Sep 15, 2020

"পল্লবী" - রাজর্ষি পাল

Edit Posted by with 1 comment

 


পল্লবী

রাজর্ষি পাল

 

আজও উঠতে দেরি হল পলাশের। ঘড়ির কাটা ১১টা ছুঁয়েছে। একটা ঝাঁকুনি তে ঘুম ভাঙল ওর। কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছিল বোধহয়। কোনোমতে বিছানায় উঠে বসে ভাবার চেষ্টা করল কি দেখেছে। শুধু নীল একটা শাড়ি আর একটা নাম মনে পড়লো, ‘প’ দিয়ে কিছু একটা। হয়তো তারই নাম হবে। আধখোলা চোখ নিয়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ দেওয়ালের দুটি পাশ যেখানে এসে মিশেছে সেই সরলরেখায়। শরীরের একরাশ ক্লান্তি ও দুর্বলতার ছাপ যেন কিছুতেই যাচ্ছেনা তার। কোনোমতে নিজেকে টেনে টেনে বাথরুমে নিয়ে ফেলল। ১টায় ডাক্তারের appointment, যেনতেন ভাবে স্নানটা সেরে নিল। খিদে ভাবটা অব্দি নেই। পলাশের সবকিছু যেন একটা বিরক্তিকর পুনরাবৃত্তি মনে হচ্ছে। কয়দিন এভাবে অসুস্থ সে, তাও ঠিক ঠাওর করতে পারছে না পলাশ। বাথরুম থেকে বেড়িয়ে নড়বড়ে পায়ে বিছানার কোনায় ঝুলন্ত জামা টেনে নিয়ে পড়তে লাগল সে। কলারের বোতামটা লাগাতে গিয়ে, বুকের কাছে ভেজা ভেজা কি একটা মনে হলো। তাকিয়ে দেখে লাল রঙের একটা দাগ বুকপকেটে। কিসের কিছুতেই মনে করতে পারলো না। কোথায় গিয়েছিল জামাটা পড়ে, অনেক চেষ্টা করেও মনে পড়ল না। কিন্তু পাল্টানোর সময় নেই আর। তাড়াতাড়ি তৈরি হয় নিলো জুতো পরে। ঘড়িটা কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছে না। এদিকে ওদিক তাকিয়েও পেলো না। বিছানার মধ্যেও হাতড়িয়ে দেখলো। না, সেখানেও নেই। শেষমেশ টেবিলে ডায়েরির ফাঁকে পেল। ঘড়িটা বের করতে গিয়ে লক্ষ্য করলো কিছু একটা লেখা আছে শেষ পৃষ্ঠাটায়। কিন্তু তাকিয়ে দেখার ইচ্ছেটুকু আর নেই। ঘড়িটা হাত পড়ে দেখে বন্ধ হয়ে আছে। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো পলাশের। এখন উপায় নেই এটাই পরা ছাড়া। তাড়াতাড়ি বেড়তে হবে।

ভিড়ের বাসে কোনোরকমে চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে, ধাক্কাধাক্কি করে নামল পলাশ। কিন্তু এসবের প্রতি ভ্রুক্ষেপ নেই আর পলাশের।

বাস স্টপের মোড় থেকে বাড়ির দিকে একটা ঘোরের মধ্যে হাটতে লাগল। ব্যাগের খোলা চেন থেকে রিপোর্ট এর অর্ধেক বেরিয়ে রয়েছে। তীব্র রোদের মধ্যে একটা অটো নেওয়ার কথাও যেন মনের নেই তার। এপার্টমেন্টের এর গেট দিয়ে ঢুকেই সামনের বেঞ্চটায় গিয়ে বসল পলাশ। রোদের তাপে গরম হয়ে আছে বেঞ্চ। ভাদ্রের দুপুরে ভ্যাপসা গরম হাওয়া বইছে। কিন্তু কিছুতেই যেন কোনো মন নেই পলাশের। হঠাৎ দূর থেকে কথা কাটাকাটির আওয়াজ কানে এলো পলাশের। একরাশ বিরক্তি নিয়ে ঘুরে তাকালো পলাশ। গেটের ওখানে ওয়াচম্যান কোনো এক মহিলার সাথে তর্ক করছে। মহিলাটি বারবার তার দিকেই আঙ্গুল তুলে কি বলছে। একটু অবাক হলো পলাশ। ওয়াচম্যান এবার তার দিকে এগিয়ে এসে বলল মহিলাটি নাকি তার সাথে দেখা করতে চাইছে, কিন্তু এন্ট্রি রেজিস্টার এ নাম ঠিকানা দিতে তার আপত্তি।

এবার ভালোমতো ফিরে দেখল মহিলাটির দিকে পলাশ। নীল রঙের একটি শাড়ী পরিহিতা, হলুদ রঙের ব্লাউজ, ছোট করে কাটা চুল, বয়েস তিরিশের কোঠায় হবে। ওয়াচম্যান বলছে তাকে গেটে গিয়েই কথা বলে আসতে। এখন বিরক্তির জায়গায় একরাশ কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে গেল পলাশ। ব্যাগটা বেঞ্চেই রেখে এগোলো। কাছে যেতেই এক অদ্ভুত হাসি নিয়ে মেয়েটা জিজ্ঞেস করল, "আপনিই কি পলাশ বাবু ?"

-হ্যাঁ। আমিই। বলুন কি দরকার ?

-আমি বাসে আপনার পেছনে ছিলাম। আপনার ব্যাগ এর চেনটা খোলা ছিল। নামার সময় পরে গেছে একটা envelope, ভিড়ের মধ্যে ডাকলেও শুনতে পাননি। ওটাই দিতে এলাম।

কিছুটা হুস ফিরল এবার পলাশের। এতটা অন্যমনস্ক হওয়া ঠিক হয়নি। এভাবে রিপোর্টগুলো হারিয়ে গেলে কি হতো কে জানে।

-এই নিন, আপনার খাম। ওপরে আপনার ঠিকানা দেখে চলে এলাম।

খামটা হাতে নিয়ে আড়চোখে একবার দেখল পলাশ যে বন্ধ রয়েছে মুখটা। মেয়েটা এবার চলে যেতে উদ্যত হল। পলাশ ভাবল এই রোদের মধ্যে এতদূর এসেছে মেয়েটা। একবার বাড়িতে না ডাকলে খারাপ দেখাবে।

-বলছি, এত কষ্ট করে এতদূর এলেন। একবার আসুন আমার ফ্ল্যাটে। অনেক ধন্যবাদ ফেরত দেওয়ার জন্য এটা।

-না না সেসবের প্রয়োজন নেই। তবে একটু জল অবশ্যই দিতে পারেন। অটো না পেয়ে হেটে এলাম তো তাই।

ওয়াচম্যান-কে ইশারায় গেট খুলতে বললো পলাশ।

-বলছি আমার নামটা তো জেনেই গেছেন। আপনার নামটা তো জানাই হল না।

-আমার নাম পল্লবী।

বেঞ্চের দিকে এগিয়ে গেলো পলাশ। ব্যাগটা নিতে।

-বলছি যে, আপনি কি ডক্টর দেখতে গিয়েছিলেন। খামটায় রিপোর্ট মনে হলো। আসলে আমি একজন radiologist তাই আর কি কৌতূহল আটকাতে পারলাম না।

-হ্যাঁ। শরীরটা বিশেষ ভালো নেই কিছুদিন ধরে তাই।

এই বিষয়ে কথা ওঠাতে অস্বস্তি তে পড়লো পলাশ। তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেলো ব্যাগটা নিতে। ব্যাগটা হাতে নিয়ে ঘুরতেই পেছনে দেখল পল্লবী দাঁড়িয়ে। একটু হকচকিয়ে গেল এত কাছে একটা মেয়ে কে দাঁড়াতে দেখে।

-আমার জরুরি একটা ফোন কল এলো এখনই। বেরোতে হবে। আমার কার্ড দিয়ে যাচ্ছি। অসুবিধা হলে ফোন করবেন।

চকিতের মধ্যে পলাশের বুকপকেটে কি একটা গুঁজে দিয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল মেয়েটা। এতো দ্রুত সবকিছু ঘটলো যে কিছু ঠাহর করতে পারলোনা সে। গেট এর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো পলাশ। মেয়েটা হন্তদন্ত হয়ে গেট থেকে বাদিকে যেন দৌড়োচ্ছে। এতো তাড়াই যদি থাকবে তবে দিতেই বা এলো কেন। একবার ভাবলো ডাকবে, কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলো, চেনা নেই জানা নেই কি দরকার।

একটু ধাতস্থ হয়ে, বুকপকেটে হাত দিয়ে দেখল, একটা ঘিয়ে রঙের ভিজিটিং কার্ড। তাতে লাল কালি তে লেখা, পল্লবী। আর নীচে একটা যোগাযোগের নাম্বার। আরো অবাক হলো পলাশ। শুধু একটা নাম আর নম্বর। না আছে পদবি না আছে ঠিকানা। এমন আজব কার্ড সে আগে দেখেনি। মেয়েটার মতোই এটাও অদ্ভুত। ব্যাগ আর খামটা নিয়ে নিজের wing এর দিকে এগোলো পলাশ। হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়ল মেয়েটা আবার যাওয়ার সময় বলে গেল যে অসুবিধা হলে যোগাযোগ করতে। কিন্তু এরও কোনো মাথা মুন্ডু কিছু বুঝলো না সে। কেন সে তার সাথে যোগাযোগ করবে, যার নাম ছাড়া আর কিছুই সে জানে না। আর কি-ই বা অসুবিধা হবে। যা অসুবিধা সব তো নিজেই সামলাচ্ছে।

লিফ্টে উঠে ৭ এর বোতাম টিপল পলাশ। আরেকবার দেখার জন্য কার্ডটা বুকপকেট থেকে বের করলো। হঠাৎ বুকে হালকা একটা ব্যথা অনুবভ করলো। ঠিক ইঞ্জেকশন দিলে যেমন হয়। তাকিয়ে দেখে লাল দাগ যেখানে ছিল সকালে, সেটায় আঠা আঠা মতন। ব্যথা ক্রমশ বেড়েই চলছে। লিফ্ট থেমে দরজা খুলল। কোনোমতে ব্যাগটা নিয়ে বেরোলো পলাশ। ব্যথাটা এবার বুক থেকে গলা হয়ে মাথা অব্দি পৌঁছে গেছে। কোনদিকে তার ফ্ল্যাট সেটাও ঠিক করতে পারছে না পলাশ। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে। ঘেঁষতে ঘেঁষতে শরীরটা নিয়ে ঘরে ঢুকলো পলাশ। ব্যাগটা হাতে নেই আর। মাথা ব্যথায় ফেটে যাচ্ছে। পা থেকে যেন আগুন জ্বলছে। হাত-পা কিছুই আর অনুভব করতে পারছে না। কোনোমতে টেবিলের সামনে বসল। হঠাৎ মনে পড়লো পল্লবী মেয়েটার কথা। অসুবিধা হলে যোগাযোগ করতে বলেছিল। হাত দুটো কাঁপছে। কপাল পুড়ে যাচ্ছে। কার্ডটা বের করে জামাটা কোনোমতে খুলে, ছুঁড়ে ফেললো পলাশ। হাতে নিয়ে নাম্বারটা বোঝার চেষ্টা করল। কিন্তু চোখের সামনে সব ঝাপসা। বুঝলো ধরে রাখতে পারছে না কার্ডটা। সামনের ডায়েরির পাতায় তা খুলে, লেখার চেষ্টা করলো নাম্বারটা। কোনোমতে পল্লবী নামটা লিখলো। কিন্তু কপালের ঘাম পরে পাতা ভিজে যাচ্ছে। পাতা পাল্টাতে চাইল পলাশ। কিন্তু এ কি! চোখ প্রায় বন্ধ হয়ে আসছে তার। কিন্তু তার মধ্যেও শিরদাঁড়া দিয়ে যেন বিদ্যুৎপ্রবাহ ঘটে গেল তার। আগের প্রতিটা পাতাতেই মেয়েটার নাম লেখা। একদম শুরু থেকে শেষ অব্দি সবকটা পাতায় শুধু পল্লবী লেখা। জলের মতো কিছু পড়ে শুরুর দিকটা পড়া যাচ্ছে না। পাগল পাগল মনে হলো নিজেকে পলাশের। এও কি করে সম্ভব, সে তো ওই মেয়েটাকে আগে কখনো দেখেনি। তাহলে ওই মেয়েটার নাম তার ডায়েরিতে এলো কিভাবে। ওর মনে হল সকালের দুঃস্বপ্ন যেন এখনো কাটেনি। সাতসতেরো ভাবতে ভাবতে আধখোলা দরজার দিকে এগোতে চেষ্টা করল পলাশ। কিন্তু পারলো না। পড়ে গেল। এবার চোখ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে এলো তার। আর যেন কোনো ব্যাথাই অনুভব হচ্ছেনা। মনে হচ্ছে যেন জলের ওপর ভাসছে। কে যেন কানের কাছে বারবার বলছে "আমি পল্লবী"। পল্লবী, পল্লবী এই আওয়াজ শুনতে শুনতে এবার ঘুমাবে সে। শেষবারের মতো চোখ খোলার চেষ্টা করল। ভারী জুতোর শব্দ শুনতে পেল। টের পেল কে যেন দরজাটা বন্ধ করলো। আর কিছু মনে নেই পলাশের।

উঠতে আবার দেরি হলো পলাশের। ঘড়ির কাটা বলছে এগারোটা।


1 comment: