা নাড়ে।
পুলকের তখন খেয়াল হয় যে, পারুলের ডালিম্ব সম স্তন দুটি তার বুকের সঙ্গে একেবারে ঠেসে
রয়েছে। আর তার হাত দুটি তার দুই ঘাড় ধরে রয়েছে। আর তার পাতলা ঠোঁট পুলকের ঠোঁটে
ঠেকছে। খেয়াল হওয়া মাত্র পুলকের শরীরে হঠাৎ বিদ্যুৎ প্রবাহ হতে শুরু করে। পুলকের
শীতল শরীর উষ্ণ হতে থাকে ও শিহরণ খেলে যায় দুজনের শরীর-মনে। ভালোবাসার সমুদ্রে দু’জনেই নিমজ্জিত হয়ে ধীরে ধীরে অতলে তলিয়ে যায়। এরপর চৈতন্য
ফিরলে দু-জনেই ভীষণ লজ্জা পায়। তারপর এভাবে তারা দেখা করতে থাকে।
পঁচিশ বছর আগে তাদের দেখা হওয়ার
প্রথম দিনটির কথা মনে পড়ে যায় পুলকের। বুকের ভিতরটা তারপর হঠাৎ তার কেমন করে ওঠে।
এই নারী কণ্ঠটাই কি তাহলে পঁচিশ বছর আগের সেই পারুল? এরকম মনে হলে পরে পুলক বলে, "তুমি কি পারুল?"
হাউমাউ করে অমনি কেঁদে ফেলে কণ্ঠটা, "হ্যাঁ গো, আমি পারুল। পঁচিশ
বছর আগে যার সঙ্গে তোমার পরি বাড়িটির ভেতর...
আমি সেই পারুল।"
হঠাৎ পারুলের এহেন কান্নায় পুলক থতমত
খেয়ে যায়। ফলে তার স্বাভাবিক হতে কিছুটা সময় লাগে। পরে স্বাভাবিক হয়ে সে বলে, "এ কি! তুমি কাঁদছ কেন? কান্না থামাও!"
পুলক কান্না থামাতে বলায় পারুল চুপ
করে যায়। গিয়ে সে বলে, "অনেক দিন বাদে
তোমার সঙ্গে কথা বলছি তো তাই আবেগে কান্না চলে এল। কান্না রুখতে পারলাম না।"
পুলকের এরপর আপনি মনে পড়ে যায়, পরি বাড়িটির ভিতর সেদিন তাদের আকস্মিকভাবে মিলন ঘটে যাওয়ার
পর পারুল মাত্র দেড় মাস মতো স্কুল আসে। তারপর তার কি যে হয় স্কুল আসা বন্ধ করে
দেয়। তারপর আর কোনদিন তার সঙ্গে দেখা নেই।
কেন স্কুল আসা বন্ধ করে দেয় পুলক এখন
তাকে সেটা জিজ্ঞেস করলে পরে পারুল বলে যে, সে স্কুল আসা বন্ধ করবে কেন? তার বাড়ি থেকে বন্ধ
করে দেয়। কারণ ঘটনাটা বাড়িতে জানাজানি হয়ে যায়। মেনকা নামে তাদের পাড়ার একটা
মেয়েকে কথাটা সে একদিন কথায় কথায় বলে ফেলে। আর মেনকা বাড়িতে বলে দেয়। বাড়িতে কথা
শুনতে হবে এই ভয়ে বর্ধমানে তার মামার বাড়ি পালিয়ে যায়। তারপরই স্কুল, পড়া সব বন্ধ।
পুলকের মুখ থেকে চরম আফসোসে তখন আপনি
বেরিয়ে যায়, "ইস, কি ভুল করেছিলে গো! কি ভুল করেছিলে!" তারপর বলে, "এতবড় ভুল কাজ কেউ করে?"
"ও যে বলে দেবে সেটা কি আমি জানতাম?" পারুল তারপর বলে, "তবু আমি চুরি করে একদিন স্কুল আসি। তোমার সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু তুমি স্কুল
আসোনি। আমিও আর বাড়ি ফিরে যাই না। বাবা-দাদা তাহলে যে আমাকে ধরে মেরে মেরে ফেলবে।
আমি তখন করি কি, বাসে চেপে সোজা বহরমপুর চলে আসি। এসে
এখানে বাসস্ট্যান্ডে একটা বিধবা মেয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। নাম নমিতা। তার
সন্তানাদি কেউ নেই। একটা বাড়িতে একা থাকে। কান্দি মহকুমার 'নব দূর্গা' গ্রামে। মেয়েটা
আমার সমস্ত কথা শোনে। শোনার পর আমাকে তার বাড়ি নিয়ে চলে আসে। আমি ছোট বোনের মতো
তার আশ্রয়ে থাকতে শুরু করি এবং আমার একমাত্র মেয়েটাকে নিয়ে এখনও আছি।"
"তোমার বিয়ে?"
"বিয়ে করিনি।"
"তাহলে মেয়ে পেলে কোথায়?"
"বলবো। তার আগে তোমাকে একটা খুশির খবর
শোনাই। সেটা হল, আমার মেয়ের একটা হায়ার সেকেন্ডারি
স্কুলে চাকরি হয়েছে। আজকেই জয়েন করে এল।"
"শুনে খুব খুশি হলাম। কোন স্কুল?"
"সরস্বতী উচ্চ বিদ্যালয়।"
নামটা শুনে পুলক চমকে যায়, "কোন স্কুল বললে!"
"সরস্বতী উচ্চ বিদ্যালয়।"
পুলক তখন বলে, "আমি তো ওই স্কুলেরই শিক্ষক।"
"আমি তা জানি। তোমাদের বানিয়াখালি
গ্রামের হরিচরণবাবু নামে এক ভদ্রলোক এখানে চাকরি করেন। আমার মেয়ে তাঁর ছাত্রী। এস
এস সি পরীক্ষায় মেয়ে পাশ করলে উনি একদিন বাড়িতে বেড়াতে আসেন। কথায় কথায় ওনাকে
তোমার কথা জিজ্ঞেস করলে ওনার মুখ থেকেই সেটা জানতে পারি। তাই তো মেয়েকে আজ বাড়ি
থেকে বের হওয়ার সময় বারবার করে বলে দিই যে, সে যেন তোমার ফোন নম্বরটা অবশ্য অবশ্যই চেয়ে একটা কাগজে লিখে আনে এবং কাগজটা
আমাকে দেয়। এইভাবে আমি তোমার ফোন নম্বর সংগ্রহ করি।"
"তারমানে মাধবী তোমার মেয়ে!"
"আমার একার নয়, তোমারও।"
"আমারও!"
"হ্যাঁ, তোমারও।"
"কি করে আমারও!"
মালতি ওদের ভালোবাসার ফসল। সুতরাং
মালতি তার একার নয়, তারও।
পুলকের মুখ থেকে তখন আপনি বেরিয়ে যায়, "উফ, গড!"
তারপর কারো মুখে কোন কথা নেই
কিছুক্ষণ। কিছুক্ষণ বাদে পারুল বলে, "তুমি আজো বিয়ে করোনি?"
"না।"
"করবে না?"
"করবো।"
"কাকে?"
পুলকের মুখ থেকে তখন যে কথাটা বের হয় পারুলের হৃদয় আনন্দে নেচে ওঠে তাতে। যা পঁচিশ বছরে কোনদিন নাচে নি।