আইসক্রিমওয়ালা
সায়ন বণিক
“এই কুলপি-কুলপি— পাঁচ টাকা, দশ টাকা" চেঁচাতে চেঁচাতে গ্রামের পথ
দিয়ে যাচ্ছিলেন এক বৃদ্ধলোক। বয়স কম করে বললেও ষাট-পয়ষট্টির অধিক না।
নদীর মাঝে পা রেখে যে দূর দিকের গ্রাম দেখা যায়, সেখান থেকে আরও ভিতরে
গিয়ে দুই ক্রোশ পার হয়ে লোকটির বাড়ি। সে জায়গায় এখনও বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি। দু-তিনটে
গেরস্ত বাড়ির আলো আছে ঠিকই, কিন্তু মাঝেমধ্যেই বিদ্যুৎ সংযোগ থাকে না। পাছে, গ্রামের
মানুষগুলো গরমকালে একটু পাখার হাওয়া খেতে খেতে তাদের বাড়িতে বসে গল্প জমিয়ে ফেলে,
এই ভয়ে বিদ্যুৎ থাকলেও তারা ‘না’ বলে ফিরিয়ে দেয়।
অসিত দাস। বামুন ঘরের মানুষ। তার বাবাও ছিলেন আইসক্রিম ব্যবসায়ী, তাঁর
ছেলেটিও ধরেছে আইসক্রিমের ব্যবসা। গ্রামের মানুষেরা অসিতদা-অসিতদা বলেই তাকে ডাকে।
খুব চেনা মুখ এই অসিতদা, যদিও ‘অসিতদা-র আইসক্রিম’ বলাই ভালো।
গরম পড়লেই, ছোট থেকে বড়োদের একটাই নাম জপ হতে থাকে— অসিতদার আইসক্রিম,
অসিতদার আইসক্রিম। ছোট-ছোট শিশুরা তাকে না চিনলেও তার গাড়ির ওপর বড়ো করে ‘অসিতদার
আইসক্রিম’ লেখাটি দেখে ঠিক চিনে ফেলে। তখন কেউ বা, কাকু কেউ বা দাদু এসব বলেই তাকে
সম্বোধন করে। আর, গ্রামের দিনমজুর-কৃষক ওরা তো সবাই প্রায় তার কাছ থেকে আইসক্রিম নেয়—
আবার কেউ কেউ তার বাবার কাছ থেকেও নিত একসময়।
সেই গ্রামের দিনেরবেলা যেমন চারিদিকটা ঝলমলে, সূর্যালয়ে ছোট ছোট শিশুরা
খেলে, কৃষকেরা মাঠে চাষ করে, দিনমজুরেরা শহরে আসে বিভিন্ন বাড়িতে কাজ করতে, ঠিক তেমনি
রাতেরবেলাটা একদম অন্যরকম। রাতের গ্রামের পরিবেশটা এখানে খুব শান্ত হয়ে ওঠে— অবশ্য,
শান্ত বললেও ঠিক মানায় না। ঝিঁ-ঝিঁ পোকাদের ডাকগুলি রাত হলেই কানের মধ্যে বাজা শুরু
করে দেয় একভাবে। সেখান থেকে কিছুটা দূরেই একটা মরা নদী বয়ে গেছে গ্রামের ভিতর দিয়ে।
বর্ষার সময় বড়ো নদীর জল এই নদীতে প্রবেশ করে আবার জীবন্ত করে তোলে। আবার বন্যা হলে
গ্রামের মাঠে-ঘাটে জল উঠে যায়, চাষিরা চাষ করতে পারে না বাড়িতে বসে থাকে। কিন্তু
তাদের কর্ম্মের শরীর, বাড়িতে বসে থাকলেই বা কি ! তাদের বউ-এর সঙ্গে কাজ-কর্ম্ম করতে
থাকে। তাদের বউগুলিও যে বসে থাকে না, ওরাও কাজ করে— বাড়িতে বসে বিড়ি বাঁধে। সেই গ্রামে,
দুপুরের পর বিকেলে গেলেই দেখতে পাওয়া যায় তাদের বৌয়েরা বিড়ি বাঁধতে বসে আছে।
“কাকু, কাকু ! কাঠি আইসক্রিম আছে তোমার কাছে?" বৃদ্ধ লোকটির আওয়াজ
শুনতে পেয়ে এক বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে একটি বাচ্চা তার কাছে জিজ্ঞেস করল।
“হ্যাঁ, আছে। কত টাকার লইবা বাবা?"
“পাঁচ টাকারটা দাও।
গাড়ির ভেতরটা খুলে পাঁচ টাকার একটা আইসক্রিম বাচ্চাটির হাতে দিয়ে আবার
হাঁকতে হাঁকতে চলে গেল। লাল রঙের একটি আইসক্রিম হাতে পেয়ে মহানন্দে খেতে খেতে বাড়ির
দিকে আবার চলে গেল।
“অসিতদা ! কেমন আছেন?" আইসক্রিম ফ্যাক্টরির একটা লোক জিজ্ঞেস করল।
“এই আছি..." কিছু বলতে গিয়ে আটকে গেল।
“আপনাকে সেরকম একটা দেখা যাচ্ছে না— কি ব্যাপার বলুন তো! অন্যকোনো ফ্যাক্টরির
সন্ধান পেলেন নাকি আবার" লোকটি বিকটরকম দৃষ্টিভঙ্গি করে অসিতবাবুর দিকে তাকালেন।
“না বাবা ! শরীরটা কয়দিন ধইরে দেখি খুব খারাপ যাইতেছে। আর এখন ব্যবসাও
সেরকম একটা নাই।" ইতস্ততভাবে বলতে থাকলেন অসিতবাবু।
তার কথা শুনে নিয়ে লোকটি বলল, “শরীর খারাপ হলে বাড়িতে থাকতে পারেন তো।
কেন ফালতু এতটা দূর প্রতিদিন শহর থেকে গ্রামে নিয়ে আইসক্রিম বেঁচেন !" তার কষ্ট
দেখে লোকটিরও দুঃখ জাগলো।
“বেঁচিয়া যাইতে হয় এই পেটের দায়ে। আর তাছাড়া, আমাদের গ্রামের বাচ্চাগুলো
খুব ভালোবাসে এই অসিতদা-র আইসক্রিম খাইতে।" কথা না বাড়িয়ে গাড়ি নিয়ে ফ্যাক্টরির
ভিতর ঢুকল। গাড়ির ভিতর বরফ বসিয়ে আইসক্রিম ঢুকিয়ে নিয়ে ঢাকনাটা লাগিয়ে দিল।
“নিজের শরীরের একটু খেয়াল রাখবেন অসিতদা। দিন দিন যে শরীর শুকিয়ে যাচ্ছে।"
"হ্যাঁ বাবা। আছিই তো আর কয়েকটা দিন— এখন আর সংসারটাই চলে না যে
!" প্রথম কথাটা জোরে বলে নিয়ে, একাই একাই বলতে থাকল বাকি কথাগুলো।
গাড়িটা টানতে টানতে আবার গ্রামের ভিতর দিয়ে প্রবেশ করল বৃদ্ধ লোকটি।
অসিতবাবুর বাবা যখন বেঁচে ছিলেন, তখন ‘পেপসি’ খুব চলত। থার্মোকলের বাক্সে
রেখে ‘পেপসি-পেপসি’ বলে তার বাবাও চেঁচাতে থাকতো। বাবার হেঁকে যাওয়ার ধারাটাই পেয়েছে
ছেলে। তার বাবার কাছে আইসক্রিম সেরকম একটা পাওয়া যেত না, পেপসিটাই বেশি রাখত। ভর্তি
একটা ছোটো প্যাকেটের মধ্যে ফলের রসের মত তরলকে কঠিন বানিয়ে বিক্রি করত। সেই প্যাকেটের
একটা দিক দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে, চুষে চুষে খেত ছেলেমেয়েরা।
অসিতবাবুর ক্লাস সেভেনে থাকাকালীন তার বাবা মারা যায়। তার ঠিক এক বছরের
মাথাতেই মা মারা যায়। স্বাভাবিকভাবেই সংসারের হালটা তার মাথায় ধুপ করে পড়ে বসে।
তার সাত বছরের একটা ছোট বোন ছিল। তার বোনটিও অসিতের অধীনে চলে আসে। বাবা মা-এর মৃত্যুর
পর অসিত কাজের সন্ধানে এ জায়গায় - ও জায়গায় খুঁজতে থাকে। শেষপর্যন্ত তার পছন্দমত
কাজ খুঁজে না পাওয়ায়, বাবার ব্যবসাটাই করতে শুরু করে। বোনকে ম্যাট্রিক পাশ করানোর
পর বিয়ে দিয়ে দিতে হল। চার-পাঁচ বছর পর অসিতবাবু নিজেও কায়েস্ত ঘরের একটা মেয়েকে
বিয়ে করে, বামুনের ঘরে আনলেন। অল্প অল্প করে ঘরের ভাঙ্গা ছাউনি ঠিক করলেন— সামনে বেড়া
দিয়ে ঘিরে দিলেন। সেখানে তার আইসক্রিমের গাড়িটা রেখে দিতেন। তাদের একটি কন্যা সন্তান
জন্মাল, তাকে মানুষ করে, অল্প-কিছু লেখা-পড়া শিখিয়ে বিয়ে দিয়ে দিল। এমনভাগ্য অসিতদার,
মেয়েটিকেও দূরে বিয়ে দিয়ে দিল— সেও এখন দেখতে আসতে পারে না তার বাবা-মাকে। কোনরকমভাবেই
দিনযাপন করতে থাকে জীর্ণ বৃদ্ধ এবং আইসক্রিমওয়ালা।
“গিন্নি ! দিন-দিন যে অবনতি হইতেছে আমাদের। এই অসিতদা আর অসিতদা নাই গো—
বাজারে নাকি এখন বড়ো বড়ো কোম্পানির আইসক্রিম আসিয়াছে। বলাবলি করছিল ফ্যাক্টরির লোকেরাই।”
“কও কি? আমাদের যে পেটে মরতে হইবে, তা হইলে !”
“জানো, আজ পঞ্চাশটা টাকারও বিক্রি করতে পারি নাই। সারাদিন গাধার মত পরিশ্রম
করিয়া, এদিক-সেদিক গ্রাম-গঞ্জে ঘুরিয়া যখন দুইজনের সংসারের জন্য খাওয়ার খরচটাই না
ওঠে, তা হইলে তো একদিন না খাইতে পারিয়াই মইরা যাইব।”
বউ তার শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছে দেয়। সেও যে নিরুপায়— বিড়ি বেঁধে
কি আর সংসার চলে; স্বামীকে যে যথাসাধ্য উপার্জনটুকু করতে হয়। এমন কপাল তাদের, একটা
পুত্রসন্তানও জন্ম দিতে পারেনি তারা। যদিও, সব ছেলেরাই যে বাবা-মাকে দেখে বেড়াবে,
সেটাও নয়। তারাও যে এখন আধুনিক, নিজেরটা খুব বুঝে নেয়। যদি সেই পুত্রসন্তান-ও তাদের
না দেখত, পিছে লাথি মেরে তাড়িয়ে দিত। এইসব ভেবে, সেই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা কষ্ট পেলেও তাদের
মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে।
তিনি বললেন, “কখনও ভাবিনাই এই শেষ বয়সটায় আসিয়া আবার কষ্ট ভোগ করিতে
হইবে।
আজকে ওই লোকগুলো বলাবলি করিতেছিল, ভ্যাদিলাল— কোলিটিয়ালস্ কি কি বা নতুন
নতুন রকম কোম্পানির আইসক্রিম চলিতেছে বাজারে। গ্রামের লোকগুলাও নাকি এখন ওইসব কোম্পানির
আইসক্রিম কেনে।
লোকাল আইসক্রিম যে আর চলে না গো— লোকাল আইসক্রিম যে আর চলে না। মানুষেরা
ওই নতুন কোম্পানির আইসক্রিম পাইয়া এই লোকাল আইসক্রিমকেই ভুলিয়া গেছে। জানিনে গিন্নি,
তোমার এই অসিতদা-র আইসক্রিম চলবে কিনা কখনও!”
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খাওয়ার পাতেই কথাগুলো বলছিল অসিতবাবু। এদিকে তার গিন্নি
মাথার ওপর পাখার হাওয়া করেই চলেছে। ভাঙ্গা বেড়ার ভিতরে রাখা ছিল তার আইসক্রিমের গাড়িটি।
দূর থেকেও, তার ওপরে ‘অসিতদা-র আইসক্রিম’ লেখাটি স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল।
0 comments:
Post a Comment