Sep 27, 2020

নেট ফড়িং সংখ্যা- ১৬০

Edit Posted by with No comments

Sep 20, 2020

নেট ফড়িং সংখ্যা- ১৫৯

Edit Posted by with 4 comments

Sep 15, 2020

"পল্লবী" - রাজর্ষি পাল

Edit Posted by with 1 comment

 


পল্লবী

রাজর্ষি পাল

 

আজও উঠতে দেরি হল পলাশের। ঘড়ির কাটা ১১টা ছুঁয়েছে। একটা ঝাঁকুনি তে ঘুম ভাঙল ওর। কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছিল বোধহয়। কোনোমতে বিছানায় উঠে বসে ভাবার চেষ্টা করল কি দেখেছে। শুধু নীল একটা শাড়ি আর একটা নাম মনে পড়লো, ‘প’ দিয়ে কিছু একটা। হয়তো তারই নাম হবে। আধখোলা চোখ নিয়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ দেওয়ালের দুটি পাশ যেখানে এসে মিশেছে সেই সরলরেখায়। শরীরের একরাশ ক্লান্তি ও দুর্বলতার ছাপ যেন কিছুতেই যাচ্ছেনা তার। কোনোমতে নিজেকে টেনে টেনে বাথরুমে নিয়ে ফেলল। ১টায় ডাক্তারের appointment, যেনতেন ভাবে স্নানটা সেরে নিল। খিদে ভাবটা অব্দি নেই। পলাশের সবকিছু যেন একটা বিরক্তিকর পুনরাবৃত্তি মনে হচ্ছে। কয়দিন এভাবে অসুস্থ সে, তাও ঠিক ঠাওর করতে পারছে না পলাশ। বাথরুম থেকে বেড়িয়ে নড়বড়ে পায়ে বিছানার কোনায় ঝুলন্ত জামা টেনে নিয়ে পড়তে লাগল সে। কলারের বোতামটা লাগাতে গিয়ে, বুকের কাছে ভেজা ভেজা কি একটা মনে হলো। তাকিয়ে দেখে লাল রঙের একটা দাগ বুকপকেটে। কিসের কিছুতেই মনে করতে পারলো না। কোথায় গিয়েছিল জামাটা পড়ে, অনেক চেষ্টা করেও মনে পড়ল না। কিন্তু পাল্টানোর সময় নেই আর। তাড়াতাড়ি তৈরি হয় নিলো জুতো পরে। ঘড়িটা কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছে না। এদিকে ওদিক তাকিয়েও পেলো না। বিছানার মধ্যেও হাতড়িয়ে দেখলো। না, সেখানেও নেই। শেষমেশ টেবিলে ডায়েরির ফাঁকে পেল। ঘড়িটা বের করতে গিয়ে লক্ষ্য করলো কিছু একটা লেখা আছে শেষ পৃষ্ঠাটায়। কিন্তু তাকিয়ে দেখার ইচ্ছেটুকু আর নেই। ঘড়িটা হাত পড়ে দেখে বন্ধ হয়ে আছে। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো পলাশের। এখন উপায় নেই এটাই পরা ছাড়া। তাড়াতাড়ি বেড়তে হবে।

ভিড়ের বাসে কোনোরকমে চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে, ধাক্কাধাক্কি করে নামল পলাশ। কিন্তু এসবের প্রতি ভ্রুক্ষেপ নেই আর পলাশের।

বাস স্টপের মোড় থেকে বাড়ির দিকে একটা ঘোরের মধ্যে হাটতে লাগল। ব্যাগের খোলা চেন থেকে রিপোর্ট এর অর্ধেক বেরিয়ে রয়েছে। তীব্র রোদের মধ্যে একটা অটো নেওয়ার কথাও যেন মনের নেই তার। এপার্টমেন্টের এর গেট দিয়ে ঢুকেই সামনের বেঞ্চটায় গিয়ে বসল পলাশ। রোদের তাপে গরম হয়ে আছে বেঞ্চ। ভাদ্রের দুপুরে ভ্যাপসা গরম হাওয়া বইছে। কিন্তু কিছুতেই যেন কোনো মন নেই পলাশের। হঠাৎ দূর থেকে কথা কাটাকাটির আওয়াজ কানে এলো পলাশের। একরাশ বিরক্তি নিয়ে ঘুরে তাকালো পলাশ। গেটের ওখানে ওয়াচম্যান কোনো এক মহিলার সাথে তর্ক করছে। মহিলাটি বারবার তার দিকেই আঙ্গুল তুলে কি বলছে। একটু অবাক হলো পলাশ। ওয়াচম্যান এবার তার দিকে এগিয়ে এসে বলল মহিলাটি নাকি তার সাথে দেখা করতে চাইছে, কিন্তু এন্ট্রি রেজিস্টার এ নাম ঠিকানা দিতে তার আপত্তি।

এবার ভালোমতো ফিরে দেখল মহিলাটির দিকে পলাশ। নীল রঙের একটি শাড়ী পরিহিতা, হলুদ রঙের ব্লাউজ, ছোট করে কাটা চুল, বয়েস তিরিশের কোঠায় হবে। ওয়াচম্যান বলছে তাকে গেটে গিয়েই কথা বলে আসতে। এখন বিরক্তির জায়গায় একরাশ কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে গেল পলাশ। ব্যাগটা বেঞ্চেই রেখে এগোলো। কাছে যেতেই এক অদ্ভুত হাসি নিয়ে মেয়েটা জিজ্ঞেস করল, "আপনিই কি পলাশ বাবু ?"

-হ্যাঁ। আমিই। বলুন কি দরকার ?

-আমি বাসে আপনার পেছনে ছিলাম। আপনার ব্যাগ এর চেনটা খোলা ছিল। নামার সময় পরে গেছে একটা envelope, ভিড়ের মধ্যে ডাকলেও শুনতে পাননি। ওটাই দিতে এলাম।

কিছুটা হুস ফিরল এবার পলাশের। এতটা অন্যমনস্ক হওয়া ঠিক হয়নি। এভাবে রিপোর্টগুলো হারিয়ে গেলে কি হতো কে জানে।

-এই নিন, আপনার খাম। ওপরে আপনার ঠিকানা দেখে চলে এলাম।

খামটা হাতে নিয়ে আড়চোখে একবার দেখল পলাশ যে বন্ধ রয়েছে মুখটা। মেয়েটা এবার চলে যেতে উদ্যত হল। পলাশ ভাবল এই রোদের মধ্যে এতদূর এসেছে মেয়েটা। একবার বাড়িতে না ডাকলে খারাপ দেখাবে।

-বলছি, এত কষ্ট করে এতদূর এলেন। একবার আসুন আমার ফ্ল্যাটে। অনেক ধন্যবাদ ফেরত দেওয়ার জন্য এটা।

-না না সেসবের প্রয়োজন নেই। তবে একটু জল অবশ্যই দিতে পারেন। অটো না পেয়ে হেটে এলাম তো তাই।

ওয়াচম্যান-কে ইশারায় গেট খুলতে বললো পলাশ।

-বলছি আমার নামটা তো জেনেই গেছেন। আপনার নামটা তো জানাই হল না।

-আমার নাম পল্লবী।

বেঞ্চের দিকে এগিয়ে গেলো পলাশ। ব্যাগটা নিতে।

-বলছি যে, আপনি কি ডক্টর দেখতে গিয়েছিলেন। খামটায় রিপোর্ট মনে হলো। আসলে আমি একজন radiologist তাই আর কি কৌতূহল আটকাতে পারলাম না।

-হ্যাঁ। শরীরটা বিশেষ ভালো নেই কিছুদিন ধরে তাই।

এই বিষয়ে কথা ওঠাতে অস্বস্তি তে পড়লো পলাশ। তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেলো ব্যাগটা নিতে। ব্যাগটা হাতে নিয়ে ঘুরতেই পেছনে দেখল পল্লবী দাঁড়িয়ে। একটু হকচকিয়ে গেল এত কাছে একটা মেয়ে কে দাঁড়াতে দেখে।

-আমার জরুরি একটা ফোন কল এলো এখনই। বেরোতে হবে। আমার কার্ড দিয়ে যাচ্ছি। অসুবিধা হলে ফোন করবেন।

চকিতের মধ্যে পলাশের বুকপকেটে কি একটা গুঁজে দিয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল মেয়েটা। এতো দ্রুত সবকিছু ঘটলো যে কিছু ঠাহর করতে পারলোনা সে। গেট এর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো পলাশ। মেয়েটা হন্তদন্ত হয়ে গেট থেকে বাদিকে যেন দৌড়োচ্ছে। এতো তাড়াই যদি থাকবে তবে দিতেই বা এলো কেন। একবার ভাবলো ডাকবে, কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলো, চেনা নেই জানা নেই কি দরকার।

একটু ধাতস্থ হয়ে, বুকপকেটে হাত দিয়ে দেখল, একটা ঘিয়ে রঙের ভিজিটিং কার্ড। তাতে লাল কালি তে লেখা, পল্লবী। আর নীচে একটা যোগাযোগের নাম্বার। আরো অবাক হলো পলাশ। শুধু একটা নাম আর নম্বর। না আছে পদবি না আছে ঠিকানা। এমন আজব কার্ড সে আগে দেখেনি। মেয়েটার মতোই এটাও অদ্ভুত। ব্যাগ আর খামটা নিয়ে নিজের wing এর দিকে এগোলো পলাশ। হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়ল মেয়েটা আবার যাওয়ার সময় বলে গেল যে অসুবিধা হলে যোগাযোগ করতে। কিন্তু এরও কোনো মাথা মুন্ডু কিছু বুঝলো না সে। কেন সে তার সাথে যোগাযোগ করবে, যার নাম ছাড়া আর কিছুই সে জানে না। আর কি-ই বা অসুবিধা হবে। যা অসুবিধা সব তো নিজেই সামলাচ্ছে।

লিফ্টে উঠে ৭ এর বোতাম টিপল পলাশ। আরেকবার দেখার জন্য কার্ডটা বুকপকেট থেকে বের করলো। হঠাৎ বুকে হালকা একটা ব্যথা অনুবভ করলো। ঠিক ইঞ্জেকশন দিলে যেমন হয়। তাকিয়ে দেখে লাল দাগ যেখানে ছিল সকালে, সেটায় আঠা আঠা মতন। ব্যথা ক্রমশ বেড়েই চলছে। লিফ্ট থেমে দরজা খুলল। কোনোমতে ব্যাগটা নিয়ে বেরোলো পলাশ। ব্যথাটা এবার বুক থেকে গলা হয়ে মাথা অব্দি পৌঁছে গেছে। কোনদিকে তার ফ্ল্যাট সেটাও ঠিক করতে পারছে না পলাশ। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে। ঘেঁষতে ঘেঁষতে শরীরটা নিয়ে ঘরে ঢুকলো পলাশ। ব্যাগটা হাতে নেই আর। মাথা ব্যথায় ফেটে যাচ্ছে। পা থেকে যেন আগুন জ্বলছে। হাত-পা কিছুই আর অনুভব করতে পারছে না। কোনোমতে টেবিলের সামনে বসল। হঠাৎ মনে পড়লো পল্লবী মেয়েটার কথা। অসুবিধা হলে যোগাযোগ করতে বলেছিল। হাত দুটো কাঁপছে। কপাল পুড়ে যাচ্ছে। কার্ডটা বের করে জামাটা কোনোমতে খুলে, ছুঁড়ে ফেললো পলাশ। হাতে নিয়ে নাম্বারটা বোঝার চেষ্টা করল। কিন্তু চোখের সামনে সব ঝাপসা। বুঝলো ধরে রাখতে পারছে না কার্ডটা। সামনের ডায়েরির পাতায় তা খুলে, লেখার চেষ্টা করলো নাম্বারটা। কোনোমতে পল্লবী নামটা লিখলো। কিন্তু কপালের ঘাম পরে পাতা ভিজে যাচ্ছে। পাতা পাল্টাতে চাইল পলাশ। কিন্তু এ কি! চোখ প্রায় বন্ধ হয়ে আসছে তার। কিন্তু তার মধ্যেও শিরদাঁড়া দিয়ে যেন বিদ্যুৎপ্রবাহ ঘটে গেল তার। আগের প্রতিটা পাতাতেই মেয়েটার নাম লেখা। একদম শুরু থেকে শেষ অব্দি সবকটা পাতায় শুধু পল্লবী লেখা। জলের মতো কিছু পড়ে শুরুর দিকটা পড়া যাচ্ছে না। পাগল পাগল মনে হলো নিজেকে পলাশের। এও কি করে সম্ভব, সে তো ওই মেয়েটাকে আগে কখনো দেখেনি। তাহলে ওই মেয়েটার নাম তার ডায়েরিতে এলো কিভাবে। ওর মনে হল সকালের দুঃস্বপ্ন যেন এখনো কাটেনি। সাতসতেরো ভাবতে ভাবতে আধখোলা দরজার দিকে এগোতে চেষ্টা করল পলাশ। কিন্তু পারলো না। পড়ে গেল। এবার চোখ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে এলো তার। আর যেন কোনো ব্যাথাই অনুভব হচ্ছেনা। মনে হচ্ছে যেন জলের ওপর ভাসছে। কে যেন কানের কাছে বারবার বলছে "আমি পল্লবী"। পল্লবী, পল্লবী এই আওয়াজ শুনতে শুনতে এবার ঘুমাবে সে। শেষবারের মতো চোখ খোলার চেষ্টা করল। ভারী জুতোর শব্দ শুনতে পেল। টের পেল কে যেন দরজাটা বন্ধ করলো। আর কিছু মনে নেই পলাশের।

উঠতে আবার দেরি হলো পলাশের। ঘড়ির কাটা বলছে এগারোটা।


Sep 14, 2020

"নেক্সিটো প্লাস" - রণজিৎ পাণ্ডে

Edit Posted by with No comments

 


নেক্সিটো প্লাস

রণজিৎ পাণ্ডে

        

আজ অনুজদার বিবাহ বার্ষিকী, অনুজদা বেশ চিন্তিত। আমি বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করলাম, কি গো কী ভাবছ ? উত্তরে অনুজদা বলল, আর বলিস না ভাই ! এমনিতেই লকডাউনের বাজার, তোর বৌদিকে বলেছিলাম বিবাহ বার্ষিকীতে একটা মোবাইল সেট দেব। তেনার তো আবার স্যামসং এর গ্যালাক্সি জে-9 চাই, বাজারে মাছি পর্যন্ত উড়ছে না, কী যে করি !

-  ভাবছো কেন ? কিনে দেবে।

- তা কিনবে কি রে ভাই, যে কিনবে তারই তো অভাব। জানিস তো কোম্পানির চাকরি করি, লকডাউনে বন্ধ, বেতনও বন্ধ।

-তবে বৌদিকে বলো, এবারে দেওয়া হচ্ছে না।

অনুজদা বলেছিল, জ্যান্ত ? শোন এক কাজ কর, আমার সোনার আংটি-টা বেচে দিতে পারবি ? তাহলে বেশ উপকার হয়।

কেন তুমিও তো যে কোনো স্বর্ণকারদের কাছে বেচতে পারো।

-ও তুই বুঝবি না! সব কাজ সবার জন্য নয় রে, মানিস কিনা?

আমি অনুজদাকে মান্য করতাম বলে সোনার আংটিটি নিয়ে বেরিয়ে ছিলাম, তাতে যে ভালো কিছু ফল হয়েছে তা নয়, কারণ  লকডাউনে সব দোকানই বন্ধ ছিল।

অনুজদা সন্ধ্যায় যখন বাড়ি ফিরেছিল, অভ্যাস মতো মেয়েদের সোনা, মান্তু বলে আদরের নামেও ডাকেনি, মুখ ছিল সম্পূর্ণ  ফ্যাকাশে। বৌদি দেখেই জিজ্ঞেস করেছিল, কি গো শরীর খারাপ নাকি? অনুজদা বলেছিল, না না ওই মাথাটা একটু ধরেছে।  জানোই তো আমার মাইগ্রেন, বলে পকেট থেকে দু’টো ডেয়ারি মিল্ক চকলেট বের করে মেয়ে দুটোর হাতে দিয়ে সামনের চেয়ারে বসে পড়েছিল ধপ করে।

ছুটে এসে বৌদি বলল, কী হয়েছে তোমার, সত্যি করে বলো ?

অনুজদা বলছিল, তোমার মোবাইল সেট এবারে হচ্ছে না।

- তাতে কী হয়েছে ? সামনের-বার হবে। তা বলে তো বিবাহ বার্ষিকী আটকে থাকতে পারে না। আর পুচকুটাকে বোঝাও, আজ তোমার পাশেই শোবো।

অনুজদা লাফিয়ে উঠে বৌদিকে বলেছিল, শোনো আজ রাতে আর  নেক্সিটো প্লাস খাবার প্রয়োজন নেই।


"সুচেতনা" - শাহীন ইমতিয়াজ

Edit Posted by with No comments


 

সুচেতনা

শাহীন ইমতিয়াজ

 

কতদিন কবিতা লেখা হয়না সুচেতনা।

আমি ভুলে গেছি শেষবার তোমার খোঁপায় জুঁইফুল নাকি শিউলি ফুল ছিলো ! এবার দেখা হলে মনে করে ঘাসফুল খোঁপায় গুঁজে দেবো। কী বা আর দিতে পারি। দেওয়ার বলতে ওই সামান্য ফুল, গঙ্গা নদীর স্রোত, রাষ্ট্র আর একটি কবিতা। বাড়ির পাশের গাছটি, পা ভাঙা কুকুরটি, অনাথ শিশুটির কথা জানতে চাই।

প্রায় একটা দীর্ঘকায় চিঠি সমাপ্ত করলো সন্দীপ।

সন্দীপ সীমান্তের আর্মি। চারমাস হলো পাহাড়ে পোস্টিং পরেছে। ছোটোবেলায় একবার বাবা রাষ্ট্র, মানচিত্রে কাটাকুটি খেলার গল্প শুনিয়েছিল। বাবাকে প্রশ্ন করেছিলো, "বাবা গোটা পৃথিবীটা তো একটাই মানচিত্র। বসুধৈব কুটুম্বকম্"। পাহাড়ের সবথেকে উঁচুতে দাঁড়িয়ে রোজ পৃথিবী দেখার চেষ্টা করে। দু-চোখ যতদূর যায় বগলের রাইফেল মাটিতে রেখে দুহাত প্রসারিত করে শূন্যতা আগলে নেয়। নেশা বলতে সময় পেলেই কবিতা লেখে কিংবা চিঠি। সন্ধ্যা নামলে ক্যাম্পে চা, সিঙ্গারা অবসরের ডাক পরে। সন্দীপ রোজ চারদিকের ছোট্ট ছোট্ট ঘটনাগুলো দেখে। শাহনাওয়াজ তার নতুন বিবির একজোড়া চুড়ি এনেছে তাই বারবার চায়ের কাপের পাশে রাখে আর চোখ বুলিয়ে নেয়। রাজেন্দ্র সিং সারাদিনের পাগড়ির ধুলো মুছতে থাকে। কুমারামান গলা ছেড়ে তেলেগু ভাষার একটি লোকগীতি হবে হয়তো! গাইছে। এমন ছোটো ছোটো কথা সবার।

সন্দীপের মনে পড়ে একদিন বিকেলে গঙ্গার পাড়ে সুচেতনা ও সে কোনো এক অজ্ঞাত মাঝির কন্ঠে মানব জনম নিয়ে একখানি বাউল গান শুনেছিলো। সুরটি এখনও কানে বাজে। সুরটি ভারতবর্ষের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত একটি সরলরেখা এঁকে দেয়। সারাটাদিন কতকিছুই ভাবতে ভাবতে ট্রিগারের লোহাটুকুকে গোলাপের পাপড়ি মনে হতে থাকে। রাইফেলের নলা থেকে একঝাঁক পাখিরা রোজ সকাল সন্ধ্যা অনায়াসে এদেশ থেকে ওদেশ ঘুরে বেড়ায়। পাখিদেরও বুঝি জাতিপুঞ্জের বৈঠক হয় নয়তো কাঁটাতার কি চোখে পড়েনা। "খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়" গানটি সন্দীপ গুনগুন করতে করতে নিজেই পাখি হয়ে যায়।

সকালে আয়নার সামনে নিজেকে দেখে চমকে গেছে। শরীরটা কলকব্জা, নাটবল্টু দিয়ে ঘেরা একটা আস্ত রোবোট। হৃদয়হীন একটা যন্ত্রের মত। সকালে নিজেকে আর দেখে না। এমন প্রতিজ্ঞা সংবাদপত্রের ওপরেও হয়েছিল। প্রথমপাতা থেকে শেষপাতা শুধু হিংস্রতা, রাহাজানি, খুনোখুনি, ধর্ষণ, রাজনীতি কোথাও একটি কবিতা নেই।

সুচেতনার হাতে সংবাদ পত্র, "গতরাত্রে বেয়নেটের আঘাতে এক যুবক আর্মির মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে। বেয়নেটের ধারালো চকচকে ইস্পাতের মাথায় একটি চিঠি পাওয়া গেছে-কতদিন কবিতা লেখা হয়না সুচেতনা...।"

Sep 13, 2020

নেট ফড়িং সংখ্যা- ১৫৮

Edit Posted by with 1 comment

Sep 10, 2020

নেট ফড়িং জন্মদিন সংখ্যা- ২০২০

Edit Posted by with 4 comments

Sep 7, 2020

'ভিটেমাটি' - অবাস্তব ডায়েরী

Edit Posted by with No comments

 


ভিটেমাটি

অবাস্তব ডায়েরী

 

উফ কত পুরোনো বাড়ি তোমার। সামনের অংশ তো পুরো জঙ্গল হয়ে গেছে। আর কি ধুলো। এত ধুলোতে মানুষ থাকতে পারে নাকি ? নাকে রুমাল দিয়ে সপ্তকের দিকে তাকিয়ে বলল অর্চিতা। প্রায় ২৫ বছর পর বাড়িতে ফিরলো ও সাথে তার স্ত্রী অর্চিতা। তাদের একমাত্র ছেলে ইন্দ্র কাজের সূত্রে আমেরিকায় থাকে, তারও আসার কথা ছিল কিন্তু কাজের চাপে আর আসতে পারেনি। এমনিতে সপ্তক কাজের সূত্রে জার্মানি থাকে, ও একজন ডাক্তার। খুব বেশি দেশে ফিরতে পারে না, কিন্তু মা মারা যাবার পর থেকেই বাড়িটা ফাঁকা পরে রয়েছে, তাই সপ্তক ঠিক করেছে বাড়িটা বিক্রি করে পাকাপাকি ভাবে জার্মানিতে থাকবে। আর তো কোনো পিছুটান নেই এ দেশে তবে আর বাড়িটা রেখে কি হবে।

মেদিনীপুর জেলার এক অখ্যাত গ্রামের ছোট্ট একটা বাড়িতে সপ্তকরা থাকতো। এই বছর দশেক আগেও এই বাড়িতে ধুঁকছিল একটা প্রাণ। শক্ত করে মনের প্রান্তে আঁকড়ে রেখেছিল একটা আশা, একটা স্বপ্ন। বাড়িটা দেখে অনেক পুরোনো স্মৃতি এক লহমায় মনে পড়ে গেল সপ্তকের। প্রত্যেক সেমেস্টার শেষে যখন বাড়ি ফিরত এরকমই আনন্দ অনুভব করতো সে ।

ঘরের দরজাটা খুলতে একটা ভ্যাপসা গন্ধ বেরিয়ে গেল। ঘরটা বেশ খোলামেলা। তবে এর মধ্যে একটা শুন্যতা অনুভব করছিল অর্চিতা। পূর্বে আর দক্ষিণে দুটো বেশ বড় বড় জানলা। তবুও যেন অসম্ভব দম বন্ধ করা পরিবেশ ঘিরে রয়েছে বাড়িটাতে। সুন্দর দামি রুমাল দিয়ে সামনে রাখা বেতের চেয়ারটা মুছে নিলো সপ্তক। দামি ফ্রেমের চশমাটা সামনের টেবিল রেখে, চেয়ারে নিজেকে এলিয়ে দিলো সে। বাবার শখ করে কেনা এই বেতের চেয়ারটা। প্রতি বিকেল বেলা এক হাতে বই আরেক হাতে চায়ের কাপ নিয়ে,এই বেতের চেয়ারে বসতো বাবা।

মেদিনীপুরের এই গ্রামটাকে গ্রাম না বলে মফঃস্বল ও বলা চলে। চার দিকে সবুজের সারি। এই গ্রামে একটাই মাত্র স্টেশন। খুব বড় স্টেশন না, দুটো মাত্র প্লাটফর্ম। সেই স্টেশনেরই স্টেশনমাস্টার ছিল তার বাবা। এই বাড়ির সামনেই খুব বড়োএকটা জলাশয় আছে। এই জলাশয়তে প্রতি রবিবার বাবার সাথে আসতো মাছ ধরতে। ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতো বাবা।সপ্তকের বিরক্ত লাগতো। কিন্তু ওর বাবার মুখে বিরক্তির লেশ মাত্র থাকতো না। কি অপরিসীম ধৈর্য ছিল লোকটার। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে তাই ও কিছু বলতো না আর।

চল্লিশ বছর আগে এই তিনজনের হাসি খুশিতে মেতে উঠতো টিনের চালের বাড়িটা। সামর্থ্য সীমিত, কিন্তু স্বপ্ন ছিল অনেক বড়ো। তিনজনেরই স্বপ্ন ছিল চাঁদকে ছোঁয়ার। সপ্তকের বাবা দিনরাত এক করে খেটে  চলেছিল সেই স্বপ্ন পূরণ করার জন্য। কিন্তু স্বপ্ন পূরণের সংগ্রামের পথে বারবার অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল অভাব। সপ্তকও এক মুহূর্তের জন্য তার লেখা পড়ায় ঢিলেমি দেয়নি। মা বাবা তাদের সর্বশক্তি দিয়ে এই সংগ্রাম কে পরাজয় করে সপ্তকের স্বপ্নপুরণ করেছিল।

তিলেতিলে গড়ে তুলেছিল ভবিষ্যৎ। আশ্চর্য মানসিক শক্তি এদের। মা যখন সন্ধে বেলায় কেরোসিনের আলোতে সেলাই করতো,তখন সপ্তক ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি যে মা বুনছে ভবিষ্যতের নকশিকাঁথা।

এই রাতটা অভুক্ত থাকতে হবে জেনেও আগামীকাল ছেলেকে কি ফুটিয়ে দেবে তার চিন্তাই  ছিল সর্বক্ষণ।

সপ্তকের বাবারও সর্বক্ষণ মনে হতো ছেলে কি করে ভালো থাকবে। কখনোই মনে হয়নি নিজের শরীরের এর যত্ন নেওয়ার প্রয়োজন আছে। এতো সংগ্রামের পরেও তাদের মুখে সর্বদা হাসি লেগে থাকতো। হয়তো পৃথিবীর সব মা বাবা-ই এরকম।

কি আবোল তাবোল ভাবছো ? যাও গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসো। বাইরের কেনা খাবার তাড়াতাড়ি না খেলে এই ভ্যাপসা গরমে নষ্ট হয়ে যাবে। আর তাছাড়া দাসবাবু আসবে বাড়ির ব্যাপারে কথাবার্তা বলতে অর্চিতার ডাকে চোখ খুলে সপ্তক বলল ও হ্যাঁ, অর্চিতা তুমি গিয়ে বরং আগে ফ্রেশ হয়ে আসো। তোমার পরে আমি যাচ্ছি।" অর্চিতা ফ্রেশ হতে বাথরুমের দিকে চলে গেলে সপ্তকের চোখে পড়লো টেবিলে রাখা ফোটোটার দিকে। একবার জার্মানি থেকে খুব দামি একটা ডিজিটাল ক্যামেরা কিনে এনেছিল ও। তারপর সেই ক্যামেরা দিয়ে মা বাবার একটা ফটো তুলে দিয়েছিল ও। ফটোতে মা-বাবার হাসিটা জীবন্ত লাগছে। ঠিক যুদ্ধজয়ের হাসি। সত্যি যুদ্ধজয়, এত অভাব, সংগ্রামকে পাশে রেখে ছেলেকে ছোট থেকে বড় করা, ডাক্তারি পাশ করানো, তারপর ছেলের বিদেশে যাওয়া এসব যুদ্ধজয়ের থেকে কোনো অংশে কম নয়। দুখী হয়েও যেন তারা দুনিয়ার সবথেকে বড়ো সুখী। ছেলে ফিরলে তাকে ভাত বেড়ে দেওয়া, পছন্দমতো রান্না করা, তার জামাকাপড় পরিষ্কার করা, নিতান্তই সরল একতরফা খুনসুটিতে সুখের ছোয়া পেতেন।

ছেলে বিদেশে যাবে শুনে মায়ের বুক হু হু করে উঠেছিল। তবুও হাসি মুখে বিদায় দিয়েছিল। বাপের মাথাও গর্বে উঁচু হয়েছিল। ওরা ভেবেছিল ছেলে কিছুবছর পর দেশে ফিরে আসবে, তারপর গ্রামের মানুষের সেবা করবে। প্রথম প্রথম ছেলে প্রতিবছর  একবার হলেও বাড়ি আসতো। যাবার সময় মা সপ্তককে জড়িয়ে বলত এবার বাবা পাকাপাকিভাবে দেশে চলে আয়। আর যেতে হবে না।কিন্তু প্রতিবারই সপ্তক বলত : দেখছি মা, কি করা যায়।

দেখতে দেখতে সপ্তকের বিয়ে হয়ে গেল অর্চিতার সাথে। জার্মানিতেই আলাপ। বিয়ের পরই সপ্তকের মনে পরিবর্তন ঘটতে লাগলো। বিয়ের পর অবশ্য একবার এসেছিল অর্চিটাকে নিয়ে, সাতদিন থেকে চলে গেছিল ব্যাস ওই শেষবার। তারপর আর একবারও আসেনি। ইন্দ্র জন্মাবার পর তার মুখ দেখার খুব ইচ্ছা ছিল সপ্তকের মা বাবার। কিন্তু কাজের চাপে সেটাও করতে পারেনি। এরপর থেকে দুজন অধীর প্রতীক্ষায় থাকতো এই বুঝি ছেলে আসবে। প্রতিবার পুজো এলেই মনে করতো এই বুঝি ছেলে আর বৌমা এলে তাদের ক্ষীরের নাড়ু খাওয়াবে। সপ্তক বড়ো ভালোবাসতো। নাতিটাও কি ভালোবাসবে ?

দুপুরের খাওয়া শেষ করে অর্চিটাকে একটু রেস্ট নিতে বলে বাইরে হাঁটাহাঁটি করতে গেল সপ্তক। সত্যি দেশের মাটির গন্ধ একটু অন্যরকম বড্ডো আপন। আজ প্রথমবার বুঝলো সপ্তক। হাঁটতে হাঁটতে বাজারের দিকে চলে গেল সপ্তক। এই ভরদুপুরবেলা বাজারের প্রায় সব দোকানই বন্ধ, কেবলমাত্র একটা চায়ের দোকান খোলা আছে। দোকানি বসে বসে ঝিমোচ্ছে। সপ্তক গিয়ে বসলো সামনের বেঞ্চিটায়। সপ্তক-কে বসতে দেখে দোকানদারের তন্দ্রাছন্ন ঘটলো। একটা হাই তুলে চোখ কচলাতে কচলাতে বললো, “বলুন বাবু কি চান?”

একটা দুধ চা দাও তো এইদেশের দুধ চা-টা খুব মিস করে সপ্তক । জার্মানি এই দেশের থেকে অনেক উন্নত, কিন্তু মাটির ভাঁড়ের চা আর আড্ডাটা জার্মানির লোকেরা বুঝবেনা। দোকানি চায়ের জল চাপিয়ে বললো আপনারে তো ঠিক ঠাওর করতে পারছি না। আপনি কোন গাঁয়ের লোক?”

আমাকে তুমি ঠিক চিনবে না, এখন আমি বাইরের দেশে থাকি। তবে জন্ম আমার এ গ্রামে

লোকটি অনেকক্ষণ সপ্তকের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল বাবু আপনি সাগর বাবুর ছেলে না?

আপনারে ঠিক চিনেছি। আগে বাবার সাথে আসতেন না? এতোদিন পরে গ্রামের কথা মনে পড়লো?”

হ্যাঁ কাজের চাপে আর আসা হয় না। এবার এসেছি বাড়ি সংক্রান্ত কাজের জন্য।লোকজন এখনো চেনে আমাকে? মনে মনে ভাবলো সপ্তক। দোকানদার বললো বড্ডো ভালো মানুষ ছিল তোমার বাবা।

কিন্তু সেবার যখন তোমার বাবা সাপের কামড়ে আমাদের সবার চোখের সামনে নিস্তেজ হয়ে গেলো, খুব খারাপ লেগেছিলো তখন। সত্যি ভগবান কত নিষ্ঠূর। যার ছেলে কিনা একজন ডাক্তার , অথচ তার বাবাই বিনা চিকিৎসায় মারা গেলো। সাগর বাবু মারা যাওয়ার পরেই তোমার মা একা হয়ে পরে। শেষের দিকে তার মাথাও খারাপ হয়ে যায়। সারাক্ষণ শুধু তোমার নামই বলতে থাকে, কেউ গেলেই জিজ্ঞেস করতো সপ্তকের খবর কি তোমরা জানো কেউ? মাঝে মধ্যে আগে নাকি ফোনে কথা হতো সেটা অবশ্য শুনেছি, তোমার মায়ের বড্ডো ইচ্ছা ছিল ছেলের হাতের জলটা যেন পায়। তার সেই ইচ্ছাও অপূর্ণ থেকে গেছে। বছর দশেক হল সেও মারা গেছে। এই নিন বাবু চা।করুণ স্বরে বলল লোকটা।

চা টা খেয়েই সপ্তক আর বসলো না উঠে পড়লো, যেতে যেতে সপ্তক ভাবতে লাগলো।  বহুবার মা বাবাকে বলেছে বিদেশে যেতে, কিন্তু মা বাবা বাড়ির মায়া ত্যাগ করতে পারেনি। আসলে মা বাবা পুরোনো গ্রামবাসি আর আত্মীয়দের ছেড়ে যেতে চায়নি।

বাবা মারা যাওয়ার পরে সপ্তক খুব করে চেয়েছিলো বাড়ি ফিরতে, কিন্তু ছুটি না পাওয়ার জন্য আসতে পারেনি। এরপর থেকে মা যে একা হয়ে যাবে সেটা ভালোই আন্দাজ করতে পেরেছিলো। কিন্তু মাকে যতবারই ফোন করে জিগেস করতো কেমন আছো? প্রত্যেক বার উত্তর পেত আমি ভালোই আছি।

মায়ের ভালো থাকার কথা শুনে সপ্তকও আর কিছু বলতো না। কিন্তু আজ বুঝতে পারছে মায়ের ভালো থাকার আসল অর্থ। ইন্দ্র দূরে থাকার জন্য সপ্তক আর অর্চিটার যেরকম কষ্ট হয়, ঠিক সেই রকমই কষ্ট পেতো তার মা বাবা। ইন্দ্রর ফিরে আসার সময় যে  খুশি তা হয় বহু বছর আগে সেই হাসির ঝলকটাই অনুভব করতো তার মা বাবা। আসলে বাবা মা কখনোই চায়না ছেলে মেয়ে তার থেকে দূরে থাকুক। এদিকে সন্তানও বুঝতে পারে না মা বাবার মনে কিরকম ঝড় চলছে। আসলে আমরা মা বাবার দুঃখ কষ্ট তা ঠিক বুঝতে পারিনা যতক্ষণ সেটা আমাদের সাথে ঘটছে।

এসব ভাবতে ভাবতে বাড়িতে চলে এল সপ্তক। বাড়ি ফিরে এসে সপ্তক দেখল "ততক্ষণে দাসবাবু চলে এসছে। সপ্তক কে ঢুকতে দেখে দাসবাবু দাড়িয়ে, করজোড়ে নমস্কার করে বলল "হে হে, আমি একটু আগেই এসছি। আপনার বাড়ির অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, একটু মেরামত করার দরকার। তবে সব নিয়ে ভাববেন না, আমার চেনাজানা লোক আছে তাদের দিয়ে করিয়ে নেব। আর ভালো কথা, একজন খদ্দের পাওয়া গেছে। সে আপনার বাড়িটা কিনতে চায়। বললে কালই তাকে নিয়ে আসবো বাড়িটা দেখতে। জানি আপনার ও ওদেশে ফেরার আছে। যতদূর তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজ শেষ করিয়ে দিতে চাইছি" । দাসবাবুর কথা শেষ হতে সপ্তক হেসে বলল "তাকে আসতে না করে দিন"।

"তার মানে"

"মানে টা হল আমি এ বাড়ি বিক্রি করতে চাই না।"

"আপনি তো এত তাগাদা দিলেন বাড়ি বিক্রি করার জন্য। আমি হন্যে হয়ে খুঁজে একটা লোক পেলাম। এখন বলছেন আপনি বিক্রি করতে চান না। ভারী অদ্ভুত তো মশাই আপনি।"

"হ্যা সত্যি আমি এ বাড়ি বিক্রি করতে চাই না। আর আপনার লোক দেখার দরকার নেই। আপনি পারলে আসতে পারেন"

রাগে দু চারটে কথা বলে দাস বাবু চলে যেতে অর্চিতা বলল "এ আবার তোমার কি মতিভ্রম হল, এই বাড়ি বিক্রি করার জন্য দেশে এলে। এখন বলছো বাড়ি বিক্রি করবে না"

সপ্তক বলল "মতিভ্রম না, মন পরিবর্তন হল, আসলে মা বাবা বেঁচে থাকতে তাদের যোগ্য সন্মান দিতে পারিনি। এই বাড়ি বেঁচে দিলে তাদের স্মৃতির শেষ সম্বলটুকু ছিনিয়ে নেওয়া হবে। আমি চাই না বাড়িটা বেঁচে দিয়ে তাদের স্মৃতি মুছে দিতে। ভাবছি আর ওদেশে ফিরবো না। এখানেই পাকাপাকিভাবে থাকি, আর গ্রামের মানুষের সেবা করি। যে রকম আমার মা বাবা চেয়েছিল। সন্তান হয় এইটুকু আশা পূরণ করতেই পারি। কি বল?"

'আন্তরিকা ' - রণজিৎ পাণ্ডে

Edit Posted by with No comments

 


আন্তরিকা

রণজিৎ পাণ্ডে

        

চেনা কন্ঠস্বরের শব্দে বাসস্ট্যান্ডের বাম পাশে বাইক থেমে গেল জিৎ এর। মুখে মুক্ত হাসি নিয়ে জয়া জিজ্ঞেস করল কোথায় যাবে?

জয়া জিৎ এর খুব পরিচিতা, দীর্ঘ নয় বছর পর হঠাৎ প্রশ্ন শুনে হকচকিয়ে যায় জিৎ, পরক্ষণেই সম্বিত মতো উত্তর ও প্রশ্ন মিলে জবাব দেয়, গ্রামের বাড়ি, তুমি কি বাস পাওনি?

না, চলো আজ তোমার সাথেই যাব। একটি তো স্টপেজ। বলেই জয়া জিৎ এর বাইকের পিছনে সরস্বতী ঠাকুরের মতো বসে আবারও বলল, চলো।

বাইক ছুটতে থাকে ধীর গতিতে, হঠাৎ প্রশ্ন করে জয়া, কিগো তুমি কী আমাকে একেবারে ভুলে গেছ? কিছুই মনে নেই?

জিৎ বলেছিল, কেন মনে থাকবে না? সব মনে আছে, যাকে নিয়ে চোদ্দ বছর ঘর করছি তাকে কীভাবে ভুলি, আজও তোমাকে স্বপ্নে পেয়েছি। দেখছিলাম তুমি হোস্টেল থেকে দীর্ঘ সাত দিন পর রবিবার বাড়ি ফিরছ নিয়ম মতো। আমি দৌড়ে গিয়ে কিস করে  তোমাকে বলছি, সপ্তাহে দুটো রবিবার হলে বেশ ভালো হত বলো?

যাঃ! এখন তো এখানেই থাকি আসতে পারো, মোবাইলেও কথা হতে পারে, জয়া বলেছিল।

- তা ঠিক হবে না, এখন তোমার স্বামী, সংসার হয়েছে, সেখানে কোনো ফাটল না ধরে, আমি তাই চাই। তবে তোমাকে যে লুকিয়ে আজও দেখি না, সেটা বললে মিথ্যে বলা হবে। তুমি আমার মনের আকাশে সব সময় উড়ছো। তাই যেখানে থাকো ভালো থাকো এটাই চাই।

জয়া রূঢ় কন্ঠে চোখে জল নিয়ে বলেছিল, তুমিই তো আমাকে বিয়ে না করে অন্য কে বিয়ে করেছো আগে।

- ভবিতব্য, কার যে কখন কীভাবে কি হয়ে যায়, মনে হয় ভগবানও জানতে পারেন না, আমি তার কি ব্যাখ্যা দিই বলো তো?

স্কুল শিক্ষিকা জয়ার স্কুল সামনে আসতেই বাইক থেমে গেল, বাইক দুলিয়ে নেমে, রুমাল দিয়ে চোখ মুছে জয়া শুধু বলেছিল "এ কথা কাউকে বলো না যেন, আর হ্যাঁ আশা করছি আগামী কালও আসবে!"

উত্তরে জিৎ এমন ভাবে মাথা ঝোকাল হ্যাঁ কি না কিছু বোঝাই গেল না।


"জঞ্জালও" - আবদুস সাত্তার বিশ্বাস

Edit Posted by with No comments

 


জঞ্জালও

আবদুস সাত্তার বিশ্বাস

 

বাসে চেপে খানিক সিটে বসে রয় মইন। তারপর সে নেমে পড়ে লোকের ভিড়ে দৌড়ে মিলিয়ে যায়। পরে একটা বাস ধরে চেপে নেবে।

বাসটা থেকে সে নামতো না। প্রথম গেট থেকে দুটো সিট পরে জানলার ধারে সিটটা সে ভালো পেয়েছিল। টিকিট কাটার সময় কাউন্টারে একটা ভালো সিট দেওয়ার কথা বলেছিল। তাই ভালো সিটটা পেয়ে সে বসেও ছিল আরাম করে। জানলা দিয়ে বাইরে মুখ করে।

অতএব নামার তো কোন প্রশ্নই ছিল না। কিন্তু নামতে হয় তাকে অন্য কারণে। না নামলে বিষয়টা খুবই খারাপ দেখাত বলে। তাছাড়া অস্বস্তি হত। মুখ গোমড়া করে বেমুখ হয়ে বসে থাকতে হতো। বুকে পাথর নিয়ে বসে থাকার মতো। ও বাসের মধ্যে পরিচিত কেউ থেকে থাকলে সে দেখে ফেলে গ্রামে গিয়ে বলে দিলে জাত যেত। গ্রামের লোকের সামনে সে মুখ তো দেখাতে পারতোই না। বরং গ্রামের লোক তাদের এক ঘরে করত। তাদের গ্রামের মানুষ এসব কাজে খুব সিদ্ধহস্ত। এসব কাজ পেলে হয়।

মুখে মাস্ক পরা একটা মেয়ে তার ডান পাশের খালি সিটটায় বসে। ফলে মইন বাম দিকে একটু চেপে যায়। মইনেরও মুখে মাস্ক পরা।

বাস ছাড়তে এখনো পনেরো বিশ মিনিট লেট। এতক্ষণ চুপচাপ বসে না থেকে পাশের মেয়েটার সঙ্গে টুকটাক গল্প করা যেতেই পারে। টাইম পাস।

মইন জিজ্ঞেস করে, "কোথায় নামবেন?"

মেয়েটা এতক্ষণ অন্য দিকে মুখ করে বসে থাকলেও সে এবার মইনের দিকে মুখ করে বসে।

মইন অমনি তাকে দেখে চিনতে পেরে গিয়ে দ্রুত বাস থেকে নেমে পড়ে- সে চিনতে পেরেছে কি না সে জানে।

কেননা মেয়েটার নাম ঊর্বশী। দেখতে ভালো মেয়েটা। মইনদের পাশের গ্রামে তার বাবার বাড়ি। বাবার অবস্থা খুব একটা ভালো না। শুধু মেয়েটাই দেখতে ভালো বলে মইন তাকে বিয়ে করে এবং দুবছর তার সঙ্গে ঘর সংসার করে। ভাগ‍্যিস কোন বাচ্চা কাচ্চা নেই। থাকলে সমস্যা হতো।

গত বছর এই সময় মইন মেয়েটাকে ছাড়ান দেয়। লোক ডেকে লোকের সামনে তিন তালাক ও বায়ান তালাক দিয়ে। ছাড়ান দিতে যদিও তার বেশ কিছু টাকা গচ্চা লাগে। সে লাগুক গে। সে কেমন এখন আরামে আছে। শান্তিতে আছে। ভালো আছে। দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে কেমন সুখে ঘর করছে। কোন উৎপাত নেই। কোন কান ভাঙানি নেই। কোন জ্বালা যন্ত্রণা নেই।

আর ও থাকলে বাবাকে খুন করে বাবার চাকরিটা নেওয়ার কথা আবারও বলতো।

সমাজের এরা শুধু কলঙ্কই নয়,জঞ্জালও।


Sep 6, 2020

নেট ফড়িং সংখ্যা- ১৫৭

Edit Posted by with No comments

Sep 2, 2020

"অনিমা দাই" - আবদুস সাত্তার বিশ্বাস

Edit Posted by with No comments

 


অনিমা দাই

আবদুস সাত্তার বিশ্বাস

        

লকডাউনে গরিব মানুষ গুলো খুব নাকাল হচ্ছে। মনে কারও শান্তি নেই। শরীরে কোন ফুর্তি নেই। পেটে খিদে নিয়ে সবাই বেঁচে আছে। আর বড়লোক গুলো? ফ্যানের তলায় নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। তাদের পেটে তো আর খিদে নেই। জঠরে কোন জ্বালা নেই। সুতরাং তাদের ঘুমাতে কোন অসুবিধা নেই। বসে বসে তারা টাকা পাচ্ছে। অফিসে যেতে হচ্ছে না। ডিউটি করতে হচ্ছে না। সরকার তাদের এমনি এমনি টাকা দিচ্ছে। ফলে তাদের লকডাউন হলেই বা কি না হলেই বা কি।

মুশকিল হয়েছে যত গরিব মানুষদের। তাদের না আছে কাজ। না আছে ঘরে খাবার। না আছে পকেটে টাকা। সুতরাং চরম সমস্যার মধ্যে তাদের দিন কাটছে। এই পৃথিবীতে যে কেউ কারও না। বিশেষ করে গরিব মানুষদের জন্য তো কেউ-ই না। হলে খুবই ভালো হতো। খুবই ভালো হতো। গ্রামে যারা বড়লোক রয়েছে তাদের সামান্য বদান্যতায় গ্রামের গরিব মানুষ গুলো তাহলে সবাই বেঁচে যেত। কাউকে খাবারের জন্য সমস্যায় পড়তে হত না। কিন্তু গরিব মানুষদের নিয়ে তারা ভাবে না। কোনদিনও না।

দুই

এদের নিয়ে ভাবল অনিমা দাই। দাইয়ের কাজ অনিমা করেনা। তবু সে দাই। তার কারণ তার মা একসময় দাইয়ের কাজ করত আর সে তার মায়ের সঙ্গে সঙ্গ দিত। তাই সে-ও দাই। গ্রামের মানুষ তাকে তাই দাই বলেই ডাকে। অনিমা দাই।

যাইহোক, অনিমা দাই যে খুব বড়লোক মেয়ে তা কিন্তু নয়। সে খুব গরিব মেয়ে। খুবই গরিব মেয়ে। তার স্বামী সংসার নেই। মেয়েবেলায় তার একবার একটা বিয়ে হয়েছিল। স্বামী জোয়ান মরদ ছিল। কিন্তু ভগবানের কি খেলা! স্বামী বিয়ের রাতেই সাপের কামড়ে মারা যায়। এরপর পরে সে আর বিয়ে করেনি। করেনি তো এ পর্যন্ত করেনি। যদিও তার রূপ ও যৌবনে মুগ্ধ হয়ে অনেক ছেলে পরে তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। কিন্তু অনিমা দাই করেনি। "মানুষ বিয়ে কতবার করে? একবার করেছিলাম সুতরাং আর নয়। ভগবান যা করে তাই হবে।"

এখন অনিমা দাইয়ের বয়স হয়েছে। শরীরের চামড়া জড়ো জড়ো হয়েছে। যৌবনও ফুরিয়েছে। রূপও ঝরেছে। এখন তো ওসব চিন্তা মাথায় আসবেই না।

তিন

অনিমা দাই তার বাবার ভিটাতে থাকে। প্রথম থেকেই বাবার ভিটাতে থাকে। কারণ অনিমা দাইয়ের বাবা যখন মারা যায় ভিটাটা অনিমা দাইকে রেজিস্ট্রি করে দিয়ে যায়। যাতে অনিমা দাইয়ের বাস করতে এখানে কোন অসুবিধা না হয় এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সে নির্বিঘ্নে কাটাতে পারে। কেননা অনিমা দাইয়ের একটা দাদা ছিল। বাবার মাঠান পাঁচ বিঘা জমি সে জাল করে সব লিখে নেয়। বাবা সেটা জানতে পারার পর অনিমা দাইকে ভিটাটা লিখে দেয়। অনিমা দাইয়ের ওই দাদা ইন্দ্রজিৎ। সে এখন গ্রামে থাকেনা। শ্বশুরের গাঁয়ে থাকে। গ্রামে কোনদিন আসেনা। অনিমা দাইয়ের খোঁজ খবর রাখেনা। অনিমা দাইও ভুলে গেছে দাদাকে। গ্রামের মানুষই এখন তার সব। গ্রামের মানুষই এখন তার আপন এবং অতি প্রিয়জন।

চার

বাবা মারা যাওয়ার পর অনিমা দাই কিছুদিন খুব কষ্ট পেয়েছিল। খাবারের কষ্ট পেয়েছিল। পয়সার কষ্ট পেয়েছিল। কারণ তার তো তখন কোন রোজগার ছিল না। তবু তার রোজগেরে দাদা তার জন্য কিছু করেনি। কিছু পয়সা কড়ি দিয়ে সাহায্য পর্যন্ত করেনি। তার প্রিয় গ্রামবাসী ভাইয়েরা তখন কাজটা তাকে পাইয়ে দেয়। গ্রামের শিশু শিক্ষা কেন্দ্রে বাচ্চাদের খিঁচুড়ি রান্না করার কাজটা। ও তার বিধবা ভাতা ছিল না সেটাও করে দেয়। দুটো কাজ একসঙ্গে পেয়ে অনিমা দাই এখন খুব ভালো আছে। তার একার কোন অসুবিধা নেই। তার অসুবিধা না হলে কি হবে? গ্রামের আরো মানুষের তো অসুবিধা আছে। সুতরাং তার একার ভালো থাকার তার কাছে কোন মূল্য নেই। সে ভালো থাকবে আর তার প্রিয় গ্রামবাসী ভাইয়েরা কষ্টে থাকবে! না খেয়ে থাকবে! এটা তো হয়না। অতএব সে চায় সবাই মিলে একসঙ্গে ভালো থাকতে।

পাঁচ

অতঃপর অনিমা দাই একদিন গ্রামের নিরন্ন মানুষদের নিয়ে ভাবতে লাগল। লকডাউনে যারা সবচেয়ে বড় সমস্যার মধ্যে পড়ে রয়েছে সেইসব মানুষদের নিয়ে। সেদিন সারাদিন সারারাত ধরে ভাবল। ভাবতে ভাবতে ভাবনা শেষে সে এই সিদ্ধান্তে এল যে, গ্রামে যে পঞ্চাশ জন নিরন্ন মানুষ রয়েছে তাদের সে খাদ্য দান করবে। চাল, ডাল, আলু। তারপর পরে যা হবে তখন দেখা যাবে। এখন তো মানুষ সামান্য কিছু খেয়ে জানে কিছুদিন বেঁচে থাকুক।

ছয়

অনিমা দাইয়ের দাদা যেহেতু কোন খোঁজ খবর রাখেনা অনিমা দাই তার দিন অদিনের জন্য পেট চালিয়ে কিছু টাকা জমিয়ে রেখেছে। কিন্তু মানুষের এখন যে ঘোরতর বিপদ চলছে তাতে সে যক্ষের ধনের মতো টাকাটা আগলে রাখে কি করে? না, সেটা ঠিক হবেনা। তার দিন অদিন আছে ভগবান আছে। তার প্রিয় গ্রামবাসী আছে। নিশ্চয় তারা তার ব্যবস্থা করবে। কেউ তাকে ফেলে রাখবে না। তার টাকাটা নিয়ে সে এখন চরম দুর্দিনে মানুষের পাশে দাঁড়াতে চায়। নিরন্ন মানুষের অন্ন দান করতে চায়। ভাবনা মতো অনিমা দাই একদিন করলও তাই। মাথা পিছু প্রত্যেককে তিরিশ কিলো করে চাল। দু-কিলো করে ডাল। আর দশ কিলো করে আলু দান করল। অনিমা দাইয়ের এই দান পেয়ে নিরন্ন মানুষ গুলো ভীষণ ভীষণ খুশি হল এবং দু-হাত ভরে ঠাকুরের নামে সবাই তাকে আশীর্বাদ করল এবং প্রাণ ভরে প্রার্থনা করল। তার এই দান থেকে গ্রামের শেষ প্রান্তে যে দু-জন মুসলিম ঘরামী ছিল তারাও বাদ গেল না। অনিমা দাইয়ের এই মহানুভবতার কথা ইথারের মতো বাতাসে গ্রামের আনাচে কানাচে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। তারপর গ্রাম পেরিয়ে শহরেও। সুদূর কলকাতা শহরে এবং সেখান থেকে টিভি ও কাগজের লোকেরা ছুটে এল। অনিমা দাইয়ের ছবি তুলল। তার মুখে কথা শুনলো এবং সেরা সমাজ সেবিকার সে সম্মান পেল। তার সম্মানে গোটা গ্রাম সম্মানিত হল। সবাই মেতে উঠল তার সম্মানে। গ্রামে যারা বড়লোক ছিল লজ্জায় তারাও এবার দান করতে শুরু করল। তাদের দানে গ্রামের নিরন্ন মানুষ গুলোর খাদ্যাভাব দূর হল। পরে সরকার গোটা দেশ জুড়ে দান দিল।

হায়! অনিমা দাইয়ের মতো মেয়ে যদি আমাদের দেশে প্রত্যেক গ্রামে একটি করে থাকতো কি ভালো হতো!


Sep 1, 2020

"লোডশেডিং" - মনামী সরকার

Edit Posted by with No comments


 

লোডশেডিং

মনামী সরকার

 

সময়টা ১৯৮৮- ৮৯হবে | তখনো আমার শহরে ইনভার্টার এর প্রচলন হয়নি | দু একজনের কাছে ইমারজেন্সি চার্জার লাইট থাকলেও থাকতে পারে | কিন্তু আমার চোখে সেভাবে কখনো পড়েনি | লোডশেডিং হলে ভরসা ছিল লন্ঠন, কুপি, ড্রিমলাইট, মোমবাতি আর টর্চ | তখন সন্ধ্যা বেলা প্রায় নিয়ম করেই লোডশেডিং হত | বিকেলের খেলাধুলোর পর সন্ধ্যার জলখাবার খেয়ে বই নিয়ে বসতে না বসতেই লোডশেডিং হয়ে যেত | সত্যি বলতে আমরাও হয়তো লোডশেডিং এর জন্যেই অপেক্ষা করতাম | আমার ছোট বেলাটা কেটেছিল একটা সরকারি আবাসনে | কারেন্ট যাওয়া মাত্রই মনটা আনচান করত কখন ঘরের থেকে একটু বেরোবো | আমার মত সবারই একই অবস্থাই ছিল | পড়াটা কোনভাবে শেষ করেই যে যার ঘরে থেকে বেরিয়ে আসতাম | আবাসনের ভেতরে একটা ছোট খেলার মাঠ ছিল | অন্ধকার হলেই কোথা থেকে যেন হাজার, হাজার জোনাকি চলে আসতো সেখানে | জোনাকির মৃদু আলোয় চারপাশটা ভরে উঠত | ছোট-বড় যে যার মতো ছোট ছোট দল করে করে চলত আড্ডা | আর গরমকাল হলে মাঝে মাঝে সঙ্গী হত তালপাখা | সেই আড্ডায় গানের লড়াই থেকে শুরু করে বিতর্ক প্রতিযোগিতা কিনা চলত | মাঝে মাঝে কিছু মনের কথা আদান প্রদান, ভবিষ্যতের অলীক কল্পনা | কি না থাকত সেখানে | মোটকথা নির্ভেজাল একটা আড্ডা | একইভাবে পাড়ার মোড়ে মোড়ে, বা বাড়ির পুলের সামনে এরকম আড্ডা জমে উঠত লোডশেডিংকে কেন্দ্র করে |

মনে আছে লোডশেডিং যদি অনেকক্ষণ ধরে চলত ওই অন্ধকারেই মা হ্যারিকেন বা ড্রিম লাইট সহযোগে খাবারের জোগার করত | আর খেতে বসা মাত্রই সে কি পোকার অত্যাচার | ওই হ্যারিকেনের আলোকে কেন্দ্র করে কোথা থেকে যেন ছোট ছোট পোকাগুলো চলে আসতো কে জানে ? মাঝে মাঝে দু'চারটা আবার খাবার থালার মধ্যেও লাফিয়ে পড়তো | দু-একটা কে ধরে ধরে আবার হ্যারিকেন এর মধ্যে ফেলে দিতাম |

পরীক্ষার আগ দিয়ে মাঝে মাঝে লোডশেডিং হলেও বাইরে বেরোনোর অনুমতি পাওয়া যেত না | ওই মোমবাতি বা হ্যারিকেন এর আলোতে বসে পড়তে হত | কিন্তু মন কি আর ঘরে থাকে | ওই পড়তে পড়তে জানলা দিয়ে জোনাকির আলো' দেখতাম | আর হ্যারিকেনের কাঁচের মধ্যে মোমটাকে লাগাতাম | হ্যারিকেনের আঁচে মোমবাতিটা একটু একটু করে গলে হ্যারিকেনের কাঁচের মধ্যে লেগে যেত | পরে সেই জন্য যদিও মার কাছে খুবই বকুনি খেতাম | কিন্তু বেশ মজা লাগতো করতে | আর মোমবাতি সামনে থাকলে হাত দিয়ে মোমের আগুনটাকে ধরার চেষ্টা, এটা কমবেশি সবাই আমরা করেছি | হ্যারিকেন মোমবাতির আলোর সাথে ছায়ার খেলা ভীষণ প্রিয় ছিল আমার | ড্রিম লাইট এর উপর কাগজ চাপা দিয়ে কার্বন-ডাই-অক্সাইড এর অস্তিত্বপরীক্ষা করতে গিয়ে বাতি নিভিয়ে দেওয়া | হ্যারিকেনের কালি হাতে মেখে দুষ্টুমি করা এগুলো খুব কমন ব্যাপার ছিল | আর টর্চের আলোতে ভূত সাজা, আর হাতের মধ্যে টর্চ চেপে ধরে শরীরে রক্ত আছে কিনা পরীক্ষা করা এগুলোই ছিল তখন আমাদের খেলা |

তারপর কখন নিজের অজান্তেই চার্জার লাইট, ইনভার্টার চলে এলো | ওই জোনাকি পোকাগুলো কোথায় যেন হারিয়ে গেল | হারিয়ে গেল ওই আড্ডাগুলো | এখন লোডশেডিং হলেও আর আলাদা করে কিছু বুঝতে পারিনা | কিছু কিছু ভালো লাগা ভালো  অনুভূতিগুলো প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে কোথায় যেন চাপা পড়ে গেছে।