Dec 28, 2020

নেট ফড়িং সংখ্যা - ১৭৩

Edit Posted by with No comments

Dec 20, 2020

নেট ফড়িং সংখ্যা - ১৭২

Edit Posted by with No comments

Dec 13, 2020

নেট ফড়িং সংখ্যা- ১৭১

Edit Posted by with No comments

Dec 10, 2020

“সিমন্তিনি তোমাকে” - বিক্রম শীল

Edit Posted by with No comments


সিমন্তিনি তোমাকে

বিক্রম শীল

পর্ব- ১

কয়েকদিন ধরেই আমার কবিতার খাতাটা খুঁজছি। কলেজ বেলায় আমার লেখা সব কবিতাই আছে ওখানে। সম্ভবপর সব জায়গাতেই খাতাটা খুঁজেছি। যেখানে যেখানে থাকা সম্ভব প্রায় সব জায়গাতেই। কিন্তু পাইনি এখনো। কলেজ বেলার বেশ কিছু কবিতা আমার অন্য ডায়েরিতে তোলা ছিল সেগুলোই কলকাতার এক প্রকাশককে পড়িয়েছিলাম। তিনি উচ্ছসিত হয়ে আমার বই প্রকাশ করার প্রস্তাব দেন। তখনি ঠিক করেছিলাম বাড়িতে গিয়েই খাতাটা খুঁজবো। সন্ধ্যায় বসে চা খাচ্ছিলাম হঠাৎ নজরে এলো সিমন্তিনির দেওয়া উপহারটার দিকে। হ্যাঁ সিমন্তিনি, কলেজের বান্ধবী। শুধু কি বান্ধবী না না আমার সারাটা মন জুড়েই ছিল শুধু সিমন্তিনি, এখনো আছে। ওকে ঘিরেই তো কত কবিতা লিখেছি, কত স্বপ্ন দেখেছি একসময়। ও বলেছিল যেদিন আমার কবিতার বই বেরোবে সেদিন পড়বে।

সেই খাতাটায় ওকে ঘিরেই তো আমার লেখা সব কবিতা ছিল। ও সবসময় বলতো এসব কবিতা লিখে কি হবে। কলেজের পড়া শেষ করে ও এম এসসি করতে কলকাতা চলে গেল। অনেকে বলে দুরত্ব বাড়লে নাকি যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে যায়। আমাদেরও তাই হয়েছিল হয়তো। ভৌগলিক দূরত্বটা সময় চক্রে হলেও মনের দূরত্বটা ওই বাড়িয়ে নিয়েছিল। আসলে কবিরা শুধু গড়তেই জানে ভাঙতে শেখেনি কখনো।

আমাদের ব্যাচমেট রিয়ার কাছ থেকে সিমন্তিনির নতুন ঠিকানাটা পেয়েছি। আমার বইটা বেরোলে প্রথম কপিটাই সিমন্তিনি কে পাঠাবো। আর সাথে এই চিঠিটা।

প্রিয় সিমন্তিনি,

                     আশা রাখি খুব ভালো আছো। তোমার ঠিকানা পাল্টে গেলেও ঘটনাচক্রে আমরা এখন এক শহরে। একটা সংবাদপত্রে এখন আমি প্রুফ দেখার কাজ করছি। তুমি ঠিকই বলেছিলে কবিতা লিখে কি হবে। তাই কাজ করেই এখন আমার সংসার চলছে। সংসার বলতে মা আর আমিই এখন। কলেজের থার্ড ইয়ারের পরীক্ষা শেষ হয়ে যাওয়ার পর বাবা চলে গেলেন, সংসারের সব দায়িত্ব আমার ওপর এসে পড়ল। প্রায় ৬মাস কলকাতা পড়ে থেকে কাজটা পেলাম। ও তোমারও তো নতুন সংসার এখন। রিয়ার কাছে শুনলাম তুমি বিয়ে করেছ। বর ভালো চাকরী করে, সুখে আছো খুব বেশ ভালো লাগলো শুনে জানো তো জীবনে বেঁচে থাকা আর ভালো থাকার মধ্যে বড় প্রার্থক্য আছে। আচ্ছা তুমি কি আমাকে বেমালুম ভুলে গেলে নাকি গো। বিয়ের খবরটা তো দিতে পারতে। মা আমাকেও চাপ দেয় বিয়ে করার জন্যে, অনেক পাত্রীর ছবি দেখায় কিন্তু কারো মধ্যেই সেই সিমন্তিনি কে পাই না। শেষবার কলেজের সোশ্যালের দিন তোমার কাছে আমার কবিতার খাতাটা রাখতে দিয়েছিলাম। ইস খাতাটা যদি একটু উল্টে দেখতে ! দেখোনি জানি দেখলে ঠিক আমাকে প্রশ্ন করতে। তোমাকে মুখ ফুটে যদি মনের কথাগুলো বলতে পারতাম জীবনটা হয়তো অন্যরকম হত সিমন্তিনি। দেখো কথা বলতে বলতে ভুলেই গেছি একটা খুশির খবর আছে। আমার কবিতার বই বেরোচ্ছে সামনের বৈশাখে। সেটারই প্রথম কপিটা তোমায় পাঠালাম। সাথে আমার চিঠিটা। তুমিই তো বলেছিলে যেদিন আমার কবিতার বই বেরোবে সেদিন পড়বে আমার কবিতা। আসলে ফোনে আমি সব কথা ঠিক করে বলতেই পারতাম না। তুমি তো জানো তোমার কন্ঠ শুনলে আমার সব কেমন এলোমেলো হয়ে যায়। অনেকদিন ধরে কবিতা লিখি না। আচ্ছা আবার যদি আমি কবিতা লিখি তুমি পড়বে তো এবার সিমন্তিনি ???? ভালো থেকো।

                                                                         ইতি- কিংশুক

(সিমন্তিনির বর্তমান ঠিকানায় চিঠি পৌঁছে গেল প্রায় দু’মাস পরে।)


পর্ব- ২

(কেটে গেল কয়েক মাস...)

আমার চার ফর্মার বই এর জন্য আরো একটি কবিতা লেখা সম্পন্ন হল। আমার প্রথম কবিতার বইটির অভাবনীয় সাফল্যের পর প্রকাশনী কতৃপক্ষ অনুরোধ করেছে আরো একটি বই লেখার জন্য। আমার দ্বিতীয় কবিতার বইটি সামনের বছর কলকাতা বইমেলায় প্রকাশ করার তোরজোর শুরু করেছে প্রকাশনী।

আমি শুধু একটু সময় নিতে চেয়েছিলাম। প্রকাশকবাবু তাতেও রাজি।।

আজকের কবিতাটা পাঠাতে হবে সিমন্তিনি-কে।

সিমন্তিনি কে এখন প্রায়শই আমার লেখা কবিতা পাঠাই। পাঠানোর মাধ্যমটা অবশ্য এখন পাল্টে গেছে। হোয়াটস আপ-এ ওকে লিখে পাঠাই কবিতা, কখনো বা ডায়েরি থেকে ছবি তুলে। পুরোটা খুঁটিয়ে পড়ে মতামত জানায়। সবথেকে অবাক হয়ে যাই এটা ভেবে যে মেয়েটা একসময় আমার কবিতাকে পাত্তা দিত না সে এখন আমার লেখার সমালোচনা করে, সাথে কোন শব্দ কেন ব্যবহার করলাম তার আবার চুলচেরা বিশ্লেষণ। ভাবা যায়...

(কিছুদিন পর...)

একদিন সকালে প্রকাশকবাবুর কাছে খবর পেলাম আমার দ্বিতীয় বই এর কাজ খুব শীঘ্রই শুরু হবে। পাণ্ডুলিপি জমা করতে হবে কিছুদিনের মধ্যেই।

ঘটনা হল যত ফর্মার বই হবে তাতে একটা কবিতা এখনো লেখা বাকি....

আসলে কবিতা তো আর হাতের নাড়ু নয় যে শুধু বসে গেলাম আর হাতের তালুতে বানিয়ে ফেললাম। কবিতা আসে হঠাৎ, তখন তার ডাক ফেরানো যায় না। হয়তো মাঝরাতের ঝড়ো হাওয়া বা রৌদ্র তপ্ত দুপুর তখন ভীষণ কবিতা পায়....

গড়গড় করে পেন আঁচড় কেটে যায় সাদা কাগজে। এই কাব্যগ্রন্থের শেষ কবিতাটাও হয়তো আসবে তেমন করেই...

 

অনেকদিন হয়ে গেল সিমন্তিনির সাথে কথা হয় না। শেষ যেবার কথা হয়েছিল শুনেছিলাম ওরা দিল্লি চলে যাচ্ছে। ওর হাসবেন্ড এর বদলির চাকরি।

আসলে মাঝে সিমন্তিনির সাথে কথা বলার অভ্যাসটা খুব কষ্টকর হয়ে উঠেছে এখন। যতই হোক ও তো আর এখন কলেজের সেই বাচ্চা মেয়েটি নেই। বিয়ে হয়েছে, সংসার হয়েছে। আমি সেখানে শুধুমাত্র একজন তৃতীয় ব্যক্তি...। আমি শুধু অবাক হয়ে গেছিলাম যে এত মন দিয়ে আমার কবিতা পড়া শুরু করেছে বলে...

অবাক হওয়ার বোধহয় তখনো অনেক বাকি ছিল...হঠাৎ একদিন সিমন্তিনির একটা চিঠি আমাকে চমকে দিল...কোন দেরি না করেই চিঠির খামটা খুলে ফেললাম....

 

সিমন্তিনির লিখেছে-

প্রিয় কিংশুক...

কি কেমন আছো বলো। জানি এটাই ভাবছো যে এতদিন কোন খোঁজ নেইনি এখন আবার এই চিঠি...

আসলে কি বলতো জীবনের কিছু অন্ধকার দিন আসে যা সমস্ত আলোকে ঢেকে ফেলার চেষ্টা করে। কিন্তু তখন আলোর রোশনাই সব পাল্টে দেয়। জীবনকে আবার আলোকিত করে তোলে। আমার জীবনে সেটা তুমি আর তোমার কবিতা। সবাই হয়তো সমান ভাবে সংসারটা করতে পারে না। ওই নাটকের মূল চরিত্রে না থাকতে পারলে নাটক শেষ হওয়ার আগেই যেমন মঞ্চ থেকে নেমে যেতে হয় ঠিক তাই। সবাই মূল চরিত্রে থাকতে পারে না।

যাক সেসব কথা তোমাকে একটা দায়িত্ব দেবো। আমি একটু আধটু কবিতা লেখার চেষ্টা করি ওই সবই আপনার অনুপ্রেরণায়। এই কটা লাইন লিখেছি। কিন্তু শেষ করতে পারছি না জানো। তুমি প্লিজ শেষ করে আমাকে দেবে।

........

.....(দেখলাম ও একটা কবিতা লিখে পাঠিয়েছে...)

........

এত কিছু ফোনে বলা যেতে না তাই এই চিঠির আশ্রয় নিতে হল।

                                                                   ইতি- সিমন্তিনি

 

বিষয়টা আমি কিছুতেই বিশ্বাস করে উঠতে পারছিলাম না। এই প্রথম সিমন্তিনি আমাকে কবিতা লিখতে বলেছে। যে কিনা কলেজে আমার লেখা কবিতা পড়তে চাইতো না সে আমাকে নির্দেশ দিয়েছে কবিতা লিখতে। আজ কিছু নয় নিজের কাছে নিজেরই পাহাড় প্রমান প্রত্যাশার চাপ গড়ে উঠেছে।

কয়েক সপ্তাহ কেটে গেল এভাবেই...

কিছুতেই কবিতা আসছে না...

 

(কিছুদিন পর...)

একদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে গত রাতে সিমন্তিনির একটা মেসেজ এ চোখ পড়লো...

সিমন্তিনির লিখেছে-

নাটক শেষ হওয়ার আগেই মঞ্চ থেকে বিদায় নিতে হচ্ছে। অনেকদূরে চলে যাচ্ছি। আর দেখা হবে না, ভালো থেকো।

আমি পাল্টা লিখলাম এর মানে কি সিমন্তিনি... কোথায় যাচ্ছ তুমি ?

কোন রিপ্লাই পেলাম না বলে ফোন করলাম, কিন্তু ফোনও সুইচ অফ বলছে...

চিন্তায় পড়ে গেলাম...

সেদিন বিকেলবেলা রিয়ার কাছে খবরটা পেলাম... সিমন্তিনি কমিটেড সুইসাইড !!!

এত সহজে হার মেনে নিলে সিমন্তিনি, কি দেখলে জীবনটাকে, এই বোকামীটা কেন করলে তুমি...??

কেন এভাবে পালিয়ে গেল আমার থেকে...!?

 

কিছুদিন পর হঠাৎ আমার কলমে কবিতা এলো...

আমার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ সিমন্তিনি পাণ্ডুলিপির শেষ কবিতা তোলা থাক... সিমন্তিনি আর আমার কলমে...

 

আমার জীবন কবিতার অন্ত্যমিলে, জীবন গানের প্রতিটি সুরে...

আছো তুমি...

রৌদ্র ঘেষা ছায়ার নীড়ে...

আমার জীবনের মূল চরিত্রে...

আজও তুমি...

সিমন্তিনি...


(সমাপ্ত)

নিবেদনে- পথিকৃৎ ফিল্মস 

Dec 7, 2020

"অমিলে" - পহেলী পাল

Edit Posted by with No comments

 


অমিলে

পহেলী পাল

 

তুমি ভীষণ একঘেঁয়ে গান গাও

নিয়ম মেনে রুটিনমাফিক চল,

আমি পেয়েছি বাঁধনহারার স্বাদ

কাটা ঘুড়ি, কী আর করি বল।

 

তুমি একটু অদ্ভুতুরে, কেমন যেন

কোন কথায় কাব‍্যি তোমার নেই,

আমার কিন্তু পাগল পাগল দশা

ছোট্ট ঘর, ছন্দ তালেতেই।

 

তুমি আবার পরিপাটি, খুব গোছানো

আমার তো সব ভাবনাগুলোও ছন্নছাড়া,

তোমার মনে ইচ্ছে আসে কড়া নেড়ে

আমি সবেতেই মিশে যাই, আত্মহারা।

 

জীবন আমার খোলা উপন্যাস

খুবই সহজ, কাঁচা হাতের লেখা

তোমার মনের গোপন তালা চাবির

আদৌ কি কেউ পায় কখনো দেখা ?

 

হয়তো স্মৃতি কঠিন অতীতমাখা

আগামী তাই দেখো শক্ত চোখে,

আমার শুধু আজেই বাঁচা মরা

হাসা কাঁদা সবই হুজুক, ঝোঁকে।

 

তুমি তীব্র বাস্তবতায় জ্বলো

লালচে ঠোঁট, রক্তাক্ত শব্দরাশি

আমার নদীর ব‍্যস্ত গতিপথ

আমি আবার একটু ওই

আবেগ টাবেগে ভাসি।

 


Dec 6, 2020

নেট ফড়িং সংখ্যা- ১৭০

Edit Posted by with No comments

Dec 5, 2020

"বড়োদেবীর সেকাল থেকে একাল' - পার্থ দেব (পাপান)

Edit Posted by with No comments

 


বড়োদেবীর সেকাল থেকে একাল

পার্থ দেব (পাপান)

 

কোচবিহার রাজ্যের সূচনাকাল থেকেই দুর্গাপূজার বিষয়ে তথ্য পেয়ে থাকি। এই রাজ্যে প্রথম পূজা বিষয়ে কাহিনীটি বিশেষ প্রচলিত। "রাজোপাখ্যান" মতে দেখা যায় যে বিশ্বসিংহের যখন বয়স মাত্র ন বছর সেই সময় বিশু, শিশু, চন্দন, মদন চার ভাই সহ অন্যান্য তেরো জন বালক একত্রে খেলাধুলা করছিলেন, খেলাচ্ছলে শুকনো বাঁশের কঞ্চি এবং বিশুর হাতে থাকা শুকনো ময়না গাছের ডাল একত্র করে একস্থানে পুঁতে দিয়ে দেবী দুর্গা কল্পনা করে বনফুল এবং ফল ইত্যাদি এনে ভগবতীর পূজা করতে লাগলেন। সঙ্গীদের মধ্যে কেউ-কেউ নৃত্য, গান আরম্ভ করলেন। এই আনন্দময় মুহুর্তে দেবীর কাছে বলির কথা চিন্তা করে এক বালককে শিশু কল্পিত যূপ কাঠের পাঁঠার ন্যায় ধরলে ও বিশু কুশের খড়গ দিয়ে "ভগবতী বলি গ্রহণ করো" এই বলে আঘাত করা মাত্রই সত্যি সত্যিই সেই বালকটির শিরচ্ছেদ হয়ে রক্ত বইতে আরম্ভ করলো। এই ঘটনা দেখে সবাই আশ্চর্যান্বিত হলো। বিশু তৎক্ষণাৎ ঐ ছিন্ন শির আপন মস্তকে ধারণ করে ভক্তি ভরে ভগবতীর সন্মুখে দিলেন। অন্যান্য বালকগণ বিশু-শিশু এক বালককে হত্যা করেছে বলে চিৎকার করতে করতে পালিয়ে গেলো, এসব দেখে বিশু ও শিশু গভীর বনপথে চলে যায়। পথ চলতে চলতে পরিশ্রান্ত ভাতৃদ্বয় বনমধ্যে নিদ্রাচ্ছন্ন গেলে বিশু স্বপ্নাদিষ্ট হন দেবী তার পূজায় সন্তুষ্ট। তাদের আর কোনও ভয় নেই, দেবী ভগবতী বিশু-শিশুকে অভয় প্রদান করে বলেন যে স্থানে তোমরা পূজো করেছো সেস্থানে গিয়ে দেখবে আমার কৃপায় বাঁশের কঞ্চি এবং ময়না কাঠ নতুন পাতায় সুশোভিত হয়েছে তৎসহ এ স্থানে তোমরা আমার হাতের কঙ্কন ও তীক্ষ্ণ খড়গ পাবে, এমন ভাবেই ভগবতী তাদের আশীর্বাদ দিয়েছেন। এই ঘটনাকে অনেকেই কোচবিহারের প্রথম দুর্গাপূজা বলে মনে করেন। জয়নাথ মুন্সীর রাজোপাখ্যানে দেবী পূজার কথা বলা থাকলেও দেবী প্রতিমার কথা নেই। অনেকে মনে করেন বর্তমানে মদনমোহন বাড়ীতে ভবানী মন্দিরে রূপোর সিংহাসনে যে অষ্টধাতুর ভবানী দেবীর বিগ্ৰহটি আছেন তা মহারাজা হরেন্দ্র নারায়ণের রাজত্বকালে নির্মিত এবং প্রতিষ্ঠিত। কোচবিহারের রাজাদের স্বপ্নে প্রাপ্ত রূপ সেখানে ফুটে উঠেছে। বর্তমানে দেবীবাড়ীতে এই আদলেই প্রতি বছর দেবী প্রতিমা তৈরী করে বার্ষিক পূজার ব্যবস্থা করা হয় আর মদনমোহন বাড়ীতে ভবানী মন্দিরে ছোট ভবানী বিগ্ৰহের নিত্য পূজার ব্যবস্থা রয়েছে। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এই মূর্তির নীচেই রয়েছে কালো পাথরের একটি মূর্তি আকারে ছোট, অনেকের মতে অরণ্যে আত্মগোপনকালে দশভূজা দেবী খোদিত এই প্রস্তর বিগ্ৰহটি কুড়িয়ে পান। এই মূর্তিটিকে "পাট পার্ব্বতী" বলেন।

কোচবিহারে দেবী পূজার বিষয়ে আর একটি মত হলো ময়না কাঠকে দেবী কল্পনা করে বিশু সর্বপ্রথম পূজা করেন,সেই থেকেই ময়না কাঠে দেবীর অবস্থান কল্পনা করে পূজায় ময়না কাঠের শক্তি গোজ নিয়মিত ব্যবহার করা হয়।

কোচবিহারে দেবী তত্ত্ব বিষয়ে আরও একটি ঘটনা উল্লেখ করতে চাই মহারাজা নরনারায়ণের রাজত্বকালে বীর সেনাপতি ভাই শুক্লধ্বজের (চিলারায়) সহায়তায় রাজ্যসীমা ক্রমশ বেড়েই চলেছেন। মহারাজা পরম সুখে রাজত্ব করছেন। এমন সময় একদিন শুক্লধ্বজের ভাবলেন যে রাজ্য শাসন আমি করি,যুদ্ধ উপস্থিত হলে আমি যুদ্ধ করি, সকল আমার অধীন। নরনারায়ণ নামমাত্র রাজা, আমি তাকে বিনষ্ট করে নিজে রাজা হবো। এরূপ চিন্তা করে উন্মুক্ত তীক্ষ্ণ তরবারি হাতে করে রাতের অন্ধকারে নরনারায়ণের শয়ন কক্ষে প্রবেশ করে দেখলেন যে মহিষীর হাত রাজার কাঁধের ওপরে রয়েছে। এমন অবস্থায় রাজার মুন্ড ছেদনের সাহস না করে রেগে ঘর থেকে বেড়িয়ে যান। ভগবতীর ইচ্ছেতে সবকিছু হয়। প্রথমবার ব্যর্থ হলেও শুক্লধ্বজ পুনরায় একদিন মহারাজ অমাত্যবর্গের সঙ্গে সভা করছেন শুনে ভাইয়ের শিরচ্ছেদ করার মানসে খড়গ হাতে সভা মাঝে প্রবেশ করে সিংহাসনের দিকে এগিয়ে যান এবং দেখতে পান যে স্বয়ং ভগবতী দশভূজা রূপে 'চাক বালিশে' বসে নরনারায়ণকে ক্রোড়ে ধারণ পূর্ব্বক দশহাত দিয়ে তার দেহ আবৃত করে রেখেছেন। এহেন অদৃষ্ট পূর্ব্ব দৃশ্য কেবলমাত্র শুক্লধ্বজ দেখেন ও কান্নার সুরে বলতে থাকেন- আমি দুর্ভাগ্যযুক্ত, যাকে জগত জননী রক্ষা করেন তাকে কে হত্যা করতে পারেন এতো সাহস কার আছেন ! তবুও আমি নির্বুদ্ধিতায় শুধুমাত্র দ্বেষ ও লোভের বশে নিকৃষ্টতম অপরাধ করেছি যা আমার উচিত হয়নি। মহারাজ আমাকে ক্ষমা করুন। মহারাজ তার ভাইকে নানা প্রবোধ বাক্যে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগলেন, শুক্লধ্বজ দুঃখে অভিভূত হয়ে বলতে লাগলেন- "আমি অতিশয় অপরাধী-দুর্মতি, প্রথমতঃ জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা, দ্বিতীয়তঃ মহারাজা, তৃতীয়তঃ যাকে স্বয়ং ভগবতী ক্রোড়ে করে রক্ষা করেন আর আমি তাকে হত্যার বাসনা করেছি, আমার কি উপায় হবে এখন!" এই কথা শুনে সকলে চমৎকৃত হলেন। মহারাজ নরনারায়ণের চক্ষু থেকে অবিরল ধারা বইতে লাগলো, চোখের জলে বুক ভিজে গেলে তিনি ভাইকে সম্বোধন করে বলতে লাগলেন- "তুমি রাজ্যাভিলাষী হয়েছ, তুমি বৃহৎ রাজ্য ভোগ করবে, আমি তোমাকে বৃহৎ রাজ্য প্রদান করবো। তুমি বড়ো ভাগ্যবান, ভগবতী মাতাকে চাক্ষুষ দর্শন করেছো, আমি অতিশয় কুকর্ম্মকারি, নতুবা আমি তার ক্রোড়ে বসেও তার দর্শন বা তার উপস্থিতি অনুভব করতে পারলাম না। যার কঠোর সাধনা, পূজো-পাঠ, যাগ-যোগ দ্বারা সাধক, যোগী, মহাত্মা দর্শন পান না, তিনি তোমার চক্ষুগোচর হলো। অতএব তোমার চাইতে ভাগ্যবান অন্য কেউ নয়।

মহারাজ এ প্রকার অনেক আক্ষেপ করে নিভৃত স্থানে তিনদিন অনাহারে ছিলেন, রাত্রে স্বপ্নযোগে ভগবতী আবির্ভূতা হয়ে বলেন- ওঠো বৎসঃ, জগৎ সংসার আমার যে মহিষাসুরমর্দ্দিনীরূপ পূজা করে তা তুমি প্রত্যক্ষ করো। শরৎকালে তুমি এই মূর্তি নির্ম্মাণ করে যথাবিধি পূজা করবে। রাজা চক্ষুরুন্মীলন করে ভগবতীর সেই রূপ দর্শন করে পুনঃ পুনঃ প্রনাম ও স্তব-স্তুতি করতে লাগলেন। পরে সবিনয় ভগবতীর নিকট দুটি নিবেদন করলেন- প্রথম নিবেদন করলেন জগৎ মাতা তোমার যে মহিষাসুরমর্দ্দিনী রূপ আছে তাতে মহিষাসুরের দক্ষিণ হস্তে সিংহ দন্তাঘাত করে আছেন কিন্তু তার বাম হস্ত শূন্য রয়েছেন। ভগবতী তখন মৃদু হেসে বললেন ঐ স্থানে তবে একটি ব্যাঘ্র দিও। দ্বিতীয় নিবেদন করলেন ভগবতীর অতসী কুসুমাকার গাত্র বর্ণ দেখে বললেন জগৎ জননী আপনার গাত্র বর্ণ রক্ত বর্ণ হলে ভালো হয় তখন দেবী তাতেও সন্তুষ্টি বিধান করলেন।

এমনভাবে মহারাজা নরনারায়ণ দ্বারা শরৎকালে দেবীর পূজা আরম্ভ হয়।

গন্ধর্ব্বনারায়ণের বংশাবলী, ৪৩-৪৪ পত্র থেকে এই প্রতিমার বর্ণনা, গঠন বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি তুলে ধরা হয়েছেন এরূপ

দশখান বাহু বক্রু হয় একখান। তিন গোটা চক্ষু আতি দেখিতে সুঠান।।

যুবতীর বেশ শোভে অলঙ্কারগণ। সিংহের উপরত আছে দক্ষিণ চরণ।।

মহিষ পৃষ্ঠত বাম চরণ থাপিলা। মহিষর কাটা গলে পুরুষ জন্মিলা।।

দৃঢ় মুষ্ঠি পুরুষর কেশত ধরিলা। দক্ষ হস্তে হৃদয়ত ত্রিশূল ভেদিলা।।

বামহস্তে অসুরর ব্যাঘ্রে কামোরিলা। দন্তে নিকোটায়া দুষ্টে প্রাণক ছাড়িলা।।

চক্ষু ঢেল করি দুষ্টে রুধিরে ছাদিলা। দশখান অস্ত্র দশ হস্তত ধরিলা।।

শূল খড়গ শর শক্তি চক্র দক্ষিণত। বামহস্ত সব যে ধরিছে হেন মত।।

পাশ যে খেটুক ধনু পরশু অঙ্কুশ। দেখি হরপুত্র পাইল পরম সন্তোষ।।

(সূত্রঃ কোচবিহার ইতিহাস, পৃষ্ঠা-৮৬, আমানতউল্লা আহমেদ।)

ভগবতীর আজ্ঞানুসারে মহারাজ শ্রাবণ মাসের শুক্লাষ্টমী তিথিতে রাজার হাতে 'ন' মুট পরিমাণ মদন বা ময়না কাঠের শাখা "শক্তিদণ্ড" কর্তন করে যত্ন পূর্ব্বক ঘরে আনলেন। এই অনুষ্ঠানকে "যুপচ্ছেদ" বলে। প্রতি অষ্টমীতে কনকোৎসব ও ধর্ম্মগ্রন্থাদি পাঠের ব্যবস্থা আছে। ভাদ্রের শুক্লাষ্টমী যোগে শক্তিদণ্ড পাটস্থিত করায় তাকে "ধর্ম্মপাঠ" বলে।আশ্বিনী শুক্লা দ্বিতীয়াতে শক্তি নির্ম্মিত ভগবতী দর্শন তথা সওগাত প্রদানকে "দেওদেখা" বলে। ঈশ্বরীয় ঘরের পূর্ব কিছু উত্তর বস্ত্রাচ্ছাদিত স্তম্ভ তা নৃপতির কর্ণ প্রমাণ কান সেবাইত বর্তমানে তা কাম সেবাইত নামে পরিচিত। মহারাজা নরনারায়ণ প্রতিবছর মৃৎশিল্পীর দ্বারা মূর্তি নির্ম্মাণ করতঃ লক্ষাহুতি হোম পূজা আরম্ভ করলেন। এমনিভাবে স্বপ্নদর্শন রূপে প্রাপ্ত ভগবতীর শারদীয়া পূজা আরম্ভ হন। এই পুরো পূজা পদ্ধতি পুথিখানি 'দেবানন্দ' কর্তৃক লিখিত আছেন।

দেবীর রং টকটকে লাল। সেই প্রাচীন পদ্ধতিকে অবলম্বন করেই দেবীর রূপসজ্জার ব্যবস্থা হয়ে থাকে। দেবীর দুপাশে কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী নেই। এদের পরিবর্তে রয়েছেন দেবীর সখীদ্বয় জয়া বিজয়া। পূর্বে কাঠের পাটাতনের উপর ও বর্তমানে দেবী বাড়ির পাকা মন্দিরে (১৯১৫-১৬আর্থিক বর্ষে নির্ম্মিত) পূজা হয়ে থাকেন। এই উপলক্ষে দেবী বাড়িতে একটি মেলাও বসে। অষ্টমীর দিন মোষবলি একটি আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান, এই প্রথা অন্যান্য বলির চাইতে কষ্টকর। এই মহাপূজায় "গুপ্ত পূজা" এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, পূর্বে নরবলির কথা শোনা গেলেও বর্তমানে তার অনুকরণে এক বিশেষ পরিবারের ব্যাক্তির দ্বারা রক্তদান করে তা বিশেষ পূজো ও পদ্ধতির দ্বারা দেবীকে উৎসর্গ করা হয়ে থাকেন। এছাড়াও নিশাপূজা, সন্ধি পূজা, চালিয়াবাড়িয়া পূজা ও দণ্ডপূজা প্রভৃতি এই পূজার অভিন্ন অংশ।

 বিজয়া দশমীর দিন রাজপ্রাসাদে পূর্ব্বে 'আড়ম্বর' অনুষ্ঠান হত। সেই অনুষ্ঠানে একটি খঞ্জন পাখি উড়িয়ে দেওয়া হত। যেদিকে সে পাখি উড়ে যাবে সেই দিকটি বিজয় পথ হবে বলে কল্পনা করা হত এছাড়াও তার ডানা ও দীর্ঘ লেজের ওড়ান দেখে রাজ্যের ভবিষ্যৎ গণনা হতেন যা এখন অতীত পরবর্তীতে সে প্রথা মহারাজ জগদ্দীপেন্দ্রনারায়ণের সময়কাল থেকে বন্ধ হয়ে যায়। তাছাড়া বড়োদেবী মন্দিরের পেছনে একটি ঘর রয়েছে যা সিংহাসন ঘর নামে পরিচিত পূর্বে এই ঘরে রাজমহল থেকে মহারাজের সিংহাসন এনে রাখা হত ও সর্ব্বসাধারণের দেখার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হতো। দশমী স্মরণীয় করার জন্য মাহীশূরের দশেরার মতো রাজকীয় শোভাযাত্রা চলতো। রাজামলে নিরঞ্জনের দিন মদনমোহন বাড়ী থেকে প্রতিমা আসতো দেবীবাড়ীতে তৎসহ হাতির পীঠে আসতো লক্ষ্মীনারায়ণের বিগ্ৰহ। শুরুতে থাকত সুসজ্জিত পাটহাতি এরপর অন্যান্য হাতির দল। রাজকীয় পোশাকে ব্যান্ডের বিরাট দল, সেনাবাহিনী, পুলিশ ও নারায়ণী গার্ড। শোভাযাত্রায় রাজপ্রতীক বহন করা হত। সেই শোভাযাত্রা বড়োদেবী বিগ্ৰহ সহ সাগরদিঘীর তিনদিক পরিক্রমা করে শোভাযাত্রা দক্ষিণে কেশব আশ্রম হয়ে পৌছৈ যেতো তোর্সা নদীর তীরে। সেখানেই দেবী বিসর্জন হত। দশমীর দিন ঘাটে বিসর্জনের পূ্র্বে ঘাটে বিশেষ পূজা হয়, এরূপ নিয়মবিধি আর কোথাও আছে কিনা সন্দেহজনক।

আজ আর রাজা নেই, রাজত্বও নেই সেকালের রাজ্য আজ পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলায় রূপান্তরিত হয়েছে। স্বাভাবিক কারণেই পূজার আড়ম্বর অনেক কমে এসেছে। এখন সরকারী অনুদানের ওপর নির্ভর করে সেদিনের রাজসূয় যজ্ঞ এখনও গুরুত্ব সহকারে পালন করা হচ্ছেন। আজকের দিনে কোচবিহারবাসীর মনের সঙ্গে এই দেবী দুর্গাও স্মরনীয় হয়ে আছেন বড়ো দেবী রূপে।

তথ্য সূত্র:-

১) কোচবিহারের ইতিহাস-খাঁ চৌধুরী আমানতউল্লা আহমেদ।

২) রাজোপাখ্যান-মুন্সী জয়নাথ ঘোষ।

৩) স্বর্গীয় অমিয় কুমার দেববক্সী (দুয়ারবক্সী)

৪) ঐতিহাসিক ডঃ নৃপেন্দ্রনাথ পাল।

৫) সাংবাদিক দেবব্রত চাকী।

৬) বিবিধ পত্র-পত্রিকা।


(ছবি- সৌজন্যে লেখক)