May 30, 2021
May 29, 2021
লেখকের চোখে নেট ফড়িং
Edit Posted by নেট ফড়িং with 2 comments
লেখকের চোখে নেট ফড়িং
লিখেছেন- সৌমিত সরকার
একটা সময় ছিল যখন এত ছুটোছুটি ছিল না। সারাদিনে কিছুক্ষণ সময় পাওয়াই যেত
গল্পের বই নিয়ে বসার। এখনকার মতো নয়। এখন তো নিঃশ্বাস নেবার সময়ও হয় না, বসে বই পড়া
তো দূরের কথা।
এখনকার বাচ্চারাও বই পড়ে, তবে তা ছাপার অক্ষরে নয়, ই-বুক হিসাবে, মোবাইলে।
এদের বইয়ের নেশা নেই বা পড়ার নেশা নেই এরকম ভাবা কিন্তু ভুল। এরা আমাদের
থেকে অনেক বেশি পড়ে। ইন্টারনেটের দৌলতে এখন সারা পৃথিবীর সাহিত্য এদের হাতের মুঠোয়।
কিন্তু ভেবে দেখুন, জীবনে সব ক্ষেত্রেই কি এটা সত্যি নয়। নতুন আসে, পুরোনো
সরে দাঁড়ায় তাকে জায়গা করে দেবার জন্য, তবেই তো জীবন এগিয়ে চলে। আমরা নিজেরাও, একসময়
জীবন নিজেদের শর্তে বাঁচি, তারপর কোন এক সময় জীবনের হাল অন্য কারুর হাতে তুলে দিই,
আর তারপর একদিন স্রোতের মুখে ভাসতে ভাসতে চলে যাই অজানার উদ্দেশ্যে। আমরা সরে যাই,
তাই অন্য কেউ এগিয়ে আসতে পারে, সুযোগ পায় নিজের জীবন নিজের শর্তে বাঁচার চেষ্টা করার।
তাই তো একদিন পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলা পাবার জন্যে লোকে কলকাতায় থাকা বন্ধুকে
বলতো কিনে পাঠাতে, আর আজ সেই বন্ধুকেই বলে যে প্রয়োজনে অনলাইনে অর্ডার করে নিজেই তার
কাছে পাঠিয়ে দেবে – দু’জনের মধ্যে যে যেখানেই থাকুক না কেন।
এ কথা অবশ্যই সত্যি যে দিন বদলেছে, সময় পাল্টেছে। লোকের হাতে এখন বসে বই
পড়ার মত সময় নেই, তাই আজ ই-বুকের রমরমা।
আমাদের উত্তরবঙ্গে কোচবিহারের মতো প্রত্যন্ত জেলাতে কয়েকজন সাহিত্যপ্রেমী
যুবক-যুবতী স্বপ্ন-উড়ানের স্পর্ধা দেখিয়ে নেটফড়িং এর মতন অনলাইন সাহিত্য পত্রিকা
প্রতি সপ্তাহে প্রকাশ করে চলেছে। এই পত্রিকার প্রতিটি লেখকের লেখনী পাঠক মহলে ভিন্ন
স্বাদের আস্বাদন দেবেই। নেটফড়িং এমন একটি অনলাইন সাহিত্য পত্রিকা যেখানে অণুগল্প,
ধারাবাহিক গল্প, নানা স্বাদের কবিতা ও বিভিন্ন বইয়ের সম্বন্ধে সঠিক ধারণা পাঠকের কাছে
পৌঁছে যাচ্ছে, রয়েছে বিভিন্ন শিল্পীদের তোলা আলোক-চিত্র। তরুণদের স্পর্ধা দেখানোর সাহস
জোগায় এই সাহিত্য পত্রিকা। আমি এক তরুণ লেখক, লেখালেখির চেষ্টা করছি আর কী? আজ আমার
লেখা নেটফড়িং এর মাধ্যমে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে। প্রতিভার সঠিক বিচ্ছুরণ ঘটাতে
আমার মতো হাজারো তরুণ-কে পথ দেখাচ্ছে নেটফড়িং সাহিত্য পত্রিকা। আমার বিশ্বাস এভাবেই
অনেকটা পথ পাড়ি দেবে নেটফড়িং। আমি নেটফড়িং এর সঙ্গে যুক্ত হতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবান
বলে মনে করছি। আশা রাখছি আগামীদিনেও ঠিক একইভাবে পাঠক মহলে আলোড়ন সৃষ্টি করবে নেটফড়িং।
এভাবেই এগিয়ে যাক নেট ফড়িং।
May 28, 2021
"আবার ফিরে এসেছি " - অনাদি মুখার্জি
Edit Posted by নেট ফড়িং with No comments
আবার ফিরে এসেছি
অনাদি মুখার্জি
অয়ন অনেকদিন ধরে একটা বাড়ি কেনার সন্ধানে রয়েছে, শেষমেশ একটা পুরাতন ফ্ল্যাট
বাড়ি পাওয়া গেলো ! কিন্তু এই নতুন বাড়িতে আসার পর থেকে অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটতে লাগলো,
যা কল্পনাও করা যায় না ! রাত হলে একটা মেয়ের কান্না আওয়াজ পাওয়া যায়, একদিন রাতে সবাই
মিলে বসে খাওয়া-দাওয়া করছে, তখন বাথরুমের জল পড়ার শব্দ শুনতে পায়, সেই শব্দ শুনে অয়ন
বাথরুমে গিয়ে দেখে কল থেকে জল পড়ছে না, তবে কোথা থেকে শব্দ এল ? তার পর ছাদে কে যেন
আওয়াজ করে বলছে আমাকে সুখে থাকতে দিলি না সবাই কে শেষ করবো! অয়ন এইসব শুনে একটু ভয়
পেলো ! অয়নের বৌ মালা বললো দেখো কেউ আছে ছাদে
গিয়ে দেখে এসো ! অয়ন তখন ছাদে গিয়ে দেখে কেউ নেই শুধু একটা ঠান্ডা হাওয়া স্রোত
বয়ছে এতে অয়নের সারা শরীরের একটা কাঁটা দিয়ে উঠলো ! নিচে নামতে আবার সেই কান্নার
আওয়াজ এলো ! অয়ন ভাবলো পাশের বাড়ি থেকে এই কান্নার আওয়াজ আসছে, ঠিক দুই দিন পরে আবার
সেই একই ঘটনা তবে এই বার কান্নার আওয়াজ নয় বরং কে যেনো বাইরের দরজার ধাক্কা দিচ্ছে,
এত রাতে কে এল? বলে অয়নবাবু একমাত্র ছেলে সমু দরজা টা খুলে দেখে কেউ নেই তার পর হঠাৎ
দমকা হাওয়ায় সব কিছু, ঘরের জিনিস-পত্র উড়ে যেতে লাগলো ! এই দৃশ্য দেখে অয়ন ও তার বৌ
খুব ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে বললো কে তুমি বলো ? কেন
এমন করছো ? হাওয়া তখন থেমে গেল !
পরে আর এই রকম ঘটনা আর হয়নি বলে অয়ন সেই ব্যাপার টা নিয়ে মাথা ঘামালো না
! একদিন রাতের বেলায় সবাই ঘুমিয়ে আছে সেই সময় এক বিকট চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেলো অয়নবাবু
ছেলে সমুর, সেই শুনতে পেলো কান্নার আওয়াজ সেই আওয়াজ শুনে বিছানা ছেড়ে ছাদে এল, ছাদে
ঘুটঘুটে অন্ধকার কিছুই দেখা যাচ্ছে না, হঠাৎ একটা ছায়া চোখে পড়তেই বলে উঠলো কে ? ওপর
দিকে তাকিয়ে দেখে একটা মেয়ে দড়িতে ওপরে ঝুলছে, তা দেখে সমু ভয় পেয়ে বললো কে তুমি ?
কেন এমন ভয় দেখাচ্ছ? তখন ঐ ছায়াটা ঝুপ করে তার সামনে এসে পড়লো !
সমু দেখলো মেয়েটার পড়নে নীল রঙের শাড়ি, তার মুখ খানিকটা কেমন যেন থেতলে
দেওয়ার মতো, চোখের থেকে যেন লাল রক্ত ঝরছে, এই দেখে খুব ভয়ে কাঁপতে লাগলো সমু, ভয়ে
ভয়ে বললো কে তুমি ? কি চাও ? ওই মেয়েটা তখন খুব হাসতে লাগলো আর বললো তোরা কেউ থাকবি
না, তুই এখুনি মরবি বলে লম্বা একটা হাত বের করে সমুর গলা চেপে ধরলো !
সমু বললো ছেড়ে দাও আমাকে আমি কি অন্যায় করেছি ? মেয়েটা সমানে বলে যাচ্ছে
আমি ফিরে এসেছি আমাকে এখানে মেরে ফেলেছে ওরা বলে বিকট শব্দ করে বললো আমার ইচ্ছা পূরণ
হয়নি তাই তোকে মরতে হবে, আমি তোকে নিয়ে যেতে এসেছি, এখানে কেউ থাকবে না বলে সমু-কে
ছাদের ওপরে আঁছাড় মারলো !
পরেরদিন সকালে অয়নবাবু ও তার বৌ ছাদে গিয়ে দেখতে পায় সমুর লাশ পড়ে আছে,
মুখে রক্তের দাগ ও কপালের মধ্যে রক্তে লেখা আছে ‘আমি ফিরে এসেছি, আমার নাম মালা’! সেই
দৃশ্য দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো দু’জনে !
সেদিন এক প্রতিবেশীর কাছে জানতে পারে একটা ঘটনা !
অনেকদিন আগে এই বাড়িতে মালা ও তার বাবা-মা থাকতো, মালার বয়স ছিল আঠেরো বছর।
সে একটা ছেলেকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল, সেই বিয়েটা মেনে নিতে পারেননি মালার বাবা ও মা
! একদিন মালার বর কে পায়েসের সাথে বিষ মিশিয়ে মেরে ফেললো মালার বাবা ! মালা তখন জানতে
পারে তার বর-কে মেরে ফেলেছে তখন মালার কি কান্না ! সে কাঁদতে কাঁদতে বললো আমার সুখ
ছিনিয়ে নিয়ে ভালো করোনি এর পরিণতি খুব খারাপ হবে ! তখন মালাকে ওপরের ছাদে দড়ি দিয়ে
বেঁধে রেখে দিল, তখন মালা বললো আমি কাউকে ছাড়বো না, এই বাড়িতে সবাই-কে মেরে ফেলবো,
বলে ছাদ থেকে ঝাপিয়ে আত্মহত্যা করলো ! তার কিছুদিন পর মালার বাবা ও মায়ের লাশ পাওয়া
যায় এই ছাদের মধ্যেই ! সেই থেকে মালার আত্মা ঘুরে বেড়ায় ঐ ছাদের মধ্যে !
সবকিছু শুনে অয়ন ও তার বৌ বুঝতে পারলো যে ঐ মেয়েটার আত্মা তাদেরকেও শাস্তি
দেবে। এই ভয়ে পরের দিন ঐ বাড়িটি ছেড়ে দিল, আগে যদি এই ঘটনা জানতো তবে তার একমাত্র ছেলেকে
হারাতে হতো না। বিধির কি বিধান, কে করলো অপরাধ আর তার শাস্তি কে পেলো ! সেই থেকে ওই
বাড়িতে কেউ আসে না, পরে এলাকার লোকেরা ওই বাড়ির নাম দিয়েছে ‘আবার ফিরে আসবো’! মাঝেমধ্যেই
ওই বাড়ি থেকে একটা আওয়াজ শোনা যায়, ‘আমি ফিরে এসেছি’ !
"দিদিভাই ও নিগমদা" - সায়ন বণিক
Edit Posted by নেট ফড়িং with No comments
দিদিভাই ও নিগমদা
সায়ন বণিক
পশ্চিমের সূর্য্য অস্ত যাওয়ার পথে। বাড়ির ঠিক ডান পাশ দিয়ে বয়ে গেছে
ছোট্ট নদী করলা। জলপাইগুড়ি শহরটাকে যেন ভাগ করে রেখেছে এই নদী। তাও, এখন অনেক ব্রিজ
হয়েছে। বড়দের মুখে শোনা অনেক আগে নাকি এপার-ওপার করতে নৌকো বা ভেলা পার হয়ে যেতে
হত। ছ-সাত বছর আগে সেরকম একটা বাড়ি-ঘর ছিল না, তখন মা-বাবার সাথে আসতাম মাসির বাড়ি।
রাত্রি হলেই নদীটার দিকে তাকালে ভয় করত। মনে হত, এই বুঝি জলের ভেতর থেকে কেউ উঠে আসে।
ঘন্টাখানেক হল মাসির বাড়িতে এসেছি। ওরা কেউ বাড়িতে ছিল না। ব্যাগদুটো
ভেতরে রেখে নদীর পাড়টাতে দাঁড়িয়ে আছি। অস্পষ্ট দৃষ্টিতে দেখে চলেছি নদীতে জামা-কাপড়
কেঁচে নিয়ে বাঁশের মধ্যে শুকোতে দিচ্ছে তিনজন মহিলা। আমার সামনে দিয়ে দুটো গোরু কোনো
খাবারের খোঁজে পাশ দিয়ে চলে গেল। সামনের লেবু গাছটাতে এখনও তেমনভাবে লেবু ধরেনি— মাথার
ওপর দিয়ে একঝাঁক পাখি তাদের বাসার দিকে চলেছে।
"এই গুড্ডু! এলি কখন তুই?"— আমার পিছন থেকে দিদিভাই আচমকা এসে
আমাকে বলল। আমার মাসির বড় মেয়ে 'অদ্রিজা', বাড়িতে সবাই 'আইভি' বলেই ডাকে। ওর সাথে
আমার খুব ভালো একটা সম্পর্ক, ছোট থেকেই। বছর তিনেকের বড় যদিও, তবুও আমাদের মধ্যে সমস্তরকম
কথাই আলোচনা হয়।
আমি বললাম, "এইতো, প্রায় একঘন্টার মত হলো দাঁড়িয়ে আছি। ভেবেছিলাম,
হঠাৎ তোমাদের বাড়িতে এসে সারপ্রাইজ দিব। কিন্তু, নিজেই সারপ্রাইজ হয়ে গেলাম।"
বলে হাসতে লাগলাম। দিদিভাই-ও হাসা শুরু করে দিল।
"আসলে শিলিগুড়ি থেকে আমার আসার কথা ছিল কালকে, আমার কাজটাও শেষ হয়ে
গেল তাড়াতাড়ি, তাই ভাবলাম আজই চলে আসি তোমাদের বাড়ি। কিন্তু, এসে দেখি তোমরা কেউই
নেই।"
"বাড়িতে যখন দেখলি যে কেউ নেই, ফোন করলি না কেন আমাদের কাউকে?"
"করতেই গেছিলাম। মোবাইলটা অন করে দেখি কিছুক্ষণ আগেই রিচার্জটা শেষ
হয়ে গেছে।"
মাসিরা দুই বোনকে নিয়ে গেছিল ব্যাডমিন্টন খেলাতে। কিছুদিন বাদে ওদের টুর্নামেন্ট
আছে, তাই তাড়াতাড়ি চলে গেছিল আজ। ওর দুইবোন যমজ, ক্লাস সিক্সে পড়ে। খুব ছটফটে।
গেটটা খুলে ব্যাগদুটো হাতে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠলাম। ঘরটা কেমন নতুন-নতুন
লাগছে। মেঝেয় টায়েলস্ দিয়েছে নতুন, ঘরের রঙটাও নতুন করেছে। আগে যখন এসেছিলাম, তার
চেয়ে এখন বেশি ভালো লাগছে। জ্বলজ্বল করছে ঘরের দেওয়ালের সুন্দর রঙগুলো।
পাশের বাড়ি থেকে সন্ধ্যাবাতির আওয়াজ কানে আসছে। কিছুক্ষণ বাদে দেখলাম
মাসিরা বাড়ি ফিরে এল দুইবোনকে নিয়ে। তাদের সাথে আলাপ-গল্প করলাম অনেকক্ষণ। রাতের
খাওয়াদাওয়া শেষ হয়ে আসল। আমরা ঘুমোতে গেলাম।
দিদিভাই আর আমি প্রতিবারই আলাদা একটা ঘরে শুই। খুব মজা হয় ওর সাথে রাতের
বেলাটা। আমি বললাম, "দিদিভাই, তোমাদের রিলেশনশিপের ব্যাপারে কিছু বলো না! আগের
বার পুরোটা শোনার সময়ই ছিল না। এবার তোমায় প্রথম থেকে বলতে হবে।"
দিদিভাই মাথা নেড়ে "আচ্ছা" বলল।
মশারি টাঙানো খাটের উপরে। বাইরের দেওয়ালের হলুদ নাইট বালব্টার আলো কমে
এসেছে। মাথার ওপরের পাখাটা ভনভন করে ঘুরে চলেছে। আমরা ছোট্ট একটা খাটে শুয়ে উপরের
ছাদের দিকে তাকিয়ে আছি, আর পাখার ঘরঘর আওয়াজটা শুনে চলেছি।
"সেবার আমি ক্লাস ইলিভেনে পড়ি। কলকাতায় গিয়েছিলাম একটা সায়েন্স
এক্সিভিশনের জন্য। আমরা একটা মডেল তৈরি করেছিলাম, দুই বান্ধবী মিলে।
যাই হোক। অনেকে দেখতে এসেছিল আমাদের মডেল। একটা ছেলে এল আমাদের মডেল দেখার
জন্য। বেশ সুন্দর চেহারা, দাঁড়িগুলো ঠিকমত ঘন ছিল না— অগোছালো ধরনের। চুলগুলো ছোট
ছোট করে কাটা। একটা হাফ শার্ট, আর জিন্সের প্যান্ট পরা ছিল।
আমায় বলল, তোমরা কি বানিয়েছ একটু বুঝিয়ে বলো।
তার গলার মধ্যে একটা গম্ভীর ভাব ছিল। কিন্তু, তার মধ্যেও কোথায় যেন একটা
মিষ্টতা লুকিয়ে ছিল। তার চেহারা আর গলার আওয়াজ শুনে বুঝতে পারলাম যে, বয়স কুড়ি-একুশের
মাঝামাঝি।"
"কি সুন্দর রোমান্টিক গো তোমরা। আমার তো দারুণ লাগছে। তারপর?"
আমি বললাম।
দিদিভাই লজ্জা পেয়ে হাসল। বলল, "আমি ওর নাম জিজ্ঞেস করলাম, ও বলল
নিগম সরকার। কোনখান থেকে এসেছো জিজ্ঞাস করতেই, আমার মনটা প্রফুল্লিত হয়ে উঠল। ও বলল
যে জলপাইগুড়ি থেকে এসেছে।
আমি বললাম, তুমি জলপাইগুড়ি থেকে এসেছ? আমিও তো জলপাইগুড়িতেই থাকি।
—তাই নাকি? কোন জায়গায় থাকো জলপাইগুড়ির?
আমি ওর গম্ভীরভাবটা কাটিয়ে এতক্ষণে হাসি দেখতে পারলাম। কত সুন্দর করে সাজানো
ওর দাঁতগুলো..."
"আরে হ্যাঁ, বুঝেছি। নিগমদাকে আমিও ভালোমতই দেখেছি।" আমি দিদিভাইয়ের
কোথায় লজ্জা পেয়ে আটকে দিলাম।
"কেনো গুড্ডুভাই, খুব তো বলে চলেছিস আমাদের কথা শুনবি, এখন যখন বিস্তারিত
বলছি তখন লজ্জা লাগছে?" আমাকে বলে নিয়ে দিদিভাই খিলখিল করে কোলবালিশটা জড়িয়ে
হাসতে লাগল।
"তারপর, তোর নিগমদাকে সমস্ত কথা বলল আমায়। ও শুনলাম সেকেন্ড ইয়ারে
পড়ছে, ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে।
ওকে তারপর চলে যেতে লাগল। কোনো দায়িত্বে ছিল বোধহয়, তার জন্যেই ভিজিটিং-এ
এসেছিল।"
ওর চলে যাওয়ার পর আমি অনেকক্ষণ ধরে একটা চিন্তা করতে থাকলাম। জানি না কেন
! আগেও তো অনেকের সাথে কথা বলেছি— আগে তো মনের ভেতরটা ওরকম হতে কখনও দেখিনি।"
বাইরের হাওয়াটা একটু জোরে বইছে। আমি নীচে নেমে পাখার স্পিডটা কমিয়ে আসলাম।
পাশের ঘর থেকে সবার নাক ডাকার শব্দ কানে আসছে। টেবিলের ওপর রাখা বোতলটা থেকে জল খেয়ে
বিছানায় ঢুকে বললাম, "তারপরে কি হলো দিদিভাই? তুমি তো ওর নম্বর নিলে না, তবে?"
মশারিটা গুঁজতে গুঁজতে আমি বললাম।
দিদিভাই আমার দিকে পাশ ঘুরে বলল, "ভাগ্যে থাকলে যা হয়।
আমরা যথারীতি জলপাইগুড়ি চলে এসেছিলাম। এক সপ্তাহ, দু-সপ্তাহ এই করে একটা
মাস কেটে গেল।
একদিন, আমরা বান্ধবীদের সাথে ঘুরতে বেরিয়েছি রাজবাড়ী পার্কে। আমরা সবাই
যে-যার মত গল্প করছিলাম, কেউ বা ওদের বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে ঘুরতে এসেছিল।
দূর থেকে আমি লক্ষ করলাম, সেই ছেলেটা ! কাছে এগিয়ে আসতেই ঝাপসা ভাবটা কাটিয়ে
স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম সেই ছেলেটাই। যাকে আমি কলকাতায় দেখেছিলাম, ও আমার মডেল দেখবার
জন্য এসেছিল। আমি সামনে এগিয়ে গিয়ে বললাম, তুমি নিগম না?
ও বলল, হ্যাঁ।
রাজবাড়ী পার্ক। চারিদিকে লোকজনেরা বসে রয়েছে। ছোট-ছোট বাচ্চারা খেলছে,
কেউবা দৌড়াদৌড়ি করছে। আমার বান্ধবীরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের দেখছে। ও কি করল
জানিস?"
আমি উৎসাহের সঙ্গে জানতে চাইলাম, "কী করল?"
"আমাকে সবার মাঝে প্রপোজ করে বসল"
"কী...?" আমি হাসব না লজ্জা পাবো, বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
"তারপর?"
"তারপর আর কি, আমাকে সবার সামনে হাঁটু গেড়ে প্রপোজ করল। তাও আবার,
পাশের গাছ থেকে একটা ফুল ছিঁড়ে।
সেই ফুলটা আমার কাছে এখনও আছে। ডায়েরীর ভেতর রাখা।"
"আমায় দেখিও কিন্তু দিদিভাই। যাই হোক, পরে?"
"আমায় তো সবার সামনে প্রপোজ করে বসল। আর আমি মুখে হাত দিয়ে লজ্জায়
হাসছিলাম।
আমি ওর কাছ থেকে ফুলটা নিলাম। আমি ওকে বললাম, আমি ভেবে নিয়ে তোমায় জানাব।
যেমন ভাবা, তেমনি কাজ। সারাটা সন্ধ্যা ওর কথা ভেবে রাত্রিবেলা মা-র ট্যাবটা
হাতে নিলাম। হোয়াটস্অ্যাপটা খুলে ওর নম্বরটা সেভ করে, হাই লিখে পাঠালাম।"
"তুমি ওর নম্বরটা কীভাবে পেলে?"
"আমি তখনই ওর নম্বরটা নিয়েছিলাম। বলেছিলাম যে, তোমার নম্বরটা আমায়
দিয়ে দাও বাড়িতে গিয়ে ভেবে বলবো।
ব্যাস ! সারাটা রাত ভাববার পরে আমি ওকে হ্যাঁ বলে দিলাম।"
ঘড়ির কাঁটার আওয়াজটা আসতে আসতে তীক্ষ্ণ হয়ে আসছে। বাইরে হাওয়াটা এতক্ষণে
ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে। রাত্রি দুটো বাজে তাকিয়ে দেখলাম। দিদিভাই-এর গল্প শুনতে শুনতে
কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি, বুঝিনি।
সকালের পাখিদের ডাকে ঘুমটা ভেঙে গেল। দুটো সপ্তাহ জলপাইগুড়িতে কাটিয়ে
আমি নিজের বাড়ি চলে আসলাম।
নিগমদা-র সাথে কথা বলে আমার খুব মজা লাগে। এত সুন্দর ওদের লাভ স্টোরি, এত
সুন্দর ওদের মজাদার কথাবার্তা।
আগের বছর যখন ওদের বাড়িতে গিয়েছিলাম, দিদিভাই আমাকে নিয়ে বের হত ওর সাথে
দেখা করবার জন্য। আমি দূর থেকে লক্ষ করতাম, ওরা হাঁটছে— দু’জনে গল্প করছে।
ওরা একে অপরকে এতটা ভালোবাসে, যে বলাই বাহুল্য।
আমি ওদের সবসময় একসাথে দেখতে চাই, ওরা যেন পরক্ষণেও আলাদা না হয়ে থাকে।
এসব আমি দূর থেকে লক্ষ করতাম।
একদিন তো দুজনকেই বলে বসেছিলাম, এই তোমরা বিয়েটা কবে করছ গো?
দুজনেই লজ্জা পেয়ে গেছিল। নিগমদা বলল, আমার তো কোনো ব্যাপার না রে, আমার
এখন চাকরিটাও হয়ে গেছে, মা-ও সমস্ত কথা জানে। খালি বাবাকেই...ওই আর কি ! তোর দিদিকে
বল—
দিদিভাই বলে যে, এখন তো আমি তোর সাথে বিয়ে করছিই না— গান্ডু কোথাকার !
দিদিভাই, নিগমদার সাথে বহু জায়গায় ঘুরতে গেছি একসঙ্গে। 'ডমিনোস্', 'গল্প'—
বড় বড় রেস্টুরেন্টে। তাছাড়াও, তিস্তা স্পারে তো আমরা প্রায়শই আড্ডা দিতাম। ওখানে
'টাওয়ার' বলে একটা রেস্টুরেন্ট আছে, নদীর চরের মধ্যে। খুব সুন্দর করে সাজানো নদীর
ওপরের ছোট্ট রেস্টুরেন্টটা।
দিদিভাই আর নিগমদার মধ্যে কথাকাটাকাটি খুবই কম হত। বড়জোর একটা দিন, বা
একটা রাত্রি। সকালে উঠেই আবার তারা এক হয়ে যেত। এমনভাবে তারা পরের দিন বা নতুন দিনটিকে
শুরু করত, যেন তাদের কোনো ঝগড়ার কথাই মনে থাকত না।
প্রতিটা বছরই ভ্যালেন্টাইনস্ ডে তে দুজন দুজনের হোয়াটস্অ্যাপে স্ট্যাটাস
দেয়। খুব সুন্দর লাগে সেইগুলো পড়তে, আর একসাথে তোলা ওদের ছবি দেখতে। ওরা বাড়ির সমস্যার
জন্য দেখা না করতে পারলেও ফোন কল, ভিডিও কলের মধ্যে দিয়ে তারা একে অপরকে ভালোবাসার
বার্তা জানাতো।
ভ্যালেন্টাইনস্ ডে-র ঠিক চার-পাঁচ দিন পর, আমার ফোন একটা মেসেজ এল। হোয়াটস্অ্যাপটা
খুলে চেক করতেই দেখলাম দিদিভাই লিখেছে, "গুড্ডু, আমাদের মধ্যে সম্পর্কটা আর নেই
রে!"
আমি ভাবলাম আমার সাথে মজা করছে। আমিও হাসির ইমোজি সেন্ড করলাম, কিন্তু কোনো
রিপ্লাই আসল না। আমি সত্যিটা জানার জন্য নিগমদাকে মেসেজ করলাম, তার কাছ থেকেও একই উত্তর
এল।
কিছুক্ষণের জন্য চোখ বড়ো হয়ে মুখে হাত চলে গেছিল। হৃৎপিণ্ডের শব্দটা যেন
নিজের কানে শোনা যাচ্ছিল। আমি স্তব্ধ হয়ে গেছিলাম। আমার নিজের হাত-পা কাঁপা শুরু হয়ে
গেছিল।
আমার চোখে দেখা সবচেয়ে ভালো জুটি কেউ দেখতে চাইলে, আমি সোজাসুজি ওদের নাম
বলে দিতাম। আর, এটা সত্যিই অসম্ভব যে ওদের আলাদা হয়ে যাওয়াটা।
আমি দু’জনের সাথে কথা বলে যতটুকু বুঝতে পারলাম, ওদের আলাদা হয়ে যাওয়াটা
বা থাকাটা কোনো স্বাভাবিক ব্যাপারে নয়। বরং, সাময়িক আনন্দের জন্য তাদের আলাদা হয়ে
যেতে লাগলো।
দিদিভাই আর নিগমদা জলপাইগুড়িতে দেখা করা সত্ত্বেও, শিলিগুড়িতে দেখা করত।
কিন্তু, শিলিগুড়িতে দেখা করার উদ্দেশ্যটা একটু আলাদা ছিল। আর সেই উদ্দেশ্যের জন্যই
হয়তো তাদের সম্পর্কটা আজ বিচ্ছিন্ন।
সেবার, শিলিগুড়িতে ওরা দু’জন দেখা করে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হয়। ওরা
অন্ধকার ঘরে, ভালোবাসায় ভেসে গেছে। ওরা যৌনতার প্রকাশ ঘটিয়েছে, তিন বছর আগের নতুন
যৌবন আবার ফিরে পেতে চেয়েছে।
ওরা কোনো খারাপ করেনি। ওরা প্রাপ্তবয়স্ক। ওদের স্বাধীনতা, নিজের চাওয়া-পাওয়া,
মন, ইচ্ছা, আনন্দ বলেও কিছু একটা আছে। কিন্তু হ্যাঁ, বিশ্বাস হারিয়ে গেলে পাওয়াটা
খুব কঠিন হয়ে যায়।
আর ঠিক, সেরকমটাই হল ওদের সঙ্গে। কোনরকমভাবে নিগমদার মা জেনে গেছিল, সঙ্গে
ওর বাবা-ও। আর, তারপরেই তৈরি হলো ওদের মধ্যে ভাঙনের বাঁধ। যেই মা নিজের ছেলেকে এবং
সঙ্গে দিদিভাইকেও এতটা বিশ্বাস করেছিল, সেও কিনা আজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাল ছেড়ে দিল
!
সবচেয়ে বড় কারণ হয়ে উঠেছিল, নিগমদা-র বাবা। তিনি যেমনভাবে প্রতিটা দিন,
প্রতিটা মুহূর্তে কথা শুনিয়ে যেত, ওর বেঁচে থাকাটাও যেন দায় হয়ে উঠেছিল। শেষমুহূর্তে,
দু’জনেই একসাথে ভালোভাবে কথা বলে নিয়ে সম্পর্কের দড়িটা কাঁচি দিয়ে কেটে দিল। দু’জনের
মুখেই হাসি— দুজনেরই একই মন্তব্য, 'তুমিই আমার প্রথম ভালোবাসা এবং সারাটা জীবন এভাবেই
থেকে যাবে। সত্যিটা এটাই যে, ভালোবাসা কাকে বলে এই তিনটা বছরে আমরা বুঝেছিলাম— আর এটাও
ঠিক যে, তুমিই প্রথম তুমিই শেষ।'
তাদের দুজনের কথার ভাঁজটাও একইরকম— ওরা আজও প্রতিটা রাতে নিজের চোখ দিয়ে
জল গড়িয়ে দেয়। একাকীত্ব বোধ করে ওরা দুজনে। ওরা নিজেরাও জানে না যে, তাদের পরবর্তীতে
আদৌ মিলন হবে কিনা !
May 26, 2021
"বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শন" - অগ্নিমিত্র
Edit Posted by নেট ফড়িং with No comments
বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শন
অগ্নিমিত্র
ছোটবেলা থেকেই বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শন আমার খুব ভালো লাগে। আমি এই ধর্মের মধ্যে
এক অদ্ভুত প্রশান্তি খুঁজে পাই। কোনো ধর্মকে ছোট না করেই এ কথা বলছি।
কলকাতার ঢাকুরিয়া লেকের পাশে জাপানী বুদ্ধমন্দিরে মাঝে মাঝেই চলে যেতাম
ছোটবেলায়। সেখানকার পরিবেশ আমার খুব ভালো লাগতো। এরকম আরো পাঁচটি বৌদ্ধ মন্দির আছে
কলকাতায়।
বৌদ্ধ ধর্ম শান্তি, অহিংসা ও সত্যের প্রতীক। যদিও এই ধর্মেও হীনযান ও মহাযান,
এই দুই ধারা রয়েছে। ধারা দুটি সম্পূর্ণ বিপরীত। বেশির ভাগ বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত মানুষই
মহাযান ধারা মেনে চলেন। রয়েছে তন্ত্রমন্ত্রের প্রভাব। গেলুকপা, লোটাস সূত্র প্রভৃতি
আরো উপধারা আছে। যদিও গৌতম বুদ্ধ এই সব বলে যাননি। তিনি কামনা বাসনা ত্যাগ করে 'অষ্টাঙ্গিক
মার্গ' ধরে চলতে বলেছিলেন। গৃহীদের বলেছিলেন জীবনে মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে।
দুনিয়ায় বৌদ্ধধর্মের গেলুকপা ধারার প্রধান দলাই লামা।
আজকের এই সমস্যাবহুল জীবনে বুদ্ধের এই বাণী বিশেষ দরকার। এতে মন সুস্থিত
থাকবে। আর কোনো ধর্মের ভালো কিছু নিলে কোনো লজ্জা নেই।।
May 23, 2021
নেট ফড়িং সংখ্যা - ১৯৪
Edit Posted by নেট ফড়িং with No commentsMay 22, 2021
লেখকের চোখে নেট ফড়িং
Edit Posted by নেট ফড়িং with No comments
লেখকের চোখে নেট ফড়িং
লিখেছেন- অনৈতা রক্ষিত
বেশিদিন আগের কথা নয়। গুরুতরভাবে মন, শরীর সব জখম হয়ে পড়ে আছি। হঠাৎ একটা
দমকা হাওয়ার মতো নেট ফড়িং কোত্থেকে যেনো উড়ে এল। আমার মৃতপ্রায় মানুষকে এভাবে উদ্ধার
করা সম্ভব হবে আমি কোনদিন ভাবিনি। ভাবনা চিন্তা ধীরে ধীরে আরো বিস্তৃতি পেলো, চলতে
চলতে আরো অনেক বলতে শিখলাম, জানতে শিখলাম। প্রত্যেকটা মুহূর্তে নিজের সৃষ্টিগুলো পৃথিবীর
সামনে তুলে ধরার অনুপ্রেরণা পেলাম। সবমিলিয়ে ভালোবাসা দিয়ে আমাকে নতুন 'আমি' করে তুলেছে
নেট ফড়িং। নেট ফড়িং এর জন্যে রইলো একরাশ শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা।
May 20, 2021
"শুধু তুমি আর আমি" - অনাদি মুখার্জি
Edit Posted by নেট ফড়িং with No comments
শুধু তুমি আর আমি
অনাদি মুখার্জি
মেঘনা ঠিক করেছে আজ বিয়েবাড়িতে শাড়ি পড়ে যাবে। দরজা লাগিয়ে সেই দুই ঘন্টা
ধরে শাড়িটা খুলছে আর পড়ছে ! কিছুতেই শাড়িটা ঠিক মতো গুছিয়ে পড়তে পারছে না, শেষে বিরক্ত
হয়ে বলে- ‘ধুর !’
এমন সময় শুভ দরজা ঠেলে ভেতরে এসে বললো- ‘কি হল মেঘনা? এখনও তুমি রেডি হওনি
?’
মেঘনা বললো- ‘এই শাড়িটা কিছুতেই গোছ করে পড়তে পারছি না !’
সেই কথা শুনে শুভ খুব হাসতে লাগলো, মেঘনা শুভর মুখের হাসি দেখে বললো- ‘শয়তান,
বলেই তার মুখের উপর শাড়িটা ছুড়ে বললো- যাও তুমি একা, আমি যাবো না।’ শুভ তার কাছে এসে
বললো- ‘মেয়েদের আসল রুপ শাড়িতেই প্রকাশ পায়। নাও তুমি পড়ে নাও আমি দেখিয়ে দিচ্ছি
!’
মেঘনা আবার শাড়িটা পড়লো তা দেখে শুভ বললো- ‘এমন করে কেউ শাড়ি পড়ে ? খোলো
আমি তোমাকে পড়িয়ে দিচ্ছি।’ বলে শুভ বেশ সুন্দর করে তাকে শাড়িটা পড়িয়ে দিল। তা দেখে
মেঘনা শুভর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বললো- ‘তুমি তো দেখি সব কিছুই জানো।’
শুভ মেঘনাকে কাছে টেনে জড়িয়ে বললো- ‘হুম গো !’ মেঘনা বললো- ‘ছাড়ো চলো, বিয়ে
বাড়িতে দেরি হচ্ছে না?’ তারা যখন বিয়েবাড়িতে এসে খেতে বসলো, মেঘনার দুই হাতে মেহেন্দি
লাগানো। তাই সে খেতে পারছে না ! শুভ তখন তাকে খাইয়ে দিতে লাগলো, সেই সময় টুম্পা বলে
উঠলো- ‘এই মেঘনা তোর কি ভাগ্য ভাল, তোর বর তোকে খাইয়ে দিচ্ছে !’
রাতেরবেলায় যখন তারা বাড়ি এল তখন শুভ মেঘনাকে বললো-‘দাও তোমার শাড়িটা খুলে
দিই।’ তা শুনে মেঘনা বললো- ‘তুমি খুব দুষ্টু। এক নম্বর !’ শুভ বললো- ‘কেনো গো?’ মেঘনা
মুচকি হাসি দিয়ে বললো- ‘সবসময় তুমি আমার খুলে দেখতে চাও তাই না? খুবই দুষ্টু তুমি
!’ শুভ তখন মেঘনা কে বললো- ‘জেনে রাখো তুমি আমার সন্তানের মা হতে যাচ্ছো, তোমার সব
কিছুই আমার, আমি দেখবো না তো কে দেখবে?’ শুভ মেঘনাকে বললো- ‘জানো আমাদের বিয়ের আগে
যেদিন তুমি খুব বৃষ্টিতে ভিজে গিয়েছিলে ! সেই দিন তোমার পোশাক খুলে আমার জামাটা তোমাকে
পড়তে দিয়েছিলাম !’ মেঘনা বললো জানি- ‘তুমি তখন দুষ্টু চোখে আমার দিকে তাকিয়েছিলে !
এই, তোমার এই কথাটা মনে আছে? যেদিন তোমার বাবা
মারা যায় হাসপাতালে, সেদিন তোমার সাথে সারারাত আমি হাসপাতালে ছিলাম তোমার পাশে ! পরেরদিন
তোমার মন খুব খারাপ ছিল সেই সময় আমি তোমার পাশে সারাদিন বসেছিলাম !’
‘জানি’ বলে শুভ মেঘনাকে বুকে মধ্যে টেনে বললো- ‘তুমি আমার আর আমি তোমার
! তুমি যদি মেঘ হয়ে ওঠো আমি হবো বৃষ্টি।’ বলে একটি চুমু খেতে চাইলো, মেঘনা বললো- ‘এই
অসভ্য আজ ছাড়ো ঘুমাতে চলো !’ বিছানায় শুয়ে শুভ ঘুমিয়ে পড়লো শান্ত ছেলের মতো। মেঘনা
তার পাশে শুয়ে দেখছে শুভকে ! আর ভাবছে শুভ তুমি শুধু আমার ! আমি খেলে তুমি খাবে, আমি
হাসলে তার কারণ তুমি হবে ! তোমার খুশিতে আমি সুখি ! আজ জানো শাড়ি কেন পড়লাম ? শুধু
তোমার জন্যই ! তুমি শুধু আমার।
May 19, 2021
"হারানো সম্পর্ক" - অ্যস্ত্রিক্স
Edit Posted by নেট ফড়িং with No comments
হারানো সম্পর্ক
অ্যস্ত্রিক্স
আজ থেকে ঠিক দুই মাস আগে আমার আর আমার স্ত্রীর ডিভোর্স এর জন্য কোর্টে হাজির
হওয়ার তারিখ ছিল। কিন্তু এই লকডাউনের দৌলতে কোর্ট-কাছারি তো সবই বন্ধ, তাই আর হলো না।
কবে যে সব ঠিক হবে আর কবেই যে এই ঘরবন্দি থাকার থেকে নিস্তার পাবো, সেটাই বোঝা যাচ্ছে
না।
আমি একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত চাকরিজীবী, বাড়ি কলকাতাতেই তবে কাজের
সূত্রে থাকতে হয় নয়ডাতে। আমি আর আমার বউ, বিবাহিত প্রায় আট বছর, আমাদের একটা মেয়েও
আছে, তিন্নি, এবার জুলাইতে পাঁচ বছর পূর্ণ হবে তার। তিন্নি আর ওর মা কলকাতাতেই থাকে।
আসলে তিন্নির মা, মানে আমার স্ত্রী ঋতিকা, একটা বেসরকারি স্কুলের শিক্ষিকা। আমার আর
ওর কিন্তু লাভ ম্যারেজ হয়েছিল, তবে সময়ের সাথে সাথে ভালোবাসা বা ওই লাভটা যেন হারিয়ে
গেছে কোথাও। কলেজেই পরিচয় আমাদের। আমি অন্তিম স্নাতকের ছাত্র আর ওর প্রথম বৎসর। সম্পর্কটা
গড়ে ওঠে খুব কম সময়েই। বিয়েটা একটু দেরিতেই হয় আমাদের। এমনি কোনো রোমাঞ্চকর গল্প
নেই এর পেছনে, ওই দু’জনের পড়াশোনা শেষ করে, চাকরিতে ঢুকে নিজেদের একটু স্থায়ী করে
তারপর বিয়েটা করি। ওই ধরুন বিয়ের আগে পাঁচ বছরের সম্পর্ক। ওর বাড়িও কলকাতাতেই। আমি
ওই দক্ষিণ দিকে থাকতাম আর ওর বাড়ি পশ্চিম দিকে। বিয়ের পর চার বছর আমরা একসাথেই থাকতাম,
আমাদের কলকাতার বাড়িতেই। ও তখনও ওই স্কুলেই চাকরি করতো আর আমি অন্য একটা বেসরকারি
কোম্পানিতেই ছিলাম। বিয়ের তিন বছর পর তিন্নি এলো। আমরা খুবই খুশি ছিলাম। আমার মা-বাবা,
আমি, ঋতিকা আর আমাদের পরিবারের ছোটো সদস্য তিন্নি, এটাই আমাদের সংসার ছিলো। এক সাথে
বেশ ভালোই কেটেছে চারটে বছর। তারপর একটা অফার পাই আমি ব্যাঙ্গালোর থেকে, ভালো মাইনে
ছিল, তাই ঠিক করি যে এই কাজেই যোগ দেবো।
একটা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে আমি। পড়াশোনাতে আগাগোড়া ভালো ছিলাম
তাই একটা সংকল্প ছিলো, যে অনেক টাকা উপার্জন করবো। তাই একটু ভালো থাকার আর সবাই কে
ভালো রাখার চেষ্টায় ঋতিকা আর এক বছরের তিন্নিকে বাবা-মার সাথে ছেড়ে চলে যাই ব্যাঙ্গালোর।
ভেবেছিলাম ঠিক ঠাক ভাবে সব চললে, সবাই কে নিয়ে আসবো কলকাতা থেকে এখানেই। প্রথম প্রথম
কষ্ট হতো সবাইকে ছেড়ে একা একা থাকতে। আর প্রথম ছয় মাস কোনো ছুটিও দেয়নি যে বাড়ি
গিয়ে ঘুরে আসবো। কলকাতা থেকে কারো ব্যাঙ্গালোরে আমার সাথে দেখা করতে যাওয়াও সম্ভব হতো
না কারণ ঋতিকার চাকরি ছিলো তারপর তিন্নিও ছোটো আর সাথে মা-বাবাকেও একা ফেলে আসা সম্ভব
ছিল না। যাই হোক, ছয় মাস পর যাই আমি বাড়িতে, তখন সবাই খুব খুশি, প্রথমবার বাড়ির থেকে
এতদূর এতদিন ধরে থেকে এলাম। দশ দিনের ছুটি কাটিয়ে আবার ফিরে যাই। এভাবেই বছর কেটে
যায় আর মাঝে এক দু’বার এসেছিলাম বাড়ি। তারপর ব্যাঙ্গালোরে দেড় বছর চাকরিটা করার
পর নয়ডাতে বর্তমান প্রতিষ্ঠানটাতে যোগ দেই। এক বছর পর বাড়িতে বলি সবাই মিলে আমার এখানে
চলে আসতে, তবে বাবা আর ঋতিকা কেউ রাজি হয়নি, যদিও মা চেয়েছিল আসতে। তারপর তিন্নিও স্কুলে
ভর্তি হয়। ব্যাস কাউকেই আনা হয়নি আমার ওখানে, মাঝে ঘুরতে এসেছে কয়েকবার ঠিকই। আমিও
বাড়ি আসতাম মাঝে মাঝে তবে সময়ের সাথে সাথে যাওয়া আসাটাও কমে গেছে। যেখানে থাকি আর
যেমন স্তরে আমার কাজ, সেই জাকজমকে নিজের জীবনটা সাজিয়ে নিয়েছিলাম। আর কাজের চাপও
বাড়তে থাকে আস্তে আস্তে। ঋতিকার সাথে ফোনে কথা বলাটাও কমে গেছিলো। আগে দিনে দু-একবার
ফোন তো হতই, সবার সাথে কথা বলার জন্য আর সময় পেলেই ঋতিকাকে ফোন করে কিছুক্ষণ কথা বলে
নিতাম। এখন তো সেসব কিছুই কমে গেছে। হয়ত দু’দিনে একবার ফোন করতাম আর ওটাতেই সবার সাথে
কথা আর মাঝে মাঝে তো সেটাও করা হয়ে ওঠে না। তবে হ্যাঁ তিন্নি ফোন করলে আমার কথা বলতেই
হতো।
আস্তে আস্তে সময় পেরিয়ে যাচ্ছিলো আর আমি দূরে সরে আসছিলাম ঋতিকার থেকে।
কেমন যেন একটা বিরক্তি এসে পরেছিল। এমন না যে আমি অন্য কোনো সম্পর্কে জড়িয়ে পরে ছিলাম
তবে এই সম্পর্কটাও এখন বাঁধন মনে হচ্ছিলো। আর এক সাথেও তো থাকা সম্ভব হচ্ছিলো না। ও
আমার কাছে এসে থাকতে রাজি না নিজের চাকরি ছেড়ে আর আমার কাছেও কোনো উপায় নেই কলকাতা
তে স্থায়ী ভাবে থাকার। তাই ভাবলাম বিবাহটা ভেঙ্গে দেওয়াটাই উচিত হবে। তাই বললাম একদিন
ফোনেই ওকে। জিজ্ঞেস করলো "কেন, হঠাৎ কি হলো যে এতো বড়ো পদক্ষেপ?" বুঝিয়ে
বললাম সব কারণ। জিজ্ঞেস করলো "বাবা-মা আর তিন্নির কি হবে?" তখন এই প্রশ্নটার
উত্তর ছিলো না আমার কাছে। আসলে অতদুর ভাবিনি তখনও তাই বললাম "সে নয় একটা কোনো
উপায় করা যাবে।" তখন ও বললো "ঠিক আছে আগে সব ভেবে নাও তারপর জানিও, আমারও
একটু সময় চাই ভাবতে।" আমার মন বদলানোর চেষ্টা ও করেনি ঠিকই তবে ওর গলার আওয়াজটা
এবার একটু ভাঙ্গা ভাঙ্গা হলো, বুঝলাম হয়েতো চোখ দিয়ে ওর জল পড়ছে, মনটা খারাপ হয়েছে
কিন্তু বুঝতে দিচ্ছে না আমায়।
তিন দিন ভেবে একটা নির্ণয় নিয়ে ফোনে কথা বললাম ঋতিকার সাথে। জানালাম ওকে
যে ডিভোর্সের পর বাবা-মাকে আমি নিয়ে আসবো আমার কাছে নয়ডাতে আর রইলো তিন্নির কথা, সে
নয় ওর সাথেই থাকবে আর বললাম যে ও চাইলে আমাদের কলকাতার বাড়িতেই থাকতে পারে, মাঝে মাঝে
তিন্নি কে দেখতে আসবো কলকাতা তে। আসলে ওই বাড়িতে বিয়ে হয়ে এসেছিলো প্রথম, এতো বছর
ওই বাড়িতেই কাটিয়েছে, একটা আলাদা মায়া তে জড়িয়ে পড়েছে তাই আর আলাদা করতে চাইলাম
না। সব চুপ করে শুনে উত্তর দিলো "সবই তো শুনলাম, তোমার ইচ্ছে মতনই হোক সব শুধু
আমার একটা অনুরোধ আছে, সেটা রাখা গেলে ভালো হতো।" আমি জিজ্ঞেস করলাম "বলো
কি চাও? চেষ্টা করবো যথাসাধ্য।" ও বললো "বাড়িটা তুমি রেখে নিও, আমি ভাড়া
বাড়ি নিয়ে খরচা চালিয়ে নেবো, শুধু বাবা-মা কে আমার সাথে থাকতে দাও।" আমি শুনে
অবাক হলাম, জিজ্ঞেস করলাম "এটা আবার কি ধরনের আর্জি হলো? আমার বাবা-মা তোমার সাথে
কেনই বা থাকবেন ?" তখন ও বললো "আজ আমাদের বিয়ে ভেঙ্গে দিচ্ছ তুমি, বুঝতে
পারছি সেটাতে তোমার অধিকার হতেই পারে। তবে গত ১২-১৩ বছর ধরে আমার বাবা-মার সমান স্থানেই
এই দু’জন মানুষকে রেখেছি আর আমার বাবা-মা চলে যাওয়ার পর, এই দুটি মানুষ কে জড়িয়ে
আছি আমি। আমার কি এই মানুষগুলো, এই সম্পর্কগুলোর ওপরে কোনো অধিকার নেই?" শুনলাম
ওর কথাগুলো, কিছুটা বোঝার চেষ্টাও করলাম তবে মা-বাবাকে ওর কাছে দিতে পারলাম না। তাই
বলে দিলাম "না এটা সম্ভব না।" তখন ও বলে উঠলো "তবে এই ডিভোর্সটাও সম্ভব
না।" আর ফোনটা রেখে দিলো। মা বাবা অথবা তিন্নি কেউই এই সবের বিষয়ে জানতো না।
জানাইনি কারণ বাবা-মার শরীরটা ঠিক থাকে না, তাই অযথা চিন্তায় ফেলতে চাইনা আর তিন্নি
তো ছোটো, বুঝবেই বা কি ! যাই হোক, আরো এক-দুইবার ওকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম তবে ও আর
মানলো না তাই নিজের আইনজীবীকে দিয়ে ওর কাছে কাগজ পাঠালাম ডিভোর্সের, সই করেনি তাই
শেষমেষ কেসটা উঠলো কোর্টে। আর সেই সূত্রেই এলাম কলকাতা আর ব্যাস আটকে পরলাম এই লকডাউনে।
জানি এই লকডাউনটা জরুরি ছিলো খুবই, মানুষ-কে সুস্থ রাখতে, ভালো রাখতে। তবে
আমার জন্য যেন এটা একটা বিরক্তিকর দন্ড ছিলো, বন্দী হয়ে গেছিলাম সেই মানুষটার সাথে
যার থেকে আলাদা হওয়ার জন্যই আমার এখানে আসা। খুব বিরক্ত লাগতো, সারাদিন তাকে চোখের
সামনে দেখতে, তবে তিন্নিকে সারাক্ষণ কাছে পেতাম তাই সহ্য হয়ে যেত এসব। আর বাড়িতে
খুব একটা কাজও ছিলো না, সারাদিন ওই মোবাইল, ল্যাপটপ আর মেইল চেক, মাঝে মাঝে ছাঁদে গিয়ে
ফুল গাছগুলোকে একটু জল দিতাম আর একটুআধটু বাড়ির কাজ করতাম ব্যাস। এভাবেই দিন কাটছিলো,
হঠাৎ একদিন ঘুম ভাঙ্গলো একটা চিৎকারের আওয়াজ শুনে, দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে দেখি ঋতিকা
পরে আছে সিড়ির শেষে। তারাহুরো করে গেলাম ওর কাছে, বুঝতে পারলাম ভালোই চোট পেয়েছে বাম
পায়ে আর ডান হাতটাতে। হেঁটে যাওয়ার অবস্থায় ছিল না, তাই আমি কোলে করেই নিয়ে গেলাম
ওকে ওর ঘরে। ডাক্তার ডাকলাম, আমার বন্ধুই ছিলো সে, আমাদের পারিবারিক চিকিৎসক। এলো দিব্যেন্দু
আধা ঘন্টার মধ্যেই। দেখেই বললো এক্সরে আর কিছু পরীক্ষা করাতে। নিয়ে গেলাম আমি আর দিব্যেন্দু
মিলে ওকে। তিন্নি আর মা-বাবা বাড়িতেই ছিলো। সব করে ফিরতে ফিরতে তখন প্রায় দুপুর দেড়টা।
রিপোর্ট এলো বিকেলে, যা ভেবেছিলো দিব্যেন্দু সেটাই হয়েছে। ডান হাতের হাড়টা ভেঙেছে
আর বাম পায়ের হাঁটুতে চির ধরেছে। সব মিলিয়ে দাঁড়ালো যে দুই জায়গাতেই প্লাস্টার করতে
হবে আর ঠিক হতে হতে মোট এক মাস সময় লাগবে। তার আগে কোনোরকম ভারী কাজ করা বারণ আর বিছানায়
সজ্জাশায়ী থাকতে হবে কম করেও আড়াই সপ্তাহ। সব ওষুধ লিখে দিয়ে আর খাওয়ানোর পদ্ধতি
বলে দিব্যেন্দু চলে গেলো। সেদিন দুপুরের রান্নাটা আমিই করেছিলাম। আর তো কেউ নেই করার।
আর সেদিন থেকেই ঋতিকা যেসব কাজগুলো করতো সারাদিন, যত সব ওর দায়িত্ব ছিলো সবার প্রতি,
সব এলো আমার ঘাড়ে আর সাথে ওর দেখাশোনাও করতে হল।
আগামীদিন থেকে সময়তালিকা পাল্টে গেলো আমার। সকালে উঠেই গেলাম ঋতিকার ঘরে।
দেখলাম ও জেগে আছে আর মা বসেছিলো ওর পাশে। কথা বলে জানতে পারলাম, ভোর পাঁচটা থেকেই
নাকি ও জেগে আছে। ওটাই আসলে ওর রোজকার ওঠার সময় আর ওর ওঠার পর, এই সাড়ে পাঁচটা নাগাদ
মাও উঠে পড়েন তবে আজ একটু তাড়াতাড়ি উঠেছেন। আর ওঠার কারণটা হলো ঋতিকা। সকালে জেগেই
নাকি কাউকে না জানিয়ে বাথরুম যাওয়ার চেষ্টা করেছিল আর পড়ে গেছে মেঝেতে আর সেই আওয়াজেই
মার ঘুম ভেঙ্গে গেছে আর মা ওকে বাথরুমে নিয়ে গেছে। এটা দেখে ঠিক করলাম আজ রাত থেকে
ওর আর তিন্নির সাথেই ঘুমোবো নইলে মাকে অযথা বিরক্ত হতে হবে। যদিও মা একটুকুও বিরক্ত
হয়নী, বরং চিন্তিত ছিল ওকে নিয়ে। তারপর কিছু ওষুধ দেওয়ার ছিলো ওকে, সেগুলো দিয়ে
নিয়ে নিজে একটু ফ্রেশ হয়ে ঢুকলাম রান্নাঘরে, মাও এলো সাহায্য করতে, মানা করাতে বললো
যে এটুকু সাহায্য উনি সব সময়ই করেন রান্না করতে। দু’জনে রান্নার কাজটা সেরে তিন্নিকে
উঠোলাম আর ওকে ফ্রেশ করিয়ে সবাই মিলে সকালের খাওয়ারটা খেয়ে নিলাম। এরপর বাসন মাজা,
কাপড় ধোয়া, ঘর মোছা সবই এক এর পর এক করতে লাগলাম, আর মাকে বললাম ঋতিকাকে খেয়াল রাখতে
নইলে মা কোনো কাজই পুরোপুরি করতে দিতো না আমাকে। সব কাজের মাঝে হঠাৎ নজর চলে যেত ওর
দিকে আর দেখতাম ও তাকিয়ে আছে আমার দিকে, মন খারাপ নিয়ে, কারণ ও কোনোদিন আমাকে কিছু
করতে দিতো না আর যেই আমার নজর ওর ওপর যেত, অন্যদিকে তাকানোর ভান করতো। এই ভাবেই সারাদিন
কেটে গেলো। রাতে খাওয়ার পর ঘুমোতে যাই, তিন্নিকেও নিয়ে আসি আমাদেরই ঘরে, ওকে মাঝে
শুইয়ে দু’পাশে শুলাম দু’জনে। আজ প্রায় দুই বছর পর এক বিছানায় আমরা। খুব ক্লান্ত
ছিলাম তাই বিছানাতে মাথা রাখতেই ঘুমিয়ে পড়ি। পরে সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখি মাঝে তিন্নি
নেই চলে গেছে ঠাম্মা আর ঠাকুরদার কাছে, বিছানায় ছিলাম শুধু আমি আর ও। উঠে পড়লাম দেরি
না করে আর শুরু একই সেই সময়তালিকা হিসেবে কাজ করা। আজ রাত থেকে তিন্নি ঘুমাতো না আমাদের
সাথে, শুধু আমি আর ওই শুতাম একসাথে। এই ভাবেই দিনগুলো পেরোতে থাকলো, একদিন, দুইদিন,
তিনদিন করে এক সপ্তাহ। রোজ ভোরে ওঠা, সবার জন্য কাজ করা আর ক্লান্ত হয়ে বিছানায় পড়ে
যাওয়া। খুব বিষণ্ণ লাগতো মাঝে মাঝে। আর বুঝলাম আস্তে আস্তে এই কিছুদিনেই আমার এই অবস্থা
আর মানুষটা তো কতো বছর থেকে এই সব করছে আর সাথে নিজের চাকরিটাও সামলাচ্ছে। জানেন সেদিন
থেকে একটা আলাদা শ্রদ্ধা জন্মালো ওর প্রতি। সেই যে আমাদের কলেজের অপরিপক্ক ভালোবাসাটা
ছিলো, তারপর বিয়ে তারপর সেইভাবে সম্পর্কটাকে সময়টাই দিয়ে ওঠা হয়নি পূর্ণতা পাওয়ার,
যদিও বেশিরভাগ দোষটা আমারই ছিল, সেই সময়টা মনে হলো যেন সম্পর্কটা এখন পূর্ণতা পাচ্ছিলো।
দিন পেরোতে থাকলো আর তার প্রতি ভালোবাসাটা যেন ফিরে ফিরে আসছিল আমার মনে।
সেই দিনগুলো, সেই সময়গুলো ভেসে আসছিলো যখন ভালোবাসায় মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছিলাম
দু’জনে। মনে মনে ঠিক করলাম ফিরবো না নয়েডাতে আর। ওই কাজটা ছেড়ে, কলকাতাতেই কোনো কাজ
খুঁজে নেবো। সময় লাগবে একটু আর বেতনটাও হয়তো মনের মতন পাবো না, তাও যেটুকু ব্যাংকের
খাতায় আছে সেটুকুতে চলে যাবে। আর এই লকডাউন এটাও শিখিয়েছে যে আমাদের রোজকার জীবিকাতে
জরুরি জিনিসগুলোর আর্থিক মূল্য যথেষ্ট কম, অর্থ তো আমরা খরচ করি নিজেদের সদাম্ভিক জীবিকার
সামগ্রীগুলোতে। এটা মনে ভেবে রাখলাম তবে ওকে বলার সাহসটা জোগাতে সময় লেগেছে অনেক।
ভালোবাসা যখন ছিল না এই ভয়টাও ছিল না আর এখন ভয়টা এসেছে কারণ ভালোবাসাটা ফিরে পেয়েছি।
ভয়টা ওর থেকে না, ওকে হারানোর ভয় এটা।
দেখতে দেখতে ঠিক হয়ে গেল ও। এখন যথেষ্টই ভালো, নিজের সব কাজ আবার সামলে
নিচ্ছে, তবুও যেটুকু পারি হাতে হাতে ওকে সাহায্য করি, ও মানা করে তবে এই সাহায্যের
ছলেই হোক, ওর কাছাকাছি থাকতে পারি আর ওর কিছুটা আরাম হয় তাই করি। এখনো এক সাথেই শুই।
হঠাৎ একদিন শোয়ার সময় আর নিজের মনের কথা আটকাতে পারলাম না, ভেঙ্গে পরলাম, কেঁদে ফেললাম,
আর আমার চোখে জল দেখে জড়িয়ে ধরলো ও আমাকে, জিজ্ঞেস করলো "কি হয়েছে ? কাঁদছো
কেন এভাবে হঠাৎ?" আমি বললাম "আর পারছি না, তোমাকে ছেড়ে, তোমার পাশে থেকেও
তোমার থেকে কতো দূরে সরে গেছি আমি নিজের ভুলে। পারছি না আর।" আমার মাথায় হাত
বুলিয়ে বললো "তোমার জীবন, তুমি যেভাবে চাও বাঁচতেই পারো, তুমি বিয়ে করেছ বলেই
যে আমার সাথে সারাজীবন থাকতে হবে সেটাতো জরুরি না, তুমি আলাদা হতে চাও আলাদা হয়ে যেতেই
পারো। সেটা তো দোষের কিছু না।" ওর কথাগুলো শুনে যেন আরো ভেঙ্গে পড়লাম, নিজেকে
আরো ছোটো মনে হল এই মানুষটার কাছে। শেষে বললাম ওকে "আমি তোমাদের সাথে থাকবো, চাইনা
আমার ডিভোর্স, চাইনা টাকা, শুধু তোমাদের নিয়ে থাকতে চাই। এখানেই একটা কাজ খুঁজে থেকে
যাবো। একসাথে থাকবো, বলো রি তুমি থাকবে তো আমার সাথে ?" এটা শুনেই ও আমায় ছেড়ে
একটু দূরে সরে বসলো। ওর চোখটাও ভেজা তবে মুখে কিছুই বললো না। জিজ্ঞেস করলাম আবার
"বলো না রি তুমি থাকবে তো আমার সাথেই?" কিছুক্ষণ পর উত্তর দিলো "না।
আমি থাকতে পারবো না তোমার সাথে।" আমি কারণটা জিজ্ঞেস করতেই বলে উঠলো "তুমি
যা বলেছ, যেই নির্ণয় নিয়েছো এই সম্পর্কটা নিয়ে নিজের ব্যাপারে ভেবে আমি সেটাতেই রাজি
ছিলাম। আর আজ আমি নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি আর আমি চাই না এই সম্পর্কটা
রাখতে। আশা করি তুমিও জোর করবে না আমায়।" এই কথাটা শুনে আর কি বা বলতাম ওকে আমি।
ঠিকই তো বলছে ও, আমার জীবনের সিদ্ধান্তগুলো নেওয়ার অধিকার আমার থাকলে ওরও অধিকার আছে
নিজের জীবনের সিদ্ধান্তগুলো নেওয়ার। যদিও জানি ও খুব অভিমান করে আছে আমার ওপর, এটাও
হতে পারে যে ওর আত্মমর্যাদাতে অনেকখানি আঘাত লেগেছে আমার কথায় অথবা ওর আমার প্রতি
ভালোবাসাটা আজ কোথাও হারিয়ে গিয়েছে। কারণটা যেটাই হোক, অসম্মান করবো না ওর কথার আমি
শুধু প্রার্থনা করছি ওর আমার সাথে থেকে যাওয়ার। আর যদি না থাকে তাহলে এই লকডাউনটা
যতদিন আছে, নিজের এই সুবর্ণ মুহূর্তগুলো উপভোগ করে নেই। শেষে কি হবে এই সম্পর্কটার
পরিণতি আমি জানি না তবে ঋতিকাকে আজীবন ভালোবেসে যাবো আর থাকবো ওর আশেপাশেই, নিজের সব
দায়িত্বগুলো পালন করবো ওর প্রতি। ভালো রাখবো ওকে।
May 16, 2021
নেট ফড়িং সংখ্যা- ১৯৩ (ঈদ সংখ্যা)
Edit Posted by নেট ফড়িং with No commentsMay 15, 2021
লেখকের চোখে নেট ফড়িং
Edit Posted by নেট ফড়িং with No comments
লেখকের চোখে নেট ফড়িং
লিখেছেন- দেবদর্শন চন্দ
স্বভাবতই পুরোনো স্মৃতি আমাদের প্রত্যেককেই নস্টালজিক
করে তোলে। এই পত্রিকাটিও আমার কাছে তাই। প্রথমদিন থেকে বেশ কিছুটা পথ পত্রিকার সাথে
জড়িয়ে থাকার সুযোগ হয়েছে আমার। সান্নিধ্য পেয়েছিলাম কোচবিহার সহ বিভিন্ন জায়গার একঝাঁক
তরুণ তুর্কি এবং পাকা হাতের লেখকদেরও। একটা কথা না বললেই নয়। বহু ছোট-বড় বাধা অতিক্রম
করে আজ চৌমাথায় দাঁড়িয়ে নেট ফড়িং। লেভেল ক্রসিং পেরোলেই আবার ছুটতে প্রস্তুত। তবে এতটা
পথ একা চলা মোটেই সহজ নয়, কারোপক্ষেই। শুরুতেই কোনো পত্রিকার যাত্রাপথ এতটাও সহজ থাকে
না। নেট ফড়িং-ও তার ব্যতিক্রম নয়। দিনের পর দিন যত্ন করে একটা ছোট শিশুকে বড়ো করে তোলেন
অভিভাবকরাই। পত্রিকার কাছের মানুষগুলোর ভালোবাসা আগামীর যাত্রাপথে গোলাপসম। শুরুতে
অনলাইন ম্যাগাজিন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে নেটফড়িং। এরপর অনলাইনের পাশাপাশি এসেছে মুদ্রণ
সংখ্যাও। লিটল ম্যাগকে অন্যরূপে পাঠকের কাছে তুলে ধরতে দিনরাত প্রয়াস চালাচ্ছেন সম্পাদকমন্ডলী।
তাদের প্রতি রইলো কৃতজ্ঞতা। বর্তমানে পত্রিকার গঠনশৈলীতে এসেছে বেশ কিছু পরিবর্তন।
শুধু লেখক বা লেখিকারাই নয়। ছবি আঁকা হোক কিংবা ছবি তোলা, সকলের কাছেই নেট ফড়িং যেন
'হাত বাড়ালেই বন্ধু'। গ্রিক শব্দ নসটস(বাড়ী ফেরা) ও আলজিয়া (প্রত্যাশা) থেকেই নস্টালজিয়া
শব্দের উৎপত্তি। নস্টালজিয়া বলতে সুখের স্মৃতি রোমন্থন, স্মৃতি মনে করে সেই পুরোনোতে
ফিরে যেতে চাওয়া। কলম যত এগোচ্ছে ততই পুরোনো দিনগুলো অনেকটাই কাছের বলে মনে হচ্ছে।
সবটা মিলিয়ে একটা ভালো লাগার অনুভূতি। পুরোনো বন্ধু, পুরোনো মানুষ, পত্রিকা এমনকি শুরুতে
একসাথে কাজ করার অভিজ্ঞতাগুলিও আজ মনে পড়ছে ভীষণভাবে। আজ ২০০ সংখ্যার দোরগোড়ায় নেট
ফড়িং। কোচবিহার থেকে বাংলাদেশ তো বটেই, সারা বিশ্বের বহু মানুষের ভালোবাসায় আজ সমাদৃত
পত্রিকাটি। সর্বোপরি, প্রত্যেকের কাছেই নেট ফড়িং উৎসাহের আশ্রয়। উঁচুতে পৌঁছবার শেষের
আগের ধাপ। এভাবেই এগিয়ে যাক নেট ফড়িং। টিম নেট ফড়িং এর জন্যেও রইলো একরাশ শুভেচ্ছা
ও ভালোবাসা।
May 9, 2021
"ভোজন রসিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর" - অনাদি মুখার্জি
Edit Posted by নেট ফড়িং with 2 comments
ভোজন রসিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
অনাদি মুখার্জি
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন খেতে ভালবাসতেন, তেমন খাওয়াতেও ভালো বাসতেন
! মাঝেমধ্যেই তার বৈঠকখানায়তে বিশেষ আলোচনা সভা বসতো, সেই সভাতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছিলেন মধ্যমণি, অনেকক্ষণ ধরে আলোচনা হতো ! অনেক সময় রাত দুটো বেজে যেত ! কিন্তু কবি
তাদের জন্য এত রাতে মৃণালিনী দেবী-কে রান্না করতে বলতেন ! মৃণালিনী দেবী বিভিন্ন পদের
রান্না করে খাওয়াতেন ! কবি দেশি খাবার বেশি পছন্দ করতেন, দুধ আমসত্ত্ব দিয়ে সন্দেশ
খুব বেশি ভালোবাসতেন! ইলিশের ঝোল, চিতল মাছ দিয়ে মুগের ডাল, ভাত খেতেন !
১২ বছর বয়সে যখন প্রথমবার তার বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে বিদেশে যেতেন,
ওখানে নানা জায়গা ঘুরে সব ভালো ভালো খাবার খেয়ে সেই সব খাবার গুলো ঠাকুর বাড়ির হেঁশেলে
চালু করে দিতেন ! কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর খুব চা পান করতে ভালোবাসতেন। তার প্রিয় ছিল
গ্রীন ট্রি ! একটি বড়ো কাপে সারাদিনের অনেকবার চা খেতেন !
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সারাদিনে বেশ কয়েকবার খেতেন ! প্রতিদিন সকালে উঠে
এক গ্লাস নিমপাতা শরবত খেতেন, একটু বেলা হলে ভেজা বাদাম, মধু সহযোগে টোস্ট ও এককাপ
দুধ খেতেন ! আবার মাঝে মাঝে সন্দেশ ও কলা দুধের মধ্যেই ফেলে মেখে খেতেন ! পরে আবার
আম বা লেবুর শরবত খেতেন, দুপুরে সামান্য ভাত খেতেন কিন্তু বিভিন্ন রকমের তরকারি ও মাছ
থাকতো, সেইসাথে পাতের শেষে টক দই, মিষ্টি খেতেন !
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মাঝে মধ্যে নিজেই রান্না করতে ভালোবাসতেন ! দেশে-বিদেশে
বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে তিনি সেখানকার মেনুকার্ড জোগাড় করে রাখতেন তার কাছে ! পরে সেই
রকম রান্না করে খেতেন বা সবাইকে খাওয়াতেন ! আপেল দিয়ে রান্না খাসীর মাংস ও তুকী কাবাব,
এই সব খাবার বিদেশে খেয়ে, সেসব রান্না শিখে তিনি তার বাড়িতে রান্না শুরু করে দিতেন
এবং ঠাকুর বাড়ির সবাইকে তা খাওয়াতে ভালোবাসতেন ! দেশীয় খাবারে মধ্যে চিতল মাছ ও ভাপা
ইলিশ তার ছিল খুব প্ৰিয়, রাতে লুচি আর ফুলকফি ও আলু দিয়ে সবজি বা কখনো পটল দিয়ে নানা
পদের সবজি বানিয়ে খেতেন ! তার বাড়িতে কোনো সভা বসলে তিনি কাজুবাদাম ও কিসমিস মেশানো
মালপোয়া সবাইকে খাইয়ে তবে ছাড়তেন ! এসব দেখে বোঝাই যায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কতোটা
ভোজন রসিক ছিলেন !
"অভিসার" - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (নাট্যরুপ- বিক্রম শীল)
Edit Posted by নেট ফড়িং with No comments
কবিতা- অভিসার
কবি- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নাট্যরূপ- বিক্রম শীল
দৃশ্য- ০১
প্রেক্ষাপট- বোধিসত্তাবদান-কল্পলতা সন্ন্যাসী উপগুপ্ত একদিন মথুরাপুরীর প্রাচীরের নীচে ধ্যানমগ্ন ছিলেন, নগরের দীপ বাতাসে নিভে
গেছে, পৌর ভবনের দুয়ারও
বন্ধ, শ্রাবণের রাতের তারা ছিল মেঘে ঢাকা। হঠাৎ কারো নূপুর পায়ে হেঁটে
আসার শব্দ শোনা গেল! সন্ন্যাসী চমকে
জেগে উঠলেন, স্বপ্ন জড়িমা এক পলকে ভেঙ্গে গেল, আবছায়া দীপের আলোতে তার ক্ষমাসুন্দর চোখে তিনি দেখলেন নগরীর
এক যৌবনমত্তা নটী তার নির্দিষ্ট অভিসারে
হেঁটে চলছেন। তার অঙ্গে সুনীল বরণ এর আঁচ, রুনুঝুনু শব্দে তার শরীরের অলঙ্কারগুলো শব্দ করছে। সন্ন্যাসীর কাছে
এসে পা থমকে গেল বাসবদত্তার।
প্রদীপ ধরে সন্ন্যাসীর নবীন গৌরকান্তি মুখের দিকে তাকালো সেই রমণী- সন্ন্যাসীর উজ্জ্বল মুখমণ্ডল, দু’চোখ থেকে যেন করুনার আলো
ছড়িয়ে পড়ছে, সাদা কপালে যেন চাঁদের মতো স্নিগ্ধ
শান্তি ছড়িয়ে পড়েছে।
চোখে লজ্জা জড়িয়ে নরম কণ্ঠে, রমণী বললেন- “আমায় ক্ষমা করুন কুমার কিশোর,
যদি দয়া কর আমার গৃহে চলেন। এই
কঠিন ধরণীতলে থাকা খুব কষ্টকর, এখানে আপনি থাকতে পারবেন না।’’
সন্ন্যাসী করুণ সুরে রমণীর
দিকে তাকিয়ে বললেন- "এখনো আমার যাওয়ার সময় হয়নি, তুমি যেখানে যাচ্ছ সেখানে যাও, যেদিন সময় আসবে আমি নিজেই
তোমার কাছে যাবো।"
হঠাৎ সেখানে বজ্রপাত হল, ঝড়-ঝঞ্জা
শুরু হল, রমণী ভয়ে কেপে উঠলেন, বাতাসে যেন প্রলয়শঙ্খ বেজে উঠলো। সারা আকাশ জুড়ে বজ্রপাতের মাধ্যমে কেউ যেন অট্টহাসি দিতে লাগলো।
দৃশ্য-২
প্রেক্ষাপট- বছর তখনও শেষ হয়নি, সেদিন ছিল চৈত্র মাসের
এক সন্ধ্যা। বাতাস উতলা আকুল হয়ে উঠেছিল সেদিন। পথের ধারের গাছগুলোতে মুকুল এসেছে। রাজার বাগানে বকুল, পারুল, রজনীগন্ধা
ফুল ফুটেছে। অনেক দূর থেকে বাঁশির মধুর সুর ভেসে আসছিল। আজ নগর একেবারে জনহীন, নগরের সবাই মধুবনে ফুল-উৎসবে যোগ দিতে গেছেন। শূন্য নগরের আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ যেন নীরবে হাসছে। নির্জন পথে জ্যোৎস্না-আলোতে এক সন্ন্যাসী একাকি পথ চলছেন। মাথার ওপরে গাছের ডালে
থাকা কোকিল কুহু কুহু রবে বারবার ডাকছে। এতদিন পরে আজ হয়তো সেই অভিসাররাত্রি
এসেছে।
নগরের সীমানা পেরিয়ে সন্ন্যাসী
বাইরের প্রাচীরপ্রান্তে এসে পৌঁছুলেন। এসে দাঁড়ালেন পরিখার পাড়ে, হঠাৎ আম্রবনের ছায়ায় গাছের নীচের আঁধারে কোন এক রমণীকে তিনি পড়ে থাকতে
দেখলেন। কাছে গিয়ে দেখলেন নিদারুণ রোগে মারীগুটিকায় তার অঙ্গ ভরে গেছে। তার প্রায় সারা শরীর রোগে কালো হয়ে গেছে। সেকারণে
নগরের প্রজারা তাকে পরিখার বাইরে ফেলে দিয়ে গেছে। তাকে বিষাক্ত ভেবে সবাই তার সঙ্গ
ছেড়ে দিয়েছে।
সন্ন্যাসী নীচে বসে রমণীর আড়ষ্ট মাথা নিজের কোলে
তুলে নিলেন। তার শুষ্ক গলায় জল ঢেলে দিলেন। মন্ত্র পড়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে
দিলেন। রমণীর সারা দেহে চন্দন লেপে দিলেন।
সেদিন জোস্না রাতে গাছের মুকুল ঝরছে,
কোকিলের কুহু কুহু ডাক শোনা যাচ্ছে।
রমণী বললো- “ওগো দয়াময় তুমি কে?”
সন্ন্যাসী বললেন- “আজ রাতেই সেই সময়
এসেছে, আমি তোমার কাছে এসেছি বাসবদত্তা!”
(নাট্যরূপটি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর এর চরণতলে একটি শ্রদ্ধার্ঘ্য মাত্র, কবির লেখনীর নাট্যরূপ দেওয়ার ধৃষ্টতা
মার্জনা করবেন, যেকোনো ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখবেন এই নিবেদন রইলো-
বিনীত লেখক)
নেট ফড়িং সংখ্যা - ১৯২
Edit Posted by নেট ফড়িং with No commentsMay 8, 2021
"এগারো বছর" - সায়ন বণিক
Edit Posted by নেট ফড়িং with No comments
এগারো বছর
সায়ন বণিক
পড়ন্ত বিকেলের সূর্য অস্ত যাওয়ার পথে। অমল তখনও পড়েই চলেছে। ছাদের ওপরের
টেবিলটাও প্রায় অন্ধকারে ঢেকে এসেছে, এমনিতে শীতকালের বেলা।
বইটা বন্ধ করে সে একহাত দিয়ে তার চোখের জলটা মুছল। রবি ঠাকুরের কাবুলিওয়ালা
পড়েছে কিনা, জল মোছাটাই স্বাভাবিক।
নীচে গিয়ে জ্যাকেটটা গায়ে দিল। সন্ধে হয়ে এসেছে। প্রতিটা দিনই সে একটা
করে গল্প পড়বে আর বাইরে বেরোবে। স্বভাব হয়ে এসেছিল।
অমলের বাবা ডি-গ্রুপের একটা অফিসে কাজ করে। তবুও কাউকে অভাব পেতে দেয়নি,
আজ পর্যন্ত। মাসখানেক হল দোতলার ছাদটা দিয়েছে। অমলের বাবা আসলে খুব অভাব বড় হয়েছিল,
তাই তার বউ-ছেলের প্রতি কোনো অভাব রাখে না।
"বাবা, আমি একটু ঘুরে আসি" বলেই হুড়মুড় করে তার সাইকেলটা নিয়ে
বেরিয়ে গেল। অমলের মা তাদের পাশের বাড়ির বান্ধবীর বাড়িতে গিয়েছিল গল্প করবার জন্য।
তাই সে আজ বাবাকে বলেই বেরোল।
অমলের বয়স সতেরো। দু’মাস আগেই তার জন্মদিন ছিল। বেশ ভালোভাবেই খাইয়েছে
তাদের বন্ধুদের। ইলিভেনে উঠেছে, নতুন নতুন সাবজেক্ট নিয়েছে। পাঠ্য বই তেমনভাবে না
পড়লেও, গল্পের বইয়ের প্রতি খুব আগ্রহ তার সে বাংলা হোক, কিংবা ইংরেজী। আর তার বই
পড়বার সময় যদি কেউ বিরক্ত করে, তাহলে খুব রেগে যায় সে।
মাঝেমধ্যে তো অমল নিজেও ভাবে যে, সে কি করল এই সতেরোটা বছর, তার জীবনে।
তার বেশিরভাগ বন্ধুরাই পড়াশোনায় যেমন ভালো, তেমনি তাদের গার্লফ্রেন্ডরাও। যখন সবাই
একসাথে বসে গল্প করে, তখন অমলের নিজেকেই একা একা মনে হয়।
"কীরে, আজ এত দেরি করলি যে" সুজয় বলল।
"না এমনি, একটা গল্প পড়ছিলাম তো তাই" অমল বলল।
সুজয় খুবই কাছের বন্ধু অমলের। তার পাশে সুখে-দুঃখে সবসময়ই থাকে বলতে গেলে।
সে ভাবে, গার্লফ্রেন্ড ছেড়ে গেছে ঠিকই, কিন্তু সুজয় আমার সাথে কখনই বিশ্বাসঘাতকতা
করবে না। এতটুকু ভেবেই সে শান্তিতে থাকে। আসলে প্রতিটা মানুষেরই এমন কোনো একজনকে দরকার
যাকে সে সব খুলে বলতে পারে এবং সে শোনে। তাদের বন্ধুদের মধ্যে অমলই একজন ছেলে যে সব
কথা খুলে বলতে ভালোবাসে এবং হাসিখুশি থাকতে ভালোবাসে। আর তার কথা শোনবার জন্যে আছেই
তো সুজয়। সে অমলের সব কথা শোনে এবং বুঝিয়েও বলে। কিন্তু সুজয় যেন একটি আলাদা ধরণের।
তার গার্লফ্রেন্ড রিয়া সবসময়ই তার কাছে একদম যেন বেঁধে রেখে দেয়। তাদের মধ্যেকার
একটা কথাও সে নিজে বলে না, সুজয়কে দিয়ে বলায়। এই নিয়ে তাদের বন্ধুদের মধ্যে এক-একসময়
যা হাসাহাসি হয়।
"একটা সিগারেট দে না" জয়কে অমল বলল। তিন-চার মাস ধরে অমল নতুন
সিগারেট খাওয়া শুরু করেছে।
"আচ্ছা অমল, একটা কথা বলি খারাপ পাস না। তোর কি আর মনে পড়ে না ওর
কথা?" রিয়া বলল। "যতদিন থেকে এই সিগারেটটা ধরেছিস, ততদিন থেকে কেমন যেন
মনমরা হয়ে থাকিস। আগের মতন সেই আড্ডাটাও জমে না আর আমাদের। যে এত হাসি-ঠাট্টা করত
সবসময়। আর আজ..." বলতে বলতে থেমে গেল রিয়া।
জয়ের গার্লফ্রেন্ড প্রিয়াঙ্কাও বলল, "সেটাই"
বছর দুয়েক আগে...
"ও যে, মানে না মানা..." গান করতে করতে তাদের বাড়ির বাগানের
মাটি খুঁড়ছিল চারু, চারুলতা বসু। বাবা-মায়ের একমাত্র আদুরে সন্তান। ভালোবেসে 'চারু'
বলেই ডাকে সবাই। খোলা চুল, সূর্যের আলো তার মুখের উপর পড়ে যেন জ্বলজ্বল করছে। রাস্তার
ঠিক পাশেই তাদের বাড়ি, শখের জন্যে সামনেটা বাগান করেছে। তাতেই, গুনগুন করে গান করতে
করতে ধবধবে সাদা দাঁতগুলো বেরিয়ে এল। চারু তার মাটিওয়ালা হাত নিয়ে ঘাম মুছে দাঁড়াল
এবং মাথা হেলিয়ে চুলগুলো পিছনে দিয়ে ঘুরল সে।
আশ্বিন মাস। না ঠাণ্ডা, না গরম। পুজোর জন্য প্যান্ডেল বানানো শুরু হয়েছে।
অমল সাইকেলের দোকান থেকে ব্রেক-শু টা টাইট করে বাড়ি ফিরছে।
"মা, এবারের পুজোটাতে কিন্তু দারুণ আনন্দ করব। পাড়ার ক্লাবের পঞ্চাশ
বছর বলে কথা। আর তাছাড়াও সমস্ত প্ল্যান হয়ে গেছে আমাদের।" সাইকেলটা রাখতে রাখতে
তার মাকে বলল।
ষষ্ঠী ! সকাল সাতটায় অমল ঘুম থেকে উঠে গেছে। পুজোর চারটা দিন, সে বইয়ের
দিকে হাতটাও দেয় না।
"ঢাকে তাহলে কাঠি পড়ল শেষপর্যন্ত" প্যান্ট পরতে পরতে অমল তার
মাকে বলল।
দু-একটা বাড়ি পেরিয়েই সুজয়ের বাড়ি। তাকে সে ডেকে নিয়ে মণ্ডপে গেল।
ষষ্ঠীর সকাল, তেমনভাবে কেউ একটা আসছে না। তাও পঞ্চাশ বছর বলে দু-একজন করে আসা শুরু
হয়ে গেছে।
অমলের বন্ধুদের দল একদিকে মণ্ডপের গেটের পাশে বসেছে। আরেকদিকে মেয়েদের
দল। প্রিয়াঙ্কা, রিয়াও সেখানে ছিল।
দেখতে দেখতেই ভিড় উপচে পড়া শুরু হয়ে গেল। কিন্তু অমলের চোখ ভিড় এড়িয়ে
শুধু একটি মেয়ের দিকেই যাচ্ছিল। তার হাসি, টানা চোখ বান্ধবীদের সাথে হাসি-মজা করতে
করতে খোলা চুলগুলিও দুলছিল। অমল কারও সাথে কিছু না বলে চেয়ারে বসে তাকেই শুধু হাঁ
করে দেখছিল।
"কীরে, এত অন্যমনস্ক হয়ে আছিস যে" তার চোখের সামনে হাত নাড়িয়ে
সুজয় বলল। "চল কিছু খেয়ে আসি।"
মণ্ডপের লাইন দিয়ে বেশ কিছু খাবারের দোকান বসেছে। দুটো ফুচকার দোকানের
পরে অমল আর সুজয় ভেলপুরির দোকানটাতে গেল এবং দুজনে দুটো ভেলপুড়ির বাটি হাতে নিয়ে
খাওয়া শুরু করল।
"এই এই দেখ, ও আসছে।" অমল চিবোতে চিবোতে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে
বলল। সুজয়ও যথারীতি দেখল।
মেয়েটি এসে ভেলপুরির দোকানটাতে দাঁড়াল, যেখানে তারা খাচ্ছিল। সে এক প্লেট
ভেলপুরি তার জন্যে দিতে বলল।
"হাই, আমি অমল" সুজয়ের রুমালটা দিয়ে মুছে অমল বলল।
"হাই। মাইসেলফ্ চারু, চারুলতা বসু।" কিন্তু, তোমায় তো ঠিক চিনলাম
না..." ভ্রু কুঁচকে হেসে বলল।
"আমি আসলে মণ্ডপে তোমায় বান্ধবীদের সাথে দেখলাম, তাই আর কি"
অমল লজ্জার সঙ্গে হেসে চারুলতাকে বলল।
"তুমি কি এখানেই থাকো?" অমলকে জিজ্ঞাসা করল।
"হ্যাঁ হ্যাঁ, এইতো তিনটে বাড়ির পরেই।" আঙুল দিয়ে তাদের টিনের
বাড়িটার দিকে দেখাল।
ভালই গল্প-গুজব করছিল অমল আর চারু। ষষ্ঠীর দুপুরটা এভাবেই চলে গেল অমলের,
চারুর সাথে গল্প করে। চারুর বাড়িতে যেতে হবে তার মা দু’টোর মধ্যে ফিরতে বলেছিল।
"চলো চারু, এগিয়ে দিয়ে তোমায়" অমল বলল।
"চলো।"
সামনের মোড়ের বাড়িটাই চারুলতাদের। তাকে এগিয়ে দিয়ে সে বলল, "আজ
রাত্রে ফাঁকা আছো ? ঘুরবে আমাদের সাথে ?" অমল বেশ উৎসুক ভাবে তাকে জিজ্ঞাসা করল।
"না অমল, রাতে বেরোতে দেবে না বাবা-মা" চারু বলল। "কাল দুপুরে
যদি ফাঁকা থাকো, তাহলে ঘুরতে যেতে পারি।"
"হ্যাঁ হ্যাঁ, ফাঁকাই আছি।" অমল উত্তেজিত হয়ে বলল।
"ঠিক আছে তাহলে, বাই।" চারু পিছন ফিরে গেট খুলতে খুলতে বলল।
সেই রাতে তারা সবাই বন্ধু-বান্ধবী মিলেই পূজো দেখতে গেল।
সপ্তমীর সকাল ! মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। শার্টের কলারে মেসোর দেওয়া ইউরোপিয়ান
পারফিউমটা লাগিয়ে ঘর থেকে বেরোল অমল।
"এই, চল আজকে আমরা সবাই দিনের বেলায় একটু ঘুরে আসি। চারুলতাও আসবে
বলেছে।" জয়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল।
হলুদ রঙের কুর্তিটা পরে অমলদের পাশে এসে চারু বলল, "চলো যাই।"
জয়, প্রিয়াঙ্কা হাত ধরে হেঁটে চলেছে। সুজয় তার গার্লফ্রেন্ড রিয়ার কখনও
কাধেঁ হাত দেয়, আবার হাত ধরে হাঁটতে থাকে। ওরা চারজন সামনে হেঁটে হেঁটে এগিয়ে যেতে
থাকে, চারু আর অমল পেছন পেছন আসতে থাকে।
"তুমি ভবিষ্যতে কী হতে চাও?" কোনো কথা না পেয়ে, অমল চারুকে জিজ্ঞেস
করল।
"ইচ্ছে তো আছে ডাক্তারি পড়বার। দেখা যাক পরে কি হয়" হেসে চারু
বলল।
অমল ভাবল যে, সে নিজেই তো এত কাঁচা পড়াশোনায়। আর চারু ডাক্তার...। কি
করে বলব তোমায় চারু, আমি যে তোমার প্রেমে পড়ে গেছি। তোমাকে প্রথম দেখতেই যে আমার
খুব ভালো লেগে গেছে। আর এখন যদি তুমি ডাক্তার হয়ে যাও, তাহলে যে আমি তোমার কাছে কিছুই
না, নগণ্য। এই ভেবে মুখটা বিষন্নতায় ভরে উঠল অমলের।
আচমকাই অমলের হাতটা ধরে উঠল চারু। তার মনে যে অল্প হলেও জায়গা রয়েছে,
সেটা বুঝতে দেরি হল না অমলের।
"সবাই কত সুন্দর হাত ধরে হাঁটছে, আমরাও না ধরে হাঁটলে কেমন লাগছে।
তাই তোমার হাতটা ধরলাম।" চারুলতারও বুঝতে দেরি হল না যে সে তাকে পছন্দ করে না।
"বিরিয়ানি খাবে তোমরা ? আমি ট্রিট দেবো।" রিয়া বলল।
রেস্টুরেন্টে ঢুকে সবাই যে যার চেয়ারে বসল। একটা টেবিলে চারটে জায়গা।
তাই অমল আর চারু অপর টেবিলে বসল।
"এই, তোমার বান্ধবীকে বলো যে, আমি বিরিয়ানি খাবো না। আমি চিকেন কাটলেট
নিয়ে নিচ্ছি।" চারু বলল।
তারা পরস্পর কি প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলবে, এটা ভাবতে ভাবতেই তাদের খাবারগুলো
দিয়ে গেল। চাকু দিয়ে কাটলেটটা কেটে বলল, "হাঁ করে তাকিয়ে আছো কি, এই-ই নাও"
অর্ধেক টুকরোটা অমলের মুখে খাইয়ে দিয়ে চোখের দিকে তাকাল।
"নাও না, তুমিও নাও।" বিরিয়ানির প্লেটটা চারুর দিকে এগিয়ে বলল।
"আমি যে তোমায় খাইয়ে দিলাম তখন তো খেয়ে নিলে। আর এখন প্লেট এগিয়ে
দিচ্ছ, খাব না।" চারু মুখ ঘুরিয়ে বলল।
অমল তার পাতলা চুলগুলো সরিয়ে গালটা ধরে বলল, "নাও, খাইয়ে দিচ্ছি।"
অমল চামচে করে তাকে খাইয়ে দিল।
আনন্দর মধ্যে দিয়ে সপ্তমীর দিনটি কেটে গেল। রাতে শুয়ে এ কথাই ভেবে চলছিল
চারু। অমলের চুলগুলো সরিয়ে তার গাল ধরে তাকে খাইয়ে দেওয়া। এসব ভেবেই সে গায়ে দেওয়ার
চাদরটাকে টেনে নিচ্ছিল।
অষ্টমী ! যুবক-যুবতীদের যেন আজ আলাদাই দেখতে লাগে। ছেলেদের গায়ে পাঞ্জাবী
আর মেয়েদের শাড়ি।
সরস্বতী পুজোর জন্য কেনা পাঞ্জাবীটা অষ্টমীতে পড়ে বেরোল অমল। মণ্ডপে ঢুকেই
সে দেখতে পেল চারু তার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। সে ভেবেছিল আজ সবার প্রথমে সবার প্রথমে
এসে দাঁড়িয়ে থাকবে, কিন্তু তার ভাবনা ভুল হল।
অমল আর চারু দু’জনকেই খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল। চারু লাল রঙের শাড়ি পরে এসেছিল
এবং কোমর বন্ধনীর জন্য তাকে আরো অপরূপা দেখাচ্ছিল।
চারু অমলের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল এবং অমল দু-এক পা করে পিছোতে পিছোতে একটা
জায়গায় গিয়ে ঠেঁকল। চারু অমলের একটা হাত ধরে চুম্বন করা শুরু করল।
ফাঁকা মণ্ডপে বাইরে থেকে কেউ আসার শব্দ শোনা গেল।
চারু অমলের ঠোঁটের ওপর থেকে তার নিজের ঠোঁট সরিয়ে নিয়ে বলল, "আই
লাভ ইউ"
ঢাক বাজা শুরু হল। অষ্টমীর অঞ্জলী দেওয়ার জন্য ভক্তরা ঠাকুরের সামনে হাত
জোর করে দাঁড়িয়ে আছে। পুরোহিতমশাই মন্ত্র বলছে। অমল আর চারুও হাত জোর করে দাঁড়িয়ে
ছিল।
সকালটা উপোস করে ছিল তারা। অমল আর চারু দুজনে মিলে রেস্টুরেন্টে গেল। বড়
রেস্টুরেন্টে গিয়েছে। টেবিলগুলোর উপর ফুলদানি রাখা।
তারা বসল এবং অমল চারুর কাঁধে হাত রেখে গালদুটো ধরে বলল, "আই লাভ ইউ
টু" পিছনের গ্লাসে রাখা গোলাপটা নিয়ে চারুকে দিল।
নবমী, দশমীটা অমল আর চারুর ভালোবাসার মধ্যে দিয়েই সেবারের পুজোটা চলে গেল।
এরপর থেকে তারা রোজ দেখা করতে না পারলেও মাঝে-মাঝেই দেখা করত।
ওরা একে-অপরকে আরও ভালোবাসতে শুরু করল। কোনো উৎসব-অনুষ্ঠান হলেই তারা সারাটা
দিন একসাথে থাকত। অমল যখন ক্লাস নাইনে পড়ত, তখন থেকেই সে চারুকে ভালোবাসতে শুরু করেছিল,
এভাবে ক্লাস টেনটাও চলে গেল।
দশমীর দিন ! অমল আর চারু দু’জনেই ইলিভেনে পড়ে।
চারুও এখন বুঝতে শিখে গেছে। সে নিজে এখন ভাবতে থাকে যে, সে যদি বড় ডাক্তার
হতে চায়, তাহলে এসব প্রেম-ট্রেম করলে চলবে না। তার নিজের লক্ষ্যের দিকে তাকাতে হবে
আগে।
এ কারণেই অমলের সঙ্গে খুব কথা-কাটাকাটি, ঝগড়া, তর্ক-বিতর্ক এসব দু’মাস
ধরে লেগেই থাকত। তাই কোনো কারণ ছাড়াই সেদিন বিসর্জন ঘাটে গিয়ে চারু অমলকে বলল,
"আমি তোমার সঙ্গে আর কোনো সম্পর্কে থাকতে পারব না।"
এই বলে সে ওখান থেকে পেছনে ঘুরে গিয়ে চোখের এক কোণায় জল নিয়ে চলে আসল।
তারপর থেকে দেখা হলেও, অমলকে দেখেও না দেখার ভান করে চলত চারুলতা। কিছুবার
কথা বলার চেষ্টা করলেও সেটাকে চারুলতা পাত্তা না দিয়ে চলত...
—সুজয় বলল "আর এই জন্যে বিশ্বাস করবি না ভাই, আমি যে কত ডিপ্রেসড
হয়েছিলাম, সেটা একমাত্র সুজয়ই জানে।" জয়ের দিকে তাকিয়ে অমল সিগারেটটা ফেলে
পা চাপা দিয়ে বলল।
"তার জন্যেই কি তুই আজকাল এত সিগারেট খাচ্ছিস রোজ?" প্রিয়াঙ্কা
কৌতুহলীভাবে জিজ্ঞেস করল।
"কি হবে, এতগুলো সিগারেট খেয়ে ? কমিয়ে দে তোর এসব খাওয়া, ফালতু..."
কথাটা বলে আটকে গেল রিয়া।
মানসিক অবসাদ আর অমলের জমিয়ে রাখা জেদ নিয়ে আজ সে একজন সাংবাদিক। সাংবাদিকের
পাশেও সে একজন লেখক। চারুলতার ছেড়ে যাওয়ার পর সে যেমনভাবে আঘাত পেয়েছিল, তেমনি তার
মধ্যে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন দেখা গিয়ে তাকে লেখক হয়ে তুলতেও সাহায্য করেছিল।
তার জীবনের প্রথম লেখাগুলো দুঃখ-কষ্টে ভরা সব কবিতা। সাপ্তাহিক পত্রিকায়
ছাপা সব কবিতা ছিল অমলের জীবনে প্রথম লেখা প্রকাশিত হওয়া। এরপরে ছোট গল্পের দশ-বারোটা
বইও তার ছাপা হয়েছে।
আজ থেকে এগারো বছর আগের চারুলতার মুখটা যেন আজও ভাসিয়ে তোলে তার সাদা কাগজের
লেখার পাতায়। তাকে নিয়ে বেশ কিছু গল্প-কবিতা পাঠকদের জন্যও লিখেছে অমল। কিন্তু, এখনও
সে জানে না চারু তার লেখা আদৌ পড়ে কিনা !
অমল যেই ছোট্ট শহরটিতে থাকত, সেখানে এখন সে আর থাকে না। কাজের সুত্রে, ব্যস্ত
শহরেই থাকতে হয়েছে তাকে। এখানে এসে ফ্ল্যাট কিনেছে। বাবা-মাকেও ইতিমধ্যে নিয়ে আসার
কথা চিন্তা করেছে। যদিও তার একাকীত্বের সঙ্গী খাতা আর পেন।
একদিন, অফিসে কাজ করতে গিয়ে হঠাৎ তার চোখে পড়ল চারুলতা বসু রায় নামে
একটি আর্টিকেল বেরিয়েছে। সে ভালোভাবে পড়তেই দেখলো যে তার পাশের ছোট্ট গ্রামটির ঊনত্রিশ
বছরের এক মহিলা ডাক্তারের ধর্ষণ হয়েছে। তার এক বছরের বিয়ে হওয়া স্বামীও তাকে ছেড়ে
গিয়েছে। কারও সাথে কথা বলতে পারছে না সে। এমনকি, দরজার বাইরে মুখটা দেখাতেও লজ্জা
বোধ করে। যত দিন যাচ্ছে সে একটু একটু করে পাগল হয়ে যাচ্ছে।
"চারুলতা বসু রায়ের ডিটেলসটা আমাকে এক্ষুনি এনে টেবিলটাতে দিয়ে যাস"
জয়কে বলল। জয়
আর অমল একই অফিসে চাকরি করে, দেড় বছর হল নতুন জয়েন করেছে।
জয়ের কাছ থেকে ডিটেলস নিয়ে অমল পরের দিনই রওনা হল।
বাস থেকে নেমে পা রাখতেই গ্রামের প্রতিটা মানুষের মুখে বিষণ্নতার ছাপ দেখতে
পেল অমল। গ্রামের একজন মহিলাকে জিজ্ঞেস করল, "দিদি, চারুলতা বসু রায়ের চেম্বারটা
কোন দিকটায়?" মহিলা মুখ বন্ধ করেই আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন।
ট্রলি টানতে টানতে চারুলতা বসু রায়ের চেম্বারের সামনে গিয়ে, বাড়ির ভেতরের
দরজাটা খুলল।
উশকোখুশকো চুল নিয়ে পা গুটিয়ে বসে ছিল তেরো বছরের পুরোনো সেই চারুলতা।
তার নামের পেছনে 'রায়' থাকলেও, 'চারু' নামটি যেন আজও জ্বলজ্বল করছে তার মনে। অনেকটা
বড় দেখাচ্ছিল চারুকে। সমান সিঁথি থাকলেও, তার স্বামী ছেড়ে দিয়েছে কিনা ! এজন্যও
চারুর অবসাদ হওয়ার অন্য এক কারণ।
দরজা খোলায় বাইরের আলোতে স্পষ্ট চিনতে পেরেছে চারু, যে এই সেই অমল যাকে
সে এগারো বছর আগে তার জীবন থেকে হারিয়ে ফেলেছিল।
জোরে দৌড়ে এসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চারু অমলকে বলল, "আমায় ক্ষমা
করে দিও অমল। আমি তো স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনি যে তুমি এই অবস্থাতেও আমার সঙ্গে
দেখা করতে আসবে। আমি তোমাকে ভুল ভেবেছিলাম অমল। পারলে আমায় ক্ষমা করে দিও"
ট্রলি থেকে হাতটা নামিয়ে চারুর কাঁধটা ধরে, "খোঁখী, তোমী সসুরবারি
যাবিস্?" অমল মুচকি হেসে বলল।
চোখে জল নিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে "হ্যাঁ" বলল।
"অতীত দেখেই যদি জীবনটা চালাতে হত, তাহলে আর আমরা কখনই এগোতে পারতাম
না। তোমাকে নিয়েই আজ থেকে সারাটা জীবন থাকব, কথা দিলাম।
মনে আছে চারু, কাল ষষ্ঠী?" পা উঁচু করে অমলের ঠোঁটের ওপর ঠোঁট রেখে
পুরোনো অনুভব করতে লাগল চারু।
অন্ধকার চেম্বারের ভিতর দু’জনের নিঃসঙ্গতায় আনন্দ উপভোগ করছিল অমল আর চারু।
তাদের এগারো বছর পর দেখা হয়ে যেন অন্য আরেক পৃথিবীতে চলে গিয়েছিল তারা। পরস্পরের
মধ্যে কেউই ঠোঁট ছাড়ছিল না। তাদের এতগুলো বছর না দেখা হওয়ায় পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসার
টানটা শক্ত হয়ে উঠেছিল। অমল চারুর পেটের থেকে নিজের হাতটা সরালো এবং জিজ্ঞেস করলো,
"আমায় বিয়ে করবে চারু?"
কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল চারু। তারপর বলল, "তুমি তো আমায়
বলেছিলেই যে, আমি শশুরবাড়ি যাচ্ছি কিনা। আমি তো তখন হ্যাঁ বলেছিলাম। তাহলে আবার..."
নিজের হাতের আঙুল ধরে বলল।
"সবারই একটা মত থাকা জরুরী চারু। আমি যে তোমায় এখন থেকে আমার কাছে
বন্দী করে রাখব সেরকমটা নয়। তোমাকে আমি তোমার স্বাধীনতাতেই বাঁচতে দিব, তুমি যা ইচ্ছে
করতে পারো কোন আমার অসুবিধে থাকবে না। কিন্তু, আমরা যদি বিয়েটা না করি তাহলে হয়তো
সমাজের চোখে অপমানিত হয়ে থাকবো। তাই তোমায় জিজ্ঞেস করলাম চারু।" অমল মাথা ঝাঁকিয়ে
বলল।
চারুলতা সমস্ত রকম জিনিস-পত্র গোছাল। অমলও সাহায্য করল। কিছুক্ষণ বাদে,
জিনিসপত্রের ব্যাগ নিয়ে দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। একটু বাড়িটাকে দেখে নিয়ে দরজা
আটকে দিল। এরপরে তারা সেই গ্রাম ছেড়ে চলে আসল।
দু’মাস পর আজ বাইরেটা দেখতে পেয়ে, চোখের সামনে হাত নিয়ে ভ্রু কুঁচকালো।
কিছুক্ষণ পিট পিট করে তাকিয়ে থেকে আস্তে আস্তে পরিষ্কার দেখতে লাগলো চারু।
গ্রামের আশেপাশের লোকজনেরা যেভাবে সম্মান করতো ডাক্তার চারুলতাকে, সেই সম্মান
আজ আর দেখতে পেল না চারুলতা। যেসব মানুষেরা তাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতো তারাই আজ পাশ
কাটিয়ে চলে যাচ্ছে কিংবা আর চোখে দেখছে না।
চারু তার নিজের মনকে সান্তনা দিল। সে এতক্ষণে বুঝতে পেরেছে যে, সত্যিই অমল
তার প্রিয় মানুষ। এগারো বছর আগে অমলকে হারিয়ে যে কতটা ভুল করেছে চারু, সেটার জন্যেই
সে আজও নিজেকেই দোষী বলে। সে এটাও ভাবে যে, যদি আজ অমলকে না হারিয়ে ফেলত তাহলে না
ধর্ষণ হত, না বিয়েটাই হত! চারু বিড়বিড় করে বলে, "অবশ্যও, বিয়েটাতো আর আমার..."
বাসের পেছনে তাদের মালপত্রগুলো রেখে উঠল। বাসের কন্ডাক্টর জিজ্ঞেস করল অমলকে,
কোথায় যাবেন ! অমল বললো, "কলকাতা।" এই বলে অমলকে নিয়ে বাসের মাঝখানের সিটে
বসলো। চারুকে জানলার পাশে রেখে অমল তার পাশে বসলো। অমল আর চারু ঠিক এগারো বছর আগে যেভাবে
যাতায়াত করত ঠিক সেভাবেই বসলো। তাদেরকে যেন ছোটোবেলাকার অমল আর চারুলতার মতন দেখাচ্ছিল।
বাসে ওঠার আধঘন্টা পরে, রায়গঞ্জ থেকে গাড়ি ছাড়ল। চারু রায়গঞ্জটাকে একবার
ভালো করে দেখে চোখের কোণায় জল এনে 'বিদায়' জানাল। অমল তার কাঁধে হাত দিয়ে তাকে সান্তনা
দিল।
সন্ধ্যে হতে এসেছে। কলকাতায় পৌঁছবার কিছুটা পথ বাকি। চারু অমলের কাঁধে
মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল। গাড়িটা জ্যামে আটকে পড়ায় চোখ খুলল চারু।
"খাবে কিছু? স্যান্ডউইচ আছে আমার কাছে।" অমল জিজ্ঞেস করলো। চারু
মাথা নাড়লো।
অমলের ছোট ব্যাগটা থেকে টিফিনবক্সটা বের করে নিয়ে চারুকে দিল। চারু পকেট
থেকে স্যানিটাইজারটা বের করে নিয়ে অমলকে দিল আর সে নিজেও হাতে মেখে নিল।
চারটে স্যান্ডউইচ নিয়ে এসেছিল অমল। চারুকে দুটো দিয়ে, সে নিজেও দুটো খেল।
অমল ব্যাগের থেকে জলটা বের করতে করতে চারুকে বলল, "এই এগারোটা বছর
তোমায় ছাড়া আমার কিভাবে যে দিনগুলো কেটেছে, তা তুমি জানো না চারু। অনেক কথা বাকি
আছে চারু, তোমায় বলবার।" এই বলে জল খেল। চারু ভেতরে ভেতরে কষ্ট পেল। তার হাতটা
অমলের বা পায়ে রাখল।
সাড়ে সাতটায় বাস থামল। অমল তাদের জিনিসপত্রগুলো নিয়ে ট্যাক্সিতে উঠে
তার ফ্ল্যাটে পৌঁছল।
"কবে কিনেছ?" চারু জিজ্ঞেস করল।
"এইতো বছরখানেক হল। চারমাস থেকে এই ফ্ল্যাটে থাকতে শুরু করেছি। আগে
একটা ভাড়া বাড়িতে থাকতাম। তারপর দেখলাম যে খুব অসুবিধা হচ্ছে, তাই অফিসের কাছেই নিলাম।"
দরজার লকটা খুলতে খুলতে অমল বলল।
ঘরে ঢুকেই চারু দু’টো ক্যানভাসে আঁকা বিশাল ছবি দেখতে পেল। আরেকটু সামনে
যেতেই ক্যানভাসের নীচে ইংরেজিতে 'অমল দত্ত' লেখা রয়েছে দে লক্ষ করল।
"অমল, এই ছবিগুলো কি তুমি এঁকেছ? তুমি কি আর্ট শিখতে?" চারু কৌতূহলীর
সঙ্গে জিজ্ঞেস করল।
"তোমাকে বলেছিলাম না চারু, আমার আর্ট শিখবার খুব ইচ্ছে ছিল। কলেজে
উঠে আমি আর্ট শেখা শুরু করি। আর তারপর নিজের মনে যা আসত সেটাকেই ছবিতে বন্দী করে রাখতাম।"
"কিন্তু এই ছবিটা যে এঁকেছ, এটা তো আমার বহু পুরোনো। মানে, আমি যখন
ইলিভেন-টুয়েলভে পড়তাম তখনকার চেহারা।" চারু নিজেও বুঝতে পারলো যে তার এখনকার
চেহারার অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে।
"তুমি যেবার ছেড়ে চলে গিয়েছিলে, সেবার তো না আমার কাছে কোনো ছবি
ছিল, না তোমার দেওয়া কোনো গিফ্ট রেখেছিলাম। তাই তখন থেকে আরও বেশি করে আর্ট শিখবার
ইচ্ছেটা প্রবল হয়ে উঠেছিল। আর তারপরেই আমি তোমার ছবিটা এঁকেছি।" সোফার কুষাণগুলো
ঠিক করে নিতে অমল বলল
চারু সোফায় বসে জিজ্ঞেস করল, "আর এই মেয়েটা কে? যার ছবি তুমি এঁকে
রেখেছ?"
"বাসে তোমায় বলেছিলাম না, তোমার সাথে অনেক কথা বাকি আছে। এর জন্যেই
বলেছিলাম।
যাই হোক সেসব কথা বলবো, তার আগে বলো যে, কোল্ড কফির অভ্যেসটা রেখেছ তো এখনও?"
"না এখন তেমন নেই সেরকম। আসলে, আমার খুব সর্দি-কাশি হয়েছিল একবার
তারপরের থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছি। কিন্তু, এতদিন পরে যখন বলছ তাহলে দাও।" মিষ্টি
হাসি দিয়ে চারু বললো।
অমল চারুর মিষ্টি হাসিটা আবার দেখল, যা দে এগারো বছর আগে তার মুখে সবসময়
দেখতে পেত। "তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও, আমি রেডি করছি।"
চারু তার ট্রলি থেকে গেঞ্জি কাপড়ের একটা প্যান্ট আর টপ নিয়ে বাথরুমে ঢুকল।
এদিকে অমল ফ্রিজ থেকে আইস বের করল। আর তার নিজের জন্য চা বানাল।
ট্রে-তে করে চা আর কোল্ডকফিটা নিয়ে এসে সেন্টার টেবিলে রাখল।
অমলের টাওয়েলটা দিয়ে চারু মুখের চারপাশে লেগে থাকা জলগুলো মুছতে মুছতে
বাথরুম থেকে বের হল।
তার ফর্সা গায়ের রং, খয়েরী চুলগুলো দেখে অমল তার দিকে তাকিয়েছিল।
"অমন করে হাঁ করে তাকিয়ে থাকার কি হল !" মুচকি হেসে চারু বললো।
"না, তোমাকে এরকমভাবে আজ প্রথমবার দেখলাম। খুব সুন্দর দেখাচ্ছে তোমায়
জানো? মনে হচ্ছে যেন আরও একবার তোমার প্রেমে পড়ে যাই"
"তাই? তাহলে পড়ো না; নতুন করে আরও একবার আমরা প্রেমে পড়ি।"
এই বলে সে হা-হা করে হাসতে লাগল।
টাওয়েলটা ঝুলিয়ে রাখল। সোফায় বসে কোল্ডকফির গ্লাসটা তুলে চারু বলল,
"হ্যাঁ, এবার বলো।"
চায়ের কাপে চুমুক বসিয়ে বলল,
"আজ থেকে এগারো বছর আগে...
দশমীর রাতে যখন তুমি আমায় ছেড়ে চলে গিয়েছিলে, তখন আমি খুব একাকী হয়ে
পড়েছিলাম। মনে হচ্ছিল এ জগৎটা যেন খুব অন্ধকার তোমায় ছাড়া। সূর্য উঠত, অস্ত যেত
- পাখিরা বাসায় ফিরে যেত, আবার সকাল হলেই রাখালরা গোরু চড়াবার জন্য বেড়িয়ে পড়তো।
এইভাবেই আমি উচ্চমাধ্যমিকটাও দিয়ে ফেললাম।
কলকাতায় আসলাম এর পরে, নতুন কলেজে ভর্তি হলাম। বাবার কাছ থেকে কিছু টাকা
নিয়ে তোমার উদ্দেশ্যে দুঃখে-ভরা সব কবিতা যা লিখেছিলাম সেগুলোকে প্রকাশ করলাম। 'দুঃখের
জগৎ' নামে বইটা প্রকাশ হল। দু-তিনমাসের মধ্যেই বইয়ের সব কবিতাগুলো পাঠকমহলে সাড়া
ফেলে দিয়েছিল।"
"চা-টা খাও, ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।" অমলকে চারু বলল।
"এরপরে একের পর এক নানানরকম গল্প-কবিতা লিখতে শুরু করলাম আমি। পাঠকদের
উৎসাহ আমাকে আরও জাগিয়ে তুলছিল কাহিনী লেখা সাহায্য করতে।
জার্নালিসম নিয়ে পড়া শেষ করে একটা অফিসে চাকরি পেলাম। ওখানে গিয়ে একটা
মেয়ের সাথে দেখা পেলাম।"
চায়ের শেষ চুমুকটা দিয়ে কাপটা টেবিলে রাখল। সিগারেটটা হাতে নিয়ে ব্যালকনির
পাশে এসে দাঁড়ালো অমল। চারুও তার পাশে গিয়ে রেলিংটা ধরে চেয়ারটা টেনে বসল। সিগারেট
ঠোঁটে নিয়ে আগুন ধরাতে ধরাতে বললো,
"মেয়েটির নাম ছিল ক্যাথেরাইন্। ওর মা দুবাইয়ে থাকতো, তার বাবা ক্যাথেরাইনের
মাকে নিয়ে কলকাতায় এসেছিল।
ক্যাথেরাইন্ অ্যাংকারিং করত। আমরা খুব ভালো বন্ধু ছিলাম পরস্পর। আমি, জয়
আর ক্যাথেরাইন্ প্রতিদিন একইসাথে লাঞ্চ করতাম। কোনো কোনো দিন অফিস থেকে ফিরতে দেরি
হলে ক্যাথেরাইনকে তার বাড়িতে ড্রপ করে দিতাম।
আঠাশে আগস্ট আমার জন্মদিন। বন্ধুরা সবাই খুব জেদ করছিল তাদের পার্টি দেওয়ার
জন্য। একটা রেস্টুরেন্টে গেলাম, সেখানে সুজয়, রিয়া, জয়, প্রিয়াঙ্কা আর ক্যাথেরাইন্
আসল।
বিশাল বড় একটা টেবিলে ছয়জন একসাথে বসলাম। আমি বলে দিয়েছিলাম ওদের যা
খুশি ইচ্ছে অর্ডার করতে। ওরা যে যার মতন তাদের ডিশ অর্ডার করল, আর আমি দু`টো ওয়াইন্
অর্ডার করলাম।
রাত হয়ে গিয়েছিল। সবাই নিজেদের গাড়ি নিয়ে বাড়ির পথে রওনা হল। আমি ক্যাথেরাইনকে
বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছিলাম।
গাড়ি থেকে নেমে আমার কাঁচের জানলায় নক্ করল দু-তিনবার। আমি গাড়ির কাঁচটা
খুলতেই ও বলল, আচ্ছা অমল তুমি তো আমার বাড়ির ভেতরে কখনই আসনি। এতবার বলেছিলাম আগে
সবসময়ই না-না করে গেছ। আজ কিন্তু তোমায় বাড়িতে আসতেই হবে।
আমি প্রতিবারের মত এবারও মানা করে যাচ্ছিলাম। কিন্তু শেষপর্যন্ত ও ছাড়ল
না। গাড়িটা পার্ক করে রেখে, অবশেষে ঢুকতেই হল।
শর্ট স্কার্টের নিচে ফর্সা চামড়ার সরু পা গুলো থেকে লম্বা হিলওয়ালা জুতোগুলো
খুলে দরজার এক পাশে রাখল ক্যাথেরাইন্। আমিও জুতোগুলো এক পাশে খুলে রেখে তার পেছন পেছন
ঢুকলাম।
একটা ঘরের সামনে নিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলতে খুলতে বলল ক্যাথেরাইন্। আমি একবার
তার দিকে তাকিয়ে, ভয়ে ভয়ে পেছনের অন্ধকার দরজাটা খুললাম।
দরজাটা খুলতেই, চারিদিকটা বেলুন দিয়ে সাজানো ছিল এবং চারটে মোম জ্বলছিল।
আমি একটু এগোতেই ক্যাথেরাইন্ তার ঘরের ভেতর ঢুকে লাইট জ্বালাল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, এসব আবার কেন !
ক্যাথেরাইন্ তার মুখের সামনে হাত উঁচু করে বলল, সারপ্রাইজ!
আমি অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে তার এত সুন্দর করে সাজানো ঘরটাকে দেখছিলাম। ক্যাথেরাইন্
আমার দিকে এগিয়ে আসল।
ও তার পা-টাকে উঁচু করে আমার মাথাটা ধরে নিয়ে ঠোঁটে নিল। আমিও উত্তেজিত
হয়ে গেলাম।
আমাদের ঠোঁটদুটো একসাথে থাকা অবস্থাতেই দরজার ছিটকিনিটা লাগিয়ে দিল ক্যাথেরাইন্।
আমিও তখন উত্তেজিত হয়ে তার কোমল পেট ধরে চারপাশের বেলুন ছড়ানো বিছানায় চলে গেলাম।
আর আমাদের সেই রাত...।"
চারু অমলের চোখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শুনছিল। লজ্জায় এবং অস্বস্তিতে
তার চোখ থেকে নিজের চোখটা সরিয়ে নিল।
চারুর বিরক্তের সঙ্গে আগ্রহ জন্মাল। সে পুরো ব্যাপারটা জানবার জন্যে অমলকে
আবার জিজ্ঞেস করল, "ক্যাথেরাইনের কি হল পরে? ও কি তোমাকে ভালোবাসত, নাকি তুমি
ভালোবাসতে শুরু করেছিলে?"
টেবিলের ওপর রাখা বোতল থেকে জল খেয়ে আসলো অমল। চেয়ারটা এগিয়ে বসে নিয়ে
আরও একটা সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে বলতে শুরু করল,
"সেই রাতটা আমি ক্যাথেরাইনের বাড়িতেই কাটালাম। পরদিন সকালে আমি আমার
ঘরে আসলাম।
অফিসের একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং ছিল সেদিন। তাই বাড়িতে দু’ঘণ্টা থেকে অফিসে
বেরোলাম। সেদিন বাড়ি ফিরতে ফিরতে অনেকটা দেরি হয়ে গেছিল, তাই আর দুপুরে লাঞ্চ করার
সময় পাইনি।
পরেরদিন ছুটি ছিল, তাই সেদিনটা একটা উপন্যাসের কিছুটা শুরু করতে করতেই কেটে
গেল।
তারপরের দিন আবার অফিসে গেলাম। রোজকার মত লাঞ্চ করতে গেলাম। কিন্তু আজ আর
জয় আসেনি।
ক্যাথেরাইন্ আর আমি একটা টেবিলে পরস্পর মুখোমুখি বসে আছি। আমাদের সবার খাওয়ারের
রুটিন সেম ছিল। কোনো কোনোদিন এক্সট্রা জ্যুস্ নেওয়া হত।
খাওয়ার আসতে দেরি হচ্ছিল। আমার টেবিলে রাখা হাতগুলো হঠাৎ ক্যাথেরাইন্ ধরে
বলল, আই লাভ ইউ। তুমি যেদিন থেকে অফিসে জয়েন করেছ আমি তোমায় দেখে মুগ্ধ হয়ে গেছি।
আমায় বিয়ে করবে অমল ?
আমি নিমেষের মধ্যে হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমি বললাম যে, না এটা কখনই সম্ভব
নয় ক্যাথেরাইন্।
ক্যাথেরাইন্ বলল, কেনো অমল আমার
মধ্যে এমন কি নেই যে তুমি আমায় বিয়ে করতে চাও না?
মানছি আমি খুব সাজতে ভালোবাসি, ছোট ছোট ড্রেস পড়ি। কিন্তু আমার ভালোবাসা
যে সত্যি, আমি তোমায় ছাড়া থাকতে পারবো না অমল।
আমি সেদিন রাতে যা করেছি তাতে আমি খুবই দুঃখিত। আমি চাইনি আমাদের শরীরের
উত্তাপ বাড়াতে। কিন্তু আমি যে থাকতে পারিনি। আমাদের ঠোঁটের সংস্পর্শে আমরা দু’জনেই
যে উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম।
আমি ক্যাথেরাইনকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম। বললাম, তুমি আমায় ভালোবাসো ঠিক
আছে। কিন্তু আমি যে তোমায় ভালোবাসতে পারবো না ক্যাথেরাইন্।
ক্যাথেরাইন্ বলল, কেন অমল?
আমি বলতে শুরু করলাম, ‘আমি যখন ক্লাস নাইনে পড়ি তখন আমার সাথে একটি মেয়ে,
চারুলতার প্রথম দেখা হয় এবং তখন থেকেই আমাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক গড়ে উঠতে থাকে।
কিন্তু দু’বছরের মাথায় দশমীর দিন, আমাদের সম্পর্কটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
আমি জানি যে চারুলতা হয়তো আজও আমাকে ভালোবাসে। আর, আমার মন থেকে ওর প্রতি
একটুও জায়গা সরাতে পারবো না ক্যাথেরাইন্। বোঝার চেষ্টা করো।’
এই বলে আমি টেবিল থেকে উঠতে নিলাম, কিন্তু আমার হাতদুটো আটকে ক্যাথেরাইন্
রাগের মাথায় বলে উঠল,
কেন আমার মনকে জিততে দিয়েছ অমল? কেনই বা সেই রাতে ঠোঁট রাখতে দিয়েছিলে?
কেনই বা প্রতিদিন একইসাথে বসে লাঞ্চ করেছিলে? আর কেনই তুমি আমায় বাড়িতে ড্রপ করে দিতে?
চোখের কোণায় জল নিয়ে ক্যাথেরাইন্ বলতে লাগল।
ক্যাথেরাইনকে এর আগে এরকমভাবে বলতে শুনিনি। আমিও আবেগপ্রবণ হয়ে চেয়ারে
বসে পড়লাম।
কিছুক্ষণ পরে ক্যাথেরাইন্ তার নাক টেনে নিয়ে, রুমাল দিয়ে চোখদুটো মুছে
আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
দেখো অমল, আমি জানি হয়তো চারুলতার প্রতি তোমার ভালোবাসা কখনই মুছে ফেলতে
পারবে না।
আমি মাথা নাড়লাম।
কিন্তু অমল, তোমার হৃদয়ের গোপন একটা কোণায় আমার জন্য জায়গা নিয়ে রাখো।
দেখবে সেদিন হয়তো তুমিও আমাকে ভালবাসতে পারবে।
এই শুনে আমি সিগারেট জ্বালিয়ে সেখান থেকে উঠে পড়লাম।
বাড়িতে এসে ক্যাথেরাইনের শেষ দুটো বাক্য আমার মধ্যে সর্বক্ষণ ঘুরপাক খেতে
শুরু করেছিল।
সাতদিনের মাথায় একটা পার্কে আমি ক্যাথেরাইনের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।
ক্যাথেরাইন্ সেদিন শরীর ঢাকা একটা কুর্তি পরে এসেছিল।
আমি বললাম, আমায় বিয়ে করবে ক্যাথেরাইন্?
তৎক্ষণাৎ ক্যাথেরাইন্ আমায় জড়িয়ে ধরল।
দু’মাসের মধ্যেই আমাদের বিয়ে ঠিক হয়ে গেল।
আমাদের বিয়ে হয়ে গেল।"
"সত্যিই তুমি বিয়ে করে নিয়েছিলে ক্যাথেরাইনকে?" চারু অবাক হয়ে
জিজ্ঞেস করল।
"হ্যাঁ সাহসের সঙ্গে উত্তর দিল অমল।
"কিন্তু..."
"কিন্তু কী অমল?" চারু জিজ্ঞেস করল।
সিগারেটটা রেলিংয়ের বাইরে ফেলে দিয়ে বলল, "কিন্তু, আমাদের রিসেপশন্
পার্টির দিন চারু হঠাৎ উধাও হয়ে গেল।"
চারুর মনে শিহরণ জেগে উঠল।
অমল বলল, "পরেরদিন সকালে ঘন জঙ্গল থেকে ক্যাথেরাইনের দেহটা খুঁজে পেয়েছিল
যারা মাঠে কাজ করতে আসে। দুই উরু দিয়ে রক্ত ঝরছিল। গলায় হাতের ছাপ দেখতে পেল কৃষকরা।"
"ব্যাস অমল, আর না... চুপ করো...!" কাঁদতে কাঁদতে চারু তার কানদুটো
হাত দিয়ে বন্ধ করে নিল।
"পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে তদন্ত করে তারা জানাল যে তিনজন লোক একসাথে এসে
ধর্ষণ করে ক্যাথেরাইনকে গলা টিপে খুন করেছে।
আর তারপর থেকেই..." চুপ হয়ে গিয়ে, চোখের সামনে হাত নিয়ে চারুকে
না দেখিয়ে অমল কাঁদল।
চারু কাঁদতে কাঁদতে বলল, "এত সুন্দর মেয়েটার এরকম অবস্থা কেনই বা
হল ! সত্যিই আজ সমাজটা কত পাপাচারে ভরে উঠেছে।"
"আমি ভাবি, কেন এরকমটা আমার সাথেই বারেবারে হয়।
আর আমি সংবাদপত্রে তোমার খবরটা পেয়ে ছুট্টে চলে গেছি তোমার সাথে দেখা করতে।
আমি অনেক কিছু জীবন থেকে হারিয়ে ফেলেছি চারু, এগারো বছর আগে যাকে হারিয়েছি তাকে আর
নতুন করে হারাতে চাই না।" এই বলে চোখে জল নিয়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরল।
অমল বাবা-মাকে তার ফ্ল্যাটে নিয়ে আসল। তারা একসাথে থাকতে শুরু করলো। পনেরো
দিনের মাথায় তাদের মধ্যে বিয়েও হয়ে গেল।
অমল এখন বিয়ে করে খুব সুখী। চারুকেও নতুন করে চেম্বার করে দিল অমল। চারুও
এখন অমলকে দেখে রাত্রিবেলাটা লেখালিখি শুরু করে দিয়েছিল।
এই দেখতে দেখতে তিনটে বছর কেটে গেল। চারু গর্ভবতী। ছয় মাসের শিশু তার শরীরে
বেড়ে উঠছে।
কিন্তু হঠাৎ একদিন, বাড়ির মধ্যে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে গেল অমল দেহত্যাগ
করল।
তিন মাস কেটে গেল। চারুলতা ফুটফুটে একটি ছেলে সন্তান জন্ম দিল। বাবা হারা
ছেলের নাম রাখা হল, 'কমল দত্ত'।
অমলের ইচ্ছে ছিল, তাদের ভালোবাসা নিয়ে একটি বই লেখবার। আর সেই ইচ্ছে পূরণ
করতেই চারুলতা লিখতে বসল।
গল্পের নাম দিল, "এগারো বছর: ভালোবাসার অন্তিম কাহিনী"
শুরুতেই সে লিখল, "আমি অনেক কিছু জীবন থেকে হারিয়ে ফেলেছি চারু, এগারো
বছর আগে যাকে হারিয়েছি তাকে আর নতুন করে হারাতে চাই না।
আর তুমি আজ নিজেই আমাদের ছেড়ে চলে গেলে..."
টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে অমলের ইচ্ছা পূরণ করবার জন্য সারাটা রাত ভেবে লিখতে
শুরু করে দিল চারুলতা, "এগারো বছর: ভালোবাসার অন্তিম কাহিনী"।