Dec 10, 2020

“সিমন্তিনি তোমাকে” - বিক্রম শীল

Edit Posted by with No comments


সিমন্তিনি তোমাকে

বিক্রম শীল

পর্ব- ১

কয়েকদিন ধরেই আমার কবিতার খাতাটা খুঁজছি। কলেজ বেলায় আমার লেখা সব কবিতাই আছে ওখানে। সম্ভবপর সব জায়গাতেই খাতাটা খুঁজেছি। যেখানে যেখানে থাকা সম্ভব প্রায় সব জায়গাতেই। কিন্তু পাইনি এখনো। কলেজ বেলার বেশ কিছু কবিতা আমার অন্য ডায়েরিতে তোলা ছিল সেগুলোই কলকাতার এক প্রকাশককে পড়িয়েছিলাম। তিনি উচ্ছসিত হয়ে আমার বই প্রকাশ করার প্রস্তাব দেন। তখনি ঠিক করেছিলাম বাড়িতে গিয়েই খাতাটা খুঁজবো। সন্ধ্যায় বসে চা খাচ্ছিলাম হঠাৎ নজরে এলো সিমন্তিনির দেওয়া উপহারটার দিকে। হ্যাঁ সিমন্তিনি, কলেজের বান্ধবী। শুধু কি বান্ধবী না না আমার সারাটা মন জুড়েই ছিল শুধু সিমন্তিনি, এখনো আছে। ওকে ঘিরেই তো কত কবিতা লিখেছি, কত স্বপ্ন দেখেছি একসময়। ও বলেছিল যেদিন আমার কবিতার বই বেরোবে সেদিন পড়বে।

সেই খাতাটায় ওকে ঘিরেই তো আমার লেখা সব কবিতা ছিল। ও সবসময় বলতো এসব কবিতা লিখে কি হবে। কলেজের পড়া শেষ করে ও এম এসসি করতে কলকাতা চলে গেল। অনেকে বলে দুরত্ব বাড়লে নাকি যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে যায়। আমাদেরও তাই হয়েছিল হয়তো। ভৌগলিক দূরত্বটা সময় চক্রে হলেও মনের দূরত্বটা ওই বাড়িয়ে নিয়েছিল। আসলে কবিরা শুধু গড়তেই জানে ভাঙতে শেখেনি কখনো।

আমাদের ব্যাচমেট রিয়ার কাছ থেকে সিমন্তিনির নতুন ঠিকানাটা পেয়েছি। আমার বইটা বেরোলে প্রথম কপিটাই সিমন্তিনি কে পাঠাবো। আর সাথে এই চিঠিটা।

প্রিয় সিমন্তিনি,

                     আশা রাখি খুব ভালো আছো। তোমার ঠিকানা পাল্টে গেলেও ঘটনাচক্রে আমরা এখন এক শহরে। একটা সংবাদপত্রে এখন আমি প্রুফ দেখার কাজ করছি। তুমি ঠিকই বলেছিলে কবিতা লিখে কি হবে। তাই কাজ করেই এখন আমার সংসার চলছে। সংসার বলতে মা আর আমিই এখন। কলেজের থার্ড ইয়ারের পরীক্ষা শেষ হয়ে যাওয়ার পর বাবা চলে গেলেন, সংসারের সব দায়িত্ব আমার ওপর এসে পড়ল। প্রায় ৬মাস কলকাতা পড়ে থেকে কাজটা পেলাম। ও তোমারও তো নতুন সংসার এখন। রিয়ার কাছে শুনলাম তুমি বিয়ে করেছ। বর ভালো চাকরী করে, সুখে আছো খুব বেশ ভালো লাগলো শুনে জানো তো জীবনে বেঁচে থাকা আর ভালো থাকার মধ্যে বড় প্রার্থক্য আছে। আচ্ছা তুমি কি আমাকে বেমালুম ভুলে গেলে নাকি গো। বিয়ের খবরটা তো দিতে পারতে। মা আমাকেও চাপ দেয় বিয়ে করার জন্যে, অনেক পাত্রীর ছবি দেখায় কিন্তু কারো মধ্যেই সেই সিমন্তিনি কে পাই না। শেষবার কলেজের সোশ্যালের দিন তোমার কাছে আমার কবিতার খাতাটা রাখতে দিয়েছিলাম। ইস খাতাটা যদি একটু উল্টে দেখতে ! দেখোনি জানি দেখলে ঠিক আমাকে প্রশ্ন করতে। তোমাকে মুখ ফুটে যদি মনের কথাগুলো বলতে পারতাম জীবনটা হয়তো অন্যরকম হত সিমন্তিনি। দেখো কথা বলতে বলতে ভুলেই গেছি একটা খুশির খবর আছে। আমার কবিতার বই বেরোচ্ছে সামনের বৈশাখে। সেটারই প্রথম কপিটা তোমায় পাঠালাম। সাথে আমার চিঠিটা। তুমিই তো বলেছিলে যেদিন আমার কবিতার বই বেরোবে সেদিন পড়বে আমার কবিতা। আসলে ফোনে আমি সব কথা ঠিক করে বলতেই পারতাম না। তুমি তো জানো তোমার কন্ঠ শুনলে আমার সব কেমন এলোমেলো হয়ে যায়। অনেকদিন ধরে কবিতা লিখি না। আচ্ছা আবার যদি আমি কবিতা লিখি তুমি পড়বে তো এবার সিমন্তিনি ???? ভালো থেকো।

                                                                         ইতি- কিংশুক

(সিমন্তিনির বর্তমান ঠিকানায় চিঠি পৌঁছে গেল প্রায় দু’মাস পরে।)


পর্ব- ২

(কেটে গেল কয়েক মাস...)

আমার চার ফর্মার বই এর জন্য আরো একটি কবিতা লেখা সম্পন্ন হল। আমার প্রথম কবিতার বইটির অভাবনীয় সাফল্যের পর প্রকাশনী কতৃপক্ষ অনুরোধ করেছে আরো একটি বই লেখার জন্য। আমার দ্বিতীয় কবিতার বইটি সামনের বছর কলকাতা বইমেলায় প্রকাশ করার তোরজোর শুরু করেছে প্রকাশনী।

আমি শুধু একটু সময় নিতে চেয়েছিলাম। প্রকাশকবাবু তাতেও রাজি।।

আজকের কবিতাটা পাঠাতে হবে সিমন্তিনি-কে।

সিমন্তিনি কে এখন প্রায়শই আমার লেখা কবিতা পাঠাই। পাঠানোর মাধ্যমটা অবশ্য এখন পাল্টে গেছে। হোয়াটস আপ-এ ওকে লিখে পাঠাই কবিতা, কখনো বা ডায়েরি থেকে ছবি তুলে। পুরোটা খুঁটিয়ে পড়ে মতামত জানায়। সবথেকে অবাক হয়ে যাই এটা ভেবে যে মেয়েটা একসময় আমার কবিতাকে পাত্তা দিত না সে এখন আমার লেখার সমালোচনা করে, সাথে কোন শব্দ কেন ব্যবহার করলাম তার আবার চুলচেরা বিশ্লেষণ। ভাবা যায়...

(কিছুদিন পর...)

একদিন সকালে প্রকাশকবাবুর কাছে খবর পেলাম আমার দ্বিতীয় বই এর কাজ খুব শীঘ্রই শুরু হবে। পাণ্ডুলিপি জমা করতে হবে কিছুদিনের মধ্যেই।

ঘটনা হল যত ফর্মার বই হবে তাতে একটা কবিতা এখনো লেখা বাকি....

আসলে কবিতা তো আর হাতের নাড়ু নয় যে শুধু বসে গেলাম আর হাতের তালুতে বানিয়ে ফেললাম। কবিতা আসে হঠাৎ, তখন তার ডাক ফেরানো যায় না। হয়তো মাঝরাতের ঝড়ো হাওয়া বা রৌদ্র তপ্ত দুপুর তখন ভীষণ কবিতা পায়....

গড়গড় করে পেন আঁচড় কেটে যায় সাদা কাগজে। এই কাব্যগ্রন্থের শেষ কবিতাটাও হয়তো আসবে তেমন করেই...

 

অনেকদিন হয়ে গেল সিমন্তিনির সাথে কথা হয় না। শেষ যেবার কথা হয়েছিল শুনেছিলাম ওরা দিল্লি চলে যাচ্ছে। ওর হাসবেন্ড এর বদলির চাকরি।

আসলে মাঝে সিমন্তিনির সাথে কথা বলার অভ্যাসটা খুব কষ্টকর হয়ে উঠেছে এখন। যতই হোক ও তো আর এখন কলেজের সেই বাচ্চা মেয়েটি নেই। বিয়ে হয়েছে, সংসার হয়েছে। আমি সেখানে শুধুমাত্র একজন তৃতীয় ব্যক্তি...। আমি শুধু অবাক হয়ে গেছিলাম যে এত মন দিয়ে আমার কবিতা পড়া শুরু করেছে বলে...

অবাক হওয়ার বোধহয় তখনো অনেক বাকি ছিল...হঠাৎ একদিন সিমন্তিনির একটা চিঠি আমাকে চমকে দিল...কোন দেরি না করেই চিঠির খামটা খুলে ফেললাম....

 

সিমন্তিনির লিখেছে-

প্রিয় কিংশুক...

কি কেমন আছো বলো। জানি এটাই ভাবছো যে এতদিন কোন খোঁজ নেইনি এখন আবার এই চিঠি...

আসলে কি বলতো জীবনের কিছু অন্ধকার দিন আসে যা সমস্ত আলোকে ঢেকে ফেলার চেষ্টা করে। কিন্তু তখন আলোর রোশনাই সব পাল্টে দেয়। জীবনকে আবার আলোকিত করে তোলে। আমার জীবনে সেটা তুমি আর তোমার কবিতা। সবাই হয়তো সমান ভাবে সংসারটা করতে পারে না। ওই নাটকের মূল চরিত্রে না থাকতে পারলে নাটক শেষ হওয়ার আগেই যেমন মঞ্চ থেকে নেমে যেতে হয় ঠিক তাই। সবাই মূল চরিত্রে থাকতে পারে না।

যাক সেসব কথা তোমাকে একটা দায়িত্ব দেবো। আমি একটু আধটু কবিতা লেখার চেষ্টা করি ওই সবই আপনার অনুপ্রেরণায়। এই কটা লাইন লিখেছি। কিন্তু শেষ করতে পারছি না জানো। তুমি প্লিজ শেষ করে আমাকে দেবে।

........

.....(দেখলাম ও একটা কবিতা লিখে পাঠিয়েছে...)

........

এত কিছু ফোনে বলা যেতে না তাই এই চিঠির আশ্রয় নিতে হল।

                                                                   ইতি- সিমন্তিনি

 

বিষয়টা আমি কিছুতেই বিশ্বাস করে উঠতে পারছিলাম না। এই প্রথম সিমন্তিনি আমাকে কবিতা লিখতে বলেছে। যে কিনা কলেজে আমার লেখা কবিতা পড়তে চাইতো না সে আমাকে নির্দেশ দিয়েছে কবিতা লিখতে। আজ কিছু নয় নিজের কাছে নিজেরই পাহাড় প্রমান প্রত্যাশার চাপ গড়ে উঠেছে।

কয়েক সপ্তাহ কেটে গেল এভাবেই...

কিছুতেই কবিতা আসছে না...

 

(কিছুদিন পর...)

একদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে গত রাতে সিমন্তিনির একটা মেসেজ এ চোখ পড়লো...

সিমন্তিনির লিখেছে-

নাটক শেষ হওয়ার আগেই মঞ্চ থেকে বিদায় নিতে হচ্ছে। অনেকদূরে চলে যাচ্ছি। আর দেখা হবে না, ভালো থেকো।

আমি পাল্টা লিখলাম এর মানে কি সিমন্তিনি... কোথায় যাচ্ছ তুমি ?

কোন রিপ্লাই পেলাম না বলে ফোন করলাম, কিন্তু ফোনও সুইচ অফ বলছে...

চিন্তায় পড়ে গেলাম...

সেদিন বিকেলবেলা রিয়ার কাছে খবরটা পেলাম... সিমন্তিনি কমিটেড সুইসাইড !!!

এত সহজে হার মেনে নিলে সিমন্তিনি, কি দেখলে জীবনটাকে, এই বোকামীটা কেন করলে তুমি...??

কেন এভাবে পালিয়ে গেল আমার থেকে...!?

 

কিছুদিন পর হঠাৎ আমার কলমে কবিতা এলো...

আমার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ সিমন্তিনি পাণ্ডুলিপির শেষ কবিতা তোলা থাক... সিমন্তিনি আর আমার কলমে...

 

আমার জীবন কবিতার অন্ত্যমিলে, জীবন গানের প্রতিটি সুরে...

আছো তুমি...

রৌদ্র ঘেষা ছায়ার নীড়ে...

আমার জীবনের মূল চরিত্রে...

আজও তুমি...

সিমন্তিনি...


(সমাপ্ত)

নিবেদনে- পথিকৃৎ ফিল্মস 

0 comments:

Post a Comment