Jun 29, 2021

লেখকের চোখে নেট ফড়িং

Edit Posted by with No comments

 


লেখকের চোখে নেট ফড়িং

লিখেছেন- পহেলী পাল

 

আমার মত গুছিয়ে কথা বলতে বা লিখতে না পারা মানুষটার অগোছালো কথাগুলোকে কবিতা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য নেটফড়িং-কে অসংখ্য ধন্যবাদ আমার তরফ থেকে। আমি পহেলী। নেটফড়িং পরিবারের একজন সদস্য, ঠিক কবে থেকে, তা সত্যিই আজ আর হিসেব করে বলতে পারবো না। আসলে চলতে চলতে পথ, সময় কিছুরই হিসেব থাকে না। আর সেই পথ যখন বিক্রমদার মত সৃজনশীল, বিনয়ী মানুষের সাথে চলা যায়, তখন সময়ের হিসেব করার সুযোগই থাকে না। প্রতি মূহুর্তে একটা নতুন চিন্তা, চেষ্টা, চমক দিয়ে নেটফড়িং - এর চিরাচরিত সাপ্তাহিক ধারাকে নিপুণ হাতে এগিয়ে নিয়ে চলেছে বিক্রমদা সহ অ্যাডমিন প্যানেলের সকল সদস্য। আর তার ফলস্বরূপ, কিছু প্রবীণ গুণীজনের পাশাপাশি আমাদের মত কাঁচা হাতের লেখাও পাঠকদের রবিবারটাতে একটু সাহিত্যের রং মিশিয়ে দিতে ঠিক সময়ে পৌঁছে যায়। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, অন্ততঃ যেটা আমার ব্যক্তিগতভাবে ভালো লাগে সেটা এখানকার শৃঙ্খলা, সততা আর অবশ্যই সকলকে সমান গুরুত্ব দেওয়া। এককথায় খুব নিজের নিজের মনে হয়।

খুব শীঘ্রই ২০০ তে পা দিতে চলেছে নেটফড়িং। সবসময় পাশে আছি এবং আগামীতেও থাকবো।


Jun 27, 2021

নেট ফড়িং সংখ্যা - ১৯৯

Edit Posted by with No comments

Jun 20, 2021

নেট ফড়িং সংখ্যা - ১৯৮

Edit Posted by with 1 comment

Jun 19, 2021

লেখকের চোখে নেট ফড়িং

Edit Posted by with No comments

 


লেখকের চোখে নেট ফড়িং

লিখেছেন- নীলাদ্রি দেব

 

নেট ফড়িং, একটি আলোর নাম -

ভারতে ইন্টারনেটের আত্মপ্রকাশের প্রায় আড়াই দশক পেরিয়ে গেল। এই বছর পঁচিশের মধ্যে প্রযুক্তি প্রতিটি সেকেণ্ডে, প্রতিটি মুহূর্তে উন্নত থেকে উন্নততর হয়েছে. প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে শিক্ষা থেকে সাহিত্য, চারপাশে ছড়িয়ে থাকা প্রতিটি ক্ষেত্র একটি নতুন দিশার দিকে এগিয়ে চলেছে। যে কোনো বিষয় চর্চা এবং প্রসারের পরিধি যেভাবে বিস্তৃত হয়েছে এবং হচ্ছে, তা অভাবনীয়। ঠিক এমনই এক আলোর ভেতর দাঁড়িয়ে বিভিন্ন অন্ধকারকে মুখোমুখি যুঝে নিতে হচ্ছে। প্রাককথনে এত ভনিতা হয়তো মানানসই নয়, তবু বলতেই হয়, নেটদুনিয়ায় দাঁড়িয়ে 'নেটফড়িং' একটি অনন্য উচ্চারণ। যার বৃত্তের ভেতর সৃষ্টির সম্ভার। লেখক ও পাঠক হিসেবে এর সাথে জড়িয়ে থেকে অনুভব করেছি এর আন্তরিকতা। প্রথম যখন লিখেছিলাম, আজ যখন লিখছি... উত্তাপটা একই রকম। নিয়মিত, ধারাবাহিক চর্চাকে কুর্ণিশ জানাতেই হয়। আর তা যদি প্রান্তিক এক শহরে বসে দাপটের সাথে হয়, তাহলে তার প্রতি শ্রদ্ধাবোধও জাগে. অভিনবত্ব আর অধ্যাবসায়... এও নেটফড়িং এর সম্পদ। তরুণ প্রজন্মের কত লেখককে স্পেস দিচ্ছে এই পত্রিকা, তা বিস্মিত করে। আসলে এগুলোই উৎসাহ, অক্সিজেন। এই প্ল্যাটফর্ম কাজকে গঠনমূলক দিকে নিয়ে যাবে, নিউক্লিয়ার সময়েও সমবেত বাঁচতে শেখাবে, চর্চায় রাখবে, পুষ্ট করবে জ্ঞান ও বোধকে এবং তা করছেও। এটাই তো আমাদের অনেকের চাওয়া. মানসিক সুস্থতা, যৌথতা এসবই সৃষ্টিসুখের সমান্তরালে, বাকি সব মিথ্যে। আলো, গদি, মঞ্চ, মাইক... সব। যারা বিশ্বাস করেন রিপুর বিপরীতেও স্রোত আছে, খালি চোখে দেখা প্রতিদিনের জীবনের বিপরীতেও স্রোত আছে, তাদের জন্য উল্লাস। এই উল্লাসের তীব্রতা আছে বলেই এখনও ফুল ফোটে, পাখি গায়। ফড়িং উড়ে বেড়ায়। যখন অন্তর্জালে এসে বসে... আমরা মুগ্ধতা আঁকি।

Jun 18, 2021

"দেশের আজব নিয়ম" - ইয়াকুব হোসেন

Edit Posted by with No comments

 


দেশের আজব নিয়ম

ইয়াকুব হোসেন

 

বৈশাখ মাস, প্রচণ্ড গরম দিনেরবেলা কোথাও বসে থাকা যায় না। তাই সবাই রাত্রিতে আড্ডা দেই। সেখানে বয়স্ক থেকে ছোট-ছোট ছেলেরাও উপস্থিত থাকতো। হঠাৎ একদিন দাদুর (ঠাকুরদা) মুখ থেকে এই কাহিনীটি শুনে আমি নিজের মতো করে লিখছি। এক গুরু তার শিষ্যকে নিয়ে ঘুরতে গেছেন এক দেশে। সেই দেশে তেলের দাম আর ঘি-এর দাম সমান। শিষ্য গুরুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কী দেশ গুরু তেলের দাম আর ঘি-এর দাম সমান। তার উওরে গুরু বলেছিলেন এই দেশের মানুষ সব শয়তান, তাই তাদের তেলের দাম আর ঘি এর দাম সমান। শিষ্য ঘি খেতে খুব পছন্দ করতো। তাই নিজের দেশে ফেরার সময় শিষ্য গুরুকে বলেছিলেন, ‘আপনি দেশে ফিরে যান, আমি যাবো না,’ গুরু বললেন ‘কেন যাবি না?’ উওরে শিষ্য বললেন, ‘আমি ঘি খাবো ও মোটা হবো। গুরু অনেক বোঝানোর পর একাই দেশে ফিরলেন।

কিছুদিন যাওয়ার পর সেই দেশে দু’জন চোর চুরি করতে গিয়ে দেওয়ালে চাঁপা পড়ে মারা যায়। চোরের পিতা রাজার কাছে নালিশ জানায় যে, তার দুটি সন্তান চুরি করতে গিয়ে দেওয়ালে চাঁপা পড়ে মারা যায়, আমি এর বিচার চাই। রাজা বললেন দেওয়ালটা কার বাড়ির ছিল। চোরের পিতা বললো লেবুর বাড়ির দেওয়াল ছিল। রাজা বললেন লেবু-কে ধরে নিয়ে আয়, ওর ফাঁসি হবে।

রাজার কথা মতো লেবুকে ধরে নিয়ে আসা হল এবং বলা হল তোমার ফাঁসি হবে। লেবু বললো ‘কেন?’, রাজা বললেন তোমার বাড়িতে চুরি করতে গিয়ে দেওয়ালে চাপা পড়ে দুটি ছেলের প্রাণ গেছে, তাই তোমার ফাঁসি হবে। লেবু বললো দোষ তো আমার না, রাজা বললেন, ‘তাহলে কার দোষ?’ লেবু বললো, ‘দোষ মিস্ত্রির, কারণ আমি সিমেন্ট, বালু, রড ইত্যাদি সবই তো ঠিক দিয়েছি। মিস্ত্রি এখন হালকা করে দেওয়াল বানিয়েছে।’ রাজা বললেন, ‘তাহলে মিস্ত্রির ফাঁসি হবে।’ রাজার কথা মতো সেই মিস্ত্রিকে ধরে নিয়ে আসা হল এবং তাকে বলা হল তোমার ফাঁসি হবে। মিস্ত্রি বলছে ‘কেন?’ রাজা বললো, ‘তুমি লেবুর যে দেওয়ালটা হালকা করে বানিয়েছ, সেই দেওয়ালে চাঁপা পড়ে দুজন নাগরিকের প্রাণ গেছে তাই তোমার ফাঁসি হবে।’ মিস্ত্রি বলছে, ‘দোষ আমার না, দোষ হচ্ছে জোগাইলের। আমি জোগাইলকে পানি (জল) কম দিতে বলেছি, ও বেশি দিয়ে ফেলেছে তাই দেওয়াল হালকা হয়েছে।’ রাজা বললেন, ‘তাহলে জোগাইলকে ধরে নিয়ে আয় ওর ফাঁসি হবে।’ রাজার কথা মতো জোগাইলকে ধরে নিয়ে আসা হল এবং বলা হল তুমি মশলায় পানি কেন বেশি দিয়েছিলে তোমার ফাঁসি হবে। জোগাইলা বলছে, ‘ও দোষ আমার না, ও দোষ হাতি ওয়ালার। কারণ হাতি ওয়ালা হাতি ছেড়ে দিয়েছিল। সেই হাতি দৌড়ে যাওয়ার সময় হাতির পা লেগে পানির বালতি পড়ে যায়, তাই মশলায় পানি বেশি হয়েছিল, দোষ আমার না, দোষ হাতিওয়ালার।’ রাজা বললেন, ‘হাতিওয়ালাকে ধরে নিয়ে আয় ওর ফাঁসি হবে।’ রাজার কথা মতো হাতিওয়ালাকে ধরে নিয়ে আসা হল এবং তাকে বলা হল তুমি হাতি ছেড়ে দিয়েছিলে কেন, তোমার ফাঁসি হবে। হাতিওয়ালা বললো, ‘দোষ আমার না, দোষ হচ্ছে মহিলার। মহিলাটি পায়ে ঘুঘরা পড়েছিল, সেই ঘুঘরার ঝনঝন আওয়াজ শুনে আমার হাতি দৌড় মেরেছিল।’ রাজা বললো তাহলে মহিলাটিকে ধরে নিয়ে আয়, মহিলার ফাঁসি হবে। রাজার কথা মতো মহিলাটিকে ধরে নিয়ে আসা হল এবং মহিলাটি বললো, ‘দোষ আমার না, দোষ হচ্ছে বানিয়ার। কারণ বানিয়াই আমাকে এই ঘুঘরা বানিয়েদিয়েছে।’ রাজা বললো, ‘তাহলে বানিয়াকে নিয়ে আয়, বানিয়ার ফাঁসি হবে।’ রাজার কথা মতো বানিয়াকে ধরে নিয়ে আসা হল এবং বলা হল তোমার ফাঁসি হবে। বানিয়া হতবাক হয়ে বলছে ‘কেন?’ তখন রাজা সব ঘটনা খুলে বললো কিন্তু বানিয়ার কাছে কোনো উপায় না থাকায় ফাঁসি নিতে বাধ্য হয়।

বানিয়াকে ফাঁসি দেওয়ার জন্য বিদেশ থেকে দড়ি নিয়ে আসা হল এবং বানিয়াকে ফাঁসিতে ঝোলানো হল, কিন্তু বানিয়ার গলা এতটাই চিকন যে দড়ি তার গলাকে ধরে রাখতে পারছেনা, সে দড়ি থেকে খুলে পড়ে যাচ্ছে। জল্লাদ বললো, ‘রাজামশাই আপনার হুকুম তো কার্যকরী হচ্ছে না !’ রাজা বললো ‘কেন?’ জল্লাদ বললো- ‘বানিয়ার ঘাড় খুব চিকন, দড়িতে আটকায় না।’ রাজা বললো, “এই দড়িতে যার গলা মিলবে তাকেই নিয়ে আয়।’ খুঁজতে খুঁজতে সেই শিষ্যকে পাওয়া গেল এবং তাকে ধরে নিয়ে আসা হল, তাকে বলা হল তোমার ফাঁসি হবে, শিষ্য বললো- ‘কেন আমি তো কোন অন্যায় করিনি।’ রাজা বললো, ‘তোর ঘাড় মোটা এই জন্য তোর ফাঁসি হবে।’ শিষ্য তখন নিরুপায়, রাজা তাকে বললেন, ‘তোমার কোন শেষ ইচ্ছে থাকলে বলো।’ শিষ্য বললেন ‘আমার শেষ ইচ্ছে হল আমি আমার গুরুর সঙ্গে দেখা করতে চাই।’

শিষ্যের কথা মতো তার গুরুকে চিঠি দেওয়া হল, সেই চিঠি পেয়ে গুরু সেখানে তাড়াতাড়ি পৌঁছে যায়। গুরুকে দেখে শিষ্য গুরুর পা জড়িয়ে ধরে বলে, ‘গুরু আমাকে বাচান।’ গুরু তখন শিষ্যকে বললো ‘আমার বুদ্ধি মতো কাজ করবি...।’ শিষ্য বললো ‘ঠিক আছে।’ ফাঁসির দিন গুরু বলছে ‘আমারে ফাঁসি দেন, আমার শিষ্যকে ছেড়ে দেন’ ; শিষ্য বলছে ‘আমাকে ফাঁসি দেন, আমার গুরুকে ছেড়ে দেন।’ জল্লাদ বলছে ‘রাজা দু’জনকেই ফাঁসি দিয়ে দেই।’ রাজা বলছে ‘না, ফাঁসি হবে একজনের। জল্লাদ তুমি একটু থেমে যাও, দুজনেই ফাঁসি নিতে চাচ্ছে এর মধ্যে রহস্য আছে।’ রাজা সেই রহস্য জানতে চাইলে তারা কেউ বলতে চাচ্ছিলেন না, অনেক অনুরোধের পর গুরু বলতে শুরু করে যে আমি ওই দড়ির মধ্যে সব স্বর্গ (জান্নাত) দেখতে পাচ্ছি। এই দড়িতে যার ফাঁসি হবে সে স্বর্গ (জান্নাত) লাভ করবে। রাজা মনে মনে বলছে আমি জীবনে কত পাপ করলাম, আমি জানি আমি নরকে (জাহান্নামে) যাবো, আর যদি এই দড়িতে আমার ফাঁসি হয় তাহলে আমি স্বর্গ (জান্নাত) লাভ করবো। এই ভেবে জল্লাদ-কে বলে ‘ওদের ছেড়ে দিয়ে আমার ফাঁসি দে।’


Jun 13, 2021

নেট ফড়িং সংখ্যা - ১৯৭

Edit Posted by with No comments

Jun 12, 2021

লেখকের চোখে নেট ফড়িং

Edit Posted by with No comments

 


লেখকের চোখে নেট ফড়িং

লিখেছেন- মনামি সরকার

 

নেট ফড়িং এর সাথে আমার বহু স্মৃতি আছে তবে তার মধ্যে অন্যতম হলো তখনও আমি মোবাইলে বাংলা টাইপ করতে পারি না। যেটুকু যা লেখালিখি কাগজ কলমে করতাম। তাই কখনও কোনও অনলাইন ম্যাগাজিনে নিজের লেখা পাঠাতে পারতাম না। কিন্তু ইচ্ছেটা মনে ছিলই। একদিন ভাই বিক্রমের সাথে এই ব্যাপারে কথা হল ও বলল "ঠিক আছে ফটো তুলে পাঠাও দেখি কিছু করা যায় কিনা"? পরের সপ্তাহে নেট ফড়িং এর লেখক তালিকা যখন ফেসবুকে প্রকাশিত হল সেখানে নিজের নাম দেখে কি যে আনন্দ হয়েছিল বলে বোঝাতে পারবো না। ই-ম্যাগাজিন এ প্রথম আমার লেখা ছাপা হয়েছিল নেট ফড়িং এই। নেট ফড়িং এর জন্য অনেক শুভেচ্ছা রইলো।

 


Jun 11, 2021

"তা সে যতই কালো হোক" - মিলন পুরকাইত

Edit Posted by with 2 comments

 


তা সে যতই কালো হোক

মিলন পুরকাইত

 

আমাকে দেখতে বড্ড খারাপ ছিল। বেশ কালো আর মুখশ্রী... না না কালো মেয়ের রূপ গুণের বিচার আলাদা দাঁড়ি পাল্লায় হয় তাই সে কথা থাক।

দুই বোন এক ভাই ছিলাম আমরা। দিদি রূপে গুণে একেবারে লক্ষী সরস্বতীর মতো ছিল। দাদাই তো ছেলে তাও সে খুব ফর্সা খুব লেখাপড়ায় ভালো ছিল।

বাকি আমি !! তো সবাই বুঝিয়েই দিতো কিন্তু কি আর করা যায়।

একমাত্র বাবাই আমাকে বড্ড ভালোবাসতো। আমাদের সংসারটা মোটামুটি বাবার আয়েই চলতো।

বাবার সব চেয়ে বড় দিদি বিধবা হবার পরে এ সংসারে তখন এসেছিল যখন আমি খুব ছোট। জেঠু-জেঠিমা একতলায় থাকতো, আলাদা রান্না খাওয়া হলেও তাদের ভারও বাবার ওপরই বেশিটা ছিল।

কারণ জেঠু যে কারখানায় ক্যাশিয়ারের কাজ করতেন সেটা বছরের ছ'মাস বন্ধ থাকতো কেন কে জানে। পিসি নিঃসন্তান ছিল  আর সারাদিন সংসারের কাজে মার সাথেই লেগে থাকতো।

বাবা খুব গুরু গম্ভীর মানুষ ছিল। অফিস যাওয়া আর বাড়ি আসা আর ফিরেই খবরের কাগজ বা বই মুখে বসে থাকা।

কেউ বিশেষ ঘেঁষতো না বাবার কাছে। অথচ আমি হা পিত্যেস করে বসে থাকতাম কখন ফিরবে বাবাই। আমার সারাদিনের গল্প, স্কুলের, দিদি-দাদার নামে নালিশ, সব নিয়ে আমি বসে থাকতাম বলবো বলে।

সব শুনে ডাক পড়তো তাদের।

কিছুই তেমন বলতো না বাবাই। শুধু যেদিন আমি লাল ফ্রক নেবার জন্য বায়না করেছিলাম আর জেঠি হেসে বলেছিল "এখানে যা করছিস করে নে, বিয়ের পর যেন শাশুড়ির কাছে আবদার করিস না আমাকে লাল শাড়ি কিনে দাও যেমন আমার কাছে করেছিলি" আর বলে খুব হেসেছিল ওরা সবাই মিলে সেদিন বাবাকে সব বলার পরে কেমন থমকে গেছিলো বাবা।

আর একটু পরে নিজের স্বভাব-বিরুদ্ধ কাজ করেছিল। চটি পরে আমার হাত ধরে নিজের বড় দাদার ঘরের দরজায় পৌঁছে গেছিলো।

জেঠিমা শাঁখ হাতে ঠাকুরের সামনে বসেছিল আর জেঠু কি জানি কি বলছিল। আমার বুকের মাঝে ধড়াস ধড়াস করছিল আর মন বলছিল কিছু একটা খারাপ হতে চলেছে।

জেঠুর মেয়ে অনেক বড় ছিল আমার থেকে। কলেজের শেষ পড়া চলছিল তার তখন। কিন্তু কে জানে কেন ঝুমদি আমাকে খুব ভালোবাসতো। আমাদের দেখে একলাফে বাইরে এসে আমার হাত ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে যেতে বললো "ও মা ও বাবা, কাকাই এসেছে আর তোমরা নিজেদের মধ্যে কি জানি কি কথা বলে চলেছো"

জেঠু-জেঠিমা মনে মনে কতটা বাবাকে পছন্দ করতো তা জানতাম না কিন্তু সামনে খুব ভালো ব্যবহার করতো।

বাবা কিন্তু এক পাও ভেতরে না রেখে খুব আস্তে আস্তে বললো "আচ্ছা বৌদি কোনদিন কি আমি বা আমার ছেলে-মেয়েরা তোমাকে কোন অসম্মান করেছে। সত্যি করে বলো তো ! আর মিতা ও তো তোমাকে নিজের বড় দিদির মতো ভালোবাসে। আজ তুমি মিমিকে যা বলেছো সেটা ও তোমার মেয়ে নয় বলে তাই না! আর একটা কথা বৌদি তুমি যেদিন বিয়ে করে এ বাড়ি এসেছিলে আমার মাকে তো সবাই বলেছিল, ওমন ফর্সা ছেলের এই এত শ্যামবর্ণ মেয়ে ! তোমার মনে আছে বৌদি আমার মা কিন্তু তীব্র প্রতিবাদ করেছিল সেদিন "বলেছিল মানুষের রং রূপ কতদিন থাকে, থাকে তার গুণ, তার স্বভাবের মিষ্টতা তাই না !

আজ বড্ড কষ্ট পেলাম তোমার ব্যবহারে"

দাঁড়ায়নি বাবাই আমার হাত ধরে ফিরে এসেছিল নিজের ঘরে।

জেঠি আর জেঠু তারপর অনেক কিছু বলেছিল যদিও কিন্তু বাবা তারপর থেকে আর কোনদিন স্বাভাবিক হয়নি সেটা সবাই জানতো।

ধীরে ধীরে বড় হচ্ছিলাম আমরা আর ঝুমদি সবার বড় হওয়ায় বিয়ে হয়ে যখন শ্বশুরবাড়ি চলে গেলো তখন আমি স্কুলের পড়া সবে শেষ করেছি।

রিয়া আমার দিদি আর ঝুমদি কিছু ছোট বড় ছিল বয়েসে।

জেঠিমা, জেঠু দু’জনেই ছেলেদের ভালোবাসতো। মেয়েরা যতই লেখাপড়া করে নিক আর কত বড় বড় চাকরি করুক না কেন তবু মেয়েরা তো মেয়েই হয়, ছেলেদের সাথে তাদের তুলনা করা একেবারে বৃথা এটাই মত ছিল দু’জনেরই।

আমার মা আর দিদি যদিও ওই আলোচনায় তেমন থাকতো না তবু কেমন যেন মনে হতো ওরা ওটাকেই সমর্থন করছে।

ঝুমদি বিয়ে হয়ে চলে যাবার পরে জেঠিমা বড্ড একা হয়ে গেছিলো। আমার দিদি নিজের পড়া আর আসন্ন বিয়ের কথা ভেবে নিজের রূপচর্চার পেছনেই বেশী সময় দিতো।

আমার কলেজে ভর্তির পরেও তখন ক্লাস তেমন শুরু না হওয়ায় আমি যখন তখন "ও মামণি কি করছো" বলে পৌঁছে যেতাম। খুব ছোট থেকেই কেন জানি না আমি জেঠিকে মামণি বলেই ডাকতাম।

ঝুমদি চলে যাওয়ার পরে কেমন যেন মনে হতো জেঠিমা আমার পথ চেয়ে বসে থাকতো।

প্রথম প্রথম যদিও তেমন কিছু বলতো না, নিজের মনে কাজ করতো, পরে একটু একটু করে বদলে গেছিলো জেঠি।

আমার পছন্দের খাবার বানিয়ে রাখতো, কখনো বা আমি গেলেই বলতো "যা না তোর মা আর দি'কেও ডেকে আন, আজ চা'টা সবাই মিলে এখানেই খাবো ভেবেছি !"

বাবা কিন্তু সেই সেদিনের পর থেকে মোটেই আর বদলায়নি। নিজের দায়িত্ব কর্তব্য সব করলেও বাবা একটু দূরে দূরেই থাকতো নিজের বৌদির থেকে। এমন নয় যে কথা বলতো না, বলতো কিন্তু তাতে প্রচ্ছন্ন অভিমান লুকিয়ে থাকতো।

বিয়ের পর ঝুমদির আসা যাওয়া একেবারেই ছিল না বললে চলে।

ফোনেও তেমন কথা হতো না কারো সাথে। আমাকে মাঝে মাঝে ফোন করে কথা বলতো দি। যেই বলতাম "কবে আসবি 'দি !"

একটু চুপ করে থেকে বলতো

"মা-বাবা তো নিজের ছেলেকেই ভালোবাসে, কই আমাকে তো একবারও ফোন করে না তারা !"

এমন দিনেই জেঠির বড্ড শরীর খারাপ হলো। কি যে হলো কেউ বুঝতে পারছিল না। ডাক্তার ওষুধ সব চলছিল আর আমি সেই প্রথম দিন থেকেই জেঠির কাছে থেকে গেছিলাম।

মা, বাবা কোনদিন আমাদের কোন কাজে বাধা দেয়নি এবারও দিলো না।

ওপর থেকেই রান্না করে মা সব পাঠিয়ে দিতো। রিয়া'দি মাঝে মাঝেই আসতো কিন্তু আমি নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে ওই জেঠির পাশেই থাকতাম।

দিন কাটছিল আর আমার কলেজ যাবার দিন এগিয়ে আসছিল। মা দেখা শোনা তেমন ভাবে করতে পারবে না বলে পিসির ওপর জেঠিকে দেখার ভার এসে পড়লো।

ভালো ছিল পিসি কিন্তু দু'জনের একদম বনি-বনা হতো না।

হাঁড়ির মতো মুখ করে পাশ ফিরে শুয়ে থাকতো জেঠি, পিসিও অন্যমনে নিজের বই বা সেলাই নিয়ে বসে থাকতো।

আমি কলেজ থেকে ফিরেই কিছু না খেয়েই পৌঁছে যেতাম জেঠির কাছে। পিসি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচতো। সোজা উঠে ওপরে নিজের ঘরে পৌঁছে যেত।

বছর ঘুরে আবার নতুন বছর আসার আগেই আমার বিয়েটা হঠাৎ ঠিক হয়ে গেলো।

আমি শুধু না আমার বাড়ির লোকেরাও খুব অবাক হলো যখন অভিমন্যুর মতো এত হ্যান্ডসাম ছেলে রাজি হয়ে গেছিলো আমাকে বিয়ে করতে।

ছোট্ট পরিবারে অভিমন্যু ওর বাবা মা আর ওর ঠাকুমা থাকতো।

মেয়ে দেখতে ওর ঠাকুমা এসেছিল ওর বাবার সাথে।

সেদিন জেঠির শরীরটা বড্ড খারাপ ছিল। ঝুমদি এসেছিল আমাকে দেখতে আসবে শুনে। মা আর রিয়া'দি বারবার তাড়া দিচ্ছিলো আমাকে

"মিমি চল, ফেসপ্যাকটা লাগিয়ে নে, আর সময় নেই, ওরা পাঁচটা বাজলেই এসে পড়বে"

কিন্তু আমি যতবার জেঠিকে ঘুম পাড়িয়ে ঝুমদি আর পিসিকে বলে উঠতে যাচ্ছিলাম, জেঠি আমার আঙ্গুল শক্ত করে ধরে বলে উঠছিলো

"যাস না আমাকে ছেড়ে মামণি"

জ্বরের ঘোরে ভুল বকছিলো জেঠি। আজকাল রাতে দিনে যখনই বেশি শরীর খারাপ হতো জেঠি আমাকে মামণি বলেই ডাকতো কেন কে জানে !

একটু পরেই বাবাইকে দৌড়ে আসতে দেখেই বুঝে গেছিলাম, ওরা এসে গেছে কিন্তু আমার তো কিছুই করার উপায় ছিল না।

আমি কোন মেকআপ ছাড়াই বসে ছিলাম জেঠির পাশে।

আমার কালো কোঁচকানো চুল এলোমেলো হয়ে আমার কপালকে প্রায় ঢেকে রেখেছিল। চান করে সেদিন চার বছর আগে জন্মদিনে বাবাইয়ের দেওয়া লাল কুর্তি আর সাদা স্কার্ট পরেছিলাম আমি।

মা আর ঝুমদি মিলে আমার জন্য রানী রঙের সিল্কের শাড়ি আর গয়নাগাটি বের করে রেখেছিল পাত্রপক্ষের সামনে পড়ার জন্য। কিন্তু সেসব কিছুই আর পরা হয়ে ওঠেনি।

আমার কানে সব সময়ের পরে থাকা সেই লাল ডালিম পাথরের অল্প ঝোলা দুল আর গলায় তেমনই পেন্ডেন্ট ছিল। হাতে সেই ঠাম্মির দেওয়া সরু সোনার বালা ব্যস আরেক হাত একেবারে খালি।

বাবাইয়ের পেছনে এক এক করে সবাই ঢুকলো ঘরে। আমি জেঠির হাত ছাড়িয়ে উঠতে যাবার আগেই অভির ঠাম্মি বারণ করলো আমায়

"না না উঠো না। ওনার ঘুম ভেঙে যাবে !'

অভি দেখলো আমায় এক পলক। কে জানে কেন আমাকে তো এর আগেও কেউ পছন্দ করেনি তাই জানতাম এটাও তেমনই কিছু হবে।

আমি তো বড্ড কালো, আমি সাজতেও ভালোবাসি না।

তাই আমি নির্দ্বিধায় জেঠির হাতের থেকে হাত একটু ছাড়িয়ে হাত জুড়ে নমস্কার করেছিলাম।

কিন্তু পরে জেনেছিলাম শেষ বিকেলের কনে দেখা আলো সেদিন জেঠির ঘরের পশ্চিমের জানলার পর্দা ছুঁয়ে ছুঁয়ে আমার মুখে নাকি কি একটা অপরূপ আলো ছুঁইয়ে দিয়েছিল।

আমার খোলা এলোমেলো কোঁচকানো চুলের মাঝে অভির ঠাম্মি নাকি নিজের কমবয়সের 'আমি'টাকে খুঁজে পেয়েছিল।

বিয়েটা হলো আমার ঠিক একবছর পরে কারণ রিয়া'দির বিয়েটা অনেক বছর ধরেই ঠিক ছিল ওর কলেজের বন্ধুর সাথে। বাবাই শেষ পর্যন্ত রাজি হতেই দি আর শুভাশিসদার বিয়েটা হয়ে গেলো।

জেঠি সুস্থ হলেও আমাকে কাছ ছাড়া করতে চাইতো না তেমন করে ।

"আর কদিন পরেই তো চলে যাবি আমাদের ছেড়ে তোর ওই নতুন সংসারে, আর তো এসে থাকবি না এমন করে, এই কটা দিন আর ওপর নীচ না করে আমার কাছেই থাক না হয় !" সারাক্ষণ এটাই বলতো জেঠি।

বিয়ের কেনাকাটা দিদিরা আর বাবাই করেছিল। গয়না মা আগেই তৈরি রেখেছিল নিজের দুই মেয়ের জন্য।

বিয়ের আগের দিন জেঠির ঘরেই আইবুড়ো ভাত খেয়েছিলাম আমি।

নিজে বসে সমস্ত রান্না করেছিল জেঠি আমার জন্য। কারোকে হাত লাগাতে দেয়নি তাতে তেমন করে রিয়া'দি ছাড়া।

সবার খাবার শেষে বাবাইয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল জেঠি। হাতে মস্ত বড় দু দুটো প্যাকেট দেখে বাবাই অবাক হয়ে সব ভুলে সেই আগের মতোই বলেছিল

"কি আছে গো বৌদি, আমার জন্য উপহার এনেছো তুমি !"

কেঁদে ফেলেছিল জেঠি আর প্যাকেট বাবাইয়ের হাতে ধরিয়ে বলে উঠেছিল

"ক্ষমা করে দিও ঠাকুরপো। সেই একদিনের কথা শূল হয়ে বিঁধে আছে তোমার বুকে জানি। কিন্তু বৌদিরা তো মা হয় তাই না। ক্ষমা করে দিও আমাকে !'

প্যাকেটে কি ছিল তা বিয়ের দিন আমি জেনে ছিলাম...

লাল টুকটুকে বেনারসি শাড়ি আর অন্য প্যাকেটে জেঠির নিজের বিয়ের জড়োয়ার হার। লাল ছোট ছোট পাথরে সাজানো সে হার আমার ছোট থেকেই খুব পছন্দ ছিল।পাশে এসে বলেছিল জেঠি " মিমি পছন্দ হয়েছে তো !"

সাজাতে সাজাতে ঝুমদি ফিসফিস করে কানে কানে বললো

"ইশ এই হারটা মা তোকে দিয়ে দিলো, আমাকে দিলো না"

আমি গলা থেকে খুলতে যাচ্ছিলাম, মারলো দি আর ঝুম'দি আমার পিঠে।

"সব সময় খুব ভালো সাজতে ইচ্ছে হয় তাই নারে ! চুপ করে বসে থাক, বর এলো বলে !'

বিয়ে করে চলে আসার আগে কাঁদিনি আমি, আসলে কোন মেয়েরাই কাঁদে না মনে হয়। ওটা কান্না নয় আসলে...

একটা গাছকে নিজের চেনা চেনা জায়গা ছেড়ে শুধু একটা অচেনা জায়গায় নতুন মাটিতে বসিয়ে দেওয়া !

একটা একটা করে শেকড় ছিঁড়ে যায় কেউ জানতে পারে না, কেউ স্পর্শ করতে পারে না তার কষ্ট।

অন্য জায়গায় আলো হাওয়া ভালোবাসা পেয়ে কেউ কেউ খুব সুন্দর হয়ে যায় আর কেউ বা কিছুদিন বেঁচে একটু একটু করে শুকিয়ে মরে যায়।

অভিকে প্রশ্ন করে ছিলাম বৈ কি

"এত সুন্দর সুন্দর মেয়ে থাকতে এই কালো মেয়েটাকে কেন পছন্দ করেছিলে তুমি ! জানো সত্যি বলছি আমি খুব অবাক হয়েছিলাম "

অভির বাড়ির ছাদে, বারান্দায় গাছের ভিড়ে আমি নিজের একটা কোনা বানিয়ে নিয়েছিলাম আমার মতো করে, শেকড় ধীরে ধীরে ছড়িয়ে আমি নাকি সুন্দর হয়ে উঠছিলাম...

গোধূলির আলো সেদিনও আমার মুখে পড়েছিল বোধহয়। আলতো হাতে আমার কপাল থেকে চুল সরিয়ে অভি বলেছিল

"সেই ছোট থেকেই ঠাম্মির মুখে শুনে এসেছি রঙ রূপ সে তো মনের আয়না। অন্তরের আলো যখন হৃদয়ে নিজের জলছবি আঁকতে থাকে, সেই আলো মানুষের চোখে মুখে তার ছাপ ফেলে , তুমি যে কত সুন্দর তা তুমি আমার চোখে দেখে নিও !"

দূর ! আমি এত সব বুঝি না !

আমি শুধু জানি, নিজের মনের আলোয় অন্যকে একটু পথ দেখানো গেলে তাতে ক্ষতি কি !

আমি কালো, বড্ড কালো কিন্তু কি করি ওই ভালো হবার ইচ্ছেটা যে সেই ছোটথেকেই।

এই দেখো না বলতেই ভুলে গেছি ওই লাল বেনারসি আর জড়োয়ার হার পরে জেঠির পা ছুঁয়ে যখন বলেছিলাম " সাবধানে থেকো মামণি, আমি কিন্তু খুব চিন্তায় থাকবো তোমাকে নিয়ে!"

জেঠি কেঁদেছিল খুব, খুব জোরে।

বলেছিল "মামণিকে ক্ষমা করে দিস সোনামা !"

আমি কিন্তু দেখছিলাম, তিন বছরের একটা কালো মেয়ে পুজোর অষ্টমীতে লাল বেনারসী আর জড়োয়ার হার পরা জেঠির গলা জড়িয়ে কোলে বসে বলছে

"তুমি তো আমার মামণি, ঠিক এমন লাল শাড়ি আর হার দেবে গো আমাকে "

বড় হয়ে সবার মুখে হাজার বার শুনেছিলাম সে কথা।

সব ভাবতে ভাবতে

আমি হাত ছাড়িয়ে ধীরে ধীরে চৌকাঠ ডিঙ্গিয়ে বাইরে বেরিয়ে বাগানের অনেক গাছের মাঝখান দিয়ে আলতা পায়ে চলে গেছিলাম টুকটুকে লাল বেনারসী পরে অভিমন্যুর সাথে... অনেক গুলো শেকড় নিঃশব্দে ছিঁড়তে ছিঁড়তে...

শত সহস্র হাজার হাজার মেয়েদের মতো... একটা ছায়া ছায়া মাটির সন্ধানে... বাকি জীবনটার জন্য !


"শোকসংবাদ" - সায়ন বণিক

Edit Posted by with No comments

 


শোকসংবাদ

সায়ন বণিক

 

ভোর থেকেই সেই একইরকমই ব্যস্ততা। ফিসফাস কথা, বিষণ্ণ চাহনি, পা টিপে টিপে চলাফেরা। এক তলায় সিড়ির মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে থাকা ভাইবোন, দেবু আর দিয়াকে কান্নার কিনারে ঠেলে দিচ্ছে। দিয়া তার দাদার গা ঘেঁষে সরে এসে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, দিয়ার মুখটা চেপে ধরে একটা হিস হিস করে উঠলো। তা সত্বেও দিয়া মুখটা ছাড়িয়ে বলে উঠলো, ঠিক মানুষের গলায় চেঁচাচ্ছে, নারে? আমার যেন কেমন কষ্ট হচ্ছে রে দাদা !

নিচের ঘরে তখন ওদের মা রূপালী, বাবা গিরীশ আর চাকর সুকুমার। ঘরে পাখা নেই তাই দোতলা থেকে স্ট্যান্ড ফ্যানটা আনা হয়েছে। সেই একটানা ভোমরা ডেকে যাচ্ছে। মেঝেয় সতরঞ্চিতে শুয়ে আছে একটা ল্যাব্রাডর কুকুর। পাখার হাওয়া তার ধূসর মেশানো সাদা লোমে কাঁপুনি তুলছে। গত তিন দিন ধরে প্রসবযন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। "নেমো নেমো... লক্ষ্মীমেয়ে, সব ঠিক হয়ে যাবে। ডাক্তারবাবু তোমার কিচ্ছু ভয় নেই। সোনা আমার... আর একটু কষ্ট সহ্য করো তো মা।" নেমোর গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে রূপালীর স্বর বেদনায় রুদ্ধ হয়ে এল।

"ইসস, পরশুদিনই ডাক্তারকে খবর দিলে ভালো হত।" গিরীশ আফশোস করল।

"ডাক্তারবাবুকে ফোন করেছিলে তুমি?"

"হ্যাঁ, করেছিলাম। বললেন যে পাঁচ দশ মিনিটের মধ্যে এসে পড়বেন।" মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে গিরীশ বলল।

সুকুমার চুপ করে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে। গিরীশ তাকে বলল, "দেবু আর দিয়া যেন নিচে না নামে দেখিস। আর রান্নাবান্না আজ আর করে দরকার নেই। তুই বরং —" গিরীশ তাকাল রূপালীর দিকে।

"যা গরম পড়েছে, দই চিড়ে আর আম নিয়ে আসুক।" রূপালী বলল।

"আমিও তাই বলতে যাচ্ছিলুম। কাল ম্যাক্সিমাম ছিল, থার্টি নাইন পয়েন্ট ফোর, অসহ্যকর... রিচ রান্নাবান্না এখন থাক।"

"দেবু দিয়া, তোমরা কিন্তু এক তলায় একদম নামবে না, সিঁড়ি থেকে উঁকিঝুঁকিও নয়। যাও, ওপরে যাও। নেমোর বাচ্চা হওয়ার পর নামবে, তার আগে নয়।"

"বাবা, কখন হবে?" দেবু বলল।

"জানি না রে বাবা, ডাক্তারবাবুকে আনতে যাচ্ছি। দেখা যাক কী হয়!" উদ্বিগ্ন স্বরে গিরীশ বলল।

দোতলার বাথরুমের পাশে দিয়ে চলে গেলে পশ্চিমের বারান্দা। সেখানে দাঁড়ালে, কৃষ্ণচূড়া গাছের ডাল পাতার ফাঁক দিয়ে বাইক, সাইকেল এবং দু একটা স্কুল বাস যাতায়াত করতে দেখা যায়।

কিছু ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করে দিয়া বলে উঠলো, "দাদা এবারও যদি গতবারের মতো তেমন বৃষ্টি হয়? মাছ ধরবি?"

দরজা ঠক্ ঠক্ করতে করতে সুকুমার বলে উঠলো, "বাবুরা, কি করছ এখানে মাথায় হাত দিয়ে বসে বসে?"

"আচ্ছা, এই করোনা ভাইরাসের জন্য তোমাদের স্কুল কতদিন বন্ধ থাকবে?"

জলের গ্লাস হতে নিয়ে দেবু বলল, "সরকার থেকে তো একত্রিশে মার্চ অবধি ছুটি ঘোষণা করেছিল। সেটাকে আরও বাড়িয়ে নিয়ে পনেরোই এপ্রিল পর্যন্ত করে দিয়েছে।"

নিচ থেকে রূপালীর ভেসে আসে দিয়ার কানে।

"সুকুমারদা, মা তোমাকে বোধহয় ডাকছে।"

—"সুকুমার, ওই সুকুমার।"

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে সুকুমার বলে উঠল, "যাচ্ছি, বৌদিমণি।"

দু’জনে বারান্দার গ্রিল থেকে যতটা সম্ভব ঝুঁকে দেখল, সরকারি চাকুরি থেকে অবসর নেওয়া পাশের বাড়ির জগদীশবাবু রবারের নল দিয়ে তাঁর ছোট বাগানটিতে জল ছিটোচ্ছেন।

"নেমোর এবার ক টা বাচ্চা হবে বল তো দাদা?"

"আটটা।"

"এমনি, আন্দাজে, আগের বারও আটটা হয়েছিল না?"

"সব বিক্রি করে দিল। এবার বাবাকে বলবি একটা বাচ্চা রেখে দিতে।"

"তুই বলিস বাবাকে।"

"না।"

দেবু বোনের মুখের ভাব লক্ষ্য করে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বলল, "এক একটা বাচ্চার দাম কত জানিস ? প্রায়, পনেরো কুড়ি হাজার টাকা।"

কিছুক্ষন পর, দিয়া খোশমেজাজে বলে উঠলো, "অ্যাই, একবার সিঁড়িতে গিয়ে দেখে আসবি?"

"বাচ্চা হল কি না?"

"হ্যাঁ।"

দিয়ার সঙ্গে দেবুও সিঁড়ি পর্যন্ত গেল। পা টিপে টিপে দিয়া সিঁড়ি দিয়ে নেমে ল্যান্ডিংটা ঘুরছে আর সঙ্গে সঙ্গে দাঁতচাপা গর্জন উঠল।

"বলেছি না একদম নামবে না। যাও, যাও। সুকুমার, দুটোকে ঘরে বন্ধ করে দিয়ে আয় তো।"

দিয়া দেবুর অনুযোগের দৃষ্টি রেখে বলল, "তোর জন্যই তো।"

দোতলায় এসে সুকুমার ওদের দুজনের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, "দাদা বৌদির এখন মাথার ঠিক নেই, বুঝেছ ? একদম শব্দটব্দ করবে না। করলে ডাক্তারবাবুর হাত নরে যাবে আর..."

"নেমো তাহলে মরে যাবে সুকুমারদা?"

দিয়া ব্যাকুল চোখে তাকিয়ে। দেবু ঢোঁক গিলল।

"সুকুমার মাঝবয়সি, বারো বছর এ বাড়িতে কাজ করছে। দেবুর জন্ম হয় কাজ নেবার দু মাস পর। তার কোলে পিঠে করেই এরা বড়ো হয়েছে। দুজনের অবস্থা দেখে সুকুমার কষ্টবোধ করল।

"মরবে কেন। এমনিতেও, যা করোনা ভাইরাসের ছড়াছড়ি...। যাই হোক, দরজাটা ভেজানো থাক বেরিয়ো না কিন্তু।"

দরজা বন্ধ হওয়া মাত্র দিয়ার চোখ জলে ভরে এল।

দেবু উদভ্রান্তের মতো বলল, "তোর চোখে জল কেন? তুই কি কাঁদছিস ?"

দিয়ার কান্না আরও বেড়ে গেল। বিছানায় আছড়ে পরে সে বালিশে মুখ চেপে ফুপিয়ে কাঁদতে শুরু করল।

বারান্দায় গিয়ে দেবু কৃষ্ণচূড়া গাছটার ফাঁক দিয়ে সে রাস্তার দিকে তাকাল। দু দিক থেকে দুটো বাইক এসে চলে গেল। গাছের ডালে বুলবুলি ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করছে। শালিক আর কাকও সে লক্ষ্য করল কিন্তু কোন কিছুই তার মনের উপর বসছে না। ঘরে এসে, ঘামে সপসপে গেঞ্জিটা খুলে দেবু পা ছড়িয়ে বসল।

কিছুক্ষণ পর, দেবু বাথরুম থেকে আসার সময় হঠাৎই খেয়াল করল, জঞ্জাল এবং বালির স্তূপের উপর কয়েকটা প্রাণী কিলবিল করছে।

"দাদা, ওই দাদা?" চোখ মুঝতে মুঝতে জানালার ধারে এসে দাঁড়াল দিয়া।

"দেখ, বুনু দেখ – এক দুই, তিন... চার, পাঁচ... ছয়!"

"কোথা থেকে এল রে, এই কুকুরছানাগুলো ? কাল তো চোখে পড়েনি।"

কান লেজ আর পিঠের কিছু অংশ কালো, এমন একটা সাদা কুকুর ধীরে ধীরে ছানাগুলোর দিকে এগিয়ে এল। পেটটা ঝুলে রয়েছে। দেবু স্তনের বোঁটাগুলো দেখতে পাচ্ছে। কুকুরটাকে সে স্কুলে যাবার সময় রোজ দেখেছে। জুয়েল কেটারিং – এর দোকান থেকে সম্রাট সুইট্স পর্যন্ত পাঁচ ছটা বাড়ির সামনের রাস্তায় যে তিন চারটে কুকুর বসে থাকে, ঘুমোয় আর অন্য কুকুরদের সঙ্গে মারামারি করে, তাদের মধ্যে দেবু একেও দেখেছে। একে সে চেনে।

একদিন নেমোর ভিটামিন ট্যাবলেট ফুরিয়ে যাওয়ায় সুকুমার কিনতে যাচ্ছিল। দোকানে ওষুধ ছাড়াও অনেকরকম জিনিস বিক্রি হয়। আইসক্রিম, সফট ড্রিঙ্কস ইত্যাদি। মা র কাছ থেকে টাকা নিয়ে দেবু আর দিয়া সুকুমারের সঙ্গে যায়।

ওরা কাঠের চামচ দিয়ে খেতে খেতে বাড়ি ফিরছিল। পাশে পাশে হাঁটছিল একটা কুকুর। মজা করার জন্য দিয়া একটু আইসক্রিম চামচ থেকে উঁচু করে ফেলল। কুকুরটা তৈরি ছিল না, তাই রাস্তায় পড়ল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই চেটে নিল। এরপর আরও পাবার আশায় চলতে চলতে মুখ তুলে বার বার সে দিয়ার দিকে তাকাতে লাগল। কিন্তু দিয়া আর ওকে খাওয়াতে রাজি নয়।

"দে না ওকে।" দেবু বলছিল।

"আহাহা, তুমি দাও না। এইটুকু তো কৌটো। একটা খেয়ে কি কিছু হয়?"

ঠিক এই সময়ই দেবু হোঁচট খেল, একটা ইঁটে আর পড়তে পড়তে নিজেকে সামলালেও আইস্ক্রিমের প্লাস্টিকের কৌটোটা হাত থেকে ছিটকে রাস্তায় পড়ল। সবাই দাঁড়িয়ে গেছে। কুকুরটাও। কিন্তু তাড়াতাড়ি চেটে খেতে নেবার বদলে সে দেবুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। সেই সময় দেবু কুকুরটার চোখে কেমন একটা দুঃখ পাওয়ার মতো ভাব যেনো দেখতে পায়। তখন ছুটে এসে আর একটা কুকুর জিভ দিয়ে আইসক্রিমটা চেটে নিতে নিতেই গোঁ গোঁ শব্দ করে ভয় দেখাল। কেউ যেন, এমনকী অন্য কুকুরটাও যেন তার খাবারে ভাগ না বসায়।

সুকুমারের কাছে টাকা ছিল, সে দোকানে ফিরে গিয়ে আর এক কৌটো আইসক্রিম কিনে এনে দেবুর হতে দেয়। দিয়া তখন আকাশের দিকে মুখ তুলে বলেছিল, "দাদা তো কৌটোটা শেষ করেই ফেলেছিল, তাহলে আবার একটা নতুন কেনার কী দরকার।"

"মোটেই শেষ করে ফেলিনি। আদ্দেকেরও কম খেয়েছি। আচ্ছা তুই একটু নে।"

দিয়া আপত্তি করেনি। দেবু লক্ষ্য করল তখনও কুকুরটা তাদের সঙ্গ ছাড়েনি। দিয়া বলল, এবার তুই ওকে দে।

"দেবই তো।"

ঝুঁকে নিচু হতে দেবু কৌটোটাই ওর মুখের কাছে ধরল। মুখ সরিয়ে নিল কুকুরটা, অপ্রতিভ যতটা নয় তার থেকেও বেশি অবিশ্বাসভরে।

"খা খা, খেয়ে নে।"

এদিকে বাবা অফিস থেকে ফিরে এসে রূপালীর ঘরের দরজায় টোকা দিল। দরজা খুলে যেতেই সে ঘরে ঢুকে রূপালীকে জড়িয়ে ধরল।

"একি, একি ! ঘরের মধ্যে নয়। ওরা চলে আসতে পারে !"

গিরীশ দরজার ছিটকিনি লাগাচ্ছিল এবং বিছানায় রূপালী হলুদ আঁচলটাকে সরিয়ে কমলা রঙের অর্গান্ডির ব্লাউজটা খুলে, সাদা ব্রেসিয়ারটা খুলতে শুরু করেছিল।

গিরীশ মুচকি হেসে রূপালীকে বিছানায় শোয়াতে শোয়াতে বলল, "নেমে তো আছেই ওর আওয়াজেই বোঝা যাবে।"

এরপরে সে কেমন একটা লাজুক লাজুক ভঙ্গিতে সে প্রথমে জিভ দিয়ে একটু চাটল, তারপর কৌটোয় জিভ ঢুকিয়ে কয়েক সেকেন্ডেই সাফ করে দিল।

এরপরও সে ওদের পিছন পিছন চলছিল। দেবু ধমক দেয়, "আর নয়, আবার এখানে থাম।" কুকুরটা আর এগোয়নি।

"ও দিদিভাই – দাদাভাই, তোমরা এখানে কী দেখছ, জানালার ধারে দঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে?" সুকুমার খাবারের থালাগুলো হতে নিয়ে বলল।

"আরে সুকুমারদা, মনে আছে সেই সাদা কুকুরটার ? যে আমাদের পিছন পিছন আসছিল...।" দিয়া বিছানায় বসে বলল, "ছার না... এখন এসব কথা থাক।"

"তোমাদের খাবার দিয়ে গেলাম। ওপরে বসেই খেয়ে নিও। নেমোকে আর বাঁচানো গেল না।"

ভাইবোন কিছুক্ষণ পরস্পরের চোখের দিকে অবিশ্বাসভরে তাকিয়ে জীবনের প্রথম শোকসংবাদটা থেকে নিজেদের গুটিয়ে রাখল।


Jun 10, 2021

"অ্যা নাইট ইন থর ডেসার্ট (৪ঠা অক্টোবর ২০১৪)" - তীর্থংকর দে

Edit Posted by with No comments

 


অ্যা নাইট ইন থর ডেসার্ট (৪ঠা অক্টোবর ২০১৪)

তীর্থংকর দে

 

পাধারো সা - স্বাগতম আপনাকে থর মরুভূমিতে আজকের রাত্রিযাপনে। গতকালই রাত ১০টা নাগাদ জয়সালমীর পৌঁছেছি। আজ সারাদিন সোনার কেল্লায় কাটিয়ে বিকেল ৪:৩০ মিনিটে আমরা থরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলাম।

জয়সালমীর শহর থেকে থর মরুভূমি প্রায় ৪৫ কিমি। শহর ছাড়িয়ে গাড়ি এগিয়ে চলেছে আরব্য রজনীর পরিবেশে। এই পথেই উটের পিঠে মাল যেত সারা মধ্য প্রাচ্যে। প্রায় ২০ কিমি যেতেই পান্নালাল জি গাড়ি ঢুকিয়ে দিলেন ভাঙ্গাচোরা ইট আর মাটি দিয়ে তৈরি একটা রাস্তায়। গাড়ি টার্ন করার পর আমি কিছু বলার আগেই উনি বললেন সামনে কুলধ্রা গাঁও। এখানকার শাসকের কু নজরে পড়েছিল এই গ্রামেরই গ্রাম প্রধানের মেয়ে। স্বজাতির সেই মেয়ের সন্মান বাঁচাতে  সারা গ্রামের মানুষ একরাতে একসাথে গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। তারপর থেকেই এই গ্রাম একাকী সেই ইতিহাস বুকে নিয়ে দিনাতিপাত করছে। ঘুরে দেখলাম পরিত্যক্ত গ্রাম কুলধ্রা।

আবার গাড়ি ছুটতে শুরু করলো। চারিদিকে ধু-ধু বালুরাশি। একদম জনমানবহীন। অনেক পরে রাস্তায় একটি মিলিটারি গাড়ি দেখলাম। এই রাস্তাটি ইন্ডিয়ান আর্মির তত্ত্বাবধানে রয়েছে। কিছু দূর গিয়ে দেখলাম ফাকা মাঠে একটি জিপ গাড়ির সাথে দড়ি বেঁধে প্যারাস্যুট ডাইভিং ছচ্ছে। যদিও এক্ষেত্রে আমি সাহসিকতার পরিচয় দিতে পারিনি।

আরো কিছুটা যাবার পর একটা পয়েন্টে দেখি অনেক জিপ গাড়ি দাড়িয়ে রয়েছে। পর্যটকদের গাড়ি দাড় করিয়ে করিয়ে ওরা ডাকছে ১০০০ টাকায় জিপ সাফারি, ডেসার্ট মে সানসেট মত মিস করে স্যার, আইয়ে আপলোগ। ওদের ডাকে সাড়া দিয়ে ৮০০ টাকায় সানসেট দেখতে গেলাম আমরা। ৬ কিমি মরুভূমির  ভেতর গিয়ে দেখলাম সূযাস্তের অবর্ননীয় ছবি। চোখের সামনে মরুভূমির রঙ পরিবর্তন হতে লাগল। ভীষণ সুন্দর দৃশ্য দেখে ফেরার পথে হোলো ভয়ানক অভিজ্ঞতা। সাফারি জিপ হোলো নষ্ট, এদিকে অন্ধকার নেমেছে। আমাদের ফোনে তো নেটওয়ার্ক নেইই, ড্রাইভারের ফোনও কানেক্ট হচ্ছে না। মা আর দিদি প্রায় কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে। সাফারির ড্রাইভর কোনো ভাবেই আমাদের শান্ত করতে পারছে না। অন্ধকারে কোনোভাবেই রাস্তা খুঁজে পাওয়া যাবে না, তবুও হেটে হেটে রওনা দিই একথা বাবাকে বললাম। বাবা রাজি নন। ১৫ মিনিটের মধ্যেই একটা জিপ চলে এলো, ওরা আমাদের খুঁজতেই এসেছে। পড়ে ভাবলাম মাত্র ১৫ মিনিটই আমাদের কাছে এতক্ষণ কয়েক ঘণ্টা মনে হচ্ছিলো। ভগবানের কৃপায় রক্ষা পেলাম।

সন্ধ্যা ৭টার কিছু পরে আমরা এলাম মরুভূমির মাঝে আমাদের ক্যাম্পিং স্টেশনে। গাড়ি দাড়াতেই ওরা যেভাবে আমাদের স্বাগত জানালো, প্রথমবার কোনো পর্যটন কেন্দ্রে এমন আতিথেয়তা পেলাম। বিরাট বড় ঢোল সহ বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে, কপালে তিলক কেটে আমাদের নিয়ে আসা হোলো ক্যাম্পিং স্টেশনের ভেতরে। চারিদিকে টেন্ট আর মধ্যিখানে নাচ-গানার আসরের জন্য ফাঁকা জায়গা। আমাদের নির্দিষ্ট টেন্টে ওরা লাগেজ ঢুকিয়ে দিলো। আমরা বসলাম নাচগানের আসরের সামনের নির্দিষ্ট জায়গায়। বসতে বসতেই চলে এলো চিড়ের পোলাও, কচুরি, চা আর বিস্কুট। শুরু হোলো রাজস্থানি ফোক সং, সঙ্গে বিভিন্ন শারীরিক কসরত। তারপর শুরু হোলো ফোক ডান্স। আমরাও যোগ দিলাম সেই আসরে। এখানে বাবা যা ডান্স দেখালো, একেবারে ৫৭ বছরের যুবক। ঘন্টা দুয়েকের এই অনুষ্ঠানে রাজস্থানি লোকসংস্কৃতির একটা আন্দাজ পাওয়া গেলো। থর মরুভূমিতে কাটানো বিগত কয়েক ঘণ্টায় মনে হচ্ছিল ভারতের মধ্যেই এ যেন এক অন্য ভারত।

এরপর ডিনার হলো বিভিন্ন ভেজ রাজস্থানি পদের সমন্বয়ে। রাতে খাবার পর টেন্টের কর্মচারীদের সাথে গল্প করছিলাম, ওরা জানালো এখান থেকে মাত্র ১২০ কিমি দূরে তানোট মাতা মন্দির, লঙ্গেওয়ালা পোস্ট। স্থানীয় মানুষ এবং বি এস এফ রোজ মন্দিরে পূজার্চনা করে, তারা প্রবলভাবে বিশ্বাস করে ১৯৭১ ভারত পাকিস্তান যুদ্ধে তানোট মাতার অসীম কৃপায় ভারতের যুদ্ধে জয়লাভ ঘটেছিল। আরো অনেক গল্প করতে করতে রাত প্রায় ১২টা বেজে গেলো, ঘুমতে চলে এলাম টেন্টর ভেতর। রাত যতো বাড়তে লাগল ঠান্ডাও পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকলো। ভোরের দিকে কম্বল টেনে নিয়েছিলাম। সকাল ৬টায় বেড়িয়ে পড়লাম ক্যামেল সাফারিতে। উটের পিঠে মরুভূমি ঘোরার অনন্য অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করলাম।

ক্যামেল সাফারির পর সকাল ৮টায় ব্রেকফাস্ট করে থর মরুভূমিকে টাটা জানিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম এখান থেকে প্রায় ৫১০ কিমি দূরের মাউন্ট আবুর উদ্দেশ্যে।




ছবি- সৌজন্যে লেখক


Jun 6, 2021

নেট ফড়িং সংখ্যা - ১৯৬

Edit Posted by with No comments

Jun 5, 2021

লেখকের চোখে নেট ফড়িং

Edit Posted by with 2 comments

 


লেখকের চোখে নেট ফড়িং

লিখেছেন- মহাশ্বেতা বসু

 

শব্দটি আমার এক ভাই এর মুখে প্রথম শুনেছিলাম। তখন মনে হয়েছিলো, এরকমও হয় নাকি ? ডিজিটাল প্লাটফর্মে সাহিত্য সৃষ্টি, কখনও সম্ভব?

আমি আবার চিরকালই একটু সেকেলে মানুষ। আমার কাছে সাহিত্য মানেই হলো, তার সাথে বই-এর পৃষ্ঠার গন্ধটা ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে থাকবে। মোবাইল বা ল্যাপটপ এর যান্ত্রিক হরফে সাহিত্য কি আদৌ জমবে ? প্রশ্নটা এসেছিল মনে।

কিন্তু না- আমার সমস্ত ধারণাকে মিথ্যে প্রমাণ করে আমাদের সামনে এলো সাহিত্য সৃষ্টির এক নতুন মাধ্যম, এক সম্পূর্ণ নতুন মোড়কে।

অপূর্ব সাজে, দুর্দান্ত সব কাব্য-ভাণ্ডার নিয়ে হাজির হলো নেট ফড়িং।

তারপর দিন যত এগোল ক্রমশ সাক্ষী হয়ে রইলাম তার বিকাশে।

অনুভব করলাম ভিজে ঘাসে আলতো নাড়া দিয়ে ঠিক যেভাবে ফড়িংগুলো নেচে বেড়ায়, ঠিক সেভাবেই নেট ফড়িংও নেচে বেড়াচ্ছে পাঠকদের মনে।

এখন প্রতি রবিবার সকালেই অপেক্ষা করে থাকি কখন সম্পাদক ভাই নেটফড়িং এর সাপ্তাহিক পত্রিকাটি প্রকাশ করবে।

আমার নিজের কিছু সৃষ্টিও এখন জায়গা পায় নেট ফড়িং এর পাতায়। এর জন্য আমি সত্যি আনন্দিত ও গর্বিত। নিজের সৃষ্টিকে নেট ফড়িং এর মাধ্যমে পাঠকদের কাছে পৌঁছে দিতে পেরে।

তবে এর পেছনে যাদের মূল অবদান তাদেরকে ধন্যবাদ জানাতেই হয়। আমার বিশ্বাস ওদের এই নিরলস পরিশ্রম অনলাইন ম্যাগাজিন নেট ফড়িং-কে আরো শীর্ষে নিয়ে যাবে।।

Jun 4, 2021

"আইসক্রিমওয়ালা" - সায়ন বণিক

Edit Posted by with No comments

 


আইসক্রিমওয়ালা

সায়ন বণিক

 

“এই কুলপি-কুলপি— পাঁচ টাকা, দশ টাকা" চেঁচাতে চেঁচাতে গ্রামের পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন এক বৃদ্ধলোক। বয়স কম করে বললেও ষাট-পয়ষট্টির অধিক না।

নদীর মাঝে পা রেখে যে দূর দিকের গ্রাম দেখা যায়, সেখান থেকে আরও ভিতরে গিয়ে দুই ক্রোশ পার হয়ে লোকটির বাড়ি। সে জায়গায় এখনও বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি। দু-তিনটে গেরস্ত বাড়ির আলো আছে ঠিকই, কিন্তু মাঝেমধ্যেই বিদ্যুৎ সংযোগ থাকে না। পাছে, গ্রামের মানুষগুলো গরমকালে একটু পাখার হাওয়া খেতে খেতে তাদের বাড়িতে বসে গল্প জমিয়ে ফেলে, এই ভয়ে বিদ্যুৎ থাকলেও তারা ‘না’ বলে ফিরিয়ে দেয়।

অসিত দাস। বামুন ঘরের মানুষ। তার বাবাও ছিলেন আইসক্রিম ব্যবসায়ী, তাঁর ছেলেটিও ধরেছে আইসক্রিমের ব্যবসা। গ্রামের মানুষেরা অসিতদা-অসিতদা বলেই তাকে ডাকে। খুব চেনা মুখ এই অসিতদা, যদিও ‘অসিতদা-র আইসক্রিম’ বলাই ভালো।

গরম পড়লেই, ছোট থেকে বড়োদের একটাই নাম জপ হতে থাকে— অসিতদার আইসক্রিম, অসিতদার আইসক্রিম। ছোট-ছোট শিশুরা তাকে না চিনলেও তার গাড়ির ওপর বড়ো করে ‘অসিতদার আইসক্রিম’ লেখাটি দেখে ঠিক চিনে ফেলে। তখন কেউ বা, কাকু কেউ বা দাদু এসব বলেই তাকে সম্বোধন করে। আর, গ্রামের দিনমজুর-কৃষক ওরা তো সবাই প্রায় তার কাছ থেকে আইসক্রিম নেয়— আবার কেউ কেউ তার বাবার কাছ থেকেও নিত একসময়।

সেই গ্রামের দিনেরবেলা যেমন চারিদিকটা ঝলমলে, সূর্যালয়ে ছোট ছোট শিশুরা খেলে, কৃষকেরা মাঠে চাষ করে, দিনমজুরেরা শহরে আসে বিভিন্ন বাড়িতে কাজ করতে, ঠিক তেমনি রাতেরবেলাটা একদম অন্যরকম। রাতের গ্রামের পরিবেশটা এখানে খুব শান্ত হয়ে ওঠে— অবশ্য, শান্ত বললেও ঠিক মানায় না। ঝিঁ-ঝিঁ পোকাদের ডাকগুলি রাত হলেই কানের মধ্যে বাজা শুরু করে দেয় একভাবে। সেখান থেকে কিছুটা দূরেই একটা মরা নদী বয়ে গেছে গ্রামের ভিতর দিয়ে। বর্ষার সময় বড়ো নদীর জল এই নদীতে প্রবেশ করে আবার জীবন্ত করে তোলে। আবার বন্যা হলে গ্রামের মাঠে-ঘাটে জল উঠে যায়, চাষিরা চাষ করতে পারে না বাড়িতে বসে থাকে। কিন্তু তাদের কর্ম্মের শরীর, বাড়িতে বসে থাকলেই বা কি ! তাদের বউ-এর সঙ্গে কাজ-কর্ম্ম করতে থাকে। তাদের বউগুলিও যে বসে থাকে না, ওরাও কাজ করে— বাড়িতে বসে বিড়ি বাঁধে। সেই গ্রামে, দুপুরের পর বিকেলে গেলেই দেখতে পাওয়া যায় তাদের বৌয়েরা বিড়ি বাঁধতে বসে আছে।

“কাকু, কাকু ! কাঠি আইসক্রিম আছে তোমার কাছে?" বৃদ্ধ লোকটির আওয়াজ শুনতে পেয়ে এক বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে একটি বাচ্চা তার কাছে জিজ্ঞেস করল।

“হ্যাঁ, আছে। কত টাকার লইবা বাবা?"

“পাঁচ টাকারটা দাও।

গাড়ির ভেতরটা খুলে পাঁচ টাকার একটা আইসক্রিম বাচ্চাটির হাতে দিয়ে আবার হাঁকতে হাঁকতে চলে গেল। লাল রঙের একটি আইসক্রিম হাতে পেয়ে মহানন্দে খেতে খেতে বাড়ির দিকে আবার চলে গেল।

“অসিতদা ! কেমন আছেন?" আইসক্রিম ফ্যাক্টরির একটা লোক জিজ্ঞেস করল।

“এই আছি..." কিছু বলতে গিয়ে আটকে গেল।

“আপনাকে সেরকম একটা দেখা যাচ্ছে না— কি ব্যাপার বলুন তো! অন্যকোনো ফ্যাক্টরির সন্ধান পেলেন নাকি আবার" লোকটি বিকটরকম দৃষ্টিভঙ্গি করে অসিতবাবুর দিকে তাকালেন।

“না বাবা ! শরীরটা কয়দিন ধইরে দেখি খুব খারাপ যাইতেছে। আর এখন ব্যবসাও সেরকম একটা নাই।" ইতস্ততভাবে বলতে থাকলেন অসিতবাবু।

তার কথা শুনে নিয়ে লোকটি বলল, “শরীর খারাপ হলে বাড়িতে থাকতে পারেন তো। কেন ফালতু এতটা দূর প্রতিদিন শহর থেকে গ্রামে নিয়ে আইসক্রিম বেঁচেন !" তার কষ্ট দেখে লোকটিরও দুঃখ জাগলো।

“বেঁচিয়া যাইতে হয় এই পেটের দায়ে। আর তাছাড়া, আমাদের গ্রামের বাচ্চাগুলো খুব ভালোবাসে এই অসিতদা-র আইসক্রিম খাইতে।" কথা না বাড়িয়ে গাড়ি নিয়ে ফ্যাক্টরির ভিতর ঢুকল। গাড়ির ভিতর বরফ বসিয়ে আইসক্রিম ঢুকিয়ে নিয়ে ঢাকনাটা লাগিয়ে দিল।

“নিজের শরীরের একটু খেয়াল রাখবেন অসিতদা। দিন দিন যে শরীর শুকিয়ে যাচ্ছে।"

"হ্যাঁ বাবা। আছিই তো আর কয়েকটা দিন— এখন আর সংসারটাই চলে না যে !" প্রথম কথাটা জোরে বলে নিয়ে, একাই একাই বলতে থাকল বাকি কথাগুলো।

গাড়িটা টানতে টানতে আবার গ্রামের ভিতর দিয়ে প্রবেশ করল বৃদ্ধ লোকটি।

অসিতবাবুর বাবা যখন বেঁচে ছিলেন, তখন ‘পেপসি’ খুব চলত। থার্মোকলের বাক্সে রেখে ‘পেপসি-পেপসি’ বলে তার বাবাও চেঁচাতে থাকতো। বাবার হেঁকে যাওয়ার ধারাটাই পেয়েছে ছেলে। তার বাবার কাছে আইসক্রিম সেরকম একটা পাওয়া যেত না, পেপসিটাই বেশি রাখত। ভর্তি একটা ছোটো প্যাকেটের মধ্যে ফলের রসের মত তরলকে কঠিন বানিয়ে বিক্রি করত। সেই প্যাকেটের একটা দিক দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে, চুষে চুষে খেত ছেলেমেয়েরা।

অসিতবাবুর ক্লাস সেভেনে থাকাকালীন তার বাবা মারা যায়। তার ঠিক এক বছরের মাথাতেই মা মারা যায়। স্বাভাবিকভাবেই সংসারের হালটা তার মাথায় ধুপ করে পড়ে বসে। তার সাত বছরের একটা ছোট বোন ছিল। তার বোনটিও অসিতের অধীনে চলে আসে। বাবা মা-এর মৃত্যুর পর অসিত কাজের সন্ধানে এ জায়গায় - ও জায়গায় খুঁজতে থাকে। শেষপর্যন্ত তার পছন্দমত কাজ খুঁজে না পাওয়ায়, বাবার ব্যবসাটাই করতে শুরু করে। বোনকে ম্যাট্রিক পাশ করানোর পর বিয়ে দিয়ে দিতে হল। চার-পাঁচ বছর পর অসিতবাবু নিজেও কায়েস্ত ঘরের একটা মেয়েকে বিয়ে করে, বামুনের ঘরে আনলেন। অল্প অল্প করে ঘরের ভাঙ্গা ছাউনি ঠিক করলেন— সামনে বেড়া দিয়ে ঘিরে দিলেন। সেখানে তার আইসক্রিমের গাড়িটা রেখে দিতেন। তাদের একটি কন্যা সন্তান জন্মাল, তাকে মানুষ করে, অল্প-কিছু লেখা-পড়া শিখিয়ে বিয়ে দিয়ে দিল। এমনভাগ্য অসিতদার, মেয়েটিকেও দূরে বিয়ে দিয়ে দিল— সেও এখন দেখতে আসতে পারে না তার বাবা-মাকে। কোনরকমভাবেই দিনযাপন করতে থাকে জীর্ণ বৃদ্ধ এবং আইসক্রিমওয়ালা।

“গিন্নি ! দিন-দিন যে অবনতি হইতেছে আমাদের। এই অসিতদা আর অসিতদা নাই গো— বাজারে নাকি এখন বড়ো বড়ো কোম্পানির আইসক্রিম আসিয়াছে। বলাবলি করছিল ফ্যাক্টরির লোকেরাই।”

“কও কি? আমাদের যে পেটে মরতে হইবে, তা হইলে !”

“জানো, আজ পঞ্চাশটা টাকারও বিক্রি করতে পারি নাই। সারাদিন গাধার মত পরিশ্রম করিয়া, এদিক-সেদিক গ্রাম-গঞ্জে ঘুরিয়া যখন দুইজনের সংসারের জন্য খাওয়ার খরচটাই না ওঠে, তা হইলে তো একদিন না খাইতে পারিয়াই মইরা যাইব।”

বউ তার শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছে দেয়। সেও যে নিরুপায়— বিড়ি বেঁধে কি আর সংসার চলে; স্বামীকে যে যথাসাধ্য উপার্জনটুকু করতে হয়। এমন কপাল তাদের, একটা পুত্রসন্তানও জন্ম দিতে পারেনি তারা। যদিও, সব ছেলেরাই যে বাবা-মাকে দেখে বেড়াবে, সেটাও নয়। তারাও যে এখন আধুনিক, নিজেরটা খুব বুঝে নেয়। যদি সেই পুত্রসন্তান-ও তাদের না দেখত, পিছে লাথি মেরে তাড়িয়ে দিত। এইসব ভেবে, সেই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা কষ্ট পেলেও তাদের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে।

তিনি বললেন, “কখনও ভাবিনাই এই শেষ বয়সটায় আসিয়া আবার কষ্ট ভোগ করিতে হইবে।

আজকে ওই লোকগুলো বলাবলি করিতেছিল, ভ্যাদিলাল— কোলিটিয়ালস্ কি কি বা নতুন নতুন রকম কোম্পানির আইসক্রিম চলিতেছে বাজারে। গ্রামের লোকগুলাও নাকি এখন ওইসব কোম্পানির আইসক্রিম কেনে।

লোকাল আইসক্রিম যে আর চলে না গো— লোকাল আইসক্রিম যে আর চলে না। মানুষেরা ওই নতুন কোম্পানির আইসক্রিম পাইয়া এই লোকাল আইসক্রিমকেই ভুলিয়া গেছে। জানিনে গিন্নি, তোমার এই অসিতদা-র আইসক্রিম চলবে কিনা কখনও!”

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খাওয়ার পাতেই কথাগুলো বলছিল অসিতবাবু। এদিকে তার গিন্নি মাথার ওপর পাখার হাওয়া করেই চলেছে। ভাঙ্গা বেড়ার ভিতরে রাখা ছিল তার আইসক্রিমের গাড়িটি। দূর থেকেও, তার ওপরে ‘অসিতদা-র আইসক্রিম’ লেখাটি স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল।


"তোমায় চাহি রে" - মিলন পুরকাইত

Edit Posted by with 1 comment

 


তোমায় চাহি রে

মিলন পুরকাইত

 

হুট করে ছোড়দির বিয়ে ঠিক হয়ে গেলো। মেঘমালার হোস্টেলে ফোন এলো আর বাড়ি ফিরেই পিসির কাছে প্রশ্নের ঝুড়ি খুলে বসলো।

"কোথায় বিয়ে, কার সাথে বিয়ে" এই হাজার প্রশ্নের উত্তরে পিসি এক কাপ চা আর ডিমের পরোটা এনে পাশে বসলো

"তুই আসবি বলে আমি আগেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলাম। দেখ তো খেয়ে কেমন হয়েছে "

পিসিকে জড়িয়ে হেসে উঠলো মেঘমালা "সেই ছোট থেকে এটাই করে এসেছো তুমি। যখন যখন উত্তর দিতে পারো না আমার প্রশ্নের তখনই এমনটা করো। কিন্তু আজ না বললে আমি কিচ্ছুটি মুখে দেবো না। যদিও আমার খুব খুব খিদে পেয়েছে "

এতেই কাজ হল।

পিসি উঠে জানলার ধারে চলে গেল।

বললো "সে অনেক বড় গল্প। শুধু এইটুকু বলে রাখি তোর ওই উদ্ধত, কারোর কথা না শোনা ছোড়দি কি করে কে জানে এমনটা বদলে গিয়ে এই বিয়েতে রাজি হয়ে গেলো, আমি তো কিছুই বুঝতে পারিনি, তুই যদি পারিস জিজ্ঞেস করে নিস!"

রহস্য আরো বেড়ে গেলো মেঘমালার কাছে। উঠে জানলার পাশে এসে দাঁড়ালো। আর পিসির চোখে জল দেখে আরো ঘাবড়ে গিয়ে বললো "ও পিসি তুমি কাঁদছো কেন, কি হয়েছে সব বলো আমায়"

পিসি হাত ধরে এনে বসালো মেঘমালাকে খাবার টেবিলের সামনে আর ছোট ছোট টুকরো ওর মুখে দিতে দিতে বললো "ছেলেটা চোখে দেখতে পায় না "

বলেই আঁচল ঠুসে নিজের মুখে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগলো।

"মানে !"

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো মেঘমালা।

"এসব কি বলছো তুমি, আমি এখনই যাচ্ছি ছোড়দির কাছে।"

ওর হাত ধরে বসালো পিসি।

জন্ম থেকেই এই বাড়িতেই আছে রিক্তা। কি করে কে জানে বিয়ে থা আর করা হয়ে ওঠে নি। বাবা, মা, দাদা-বৌদিরাও কম চেষ্টা করেনি কিন্তু রিক্তা একবারও রাজি হয়নি এ সংসার ছেড়ে অন্য কিছু নিজের জন্য ভাবার।

আজ বাবার শরীর খারাপ, কাল মায়ের বুকে ব্যথা। কোনদিন রান্নার লোক এলো, কোনদিন এলো না সবেতেই তো রিক্তা। একে একে দুই দাদার বিয়ে হলো। দুই বৌদি এসে কোনদিন বাড়িতে একজন ননদ বসে আছে বলে কোন অশান্তি করেনি।

বরঞ্চ একে একে তাদের ছেলে-মেয়ে হয়েছে আর দিব্যি "ও দিদি ভাই একটু তুমি দেখো, একটু তুমি পড়িয়ে দাও " করতে করতে রিক্তার ঘর পরিবর্তন হয়েছে।

ছোট ঘর থেকে বড় ঘর।

তাতে চার ভাইপো ভাইঝির টেবিল খাট ঢুকেছে। আর রিক্তা পিসি থেকে কখন যেন এদের মা হয়ে গেছে

তাহলে আবার সংসার কেন আলাদা করে নিজের জন্য। এই তো সব পেয়েছির দেশ তার কাছে।

ধীরে ধীরে কেউ কাজের জন্য কেউ বা পড়ার জন্য বাইরে চলে গেছে রিক্তার সেই বড় ঘর ছেড়ে। মেঘমালা ক্লাস এইটে পড়ার সময় একটা সাদা কাগজের বোর্ডে লিখে ঝুলিয়েছিল

"সোনা পিসির হোটেল" ।

সেইটা কি করে আজও থেকে গেছে।

জানলা থেকে ফিরে এলো পিসি আর আদরের ভাইঝির মাথায় হাত বুলিয়ে বললো "তোর ছোড়দি জানিস তো ছোট থেকেই কেমন একগুঁয়ে, তোদের সবার চেয়ে আলাদা। মুখে যা আসে তাই বলে দেয়। কত বুঝিয়েছি সেই ছোট থেকে কিন্তু সেই এক কথা আমি অত রেখে ঢেকে বলতে পারবো না। অথচ মনটা ঠিক তালশাঁসের মতো নরম। কত মানুষকে কি ভাবে সাহায্য করে ও নিজেও হয়তো মনে রাখে না। "

থামলো পিসি, উঠে জল খেল আর মুখ মুছে আবার এগিয়ে এলো মেঘমালার পাশে।

" শুরু থেকেই সেই এক বন্ধু ওর মিতালী। সেই মিতালীর বাড়ি আসা যাওয়া একটু হঠাৎ বেড়েছিল। বৌদি মানে তোর মা বরাবর কারো সাতে পাঁচে থাকে না। তোর জেঠিমা সে তো আরো ব্যস্ত নিজের ঠাকুর ঘর নিয়ে। তা আমিই না পেরে আর রাতে যখন শুতে এসেছে আমার পাশে কথাটা তুললাম।

-তোর কি হয়েছে রে সোনাই, কিছুদিন ধরে বড্ড বদলে গেছিস। না চেঁচাস, না ঝগড়া করিস না শাসন করিস কাউকে-

তাতে মেয়ে একটিও কথা না বলে শুধু পাশ ফিরে শুলো। আমিও আর ওকে বিরক্ত করবো না ভেবে ওষুধ খেয়ে সবে হাত জোড় করে প্রার্থনা করছি দেখি উঠে বসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো পেছন থেকে।

তুই চলে যাবার পর থেকে ও ঘরে এখন আমরা দু’জনেই থাকি শুধু তাই একটু জোরেই বললাম - কি হয়েছে তুই কাঁদছিস কেন !

সত্যি বলতে ও মেয়েকে আমি কাঁদতে খুব কম দেখেছি !"

আবার উঠে গেলো পিসি। ঘরের দরজা খুলে ছাদ বাগানে এসে দাঁড়ালো।

আকাশ ঘুটঘুটে অন্ধকার, হয়তো অমাবস্যা আজ। রাস্তার ধারেই বাড়ি তাই গাড়ির আলো আর হর্ণের আওয়াজ মাঝে মাঝে অন্ধকার আর নিস্তব্ধতা চিরে ছারখার করে দিচ্ছে।

কোথাও যেন রাত প্যাঁচা এক ভাবে ডেকেই যাচ্ছে। অনেক গাছের মাঝে কাঁচের বড় একোরিয়ামে রাখা মাছেরা ছোট ছোট সবুজ জলের গাছের মাঝে লুকোচুরি খেলছে। একটা গোল্ড ফিস বারবার পাথরের টুকরো মুখে তুলছে আর জলের বুদবুদের সাথে তাকে বাইরে ফেলছে।

মেঘমালা এসে বসলো চুপ করে পিসির পাশে।

পিসির মুখটা ভালো করে দেখা যাচ্ছে না এখন। শুধু কখনও এক ছিটে আলো এলে বেশ বুঝতে পারছে মেঘমালা যে পিসি কাঁদছে।

"মিতালীর ছোট কাকার কাছেই পড়তো ওরা দুজন। জন্ম থেকে অন্ধ হলেও কি হবে সে লেখাপড়ায় কারো থেকে কম নয়। সারাদিন বাড়িতে ছাত্র-ছাত্রীদের ভিড় লেগেই থাকে। দু'তিনটে  ইউনিভার্সিটিতে সপ্তাহে এক দুদিন যায় ক্লাস করাতে।

সেই কাকাইয়ের কাছেই মিতালী আর তোর দিদি বেশ কিছুমাস ধরে ইংলিশ পড়েছিল।

পরে চাকরি পাওয়ার পরে আর তেমন যেতো না কোনদিন ওদের বাড়িতে তাই দেখা সাক্ষাৎও কমে গিয়েছিল।

আবার গেছিলো তিনমাস আগে মিতালীর জন্মদিনে।

ঘরোয়া খাওয়া দাওয়ার পরে তোর ছোড়দিকে সবাই নাকি গান গাইতে বলেছিল। সে গানের সাথে হঠাৎ কখন যে মিতালীর কাকাই গলা মিলিয়েছিল সে কথা সোনাই নিজেও নাকি বোঝেনি। সেদিন বাড়ি ফেরার আগে সবার থেকে বিদায় নেবার সময়ে হঠাৎ একটা অদ্ভুত কথা বলেছিল ওর কাকাই

"এই গানটা জানো আমারও সবচেয়ে প্রিয় গান"

আর বলেই চলে যেতে গিয়ে হঠাৎ হোঁচট খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল।

সোনাই স্বাভাবিক ভাবেই বলেছিল

"চলুন আপনাকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে আসি"

তার উত্তরে পেছন ফিরে হেসেছিল অনিন্দ্য - মিতালীর কাকাই। আর বলেছিল "চোখে দেখি না তো তাই অনবরত হোঁচট খাই, ছোটবেলায় মা সবসময় সাথে ঘুরতো কিন্তু এখন সে নেই তাই অভ্যেস করে ফেলেছি হোঁচট খাওয়ার"

চলে গেছিলো অনিন্দ্য।

আর নিজের অজান্তেই একটা একরোখা উদ্ধত মেয়েকে সোনার কাঠির ছোঁয়ায় বদলে দিয়েছিল ওই কিছু কথায়।

বদলে গেছিলো সোনাই সেই মুহূর্ত থেকেই। যে সোনাই জন্মদিনের উৎসবে গিয়েছিল সে সোনাই ফেরেনি আর সেই হলুদ দোতলা বাড়ি থেকে।

রোজ রোজ যেতে না পারলেও প্রায়ই যাওয়া শুরু করেছিল সে।

মিতালী অবাক হয়ে বলেছিল

"তোর হলো টা কি ! আমি কিন্তু কাকী বলে ডাকতে পারবো না তোকে"

হাসে নি সোনাই শুধু বলেছিল "নিজের সাথে নিজের লড়াই চলছে এখন রে। মনের মধ্যে অনেক লোভ, অনেক হিংসে এতদিন ধরে পুষেছি জানিস, আজ বড় ইচ্ছে করছে কারো চোখের তারায় আলো জ্বালাতে "

কেঁদেছিল মিতালী তার এই পাগল বন্ধুকে বুকে জড়িয়ে।

তারপর এ বাড়িতে বোঝানোর দায়িত্ব আমার কাঁধে চাপিয়ে তোমার ছোড়দি রোজ সকালে উঠে অফিস যাবার আগে পালা করে রান্না শিখেছে আমার কাছে।

একদিন বললাম "হ্যাঁ রে আমাদের তো কোনদিন রান্না করে খাওয়াসনি। "

তাতে মেয়ে বলে কি না "ও পিসি ওর খুব ইচ্ছে বিয়ের পরে বাইরে চলে যাওয়ার, অনেক ছোট থেকে নাকি ওই ইচ্ছে পুষে রেখেছে। তা সে সব দেশে কে এসব রান্না করে খাওয়াবে বলো ! আসলে এসব শুক্তো, পোস্ত, চচ্চড়ি খেতেই যে ভালোবাসে"

পরদিন রাতেই দেখা হলো ছোড়দির সাথে।

আমাকে দেখে জড়িয়ে নিয়ে বললো "এসেছিস, অনেক কথা আছে তোর সাথে !"

রাতে পিসিকে ঘুম পাড়িয়ে দুই বোন ছাদে এলাম।

প্রথমার চাঁদ আসবো কি আসবো না ভেবে সবে চোখের পাতা খুলেছে নীরবে।

দাঁড়ানো ছোড়দির কাঁধে হাত রাখলাম।

ফিরে তাকালো ছোড়দি। চোখ জলে ভরা অথচ কি অদ্ভুত শান্তি ছেয়ে আছে।

বললাম "এবার তুই খুশি তো ছোড়দি "

হাজার তারার আলো ছোড়দির চোখে মুখে ফুটে উঠলো।

হাসলো ছোড়দি, তাতে একটুও কষ্ট বা গ্লানি নেই। বললো

"মনে আছে তোর মেঘ, যখন কলেজের শেষ দিনে অরুণাভ আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল এই বলে- আমি না কি ওর যোগ্য নই, আমার মতো এত কালো মেয়ের না কি স্বপ্ন দেখার কোন অধিকার নেই। অথচ ওই অরুণাভ তিন বছর আমার বানানো নোটস্, আমার বই আমার খাতা ব্যবহার করেছে এমনভাবে, এত ভালো ভালো কথা বলেছে এমন করে আমি তাকে ভালোবাসা বলে ভুল করেছি, সে নাকি আমার দোষ" থামলো ছোড়দি

"জানিস আমি তো গুটিয়ে নিয়েছিলাম নিজেকে, কত সম্বন্ধ এসেছে আমার, তারা খেয়ে-দেয়ে যাবার সময় বাবা-মার মুখের ওপর বলে গেছে- “ এ মেয়ের বিয়ে হওয়া খুব মুশকিল ”

অনিন্দ্য যেদিন প্রথম আমাকে ভালো লাগার কথা বলেছিল, আমি একেবারেই না বলেছিলাম। বলেছিলাম আপনি আমাকে না দেখে এসব বলছেন। আমি খুব কালো, আমাকে কেউ পছন্দ করে না আর আমি সে নিয়ে একটুও চিন্তিত নই। আমি সারাজীবন চাকরি করে এ ভাবেই কাটিয়ে দিতে চাই।

চুপ করে গেছিলো অনিন্দ্য আর আমার হাতের ওপর নিজের হাত আলতো ছুঁয়ে বলেছিল

"কালো সাদা কি হয় আমি যে জানি না শুধু জানি তোমার কাছে যে মনটা আছে সেটা ঠিক আমার মায়ের ঘুম পাড়ানি গানের মতো স্নিগ্ধ, সরল, সুন্দর। আমি তো চোখে দেখি না তাই সে ভাবে বলতে পারবো না তোমাকে। কিন্তু মনের চোখ কোনদিন ফাঁকি দেয় না। তোমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু করবো না আমি, বাড়ি যাও। সবাইকে বলো। নিজে ভেবে দেখো তারপর যা হবে আমাকে জানিও।

আমি অপেক্ষা করবো না তোমার, তবু যদি ফিরে আসো জানবো আমার অন্ধকার চোখের তারার স্বপ্ন সত্যি হলো হয়তো"

কখন যে উঠে চলে গেছিলো ছোড়দি মনে নেই।

ছাদের সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে শুনলাম গাইছে ছোড়দি

"চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে"

ছোট থেকেই ছোড়দি বড্ড আলাদা, বড্ড একগুঁয়ে, সব সময় অন্য কিছু করার কথা ভাবে।

এবারেও তো জীবন দিয়ে বাজি খেলে গেলো।

এমন আলাদা, অন্যরকম ছোড়দি ভালো থাকিস তুই কারো চোখের তারা হয়ে - মনে মনে বলতে বলতে ঘুমন্ত পিসিকে জড়িয়ে আমি শুয়ে পড়লাম, বাতাসে ভেসে আসছে তখনও

"এখন তোমার আপন আলোয় তোমায় চাহি রে..."