অনিমা দাই
আবদুস সাত্তার বিশ্বাস
লকডাউনে গরিব মানুষ গুলো খুব নাকাল হচ্ছে। মনে কারও শান্তি নেই। শরীরে কোন
ফুর্তি নেই। পেটে খিদে নিয়ে সবাই বেঁচে আছে। আর বড়লোক গুলো? ফ্যানের তলায় নিশ্চিন্তে
ঘুমাচ্ছে। তাদের পেটে তো আর খিদে নেই। জঠরে কোন জ্বালা নেই। সুতরাং তাদের ঘুমাতে কোন
অসুবিধা নেই। বসে বসে তারা টাকা পাচ্ছে। অফিসে যেতে হচ্ছে না। ডিউটি করতে হচ্ছে না।
সরকার তাদের এমনি এমনি টাকা দিচ্ছে। ফলে তাদের লকডাউন হলেই বা কি না হলেই বা কি।
মুশকিল হয়েছে যত গরিব মানুষদের। তাদের না আছে কাজ। না আছে ঘরে খাবার। না
আছে পকেটে টাকা। সুতরাং চরম সমস্যার মধ্যে তাদের দিন কাটছে। এই পৃথিবীতে যে কেউ কারও
না। বিশেষ করে গরিব মানুষদের জন্য তো কেউ-ই না। হলে খুবই ভালো হতো। খুবই ভালো হতো।
গ্রামে যারা বড়লোক রয়েছে তাদের সামান্য বদান্যতায় গ্রামের গরিব মানুষ গুলো তাহলে সবাই
বেঁচে যেত। কাউকে খাবারের জন্য সমস্যায় পড়তে হত না। কিন্তু গরিব মানুষদের নিয়ে তারা
ভাবে না। কোনদিনও না।
দুই
এদের নিয়ে ভাবল অনিমা দাই। দাইয়ের কাজ অনিমা করেনা। তবু সে দাই। তার কারণ
তার মা একসময় দাইয়ের কাজ করত আর সে তার মায়ের সঙ্গে সঙ্গ দিত। তাই সে-ও দাই। গ্রামের
মানুষ তাকে তাই দাই বলেই ডাকে। অনিমা দাই।
যাইহোক, অনিমা দাই যে খুব বড়লোক মেয়ে তা কিন্তু নয়। সে খুব গরিব মেয়ে। খুবই
গরিব মেয়ে। তার স্বামী সংসার নেই। মেয়েবেলায় তার একবার একটা বিয়ে হয়েছিল। স্বামী জোয়ান
মরদ ছিল। কিন্তু ভগবানের কি খেলা! স্বামী বিয়ের রাতেই সাপের কামড়ে মারা যায়। এরপর পরে
সে আর বিয়ে করেনি। করেনি তো এ পর্যন্ত করেনি। যদিও তার রূপ ও যৌবনে মুগ্ধ হয়ে অনেক
ছেলে পরে তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। কিন্তু অনিমা দাই করেনি। "মানুষ বিয়ে কতবার
করে? একবার করেছিলাম সুতরাং আর নয়। ভগবান যা করে তাই হবে।"
এখন অনিমা দাইয়ের বয়স হয়েছে। শরীরের চামড়া জড়ো জড়ো হয়েছে। যৌবনও ফুরিয়েছে।
রূপও ঝরেছে। এখন তো ওসব চিন্তা মাথায় আসবেই না।
তিন
অনিমা দাই তার বাবার ভিটাতে থাকে। প্রথম থেকেই বাবার ভিটাতে থাকে। কারণ
অনিমা দাইয়ের বাবা যখন মারা যায় ভিটাটা অনিমা দাইকে রেজিস্ট্রি করে দিয়ে যায়। যাতে
অনিমা দাইয়ের বাস করতে এখানে কোন অসুবিধা না হয় এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সে নির্বিঘ্নে
কাটাতে পারে। কেননা অনিমা দাইয়ের একটা দাদা ছিল। বাবার মাঠান পাঁচ বিঘা জমি সে জাল
করে সব লিখে নেয়। বাবা সেটা জানতে পারার পর অনিমা দাইকে ভিটাটা লিখে দেয়। অনিমা দাইয়ের
ওই দাদা ইন্দ্রজিৎ। সে এখন গ্রামে থাকেনা। শ্বশুরের গাঁয়ে থাকে। গ্রামে কোনদিন আসেনা।
অনিমা দাইয়ের খোঁজ খবর রাখেনা। অনিমা দাইও ভুলে গেছে দাদাকে। গ্রামের মানুষই এখন তার
সব। গ্রামের মানুষই এখন তার আপন এবং অতি প্রিয়জন।
চার
বাবা মারা যাওয়ার পর অনিমা দাই কিছুদিন খুব কষ্ট পেয়েছিল। খাবারের কষ্ট
পেয়েছিল। পয়সার কষ্ট পেয়েছিল। কারণ তার তো তখন কোন রোজগার ছিল না। তবু তার রোজগেরে
দাদা তার জন্য কিছু করেনি। কিছু পয়সা কড়ি দিয়ে সাহায্য পর্যন্ত করেনি। তার প্রিয় গ্রামবাসী
ভাইয়েরা তখন কাজটা তাকে পাইয়ে দেয়। গ্রামের শিশু শিক্ষা কেন্দ্রে বাচ্চাদের খিঁচুড়ি
রান্না করার কাজটা। ও তার বিধবা ভাতা ছিল না সেটাও করে দেয়। দুটো কাজ একসঙ্গে পেয়ে
অনিমা দাই এখন খুব ভালো আছে। তার একার কোন অসুবিধা নেই। তার অসুবিধা না হলে কি হবে?
গ্রামের আরো মানুষের তো অসুবিধা আছে। সুতরাং তার একার ভালো থাকার তার কাছে কোন মূল্য
নেই। সে ভালো থাকবে আর তার প্রিয় গ্রামবাসী ভাইয়েরা কষ্টে থাকবে! না খেয়ে থাকবে! এটা
তো হয়না। অতএব সে চায় সবাই মিলে একসঙ্গে ভালো থাকতে।
পাঁচ
অতঃপর অনিমা দাই একদিন গ্রামের নিরন্ন মানুষদের নিয়ে ভাবতে লাগল। লকডাউনে
যারা সবচেয়ে বড় সমস্যার মধ্যে পড়ে রয়েছে সেইসব মানুষদের নিয়ে। সেদিন সারাদিন সারারাত
ধরে ভাবল। ভাবতে ভাবতে ভাবনা শেষে সে এই সিদ্ধান্তে এল যে, গ্রামে যে পঞ্চাশ জন নিরন্ন
মানুষ রয়েছে তাদের সে খাদ্য দান করবে। চাল, ডাল, আলু। তারপর পরে যা হবে তখন দেখা যাবে।
এখন তো মানুষ সামান্য কিছু খেয়ে জানে কিছুদিন বেঁচে থাকুক।
ছয়
অনিমা দাইয়ের দাদা যেহেতু কোন খোঁজ খবর রাখেনা অনিমা দাই তার দিন অদিনের
জন্য পেট চালিয়ে কিছু টাকা জমিয়ে রেখেছে। কিন্তু মানুষের এখন যে ঘোরতর বিপদ চলছে তাতে
সে যক্ষের ধনের মতো টাকাটা আগলে রাখে কি করে? না, সেটা ঠিক হবেনা। তার দিন অদিন আছে
ভগবান আছে। তার প্রিয় গ্রামবাসী আছে। নিশ্চয় তারা তার ব্যবস্থা করবে। কেউ তাকে ফেলে
রাখবে না। তার টাকাটা নিয়ে সে এখন চরম দুর্দিনে মানুষের পাশে দাঁড়াতে চায়। নিরন্ন মানুষের
অন্ন দান করতে চায়। ভাবনা মতো অনিমা দাই একদিন করলও তাই। মাথা পিছু প্রত্যেককে তিরিশ
কিলো করে চাল। দু-কিলো করে ডাল। আর দশ কিলো করে আলু দান করল। অনিমা দাইয়ের এই দান পেয়ে
নিরন্ন মানুষ গুলো ভীষণ ভীষণ খুশি হল এবং দু-হাত ভরে ঠাকুরের নামে সবাই তাকে আশীর্বাদ
করল এবং প্রাণ ভরে প্রার্থনা করল। তার এই দান থেকে গ্রামের শেষ প্রান্তে যে দু-জন মুসলিম
ঘরামী ছিল তারাও বাদ গেল না। অনিমা দাইয়ের এই মহানুভবতার কথা ইথারের মতো বাতাসে গ্রামের
আনাচে কানাচে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। তারপর গ্রাম পেরিয়ে শহরেও। সুদূর কলকাতা শহরে এবং
সেখান থেকে টিভি ও কাগজের লোকেরা ছুটে এল। অনিমা দাইয়ের ছবি তুলল। তার মুখে কথা শুনলো
এবং সেরা সমাজ সেবিকার সে সম্মান পেল। তার সম্মানে গোটা গ্রাম সম্মানিত হল। সবাই মেতে
উঠল তার সম্মানে। গ্রামে যারা বড়লোক ছিল লজ্জায় তারাও এবার দান করতে শুরু করল। তাদের
দানে গ্রামের নিরন্ন মানুষ গুলোর খাদ্যাভাব দূর হল। পরে সরকার গোটা দেশ জুড়ে দান দিল।
হায়! অনিমা দাইয়ের মতো মেয়ে যদি আমাদের দেশে প্রত্যেক গ্রামে একটি করে থাকতো
কি ভালো হতো!
0 comments:
Post a Comment