শোকসংবাদ
সায়ন বণিক
ভোর থেকেই সেই একইরকমই ব্যস্ততা। ফিসফাস কথা, বিষণ্ণ চাহনি, পা টিপে টিপে
চলাফেরা। এক তলায় সিড়ির মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে থাকা ভাইবোন, দেবু আর দিয়াকে কান্নার
কিনারে ঠেলে দিচ্ছে। দিয়া তার দাদার গা ঘেঁষে সরে এসে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, দিয়ার
মুখটা চেপে ধরে একটা হিস হিস করে উঠলো। তা সত্বেও দিয়া মুখটা ছাড়িয়ে বলে উঠলো, ঠিক
মানুষের গলায় চেঁচাচ্ছে, নারে? আমার যেন কেমন কষ্ট হচ্ছে রে দাদা !
নিচের ঘরে তখন ওদের মা রূপালী, বাবা গিরীশ আর চাকর সুকুমার। ঘরে পাখা নেই
তাই দোতলা থেকে স্ট্যান্ড ফ্যানটা আনা হয়েছে। সেই একটানা ভোমরা ডেকে যাচ্ছে। মেঝেয়
সতরঞ্চিতে শুয়ে আছে একটা ল্যাব্রাডর কুকুর। পাখার হাওয়া তার ধূসর মেশানো সাদা লোমে
কাঁপুনি তুলছে। গত তিন দিন ধরে প্রসবযন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। "নেমো নেমো... লক্ষ্মীমেয়ে,
সব ঠিক হয়ে যাবে। ডাক্তারবাবু তোমার কিচ্ছু ভয় নেই। সোনা আমার... আর একটু কষ্ট সহ্য
করো তো মা।" নেমোর গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে রূপালীর স্বর বেদনায় রুদ্ধ হয়ে
এল।
"ইসস, পরশুদিনই ডাক্তারকে খবর দিলে ভালো হত।" গিরীশ আফশোস করল।
"ডাক্তারবাবুকে ফোন করেছিলে তুমি?"
"হ্যাঁ, করেছিলাম। বললেন যে পাঁচ দশ মিনিটের মধ্যে এসে পড়বেন।"
মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে গিরীশ বলল।
সুকুমার চুপ করে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে। গিরীশ তাকে বলল, "দেবু আর দিয়া
যেন নিচে না নামে দেখিস। আর রান্নাবান্না আজ আর করে দরকার নেই। তুই বরং —" গিরীশ
তাকাল রূপালীর দিকে।
"যা গরম পড়েছে, দই চিড়ে আর আম নিয়ে আসুক।" রূপালী বলল।
"আমিও তাই বলতে যাচ্ছিলুম। কাল ম্যাক্সিমাম ছিল, থার্টি নাইন পয়েন্ট
ফোর, অসহ্যকর... রিচ রান্নাবান্না এখন থাক।"
"দেবু দিয়া, তোমরা কিন্তু এক তলায় একদম নামবে না, সিঁড়ি থেকে উঁকিঝুঁকিও
নয়। যাও, ওপরে যাও। নেমোর বাচ্চা হওয়ার পর নামবে, তার আগে নয়।"
"বাবা, কখন হবে?" দেবু বলল।
"জানি না রে বাবা, ডাক্তারবাবুকে আনতে যাচ্ছি। দেখা যাক কী হয়!"
উদ্বিগ্ন স্বরে গিরীশ বলল।
দোতলার বাথরুমের পাশে দিয়ে চলে গেলে পশ্চিমের বারান্দা। সেখানে দাঁড়ালে,
কৃষ্ণচূড়া গাছের ডাল পাতার ফাঁক দিয়ে বাইক, সাইকেল এবং দু একটা স্কুল বাস যাতায়াত
করতে দেখা যায়।
কিছু ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করে দিয়া বলে উঠলো, "দাদা এবারও যদি গতবারের
মতো তেমন বৃষ্টি হয়? মাছ ধরবি?"
দরজা ঠক্ ঠক্ করতে করতে সুকুমার বলে উঠলো, "বাবুরা, কি করছ এখানে মাথায়
হাত দিয়ে বসে বসে?"
"আচ্ছা, এই করোনা ভাইরাসের জন্য তোমাদের স্কুল কতদিন বন্ধ থাকবে?"
জলের গ্লাস হতে নিয়ে দেবু বলল, "সরকার থেকে তো একত্রিশে মার্চ অবধি
ছুটি ঘোষণা করেছিল। সেটাকে আরও বাড়িয়ে নিয়ে পনেরোই এপ্রিল পর্যন্ত করে দিয়েছে।"
নিচ থেকে রূপালীর ভেসে আসে দিয়ার কানে।
"সুকুমারদা, মা তোমাকে বোধহয় ডাকছে।"
—"সুকুমার, ওই সুকুমার।"
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে সুকুমার বলে উঠল, "যাচ্ছি, বৌদিমণি।"
দু’জনে বারান্দার গ্রিল থেকে যতটা সম্ভব ঝুঁকে দেখল, সরকারি চাকুরি থেকে
অবসর নেওয়া পাশের বাড়ির জগদীশবাবু রবারের নল দিয়ে তাঁর ছোট বাগানটিতে জল ছিটোচ্ছেন।
"নেমোর এবার ক টা বাচ্চা হবে বল তো দাদা?"
"আটটা।"
"এমনি, আন্দাজে, আগের বারও আটটা হয়েছিল না?"
"সব বিক্রি করে দিল। এবার বাবাকে বলবি একটা বাচ্চা রেখে দিতে।"
"তুই বলিস বাবাকে।"
"না।"
দেবু বোনের মুখের ভাব লক্ষ্য করে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বলল, "এক একটা
বাচ্চার দাম কত জানিস ? প্রায়, পনেরো কুড়ি হাজার টাকা।"
কিছুক্ষন পর, দিয়া খোশমেজাজে বলে উঠলো, "অ্যাই, একবার সিঁড়িতে গিয়ে
দেখে আসবি?"
"বাচ্চা হল কি না?"
"হ্যাঁ।"
দিয়ার সঙ্গে দেবুও সিঁড়ি পর্যন্ত গেল। পা টিপে টিপে দিয়া সিঁড়ি দিয়ে
নেমে ল্যান্ডিংটা ঘুরছে আর সঙ্গে সঙ্গে দাঁতচাপা গর্জন উঠল।
"বলেছি না একদম নামবে না। যাও, যাও। সুকুমার, দুটোকে ঘরে বন্ধ করে
দিয়ে আয় তো।"
দিয়া দেবুর অনুযোগের দৃষ্টি রেখে বলল, "তোর জন্যই তো।"
দোতলায় এসে সুকুমার ওদের দুজনের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, "দাদা
বৌদির এখন মাথার ঠিক নেই, বুঝেছ ? একদম শব্দটব্দ করবে না। করলে ডাক্তারবাবুর হাত নরে
যাবে আর..."
"নেমো তাহলে মরে যাবে সুকুমারদা?"
দিয়া ব্যাকুল চোখে তাকিয়ে। দেবু ঢোঁক গিলল।
"সুকুমার মাঝবয়সি, বারো বছর এ বাড়িতে কাজ করছে। দেবুর জন্ম হয় কাজ
নেবার দু মাস পর। তার কোলে পিঠে করেই এরা বড়ো হয়েছে। দুজনের অবস্থা দেখে সুকুমার কষ্টবোধ
করল।
"মরবে কেন। এমনিতেও, যা করোনা ভাইরাসের ছড়াছড়ি...। যাই হোক, দরজাটা
ভেজানো থাক বেরিয়ো না কিন্তু।"
দরজা বন্ধ হওয়া মাত্র দিয়ার চোখ জলে ভরে এল।
দেবু উদভ্রান্তের মতো বলল, "তোর চোখে জল কেন? তুই কি কাঁদছিস
?"
দিয়ার কান্না আরও বেড়ে গেল। বিছানায় আছড়ে পরে সে বালিশে মুখ চেপে ফুপিয়ে
কাঁদতে শুরু করল।
বারান্দায় গিয়ে দেবু কৃষ্ণচূড়া গাছটার ফাঁক দিয়ে সে রাস্তার দিকে তাকাল।
দু দিক থেকে দুটো বাইক এসে চলে গেল। গাছের ডালে বুলবুলি ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করছে। শালিক
আর কাকও সে লক্ষ্য করল কিন্তু কোন কিছুই তার মনের উপর বসছে না। ঘরে এসে, ঘামে সপসপে
গেঞ্জিটা খুলে দেবু পা ছড়িয়ে বসল।
কিছুক্ষণ পর, দেবু বাথরুম থেকে আসার সময় হঠাৎই খেয়াল করল, জঞ্জাল এবং বালির
স্তূপের উপর কয়েকটা প্রাণী কিলবিল করছে।
"দাদা, ওই দাদা?" চোখ মুঝতে মুঝতে জানালার ধারে এসে দাঁড়াল দিয়া।
"দেখ, বুনু দেখ – এক দুই, তিন... চার, পাঁচ... ছয়!"
"কোথা থেকে এল রে, এই কুকুরছানাগুলো ? কাল তো চোখে পড়েনি।"
কান লেজ আর পিঠের কিছু অংশ কালো, এমন একটা সাদা কুকুর ধীরে ধীরে ছানাগুলোর
দিকে এগিয়ে এল। পেটটা ঝুলে রয়েছে। দেবু স্তনের বোঁটাগুলো দেখতে পাচ্ছে। কুকুরটাকে
সে স্কুলে যাবার সময় রোজ দেখেছে। জুয়েল কেটারিং – এর দোকান থেকে সম্রাট সুইট্স পর্যন্ত
পাঁচ ছটা বাড়ির সামনের রাস্তায় যে তিন চারটে কুকুর বসে থাকে, ঘুমোয় আর অন্য কুকুরদের
সঙ্গে মারামারি করে, তাদের মধ্যে দেবু একেও দেখেছে। একে সে চেনে।
একদিন নেমোর ভিটামিন ট্যাবলেট ফুরিয়ে যাওয়ায় সুকুমার কিনতে যাচ্ছিল।
দোকানে ওষুধ ছাড়াও অনেকরকম জিনিস বিক্রি হয়। আইসক্রিম, সফট ড্রিঙ্কস ইত্যাদি। মা
র কাছ থেকে টাকা নিয়ে দেবু আর দিয়া সুকুমারের সঙ্গে যায়।
ওরা কাঠের চামচ দিয়ে খেতে খেতে বাড়ি ফিরছিল। পাশে পাশে হাঁটছিল একটা কুকুর।
মজা করার জন্য দিয়া একটু আইসক্রিম চামচ থেকে উঁচু করে ফেলল। কুকুরটা তৈরি ছিল না,
তাই রাস্তায় পড়ল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই চেটে নিল। এরপর আরও পাবার আশায় চলতে চলতে
মুখ তুলে বার বার সে দিয়ার দিকে তাকাতে লাগল। কিন্তু দিয়া আর ওকে খাওয়াতে রাজি নয়।
"দে না ওকে।" দেবু বলছিল।
"আহাহা, তুমি দাও না। এইটুকু তো কৌটো। একটা খেয়ে কি কিছু হয়?"
ঠিক এই সময়ই দেবু হোঁচট খেল, একটা ইঁটে আর পড়তে পড়তে নিজেকে সামলালেও
আইস্ক্রিমের প্লাস্টিকের কৌটোটা হাত থেকে ছিটকে রাস্তায় পড়ল। সবাই দাঁড়িয়ে গেছে।
কুকুরটাও। কিন্তু তাড়াতাড়ি চেটে খেতে নেবার বদলে সে দেবুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল।
সেই সময় দেবু কুকুরটার চোখে কেমন একটা দুঃখ পাওয়ার মতো ভাব যেনো দেখতে পায়। তখন ছুটে
এসে আর একটা কুকুর জিভ দিয়ে আইসক্রিমটা চেটে নিতে নিতেই গোঁ গোঁ শব্দ করে ভয় দেখাল।
কেউ যেন, এমনকী অন্য কুকুরটাও যেন তার খাবারে ভাগ না বসায়।
সুকুমারের কাছে টাকা ছিল, সে দোকানে ফিরে গিয়ে আর এক কৌটো আইসক্রিম কিনে
এনে দেবুর হতে দেয়। দিয়া তখন আকাশের দিকে মুখ তুলে বলেছিল, "দাদা তো কৌটোটা
শেষ করেই ফেলেছিল, তাহলে আবার একটা নতুন কেনার কী দরকার।"
"মোটেই শেষ করে ফেলিনি। আদ্দেকেরও কম খেয়েছি। আচ্ছা তুই একটু নে।"
দিয়া আপত্তি করেনি। দেবু লক্ষ্য করল তখনও কুকুরটা তাদের সঙ্গ ছাড়েনি।
দিয়া বলল, এবার তুই ওকে দে।
"দেবই তো।"
ঝুঁকে নিচু হতে দেবু কৌটোটাই ওর মুখের কাছে ধরল। মুখ সরিয়ে নিল কুকুরটা,
অপ্রতিভ যতটা নয় তার থেকেও বেশি অবিশ্বাসভরে।
"খা খা, খেয়ে নে।"
এদিকে বাবা অফিস থেকে ফিরে এসে রূপালীর ঘরের দরজায় টোকা দিল। দরজা খুলে
যেতেই সে ঘরে ঢুকে রূপালীকে জড়িয়ে ধরল।
"একি, একি ! ঘরের মধ্যে নয়। ওরা চলে আসতে পারে !"
গিরীশ দরজার ছিটকিনি লাগাচ্ছিল এবং বিছানায় রূপালী হলুদ আঁচলটাকে সরিয়ে
কমলা রঙের অর্গান্ডির ব্লাউজটা খুলে, সাদা ব্রেসিয়ারটা খুলতে শুরু করেছিল।
গিরীশ মুচকি হেসে রূপালীকে বিছানায় শোয়াতে শোয়াতে বলল, "নেমে তো
আছেই ওর আওয়াজেই বোঝা যাবে।"
এরপরে সে কেমন একটা লাজুক লাজুক ভঙ্গিতে সে প্রথমে জিভ দিয়ে একটু চাটল,
তারপর কৌটোয় জিভ ঢুকিয়ে কয়েক সেকেন্ডেই সাফ করে দিল।
এরপরও সে ওদের পিছন পিছন চলছিল। দেবু ধমক দেয়, "আর নয়, আবার এখানে
থাম।" কুকুরটা আর এগোয়নি।
"ও দিদিভাই – দাদাভাই, তোমরা এখানে কী দেখছ, জানালার ধারে দঁড়িয়ে
দাঁড়িয়ে?" সুকুমার খাবারের থালাগুলো হতে নিয়ে বলল।
"আরে সুকুমারদা, মনে আছে সেই সাদা কুকুরটার ? যে আমাদের পিছন পিছন
আসছিল...।" দিয়া বিছানায় বসে বলল, "ছার না... এখন এসব কথা থাক।"
"তোমাদের খাবার দিয়ে গেলাম। ওপরে বসেই খেয়ে নিও। নেমোকে আর বাঁচানো
গেল না।"
ভাইবোন কিছুক্ষণ পরস্পরের চোখের দিকে অবিশ্বাসভরে তাকিয়ে জীবনের প্রথম
শোকসংবাদটা থেকে নিজেদের গুটিয়ে রাখল।
0 comments:
Post a Comment