আমাদের রূপকথা
অ্যাস্ট্রিক্স
সে ধরে নিন প্রায় দশ বছর আগের ঘটনা। সবে শরৎকালের আগমন, মা আসবে বলে আয়োজন
শুরু হয়েছে সবে। তখন আমি সবে সতেরোতে পা দিলাম একাদশ শ্রেণীর ছাত্র। পাঁখাটা গজানো
শুরু হচ্ছে বুঝতেই পারেন। সেমন এক দিনেরই কথা, ছাঁদে দাড়িয়ে বন্ধুদের সাথে ঘুড়ি
উড়াচ্ছিলাম। হঠাৎ একটা গাড়ি এসে দাড়ালো ঠিক আমাদের বাড়ির গেটের সামনে। এক ভদ্রলোক
নামলেন গাড়ি থেকে আর জিনিসপত্র সব নামাতে শুরু করলেন গাড়ি থেকে। বুঝলাম সামনের বাড়িতে
লোক এসেছে নতুন, আমাদের প্রতিবেশী আর কি। তো ওখান থেকে যেই চোখ সরিয়ে ঘুড়ির দিকে
তাকাবো হঠাৎ দেখলাম গাড়ির পেছনের দরজাটা খুলে নুপুর বাঁধা পা দুটো নিয়ে নামছে সে।
এখনও মা দুর্গার আসতে কিছুটা সময় বাকি, তবে তার আগমনটা তো ব্যাস এক নজরে
হয়ে গেছিলো আমার মনে। হালকা হলুদ রঙের চুড়িদার আর চুলটা খোঁপা করে বাঁধা। মুখটাতে
এক আশ্চর্য রকমের কমনীয়তা আর বড় বড়ো দুই চোখ, খুব গভীর। গায়ের রং টা একটু চাপা তবে
সেটা যেনো আরো ফুটে উঠেছিল ওর উপর। প্রথমবার যেন এমন মনে হলো কাউকে দেখে। আর ব্যাস
এই সবের মাঝে হয়ে গেলো ভোকাট্টা, আমার ঘুড়ি আর আমার মনের।
অনেকদিন অপেক্ষা করলাম ওর জন্য, কখনো ছাদে, কখনো বা পাড়ার রাস্তায় ক্রিকেট
খেলার ছলে। খুব অস্থির হয়ে উঠেছিলাম তবে এই বারো দিনের মাঝে শুধু দু’বার ওর দেখা পেয়েছি,
একবার ও বেরিয়ে ছিলো ওর মার সাথে, তখন আমি ছাদে দাড়িয়ে আর একবার বাবার সাথে সকালে
বাজার করার সময় ওর দেখা পেলাম, ও নিজের মায়ের সাথে এসেছিল বাজার করতে। ভাগ্যটা কোনো
রকম ভাবে সঙ্গ দিয়েছিল তাই ওর মা ওর নাম ধরে ডাকলো তো শুনতে পেলাম "উমা"।
মনে হলো যেন জীবনের একটা বড়ো জয় হলো আজ। তবে অনেক চেষ্টা করেও ওর গলার আওয়াজটা শুনতে
পারিনি। আবার অপেক্ষা আর তো কিছু করার ছিল না।
কিছুদিন পড়ে ওকে আমি নিজের স্কুলে দেখলাম, খোঁজ নিয়ে জানলাম নতুন ভর্তি
হয়েছে দশম শ্রেণীতে। আসলে আমার সাথে একাদশ শ্রেণীতেই হত তবে গত বছর পরীক্ষাটা দিতে
পারেনি কারণ তখন হঠাৎ ওর খুব শরীর খারাপ হয়ে গেছিলো। এতো কিছুর মাঝে আরো একটা জিনিস
জানতে পারলাম যে ও কথা বলতে পারে না। জন্ম থেকে ওর স্বরতন্ত্রী মানে ভোকাল কর্ডটা কার্যকরী
নয়। হ্যাঁ, শুনে আমারও মনটা খারাপ হয়েছিল খুব। তবে ওকে জানার যে ইচ্ছেটা ছিল, সেটা
আরো বেড়ে গেলো।
এর মাঝে পুজো এলো, পাড়ার প্যান্ডেলে বসে থাকতে থাকতে আর বন্ধুদের সাথে
আড্ডা মারার মাঝে অষ্টমীতে পেলাম ওর দেখা। লাল শাড়ি, পায়ে নুপুর, খোঁপা করা চুল,
হাতে কাঁচের চুড়ি আর সেই কাজল দেওয়া চোখ নিয়ে অঞ্জলী দিতে এসেছিল ওর মায়ের সাথে
পাড়ার প্যান্ডেলে। আমি পাশে দাঁড়ালাম আবার অঞ্জলী দেওয়ার ভান করে আর এক চোখ বন্ধ
আর এক চোখ খুলে ওর দিকে তাকিয়ে মা দুর্গার কাছে প্রার্থনা করছিলাম উমা কে আমার জীবনে
পাওয়ার। এবার পুজোটা শেষ হয়ে এলো কিন্তু আর ওর দেখা এর মাঝে আর পেলাম না।
অনেকটা সময় কাটলো, প্রায় দু-তিনটে মাস তবে কথা বলা হল না, শুধু ওই স্কুলে
দেখতাম ওকে আবার কখনো বাড়ির ছাদ আর পাড়ার ক্রিকেটের মাঝে। প্রথমবার পরিচয়টা হয় মুখোমুখি
আমাদের স্কুলের বাৎসরিক অনুষ্ঠানে। বন্ধুরা জোর করেছিল বলে সাহসটা করতে পারলাম। বললাম
যে আমি ওর বাড়ির উল্টো পাশেই থাকি, ও হাত দিয়ে ইঙ্গিত করে উত্তর দিলো। বুঝলাম ওর
কথা গুলো আসলে ওর ব্যাপারে জানার পর এই দু-তিন মাস আমি হ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজটা কিছুটা
শেখার চেষ্টা করে ছিলাম যাতে ও এটা না ভাবে যে আমি এটুকুও জানিনা। ওই প্রথম পরিচয়ের
পরে আমাদের কথা বাড়তে থাকে আর বন্ধুত্বটা গভীর হয়ে ওঠে। আস্তে আস্তে দুজন দুজনের
ছাদে দাড়িয়ে কথা বলাও শুরু করি। একসাথে ঘুরতে যাওয়া, বাইরে দেখা করা আর সব কথা দুজন
দু’জনার সাথে ভাগ করে নিতে নিতে কবে যেনো ভালোবেসে ফেলেছিলাম ওকে।
দেখতে দেখতে একাদশ শ্রেণী পেরোলাম আমি আর ও পেরোলো মাধ্যমিক। মনে আছে এখনও,
ময়দানে গল্প করতে করতে হঠাৎ হাঁটু গেড়ে আমি ওকে প্রপোজ করি আর ও কিছুটা অবাক হলেও
মেনে নিয়েছিল সেটা। তবে আমাদের বাড়িতে আমাদের এই সম্পর্কটার ব্যাপারে জানতো না। কারণ
ওর পরিবার বিপক্ষে ছিল এই সবের আর আমিও জানতাম না আমার কি অবস্থা হবে বাড়িতে জানতে
পারলে। অনেক হাসি-ঠাট্টা আর ভালোবাসায় কেটেছিল আমাদের এই বছরটা আর পরীক্ষা এলো আবার
আর আমি উচ্চমাধযমিক পার করে স্কুল জীবন শেষ করলাম আর ও এলো এবার দ্বাদশে। আমি বাড়ির
কাছাকাছি আশুতোষ কলেজে ভর্তি হলাম। ব্যাস এখন দেখা করার সময়টা একটু পাল্টে গেছিলো
উমার সাথে আর সত্যি বলতে কিছুটা কমে গেছিলো। ওর ছিলো উচ্চমাধ্যমিক এর চিন্তা আর আমার
নতুন কলেজ নতুন জীবনের, তবে দেখাটা ঠিক করে নিতাম। খুব জরুরি একটা অংশ হয়ে উঠেছিল
আমার জন্য সে আর আমিও হয়তো তার জন্য। আমাদের কাহিনীতে শব্দ ছিলো কম তবে কথা ছিল অনেক
বেশি।
এই সবের মাঝে পরীক্ষা চলে আসে ওর, আর পরীক্ষা চলাকালীন খবর আসে ওদের চলে
যাওয়ার, শুনলাম ওর কাছে ওর বাবার বদলি হয়েছে উত্তরবঙ্গের দার্জিলিং জেলায় আর পরীক্ষার
এক সপ্তাহ পরেই চলে যাচ্ছে ওরা সবাই। খুব কেঁদেছিল ও সেদিন, আসলে কিছু বলতে পারেনা
তো তাই হয়তো কাঁদা ছাড়া আর কোনো কিছু ছিলো না করার। দেখতে দেখতে ওর যাওয়ার দিন এসে
পরে। নাহ আমি বলতে পারিনি আমাদের সম্পর্কর ব্যাপারে কোনো বাড়িতেই। কোনো আয় উপার্জন
ছিলো না আমার, কোন মুখেই বা বলতাম যে ওকে খুশি রাখবো, তাই সেদিন ও আমার উপর কিছুটা
রাগ আর মনে অনেক ভালোবাসা নিয়ে চলে গেলো। ঠিক যেমন মহালয়ার আগমন সুরের মতন এসেছিলো
ঠিক সেভাবেই দশমীর ভাসানের মতন সব ডুবিয়ে চলে গেলো সে, আমার "উমা"।
আমি কলেজ পেরিয়ে কাজ করতে শুরু করলাম, আর আস্তে আস্তে হারিয়ে যেতে লাগলো
সেই দিনগুলো। তবে সব কিছু তো আর হারায় না কিছু জিনিস সব সময় মনে রয়ে যায়।
আজ আমার প্রথম বিবাহ বার্ষিকী, বাড়ীতে আমার স্ত্রী অপেক্ষা করছে । আমার
আর আমার স্ত্রীর দেখা হয় কোম্পানির এক ক্যাম্পেইনে, প্রথমে কথাটা আমি শুরু করি আর আস্তে
আস্তে আমাদের সম্পর্কটা সময় এর সাথে গভীর হয়ে যায়। বেশ ভালো লেগেছিল তাকে, আর দেখা
এবং কথা হতে হতে ভালোবাসা আরো একবার এসেই গেলো আমার জীবনে। তার বাড়ি গরিয়াতে। চার
মাস প্রেম করার পর বাড়িতে জানিয়ে দিলাম। ওর বাড়িতে মানেনি তাই পালিয়ে যাওয়াটাই
ঠিক ভাবলাম। এখন মেনে গেছে সবাই, আসছে আজ রাতে ওর বাবা-মা আর ছোট ভাই আমাদের বাড়িতে।
ছোটো একটা আয়োজন করেছি দু’জনে ওই দু-চারটে বন্ধু-বান্ধব আর পরিবারের লোকজন। আসলে ও
এখন অন্ত:সত্ত্বা তাই বেশি ঝামেলা করিনি। ও! আমার নামটা বলাই হলো না, আমি নীল আর আমার
স্ত্রীর নাম "উমা"। হ্যাঁ সেই যাকে একবার হারিয়ে ফেলেছিলাম। ক্যাম্পেইনের
ওখানে ওকে দেখেই চিনে ফেলেছিলাম আর আমাকে দেখে ও যে কতটা খুশি ছিলো সেটা বলে বোঝানো
অসম্ভব। বুঝতে পারলাম যে পাগলিটা এখনও আমায় ততটাই ভালোবাসে যতটা আগে বাসতো, সব মনে
আছে ওরও, এক একটা কথা। চার মাসের সমযটা চেষ্টা ছিলো ওর বাড়িতে মানানোর, সেটাতেও যখন
মানেনি, আর কিছু উপায় ছিলো না। একবার ওকে হারিয়েছিলাম আবার হারাতে চাইনা। দুজন বেশ
খুশিই আছি। এই আমাদের গল্প, আমাদের রূপকথা।