অন্য বসন্ত
লগ্নজিতা দাশগুপ্ত
সকাল সকাল মুডটা
বিগড়ে গেলো
দেবপর্ণার, আজকেও রান্নার মাসি মিনিদির
লেট, উফঃ
আর ভালো
লাগে না
পর্ণার মিনিদির
এই রোজকার
দেরি।আজ আবার
বড়দির কাছে
বকা খেতে
হবে এই
মিনিদির জন্য,মহারানীকে কিছু
বললেই আবার
রাগ আর
বাহানা| এমনি
আজ স্কুলে
অনুষ্ঠান আছে,সব দায়িত্ব
পর্ণার কাঁধে,তার ওপর
দেরী| বিরক্ত
দেবপর্না রান্না
ঘরের দিকে
যাচ্ছিলো সেই
সময় হঠাৎ
কলিংবেলের আওয়াজ পেলো।
দরজা খুলতেই মিনিদি
তার রোজকার
বাহানার ঝাপি
খুলতে যাচ্ছিলো
কিন্তু তার
আগেই পর্ণা
তাকে থামিয়ে
দিয়ে বাথরুম
এ ঢুকে
যায়| বাথরুম
এর আয়নার
চোখ রাখে
পর্ণা, সেই
ডাকসাইট এ
সুন্দরী পর্ণা
আজ যেন
কোথায় হারিয়ে
গেছে| চোখের
নিচে কালি,
গালে ভাঁজ
জানান দিচ্ছে
পর্ণা তুই
বুড়ি হয়েছিস|
স্নান সেরে
বাইরে এসে
আয়নার সামনে
এসে দাঁড়ায়
আমাদের ঊনচল্লিশ
এর নায়িকা|ওর পছন্দ
সাদা জামদানিরটার
সাথে একটা
মাল্টিকালার এর বোটনেক এর ব্লাউস
পড়ে, কপালে
টিপ, চোখে
কাজল আর
হ্যাঁ লিপস্টিকটা
একটু গাঢ়
করে দেয়
যেমনটা রীত
পছন্দ করতো,আজ হঠাৎ
কেন রীতের
কথা ভাবছে
ও,অবশ্য
কবেই বা
না ভাবে|যদিও রিত
ওকে একবারও
ওর পর্ণাকে
মনে করে
না সেটা
দেবপর্না জানে।
তাড়াতাড়ি খেয়ে বেরোতে
যায় পর্ণা,মিনিদি বলে
"কি সুন্দর
লাগছে তোকে
বোন,এমন
সুন্দর রোজ
সাজতে পারিস
না? "
মিনিদির কথায় উত্তর
না দিয়ে
হেসে বেরিয়ে
যায় পর্ণা|গাড়িতে যেতে
যেতে একদল
কপোত-কপোতীকে
দেখে নিজের
স্কুলজীবনের কথা মনে পড়ে দেবপর্নার,
ও আর
রীতের ক্লাস
ওয়ান থেকে
বন্ধুত্ব;বয়স
বাড়লে অন্য
অনুভূতি,কিন্তু
কেউ কাউকে
না বলা
শুধুমাত্র বন্ধুত্ব হারানোর ভয়ে|একসাথে
ফুচকা খাওয়া,সিনেমা দেখা,বইমেলায় যাওয়া,আর সেই
বৃষ্টির সন্ধ্যা|কেমিস্ট্রি টিউশন
থেকে ফিরছিলো
ওরা দুজন,একদল ছেলে
দেবপর্নাকে দেখে টোন্ট করায় যেভাবে
ওদের রীত
পিটিয়ে ছিল
আজও ভাবলে
গায়ে কাঁটা
দেয় ওর|তারপর সেই
রীতের টাইফায়েড
এর সময়
একলা ঘরে
প্রেম নিবেদন;কলেজের ফিজিক্স
ল্যাব এ
প্রথম চুমু,আজও ভাবলে
দেবপর্নার পেট গুড়ুগুড়ু করে ওঠে
লজ্জা আর
ভয়ে।
ড্রাইভার এর ডাকে
সম্বিৎ ফেরে
পর্ণার,স্কুলের
সামনে গাড়ি
থামিয়ে দিয়েছে
ড্রাইভার,গাড়ি
থেকে নেমে
সোজা বড়দির
ঘরে যায়
পর্ণা|ম্যাডামকে
আজ একটু
সাজতে দেখে
সব ছাত্রীরা
আজ অবাক,বাকি দিদিরা
স্কুলে সেজে
আসলে ফিজিক্স
এর দিদিকে
কেউ কখন
সাজতে দেখেনি|বড়দি তো
রাগের বদলে
হেসে বললো
"বাহ্ পর্ণা বেশ লাগছে তোমায়।"
"ধন্যবাদ বড়দি,কি
কাজ আছে
বলুন"...
"অতিথি আপ্যায়ন তোমায়
যে করতে
হবে দেবপর্না,
এস.ডি.ও আসছেন
সঙ্গে আরও
কিছু লোকজন
তো আছেই|"
"আচ্ছা, দিদি কোনো
চিন্তা করবেন
না সব
হয়ে যাবে"...
"জানি, সেই জন্যই
তোমায় দায়িত্ব
দেওয়া"...
কিন্তু অতিথি আপ্যায়ন
করতে গিয়ে
ধাক্কা খায়
দেবপর্না, এ কাকে দেখছে সে,
রিতুজা, রিতুজা
মুখার্জি, একদা ওর বেস্টফ্রেন্ড অন্যদিকে
ওর প্রেমিকা|
হ্যাঁ লেসবিয়ান
ছিল ওরা,
না সমকাম
নয় সমপ্রেম
ছিল| দেবপর্না
দেখলো ঝড়টা
অন্য দিকেও
শুরু হয়েছে
তা নিজের
একুশ বছরের
বেস্টফ্রেন্ড আর সাতবছরের প্রেমিকার কালোফ্রেমের
চশমার কাঁচের
বাইরে থেকেই
বুঝতে পারছিলো|
কোনোক্রমে বরণ সেরে,
অনুষ্ঠান শুরু
হলে স্টাফ
রুম এ
চলে আসে
পর্ণা মাথাধরার
বাহানা করে|আস্তে আস্তে
মনে পড়ে
সেই দিনটা
যে দিন
ওকে আর
রিতকে খুব
ঘনিষ্ঠভাবে দেখে ফেলেছিলো রীতের বৌদি|
ঝড় উঠেছিল
দুইবাড়িতে,এককাপড়ে বাড়ি ছেড়েছিলো দুজনে
যখন দেবপর্নার
বাবা মেয়ের
বিয়ে ঠিক
করতে চায়|
রিত নিজের
এম.এস.সি করা
বাদ দিয়ে
বন্ধুর সহায়তায়
একটা চাকরী
খুঁজে দেবপর্নাকে
নিয়ে গার্লস
হোস্টেল এ
মাথা গোঁজে।
কিন্তু আস্তানা গোঁজার
সাথে সাথেই
সেখানে এসে
মেয়েকে নিয়ে
যেতে চায়
রিতুজা বাড়ি
থেকে,সে
না গেলেও
হোস্টেল এর
সবাই জেনে
যায় ওদের
ভাষায়
তাঁরা সমকামী,হোস্টেল ছাড়ে দুজনে|
এক কামরার ফ্ল্যাটটাতে
উঠে আসতেও
রিতকে কম
খাটতে হয়নি,গাধার মতো
সারাদিন টিউশন
আর স্কুল
করতো সঙ্গে
রাতে ডব্লু.বি.সি.এস এর
পড়া|দিনগুলোর
কথা মনে
পড়তেই চোখে
জল চলে
আসলো দেবপর্নার,সঙ্গে আরও
মনে পড়ে
পাড়ার লোকের
টিটকারি,রকের
ছেলেগুলোর কথাগুলো|কেউ ওদের দেখলে
বলতো "কি মজা দেখ,লাগালাগি
করলেও এদের
বাচ্চা হওয়ার
ভয় নেই",ওষুধের দোকানে
গেলে শুনতে
হতো,"কন্ডোমের টাকা লাগে না
কিন্তু ডাবল
পাউরুটি কিনতে
হয়",কেউ
আবার বলতো
"ইস রে
মাসের দুবার
করা বন্ধ
থাকে যখন
দুজনের আলাদা
ডেট এ
হয়"|রিত
প্রতিবাদ করতে
যেতে চাইলেও
পর্ণা ওকে
আটকাতো কারণ
অনেক কষ্টে
ওরা একটা
ঠিকানা পেয়েছে|
"আজও তোকে ম্যাজেন্ডা
কালার এর
লিপস্টিক এ
ভীষণ সেক্সি
লাগে"...
চেনা গলার আওয়াজ
পেয়ে পেছনে
তাকায় দেবপর্না,
উত্তর না পেয়ে
রিতুজা বলে
ওঠে
"জানি ক্ষমা করবি
না,করা
উচিৎ ও
না তবে
একটা কথাই
বলবো ভালো
থাকিস|"
"আজও কি তোর
আমাকে নোংরা
মেয়ে বলে
মনে হয়?"
"কখন ও মনে
হয়নি ইনফ্যাক্ট
যে দিন
দাদাভাই ফোন
করে বলেছিলো
তুই নাকি
ওর সাথে
শুতে ছেয়েছিস
বিশ্বাস কর
মা এর
পেটের দাদা
না হলে
খুন করে
ফেলতাম,কিন্তু
দেখ আমি
তোকে বিশ্বাস
করলাম কিন্তু
তুই একটু
বিশ্বাস বা
ভরসা কোনোটাই
রাখতে পারলি
না"...
"ভরসা, ওরা যে
আমায় বলেছিলো
তু্ই আমার
মুখ দেখতে
চাস না,তু্ই নতুন
চাকরিতে সুখে
আছিস,নিজের
মুখে আমাকে
চলে যেতে
বলতে পারবি
না বলে
তোর বাড়িতে
চাকরী পেয়ে
নিয়ে গেছিলি
যাতে ওরা
আমাকে বুঝিয়ে
বলতে পারে,আর তু্ই
ফোন ও
ধরিসনি আমি
কি করতে
পারি বল"...
"ওরা বললো তু্ই
বিশ্বাস করলি?
আর আমি
কিন্তু ও
বাড়িতে তোকে
নিয়ে যেতে
চাইনি,বরং
আমার চাকরির
খবর পেয়ে
যখন ওরা
আমাদের নিতে
এসেছিলো,তোর
জেদের জন্যই
আমাদের ও
বাড়িতে যেতে
হয়,আর
আমার মোবাইলটা
ট্রেন এ
হারিয়ে যায়,যেটা আমি
মাকে বলি
তোকে জানিয়ে
দিতে কিন্তু
থাক,আর
শোন্ তোর
সব খবরই
রাখতাম,চাকরী
পেয়েছিস,নতুন
সংসার পেতেছিস
কিন্তু কাছে
যায়নি|এমনি
কোনো অনুষ্ঠান
এ যাই
না কিন্তু
তোর স্কুল
দেখে এসেছিলাম
তোর ভুল
ভাঙতে|"
"চাকরী পেয়েছি এটা
ঠিক,সংসার
আমি পাতিনি,একবার একটা
সংসার পেতেছিলাম
একটা এক
কামরার ফ্ল্যাট
এ যেখানে
একটা মানুষ
থাকতো যে
আমি এক্সকারসনে
বাইরে গেলে
কলকাতা শহরে
দাঁড়িয়েও দিনের
বেলা অন্ধকার
দেখতো,আমার
শ্বাসকষ্টের ঔষধ প্রয়োজন ছাড়া ব্যাগ
এ নিয়ে
ঘুরতো,না
আর এরকম
কাউকে পাইনি
তাই সংসার
আর করাও
হয়নি|"...
"তবে বৌদি যে
বললো"...
"উনি তো অনেক
কিছুই বলে"...
"আজও এই ওষুধটা
খাস নাকি
দেখ তো
নাকি পাওয়ার
চেঞ্জ হয়েছে?"
একটা ওষুধ
এর স্ট্র্যাপ
এগিয়ে দেয়
রিতুজা।
অবাক হয়ে তাকিয়ে
থাকে দেবপর্না,
"ওষুধটা আজও কিনি,এক্সপেয়ার ডেট
চলে যায়,ফেলে দি,আবার কিনি,কি জানি
কিসের জন্য
কিনি"|
"তোর বাংলো পরিষ্কার
করার ক্ষমতা
আমার নেই,আমার ফ্ল্যাট
এ তাড়াতাড়ি
চলে আয়
তোর ব্যাগপত্র
গুছিয়ে,অবশ্য
জামা কাপড়
মানেই তো
তোর ঘামের
গন্ধওয়ালা টি-শার্ট আর কাঁদা
লাগানো জিন্স,আসার সময়
ডিটারজেন্ট পাউডার নিয়ে আসবি|"
"ইয়ে মানে আমার
বাংলোতে আসলে
ভালো হতো
না অনেক
জামা কাপড়
মেলার জায়গা
পেতি"|
শাড়ির আঁচল কোমর
এ পেঁচিয়ে
দেবপর্না রিতুজা
দেখে ঘুষি
পাকাতে গেলে,"আরে থাম
থাম তোর
ফ্ল্যাট এই
যাবো, নইলে
ওই বাংলো
রোজ ধুতে
যে ফিনাইল-ডেটল লাগবে
আমার পুরো
মাসের বেতন
শেষ হয়ে
যাবে"।
কপট রাগ করতে
গিয়েও হেসে
ফেলে দেবপর্না,আর শক্ত
করে ওর
হাতটা ধরে
রিতুজা,ওর
প্রিয়বন্ধু,ওর প্রেমিকা,ওর সঙ্গী|হাত দুটোর
উষ্ণতার সাক্ষী
থাকে করনডিহি
হাই স্কুলের
ফাঁকা স্টাফরুমটা।
পুনশ্চ:ভালোবাসুন মন
দিয়ে লিঙ্গ
দেখে নয়,কাম স্বল্পস্থায়ী
কিন্তু প্রেম
চিরস্থায়ী।