পাহাড়ি বালিকা
আলি মোস্তাফা
চারদিকে পাহাড়ে ঘেরা ছোট্ট একটি দেশ। সবুজ পাহাড়ের কোল ঘেঁষে কোথাও পাহাড়ী
স্রোতসীনী ঝরণা হয়ে দূর নদীতে মিশে যায়। ছোট বড় পাহাড়ের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে ছোট
বড় পাহাড়ি নদী। সেই পাহাড়ী দেশের রাজাও ছিলেন বৃহৎ পাহাড়ের মত বড় মনের, ছিলেন ভীষণ
প্রজাবৎসল । দেশের বড় বড় সব প্রতিষ্ঠানই ছিল রাজ পরিবারের সদস্যদের। সর্বত্র ছিল রাজ
পরিবারের আধিপত্য কিন্তু তা সত্বেও প্রজারা ছিল সন্তুষ্ট। অল্প সংখ্যক প্রজাদের সেই
দেশে তারা খুব সুখে শান্তিতেই বসবাস করছিল। এমন প্রজাবৎসল রাজা যিনি প্রজাদের সুখ-শান্তির
দিকে খুবই তীক্ষ্ণ খেয়াল রাখেন। নিজের বিরাট পরিবার, মন্ত্রী-পারিষদমণ্ডলী আর প্রজাদের
নিয়ে রাজা নিজেও ছিলেন ভীষণ সুখী।
ছোট্ট পাহাড়ি দেশের সেই রাজা একদিন নিজের পরিবার, কিছু বন্ধুবান্ধব ও তাদের
পরিবার নিয়ে ভ্রমণে গেলেন। বড় একটি রাজ পরিবার রাজার। চারজন স্ত্রী ও অনেক ছেলেমেয়ে
নিয়ে রাজার সুন্দর পরিবার । তার মধ্যে এক সুদর্শন পুত্রকে তিনি খুবই ভালবাসতেন। সেই
পুত্রের বয়স তখন ১৬ পেরিয়ে ১৭ এর কাছাকাছি। পুত্রের প্রতি অগাধ ভালবাসা, তাই রাজপুত্রকে
কিছুতেই চোখের আড়াল করতে চাইতেন না। কিন্তু যে ছেলে দূরন্ত কৈশোরে পা দেয় তাকে কি
ঘরে আটকে রাখা যায়? একটা ১৬ বছরের কিশোরকে কি আর সবসময় চোখের সামনে রাখা যায়? সেও
এদিক-সেদিক ছুটে বেড়াচ্ছে ভাইবোনদের সাথে, সভাসদ, বাবার বন্ধুদের ছেলেমেয়েদের সাথে
খেলছে, ঘুরছে উৎফুল্ল হয়ে ছুটছে দিকবিদিক। রাজ রক্তের উচ্ছ্বাস যেন বয়ে বেড়াচ্ছে
শরীরে সর্বত্র ।
অনেকগুলো ছেলে মেয়ের মাঝে কোন এক অপরূপা বালিকার দিকে চোখ আটকে যায় রাজপুত্রের।
সবাই তাকে পেমা নামেই ডাকে। বয়স তার ৬ পেরিয়ে ৭ এর কাছে। রাজপুত্রের সাথে পেমার প্রথম
পরিচয় হলেও অল্প সময়ের মধ্যেই তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে গেলো। আজ যেন রাজপুত্র পুরো
পৃথিবীকে পেয়েছে। একসাথেই খেলছে, ঘুরছে, গল্প করছে, যেন এক অন্যরকম পূর্ণতা এসেছে
। এক শিশু কণ্যা আর কিশোর রাজপুত্রের এমন দহরম মহরম দেখে সবার মাঝে হাসিঠাট্টারও কমতি
নেই।
ভ্রমণের দিনগুলো ফুরিয়ে এসেছে। সবকিছু গুছিয়ে রাজার সাথে সেই রাজপুত্র ফিরবে
প্রাসাদে। জ্বলজ্বল চোখে পেমা দূর হতে দেখছে। রাজপুত্র ছুটে চললো, বালিকাটি আর নিজেকে
স্থির রাখতে পারলো না হঠাৎ জড়িয়ে ধরলো রাজপুত্রকে। রাজপুত্রের বুকে মাথা রেখে কান্নাজড়িত
কণ্ঠে বললো, "আমি আবার আসবো তোমার কাছে…"
রাজপুত্রের ভেতরটা যেন হঠাৎ কেমন করে উঠলো। বালিকার আহ্লাদী কাণ্ড দেখে
বিমোহিত রাজপুত্র। বুকে জড়িয়ে ধরে রাজপুত্রের মনে হচ্ছিল যেন সে তার পরম বন্ধুকে পেয়ে
গেছে। এ যেন তীব্র বিরহের মাঝে প্রিয়তমাকে ফিরে পাওয়া। স্নিগ্ধ হৃদয়ে যেন সে চিরকালের
সহযোগী পেয়ে গেছে। আবেগের সুরে বলে উঠলো, হ্যাঁ, নিশ্চয়। তুমি আমার কাছেই আসবে…। তুমি
আমার কাছেই থাকবে…। তুমি যখন বড় হবে, যদি আমাদের আবার দেখা হয় তবে দেখবে আমি অপেক্ষমাণ
হয়ে থাকবো দূর পাহাড়ের পাদদেশে। ঝংকারে বেজে উঠা বাঁশির সুর শুনে তুমি আমাকে খুঁজে
নিও। তখন আমি যদি অবিবাহিত থাকি, আর তুমিও যদি অবিবাহিত থাকো, আমি তোমাকেই আমার জীবনের
পরম সাথী বানাবো…।
খুশি আর লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছিল বালিকা… সেই বালিকাটি ছিল রাজার এক ঘনিষ্ঠ
বন্ধু ধোন্দুপ এর মেয়ে। তিনি সেই দেশের পূর্ব সীমান্তের এক গ্রামের মোড়ল। এলাকার সবাই
তাঁকে খুব ভক্তি করেন। এদিকে রাজপুত্র আর বালিকার সেই বন্ধুত্বের কথা আর গোপন রইলো
না। রাজপুত্রের প্রতি বালিকার আকর্ষণের কারণে বালিকাটির বাবা ধোন্দুপ কিছুটা লজ্জিত
ও ভীতসন্ত্রস্ত। কোথায় রাজপুত্র আর কোথায় মোড়লের মেয়ে, এ যেন আকাশ কুসুম ভাবনা
বৈ কিছু নয় । কিন্তু রাজামশাই ওগুলো আমলে নিলেন না। বন্ধুদের মাঝে হাসতে হাসতে বললেন,
বাচ্চাদের মধ্যে ওরকম একটু আধটু বন্ধুত্ব থাকতেই পারে। এ আর এমন কি? অবুঝ মনে ভাললাগা
আর ভালবাসা বলতে কিছু আছে?
কিন্তু সেদিনের বন্ধুত্ব যেন তাদেরকে এখন প্রণয়ে বেঁধে ফেলেছে। সময় তার
আপন গতিতে চলছে অবিরত। তারা বড় হতে লাগলো এবং ধীরে ধীরে প্রেম যেন গাঢ় হতে লাগলো।
কখনো রাজপুত্র ছুটে যায় পূর্ব সীমান্তের সেই গ্রামে। কোন এক অন্তীত বন্ধন যেন বেঁধে
ফেলেছে অজান্তেই। এভাবে মাঝে মাঝে দেখা হয় খুনসুটি গল্পে সময় বয়ে যায়।পারিবারিক ভ্রমণে
যাওয়া হয় একসাথে। এভাবেই দিন কাটতে লাগলো।
এদিকে রাজার বয়স ক্রমেই বাড়ছে, ভরা যৌবনে পৌড়ত্ব এসে যেন ঘিরে ধরেছে রাজাকে।
তিনি আর খুব বেশী ঘোরাঘুরি করতে পারেন না। নেই সেই ক্ষীপ্রতা। বয়সের ভার যেন পৌড়ত্বকে
ক্রমশঃ বৃদ্ধি করছে। বার্ধক্য যেন সবকিছুকে থামিয়ে দিচ্ছে। আগের মত শাসনকার্য চালাতেও
পারছেন না। প্রজাদের সুখ-শান্তির কথা ভেবে সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি এবার বিশ্রাম নেবেন
এবং তার সেই আদরের পুত্রকেই রাজা বানাবেন। সেই পুত্র এখন ২৭ বছরের তরতাজা যুবক। তিনি
জনগণের সুখ শান্তির দিকে বেশী খেয়াল রাখতে পারবেন বলেই মনে হলো রাজার। সেইমত সবার সাথে
আলোচনা করলেন এবং ঘটা করে রাজা হিসেবে অভিষেক করা হলো রাজপুত্রকে।
সেই রাজপুত্র এখন রাজা এবং সেই পেমা নামের সেই বালিকা এখন আর বালিকা নেই।
ভরা তারুণ্যের সে যেন রূপ লাবণ্যকে ছড়িয়ে দিচ্ছে। ১৭ বছরের কিশোরী যেন দুর্বার আঠারো
কে হাতছানি দিয়ে স্বাগত জানাচ্ছে। কিন্তু সে এদেশে নেই। পড়াশোনার জন্য ভিন্ন দেশে
পাড়ি দিয়েছে। রাজপুত্র দেশ চালাতে লাগলেন আর পেমা পড়াশোনার জন্য ভিন দেশে । কখনো
ছুটি হলে সে নিজেকে ধরে রাখতে পারে না ফিরে আসে তার স্বপ্নের কুমারের কাছে। পড়াশোনার
ফাঁকে বাড়ি ফিরলে দেখা হয় দুজনের। এভাবেই কেটে বছর পাঁচেক।
রাজপুত্রের এখন ৩১ এ পা দিয়েছে। সে এখন অনেক পরিণত । আর পেমা ২১ বছরের পূর্ণ
যুবতী। এভাবে কতদিন বিরহকে বৃদ্ধি করা যায়? পেমাকে ছাড়া যেন এখন সময়ই যেতে চায় না।
কিন্তু কিভাবে পাবে সে পেমাকে? সে তো বিরহ যন্ত্রণা তীব্র করে ভিনদেশে পার করছে দিন।
রাজপুত্রের মনে হলো এবার তাকে কাছে নিয়ে আসা উচিৎ। আর যে তাকে ছেড়ে থাকতে একটুও ইচ্ছে
করে না। তাকে এবার কাছে রাখা উচিৎ। আর দেরি করতে চাইলেন না। রাজ সভাসদদের ডেকে সেই
অনুযায়ী সবার সাথে আলোচনা করলেন। সব ঠিক হল। রাজবাড়ি সাজলো রঙ্গিন সাজে। পেমাকে বরণ
করে নিতে রাজবাড়ি যেন উৎসুক হয়ে আছে। তারপর ঘটা করে তাদের বিয়ের আয়োজন হল। হাজার
হাজার মানুষ উপস্থিত থাকলেন রাজার বিয়েতে। উপস্থিত থাকলেন ভিন দেশের প্রতিনিধিরাও।
চারদিক থেকে, শুভেচ্ছা আর উপহারের বন্যা।
কিন্তু নতুন রানী কি নিজ দেশে থাকবেন? তিনি তো অন্য দেশে পড়াশোনা করছেন।
তিনি কি তাহলে আবার বিদেশে চলে যাবেন? আশঙ্কা প্রজাদের, চিন্তিত সবাই । পেমা ভাবলো
আমি তো এখন আমার নিজের নই, আমি এখন রাজার, আমি তো এখন রাজ্যের, আমি তো প্রজাদের! নিমিষেই
যেন জীবনের সব স্বাধীনতা থমকে গেল! কিন্তু পেমা জানে এটা স্বাধীনতার হরণ নয় বরং এটা
দায়িত্বের বাস্তবতা। রাজার কথা ভেবে, প্রজাদের কথা ভেবে রানী পেমা বিদেশের পড়াশোনা
স্থগিত রেখে দেশেই রয়ে গেলেন। তারপর থেকে রাজা ও রানী, পরিবারকে নিয়ে, প্রজাদেরকে নিয়ে
সুখেই দিন কাটাতে লাগলেন…
নাহ, এটা আসলে কোনো কল্পগল্প নয়। আসলে বাস্তব কাহিনী। এখানে সেই রাজা হলেন
ভুটানের পূর্বতন রাজা জিগমে সিঙ্ঘে ওয়াংচুক, রাজপুত্র হলো ভুটানের বর্তমান রাজা জিগমে
খেসার নামগিয়েল ওয়াংচুক এবং সেই বালিকাটি হলো বর্তমান রাজার স্ত্রী জেতসুন পেমা।
[প্রথম প্রকাশ: নেট ফড়িং, সংখ্যা ১২৮, ১৬ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০]
0 comments:
Post a Comment