লোডশেডিং
মনামী সরকার
সময়টা ১৯৮৮- ৮৯হবে | তখনো আমার শহরে ইনভার্টার এর প্রচলন হয়নি | দু একজনের কাছে ইমারজেন্সি চার্জার লাইট থাকলেও থাকতে পারে | কিন্তু আমার চোখে সেভাবে কখনো পড়েনি | লোডশেডিং হলে ভরসা ছিল লন্ঠন, কুপি,
ড্রিমলাইট, মোমবাতি আর টর্চ | তখন সন্ধ্যা বেলা প্রায় নিয়ম করেই লোডশেডিং হত | বিকেলের খেলাধুলোর পর সন্ধ্যার জলখাবার খেয়ে বই নিয়ে বসতে
না বসতেই লোডশেডিং হয়ে যেত | সত্যি বলতে আমরাও
হয়তো লোডশেডিং এর জন্যেই অপেক্ষা করতাম | আমার ছোট বেলাটা কেটেছিল একটা সরকারি আবাসনে | কারেন্ট যাওয়া মাত্রই মনটা আনচান করত কখন ঘরের থেকে একটু বেরোবো | আমার মত সবারই একই অবস্থাই ছিল | পড়াটা কোনভাবে শেষ করেই যে যার ঘরে থেকে বেরিয়ে আসতাম | আবাসনের ভেতরে একটা ছোট খেলার মাঠ ছিল | অন্ধকার হলেই কোথা থেকে যেন হাজার, হাজার জোনাকি চলে আসতো সেখানে | জোনাকির মৃদু আলোয় চারপাশটা ভরে উঠত | ছোট-বড় যে যার মতো ছোট ছোট দল করে করে চলত আড্ডা | আর গরমকাল হলে মাঝে মাঝে সঙ্গী হত তালপাখা | সেই আড্ডায় গানের লড়াই থেকে শুরু করে বিতর্ক প্রতিযোগিতা
কিনা চলত | মাঝে মাঝে কিছু মনের কথা আদান প্রদান, ভবিষ্যতের অলীক কল্পনা | কি না থাকত সেখানে | মোটকথা নির্ভেজাল
একটা আড্ডা | একইভাবে পাড়ার মোড়ে মোড়ে, বা বাড়ির পুলের সামনে এরকম আড্ডা জমে উঠত লোডশেডিংকে
কেন্দ্র করে |
মনে আছে লোডশেডিং যদি অনেকক্ষণ ধরে
চলত ওই অন্ধকারেই মা হ্যারিকেন বা ড্রিম লাইট সহযোগে খাবারের জোগার করত | আর খেতে বসা মাত্রই সে কি পোকার অত্যাচার | ওই হ্যারিকেনের আলোকে কেন্দ্র করে কোথা থেকে যেন ছোট ছোট
পোকাগুলো চলে আসতো কে জানে ? মাঝে মাঝে দু'চারটা আবার খাবার থালার মধ্যেও লাফিয়ে পড়তো | দু-একটা কে ধরে ধরে আবার হ্যারিকেন এর মধ্যে ফেলে দিতাম |
পরীক্ষার আগ দিয়ে মাঝে মাঝে
লোডশেডিং হলেও বাইরে বেরোনোর অনুমতি পাওয়া যেত না | ওই মোমবাতি বা হ্যারিকেন এর আলোতে বসে পড়তে হত | কিন্তু মন কি আর ঘরে থাকে | ওই পড়তে পড়তে জানলা দিয়ে জোনাকির আলো' দেখতাম | আর হ্যারিকেনের কাঁচের মধ্যে মোমটাকে
লাগাতাম |
হ্যারিকেনের আঁচে মোমবাতিটা একটু একটু করে গলে হ্যারিকেনের
কাঁচের মধ্যে লেগে যেত | পরে সেই জন্য যদিও
মার কাছে খুবই বকুনি খেতাম | কিন্তু বেশ মজা
লাগতো করতে | আর মোমবাতি সামনে থাকলে হাত দিয়ে
মোমের আগুনটাকে ধরার চেষ্টা, এটা কমবেশি সবাই
আমরা করেছি | হ্যারিকেন মোমবাতির আলোর সাথে ছায়ার
খেলা ভীষণ প্রিয় ছিল আমার | ড্রিম লাইট এর উপর
কাগজ চাপা দিয়ে কার্বন-ডাই-অক্সাইড এর অস্তিত্বপরীক্ষা করতে গিয়ে বাতি নিভিয়ে
দেওয়া |
হ্যারিকেনের কালি হাতে মেখে দুষ্টুমি করা এগুলো খুব কমন
ব্যাপার ছিল | আর টর্চের আলোতে ভূত সাজা, আর হাতের মধ্যে টর্চ চেপে ধরে শরীরে রক্ত আছে কিনা পরীক্ষা
করা এগুলোই ছিল তখন আমাদের খেলা |
তারপর কখন নিজের অজান্তেই চার্জার
লাইট,
ইনভার্টার চলে এলো | ওই জোনাকি পোকাগুলো কোথায় যেন হারিয়ে গেল | হারিয়ে গেল ওই আড্ডাগুলো | এখন লোডশেডিং হলেও
আর আলাদা করে কিছু বুঝতে পারিনা | কিছু কিছু ভালো
লাগা ভালো অনুভূতিগুলো প্রযুক্তির উন্নতির
সাথে সাথে কোথায় যেন চাপা পড়ে গেছে।
0 comments:
Post a Comment