ভিটেমাটি
অবাস্তব ডায়েরী
১
“উফ কত পুরোনো বাড়ি তোমার। সামনের অংশ
তো পুরো জঙ্গল হয়ে গেছে। আর কি ধুলো। এত ধুলোতে মানুষ থাকতে পারে নাকি ? নাকে রুমাল দিয়ে সপ্তকের দিকে তাকিয়ে বলল অর্চিতা। প্রায় ২৫
বছর পর বাড়িতে ফিরলো ও সাথে তার স্ত্রী অর্চিতা। তাদের একমাত্র ছেলে ইন্দ্র কাজের
সূত্রে আমেরিকায় থাকে, তারও আসার কথা ছিল
কিন্তু কাজের চাপে আর আসতে পারেনি। এমনিতে সপ্তক কাজের সূত্রে জার্মানি থাকে, ও একজন ডাক্তার। খুব বেশি দেশে ফিরতে পারে না, কিন্তু মা মারা যাবার পর থেকেই বাড়িটা ফাঁকা পরে রয়েছে, তাই সপ্তক ঠিক করেছে বাড়িটা বিক্রি করে পাকাপাকি ভাবে
জার্মানিতে থাকবে। আর তো কোনো পিছুটান নেই এ দেশে তবে আর বাড়িটা রেখে কি হবে।
মেদিনীপুর জেলার এক অখ্যাত গ্রামের
ছোট্ট একটা বাড়িতে সপ্তকরা থাকতো। এই বছর দশেক আগেও এই বাড়িতে ধুঁকছিল একটা প্রাণ।
শক্ত করে মনের প্রান্তে আঁকড়ে রেখেছিল একটা আশা, একটা স্বপ্ন। বাড়িটা দেখে অনেক পুরোনো স্মৃতি এক লহমায় মনে পড়ে গেল সপ্তকের।
প্রত্যেক সেমেস্টার শেষে যখন বাড়ি ফিরত এরকমই আনন্দ অনুভব করতো সে ।
ঘরের দরজাটা খুলতে একটা ভ্যাপসা গন্ধ
বেরিয়ে গেল। ঘরটা বেশ খোলামেলা। তবে এর মধ্যে একটা শুন্যতা অনুভব করছিল অর্চিতা।
পূর্বে আর দক্ষিণে দুটো বেশ বড় বড় জানলা। তবুও যেন অসম্ভব দম বন্ধ করা পরিবেশ ঘিরে
রয়েছে বাড়িটাতে। সুন্দর দামি রুমাল দিয়ে সামনে রাখা বেতের চেয়ারটা মুছে নিলো
সপ্তক। দামি ফ্রেমের চশমাটা সামনের টেবিল রেখে, চেয়ারে নিজেকে এলিয়ে দিলো সে। বাবার শখ করে কেনা এই বেতের চেয়ারটা। প্রতি
বিকেল বেলা এক হাতে বই আরেক হাতে চায়ের কাপ নিয়ে,এই বেতের চেয়ারে বসতো বাবা।
মেদিনীপুরের এই গ্রামটাকে গ্রাম না
বলে মফঃস্বল ও বলা চলে। চার দিকে সবুজের সারি। এই গ্রামে একটাই মাত্র স্টেশন। খুব
বড় স্টেশন না, দুটো মাত্র প্লাটফর্ম। সেই স্টেশনেরই
স্টেশনমাস্টার ছিল তার বাবা। এই বাড়ির সামনেই খুব বড়োএকটা জলাশয় আছে। এই জলাশয়তে
প্রতি রবিবার বাবার সাথে আসতো মাছ ধরতে। ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতো বাবা।সপ্তকের
বিরক্ত লাগতো। কিন্তু ওর বাবার মুখে বিরক্তির লেশ মাত্র থাকতো না। কি অপরিসীম
ধৈর্য ছিল লোকটার। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে তাই ও কিছু বলতো না আর।
চল্লিশ বছর আগে এই তিনজনের হাসি
খুশিতে মেতে উঠতো টিনের চালের বাড়িটা। সামর্থ্য সীমিত, কিন্তু স্বপ্ন ছিল অনেক বড়ো। তিনজনেরই স্বপ্ন ছিল চাঁদকে
ছোঁয়ার। সপ্তকের বাবা দিনরাত এক করে খেটে
চলেছিল সেই স্বপ্ন পূরণ করার জন্য। কিন্তু স্বপ্ন পূরণের সংগ্রামের পথে
বারবার অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল অভাব। সপ্তকও এক মুহূর্তের জন্য তার লেখা পড়ায়
ঢিলেমি দেয়নি। মা বাবা তাদের সর্বশক্তি দিয়ে এই সংগ্রাম কে পরাজয় করে সপ্তকের
স্বপ্নপুরণ করেছিল।
তিলেতিলে গড়ে তুলেছিল ভবিষ্যৎ। আশ্চর্য
মানসিক শক্তি এদের। মা যখন সন্ধে বেলায় কেরোসিনের আলোতে সেলাই করতো,তখন সপ্তক ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি যে মা বুনছে ভবিষ্যতের
নকশিকাঁথা।
এই রাতটা অভুক্ত থাকতে হবে জেনেও
আগামীকাল ছেলেকে কি ফুটিয়ে দেবে তার চিন্তাই
ছিল সর্বক্ষণ।
সপ্তকের বাবারও সর্বক্ষণ মনে হতো
ছেলে কি করে ভালো থাকবে। কখনোই মনে হয়নি নিজের শরীরের এর যত্ন নেওয়ার প্রয়োজন আছে।
এতো সংগ্রামের পরেও তাদের মুখে সর্বদা হাসি লেগে থাকতো। হয়তো পৃথিবীর সব মা বাবা-ই
এরকম।
২
“কি আবোল তাবোল ভাবছো ? যাও গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসো। বাইরের কেনা খাবার তাড়াতাড়ি না
খেলে এই ভ্যাপসা গরমে নষ্ট হয়ে যাবে। আর তাছাড়া দাসবাবু আসবে বাড়ির ব্যাপারে
কথাবার্তা বলতে অর্চিতার ডাকে চোখ খুলে সপ্তক বলল “ও হ্যাঁ, অর্চিতা তুমি গিয়ে বরং আগে ফ্রেশ হয়ে
আসো। তোমার পরে আমি যাচ্ছি।" অর্চিতা ফ্রেশ হতে বাথরুমের দিকে চলে গেলে
সপ্তকের চোখে পড়লো টেবিলে রাখা ফোটোটার দিকে। একবার জার্মানি থেকে খুব দামি একটা
ডিজিটাল ক্যামেরা কিনে এনেছিল ও। তারপর সেই ক্যামেরা দিয়ে মা বাবার একটা ফটো তুলে
দিয়েছিল ও। ফটোতে মা-বাবার হাসিটা জীবন্ত লাগছে। ঠিক যুদ্ধজয়ের হাসি। সত্যি
যুদ্ধজয়,
এত অভাব, সংগ্রামকে পাশে
রেখে ছেলেকে ছোট থেকে বড় করা, ডাক্তারি পাশ করানো, তারপর ছেলের বিদেশে যাওয়া এসব যুদ্ধজয়ের থেকে কোনো অংশে কম
নয়। দুখী হয়েও যেন তারা দুনিয়ার সবথেকে বড়ো সুখী। ছেলে ফিরলে তাকে ভাত বেড়ে দেওয়া, পছন্দমতো রান্না করা, তার জামাকাপড় পরিষ্কার করা, নিতান্তই সরল একতরফা
খুনসুটিতে সুখের ছোয়া পেতেন।
ছেলে বিদেশে যাবে শুনে মায়ের বুক হু
হু করে উঠেছিল। তবুও হাসি মুখে বিদায় দিয়েছিল। বাপের মাথাও গর্বে উঁচু হয়েছিল। ওরা
ভেবেছিল ছেলে কিছুবছর পর দেশে ফিরে আসবে, তারপর গ্রামের মানুষের সেবা করবে। প্রথম প্রথম ছেলে প্রতিবছর একবার হলেও বাড়ি আসতো। যাবার সময় মা সপ্তককে
জড়িয়ে বলত “এবার বাবা পাকাপাকিভাবে দেশে চলে আয়।
আর যেতে হবে না।” কিন্তু প্রতিবারই
সপ্তক বলত : দেখছি মা, কি করা যায়।”
দেখতে দেখতে সপ্তকের বিয়ে হয়ে গেল
অর্চিতার সাথে। জার্মানিতেই আলাপ। বিয়ের পরই সপ্তকের মনে পরিবর্তন ঘটতে লাগলো।
বিয়ের পর অবশ্য একবার এসেছিল অর্চিটাকে নিয়ে, সাতদিন থেকে চলে গেছিল ব্যাস ওই শেষবার। তারপর আর একবারও আসেনি। ইন্দ্র
জন্মাবার পর তার মুখ দেখার খুব ইচ্ছা ছিল সপ্তকের মা বাবার। কিন্তু কাজের চাপে
সেটাও করতে পারেনি। এরপর থেকে দুজন অধীর প্রতীক্ষায় থাকতো এই বুঝি ছেলে আসবে।
প্রতিবার পুজো এলেই মনে করতো এই বুঝি ছেলে আর বৌমা এলে তাদের ক্ষীরের নাড়ু
খাওয়াবে। সপ্তক বড়ো ভালোবাসতো। নাতিটাও কি ভালোবাসবে ?
৩
দুপুরের খাওয়া শেষ করে অর্চিটাকে
একটু রেস্ট নিতে বলে বাইরে হাঁটাহাঁটি করতে গেল সপ্তক। সত্যি দেশের মাটির গন্ধ
একটু অন্যরকম বড্ডো আপন। আজ প্রথমবার বুঝলো সপ্তক। হাঁটতে হাঁটতে বাজারের দিকে চলে
গেল সপ্তক। এই ভরদুপুরবেলা বাজারের প্রায় সব দোকানই বন্ধ, কেবলমাত্র একটা চায়ের দোকান খোলা আছে। দোকানি বসে বসে
ঝিমোচ্ছে। সপ্তক গিয়ে বসলো সামনের বেঞ্চিটায়। সপ্তক-কে বসতে দেখে দোকানদারের তন্দ্রাছন্ন
ঘটলো। একটা হাই তুলে চোখ কচলাতে কচলাতে বললো, “বলুন বাবু কি চান?”।
“একটা দুধ চা দাও তো ” এইদেশের দুধ চা-টা খুব মিস করে সপ্তক । জার্মানি এই দেশের
থেকে অনেক উন্নত, কিন্তু মাটির
ভাঁড়ের চা আর আড্ডাটা জার্মানির লোকেরা বুঝবেনা। দোকানি চায়ের জল চাপিয়ে বললো “আপনারে তো ঠিক ঠাওর করতে পারছি না। আপনি কোন গাঁয়ের লোক?”
“আমাকে তুমি ঠিক চিনবে না, এখন আমি বাইরের দেশে থাকি। তবে জন্ম আমার এ গ্রামে”
লোকটি অনেকক্ষণ সপ্তকের দিকে
একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল “বাবু আপনি সাগর
বাবুর ছেলে না?
আপনারে ঠিক চিনেছি। আগে বাবার সাথে
আসতেন না?
এতোদিন পরে গ্রামের কথা মনে পড়লো?”
“হ্যাঁ কাজের চাপে আর আসা হয় না। এবার
এসেছি বাড়ি সংক্রান্ত কাজের জন্য।” লোকজন এখনো চেনে আমাকে? মনে মনে ভাবলো
সপ্তক। দোকানদার বললো “বড্ডো ভালো মানুষ
ছিল তোমার বাবা।
কিন্তু সেবার যখন তোমার বাবা সাপের
কামড়ে আমাদের সবার চোখের সামনে নিস্তেজ হয়ে গেলো, খুব খারাপ লেগেছিলো তখন। সত্যি ভগবান কত নিষ্ঠূর। যার ছেলে কিনা একজন ডাক্তার , অথচ তার বাবাই বিনা চিকিৎসায় মারা গেলো। সাগর বাবু মারা যাওয়ার
পরেই তোমার মা একা হয়ে পরে। শেষের দিকে তার মাথাও খারাপ হয়ে যায়। সারাক্ষণ শুধু তোমার
নামই বলতে থাকে, কেউ গেলেই জিজ্ঞেস করতো সপ্তকের খবর
কি তোমরা জানো কেউ? মাঝে মধ্যে আগে
নাকি ফোনে কথা হতো সেটা অবশ্য শুনেছি, তোমার মায়ের বড্ডো ইচ্ছা ছিল ছেলের হাতের জলটা যেন পায়। তার সেই ইচ্ছাও অপূর্ণ
থেকে গেছে। বছর দশেক হল সেও মারা গেছে। এই নিন বাবু চা।” করুণ স্বরে বলল লোকটা।
চা টা খেয়েই সপ্তক আর বসলো না উঠে
পড়লো,
যেতে যেতে সপ্তক ভাবতে লাগলো। বহুবার মা বাবাকে বলেছে বিদেশে যেতে, কিন্তু মা বাবা বাড়ির মায়া ত্যাগ করতে পারেনি। আসলে মা
বাবা পুরোনো গ্রামবাসি আর আত্মীয়দের ছেড়ে যেতে চায়নি।
বাবা মারা যাওয়ার পরে সপ্তক খুব করে
চেয়েছিলো বাড়ি ফিরতে, কিন্তু ছুটি না
পাওয়ার জন্য আসতে পারেনি। এরপর থেকে মা যে একা হয়ে যাবে সেটা ভালোই আন্দাজ করতে
পেরেছিলো। কিন্তু মাকে যতবারই ফোন করে জিগেস করতো কেমন আছো? প্রত্যেক বার উত্তর পেত আমি ভালোই আছি।
মায়ের ভালো থাকার কথা শুনে সপ্তকও আর
কিছু বলতো না। কিন্তু আজ বুঝতে পারছে মায়ের ভালো থাকার আসল অর্থ। ইন্দ্র দূরে
থাকার জন্য সপ্তক আর অর্চিটার যেরকম কষ্ট হয়, ঠিক সেই রকমই কষ্ট পেতো তার মা বাবা। ইন্দ্রর ফিরে আসার সময় যে খুশি তা হয় বহু বছর আগে সেই হাসির ঝলকটাই অনুভব
করতো তার মা বাবা। আসলে বাবা মা কখনোই চায়না ছেলে মেয়ে তার থেকে দূরে থাকুক। এদিকে
সন্তানও বুঝতে পারে না মা বাবার মনে কিরকম ঝড় চলছে। আসলে আমরা মা বাবার দুঃখ কষ্ট
তা ঠিক বুঝতে পারিনা যতক্ষণ সেটা আমাদের সাথে ঘটছে।
এসব ভাবতে ভাবতে বাড়িতে চলে এল
সপ্তক। বাড়ি ফিরে এসে সপ্তক দেখল "ততক্ষণে দাসবাবু চলে এসছে। সপ্তক কে ঢুকতে
দেখে দাসবাবু দাড়িয়ে, করজোড়ে নমস্কার
করে বলল "হে হে, আমি একটু আগেই
এসছি। আপনার বাড়ির অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, একটু মেরামত করার দরকার। তবে সব নিয়ে ভাববেন না, আমার চেনাজানা লোক আছে তাদের দিয়ে করিয়ে নেব। আর ভালো কথা, একজন খদ্দের পাওয়া গেছে। সে আপনার বাড়িটা কিনতে চায়।
বললে কালই তাকে নিয়ে আসবো বাড়িটা দেখতে। জানি আপনার ও ওদেশে ফেরার আছে। যতদূর
তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজ শেষ করিয়ে দিতে চাইছি" । দাসবাবুর কথা শেষ হতে সপ্তক
হেসে বলল "তাকে আসতে না করে দিন"।
"তার মানে"
"মানে টা হল আমি এ বাড়ি বিক্রি করতে
চাই না।"
"আপনি তো এত তাগাদা দিলেন বাড়ি
বিক্রি করার জন্য। আমি হন্যে হয়ে খুঁজে একটা লোক পেলাম। এখন বলছেন আপনি বিক্রি
করতে চান না। ভারী অদ্ভুত তো মশাই আপনি।"
"হ্যা সত্যি আমি এ বাড়ি বিক্রি করতে
চাই না। আর আপনার লোক দেখার দরকার নেই। আপনি পারলে আসতে পারেন"
রাগে দু চারটে কথা বলে দাস বাবু চলে
যেতে অর্চিতা বলল "এ আবার তোমার কি মতিভ্রম হল, এই বাড়ি বিক্রি করার জন্য দেশে এলে। এখন বলছো বাড়ি বিক্রি করবে না"
সপ্তক বলল "মতিভ্রম না, মন পরিবর্তন হল, আসলে মা বাবা বেঁচে থাকতে তাদের যোগ্য সন্মান দিতে পারিনি। এই বাড়ি বেঁচে দিলে তাদের স্মৃতির শেষ সম্বলটুকু ছিনিয়ে নেওয়া হবে। আমি চাই না বাড়িটা বেঁচে দিয়ে তাদের স্মৃতি মুছে দিতে। ভাবছি আর ওদেশে ফিরবো না। এখানেই পাকাপাকিভাবে থাকি, আর গ্রামের মানুষের সেবা করি। যে রকম আমার মা বাবা চেয়েছিল। সন্তান হয় এইটুকু আশা পূরণ করতেই পারি। কি বল?"
0 comments:
Post a Comment