হারানো সম্পর্ক
অ্যস্ত্রিক্স
আজ থেকে ঠিক দুই মাস আগে আমার আর আমার স্ত্রীর ডিভোর্স এর জন্য কোর্টে হাজির
হওয়ার তারিখ ছিল। কিন্তু এই লকডাউনের দৌলতে কোর্ট-কাছারি তো সবই বন্ধ, তাই আর হলো না।
কবে যে সব ঠিক হবে আর কবেই যে এই ঘরবন্দি থাকার থেকে নিস্তার পাবো, সেটাই বোঝা যাচ্ছে
না।
আমি একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত চাকরিজীবী, বাড়ি কলকাতাতেই তবে কাজের
সূত্রে থাকতে হয় নয়ডাতে। আমি আর আমার বউ, বিবাহিত প্রায় আট বছর, আমাদের একটা মেয়েও
আছে, তিন্নি, এবার জুলাইতে পাঁচ বছর পূর্ণ হবে তার। তিন্নি আর ওর মা কলকাতাতেই থাকে।
আসলে তিন্নির মা, মানে আমার স্ত্রী ঋতিকা, একটা বেসরকারি স্কুলের শিক্ষিকা। আমার আর
ওর কিন্তু লাভ ম্যারেজ হয়েছিল, তবে সময়ের সাথে সাথে ভালোবাসা বা ওই লাভটা যেন হারিয়ে
গেছে কোথাও। কলেজেই পরিচয় আমাদের। আমি অন্তিম স্নাতকের ছাত্র আর ওর প্রথম বৎসর। সম্পর্কটা
গড়ে ওঠে খুব কম সময়েই। বিয়েটা একটু দেরিতেই হয় আমাদের। এমনি কোনো রোমাঞ্চকর গল্প
নেই এর পেছনে, ওই দু’জনের পড়াশোনা শেষ করে, চাকরিতে ঢুকে নিজেদের একটু স্থায়ী করে
তারপর বিয়েটা করি। ওই ধরুন বিয়ের আগে পাঁচ বছরের সম্পর্ক। ওর বাড়িও কলকাতাতেই। আমি
ওই দক্ষিণ দিকে থাকতাম আর ওর বাড়ি পশ্চিম দিকে। বিয়ের পর চার বছর আমরা একসাথেই থাকতাম,
আমাদের কলকাতার বাড়িতেই। ও তখনও ওই স্কুলেই চাকরি করতো আর আমি অন্য একটা বেসরকারি
কোম্পানিতেই ছিলাম। বিয়ের তিন বছর পর তিন্নি এলো। আমরা খুবই খুশি ছিলাম। আমার মা-বাবা,
আমি, ঋতিকা আর আমাদের পরিবারের ছোটো সদস্য তিন্নি, এটাই আমাদের সংসার ছিলো। এক সাথে
বেশ ভালোই কেটেছে চারটে বছর। তারপর একটা অফার পাই আমি ব্যাঙ্গালোর থেকে, ভালো মাইনে
ছিল, তাই ঠিক করি যে এই কাজেই যোগ দেবো।
একটা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে আমি। পড়াশোনাতে আগাগোড়া ভালো ছিলাম
তাই একটা সংকল্প ছিলো, যে অনেক টাকা উপার্জন করবো। তাই একটু ভালো থাকার আর সবাই কে
ভালো রাখার চেষ্টায় ঋতিকা আর এক বছরের তিন্নিকে বাবা-মার সাথে ছেড়ে চলে যাই ব্যাঙ্গালোর।
ভেবেছিলাম ঠিক ঠাক ভাবে সব চললে, সবাই কে নিয়ে আসবো কলকাতা থেকে এখানেই। প্রথম প্রথম
কষ্ট হতো সবাইকে ছেড়ে একা একা থাকতে। আর প্রথম ছয় মাস কোনো ছুটিও দেয়নি যে বাড়ি
গিয়ে ঘুরে আসবো। কলকাতা থেকে কারো ব্যাঙ্গালোরে আমার সাথে দেখা করতে যাওয়াও সম্ভব হতো
না কারণ ঋতিকার চাকরি ছিলো তারপর তিন্নিও ছোটো আর সাথে মা-বাবাকেও একা ফেলে আসা সম্ভব
ছিল না। যাই হোক, ছয় মাস পর যাই আমি বাড়িতে, তখন সবাই খুব খুশি, প্রথমবার বাড়ির থেকে
এতদূর এতদিন ধরে থেকে এলাম। দশ দিনের ছুটি কাটিয়ে আবার ফিরে যাই। এভাবেই বছর কেটে
যায় আর মাঝে এক দু’বার এসেছিলাম বাড়ি। তারপর ব্যাঙ্গালোরে দেড় বছর চাকরিটা করার
পর নয়ডাতে বর্তমান প্রতিষ্ঠানটাতে যোগ দেই। এক বছর পর বাড়িতে বলি সবাই মিলে আমার এখানে
চলে আসতে, তবে বাবা আর ঋতিকা কেউ রাজি হয়নি, যদিও মা চেয়েছিল আসতে। তারপর তিন্নিও স্কুলে
ভর্তি হয়। ব্যাস কাউকেই আনা হয়নি আমার ওখানে, মাঝে ঘুরতে এসেছে কয়েকবার ঠিকই। আমিও
বাড়ি আসতাম মাঝে মাঝে তবে সময়ের সাথে সাথে যাওয়া আসাটাও কমে গেছে। যেখানে থাকি আর
যেমন স্তরে আমার কাজ, সেই জাকজমকে নিজের জীবনটা সাজিয়ে নিয়েছিলাম। আর কাজের চাপও
বাড়তে থাকে আস্তে আস্তে। ঋতিকার সাথে ফোনে কথা বলাটাও কমে গেছিলো। আগে দিনে দু-একবার
ফোন তো হতই, সবার সাথে কথা বলার জন্য আর সময় পেলেই ঋতিকাকে ফোন করে কিছুক্ষণ কথা বলে
নিতাম। এখন তো সেসব কিছুই কমে গেছে। হয়ত দু’দিনে একবার ফোন করতাম আর ওটাতেই সবার সাথে
কথা আর মাঝে মাঝে তো সেটাও করা হয়ে ওঠে না। তবে হ্যাঁ তিন্নি ফোন করলে আমার কথা বলতেই
হতো।
আস্তে আস্তে সময় পেরিয়ে যাচ্ছিলো আর আমি দূরে সরে আসছিলাম ঋতিকার থেকে।
কেমন যেন একটা বিরক্তি এসে পরেছিল। এমন না যে আমি অন্য কোনো সম্পর্কে জড়িয়ে পরে ছিলাম
তবে এই সম্পর্কটাও এখন বাঁধন মনে হচ্ছিলো। আর এক সাথেও তো থাকা সম্ভব হচ্ছিলো না। ও
আমার কাছে এসে থাকতে রাজি না নিজের চাকরি ছেড়ে আর আমার কাছেও কোনো উপায় নেই কলকাতা
তে স্থায়ী ভাবে থাকার। তাই ভাবলাম বিবাহটা ভেঙ্গে দেওয়াটাই উচিত হবে। তাই বললাম একদিন
ফোনেই ওকে। জিজ্ঞেস করলো "কেন, হঠাৎ কি হলো যে এতো বড়ো পদক্ষেপ?" বুঝিয়ে
বললাম সব কারণ। জিজ্ঞেস করলো "বাবা-মা আর তিন্নির কি হবে?" তখন এই প্রশ্নটার
উত্তর ছিলো না আমার কাছে। আসলে অতদুর ভাবিনি তখনও তাই বললাম "সে নয় একটা কোনো
উপায় করা যাবে।" তখন ও বললো "ঠিক আছে আগে সব ভেবে নাও তারপর জানিও, আমারও
একটু সময় চাই ভাবতে।" আমার মন বদলানোর চেষ্টা ও করেনি ঠিকই তবে ওর গলার আওয়াজটা
এবার একটু ভাঙ্গা ভাঙ্গা হলো, বুঝলাম হয়েতো চোখ দিয়ে ওর জল পড়ছে, মনটা খারাপ হয়েছে
কিন্তু বুঝতে দিচ্ছে না আমায়।
তিন দিন ভেবে একটা নির্ণয় নিয়ে ফোনে কথা বললাম ঋতিকার সাথে। জানালাম ওকে
যে ডিভোর্সের পর বাবা-মাকে আমি নিয়ে আসবো আমার কাছে নয়ডাতে আর রইলো তিন্নির কথা, সে
নয় ওর সাথেই থাকবে আর বললাম যে ও চাইলে আমাদের কলকাতার বাড়িতেই থাকতে পারে, মাঝে মাঝে
তিন্নি কে দেখতে আসবো কলকাতা তে। আসলে ওই বাড়িতে বিয়ে হয়ে এসেছিলো প্রথম, এতো বছর
ওই বাড়িতেই কাটিয়েছে, একটা আলাদা মায়া তে জড়িয়ে পড়েছে তাই আর আলাদা করতে চাইলাম
না। সব চুপ করে শুনে উত্তর দিলো "সবই তো শুনলাম, তোমার ইচ্ছে মতনই হোক সব শুধু
আমার একটা অনুরোধ আছে, সেটা রাখা গেলে ভালো হতো।" আমি জিজ্ঞেস করলাম "বলো
কি চাও? চেষ্টা করবো যথাসাধ্য।" ও বললো "বাড়িটা তুমি রেখে নিও, আমি ভাড়া
বাড়ি নিয়ে খরচা চালিয়ে নেবো, শুধু বাবা-মা কে আমার সাথে থাকতে দাও।" আমি শুনে
অবাক হলাম, জিজ্ঞেস করলাম "এটা আবার কি ধরনের আর্জি হলো? আমার বাবা-মা তোমার সাথে
কেনই বা থাকবেন ?" তখন ও বললো "আজ আমাদের বিয়ে ভেঙ্গে দিচ্ছ তুমি, বুঝতে
পারছি সেটাতে তোমার অধিকার হতেই পারে। তবে গত ১২-১৩ বছর ধরে আমার বাবা-মার সমান স্থানেই
এই দু’জন মানুষকে রেখেছি আর আমার বাবা-মা চলে যাওয়ার পর, এই দুটি মানুষ কে জড়িয়ে
আছি আমি। আমার কি এই মানুষগুলো, এই সম্পর্কগুলোর ওপরে কোনো অধিকার নেই?" শুনলাম
ওর কথাগুলো, কিছুটা বোঝার চেষ্টাও করলাম তবে মা-বাবাকে ওর কাছে দিতে পারলাম না। তাই
বলে দিলাম "না এটা সম্ভব না।" তখন ও বলে উঠলো "তবে এই ডিভোর্সটাও সম্ভব
না।" আর ফোনটা রেখে দিলো। মা বাবা অথবা তিন্নি কেউই এই সবের বিষয়ে জানতো না।
জানাইনি কারণ বাবা-মার শরীরটা ঠিক থাকে না, তাই অযথা চিন্তায় ফেলতে চাইনা আর তিন্নি
তো ছোটো, বুঝবেই বা কি ! যাই হোক, আরো এক-দুইবার ওকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম তবে ও আর
মানলো না তাই নিজের আইনজীবীকে দিয়ে ওর কাছে কাগজ পাঠালাম ডিভোর্সের, সই করেনি তাই
শেষমেষ কেসটা উঠলো কোর্টে। আর সেই সূত্রেই এলাম কলকাতা আর ব্যাস আটকে পরলাম এই লকডাউনে।
জানি এই লকডাউনটা জরুরি ছিলো খুবই, মানুষ-কে সুস্থ রাখতে, ভালো রাখতে। তবে
আমার জন্য যেন এটা একটা বিরক্তিকর দন্ড ছিলো, বন্দী হয়ে গেছিলাম সেই মানুষটার সাথে
যার থেকে আলাদা হওয়ার জন্যই আমার এখানে আসা। খুব বিরক্ত লাগতো, সারাদিন তাকে চোখের
সামনে দেখতে, তবে তিন্নিকে সারাক্ষণ কাছে পেতাম তাই সহ্য হয়ে যেত এসব। আর বাড়িতে
খুব একটা কাজও ছিলো না, সারাদিন ওই মোবাইল, ল্যাপটপ আর মেইল চেক, মাঝে মাঝে ছাঁদে গিয়ে
ফুল গাছগুলোকে একটু জল দিতাম আর একটুআধটু বাড়ির কাজ করতাম ব্যাস। এভাবেই দিন কাটছিলো,
হঠাৎ একদিন ঘুম ভাঙ্গলো একটা চিৎকারের আওয়াজ শুনে, দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে দেখি ঋতিকা
পরে আছে সিড়ির শেষে। তারাহুরো করে গেলাম ওর কাছে, বুঝতে পারলাম ভালোই চোট পেয়েছে বাম
পায়ে আর ডান হাতটাতে। হেঁটে যাওয়ার অবস্থায় ছিল না, তাই আমি কোলে করেই নিয়ে গেলাম
ওকে ওর ঘরে। ডাক্তার ডাকলাম, আমার বন্ধুই ছিলো সে, আমাদের পারিবারিক চিকিৎসক। এলো দিব্যেন্দু
আধা ঘন্টার মধ্যেই। দেখেই বললো এক্সরে আর কিছু পরীক্ষা করাতে। নিয়ে গেলাম আমি আর দিব্যেন্দু
মিলে ওকে। তিন্নি আর মা-বাবা বাড়িতেই ছিলো। সব করে ফিরতে ফিরতে তখন প্রায় দুপুর দেড়টা।
রিপোর্ট এলো বিকেলে, যা ভেবেছিলো দিব্যেন্দু সেটাই হয়েছে। ডান হাতের হাড়টা ভেঙেছে
আর বাম পায়ের হাঁটুতে চির ধরেছে। সব মিলিয়ে দাঁড়ালো যে দুই জায়গাতেই প্লাস্টার করতে
হবে আর ঠিক হতে হতে মোট এক মাস সময় লাগবে। তার আগে কোনোরকম ভারী কাজ করা বারণ আর বিছানায়
সজ্জাশায়ী থাকতে হবে কম করেও আড়াই সপ্তাহ। সব ওষুধ লিখে দিয়ে আর খাওয়ানোর পদ্ধতি
বলে দিব্যেন্দু চলে গেলো। সেদিন দুপুরের রান্নাটা আমিই করেছিলাম। আর তো কেউ নেই করার।
আর সেদিন থেকেই ঋতিকা যেসব কাজগুলো করতো সারাদিন, যত সব ওর দায়িত্ব ছিলো সবার প্রতি,
সব এলো আমার ঘাড়ে আর সাথে ওর দেখাশোনাও করতে হল।
আগামীদিন থেকে সময়তালিকা পাল্টে গেলো আমার। সকালে উঠেই গেলাম ঋতিকার ঘরে।
দেখলাম ও জেগে আছে আর মা বসেছিলো ওর পাশে। কথা বলে জানতে পারলাম, ভোর পাঁচটা থেকেই
নাকি ও জেগে আছে। ওটাই আসলে ওর রোজকার ওঠার সময় আর ওর ওঠার পর, এই সাড়ে পাঁচটা নাগাদ
মাও উঠে পড়েন তবে আজ একটু তাড়াতাড়ি উঠেছেন। আর ওঠার কারণটা হলো ঋতিকা। সকালে জেগেই
নাকি কাউকে না জানিয়ে বাথরুম যাওয়ার চেষ্টা করেছিল আর পড়ে গেছে মেঝেতে আর সেই আওয়াজেই
মার ঘুম ভেঙ্গে গেছে আর মা ওকে বাথরুমে নিয়ে গেছে। এটা দেখে ঠিক করলাম আজ রাত থেকে
ওর আর তিন্নির সাথেই ঘুমোবো নইলে মাকে অযথা বিরক্ত হতে হবে। যদিও মা একটুকুও বিরক্ত
হয়নী, বরং চিন্তিত ছিল ওকে নিয়ে। তারপর কিছু ওষুধ দেওয়ার ছিলো ওকে, সেগুলো দিয়ে
নিয়ে নিজে একটু ফ্রেশ হয়ে ঢুকলাম রান্নাঘরে, মাও এলো সাহায্য করতে, মানা করাতে বললো
যে এটুকু সাহায্য উনি সব সময়ই করেন রান্না করতে। দু’জনে রান্নার কাজটা সেরে তিন্নিকে
উঠোলাম আর ওকে ফ্রেশ করিয়ে সবাই মিলে সকালের খাওয়ারটা খেয়ে নিলাম। এরপর বাসন মাজা,
কাপড় ধোয়া, ঘর মোছা সবই এক এর পর এক করতে লাগলাম, আর মাকে বললাম ঋতিকাকে খেয়াল রাখতে
নইলে মা কোনো কাজই পুরোপুরি করতে দিতো না আমাকে। সব কাজের মাঝে হঠাৎ নজর চলে যেত ওর
দিকে আর দেখতাম ও তাকিয়ে আছে আমার দিকে, মন খারাপ নিয়ে, কারণ ও কোনোদিন আমাকে কিছু
করতে দিতো না আর যেই আমার নজর ওর ওপর যেত, অন্যদিকে তাকানোর ভান করতো। এই ভাবেই সারাদিন
কেটে গেলো। রাতে খাওয়ার পর ঘুমোতে যাই, তিন্নিকেও নিয়ে আসি আমাদেরই ঘরে, ওকে মাঝে
শুইয়ে দু’পাশে শুলাম দু’জনে। আজ প্রায় দুই বছর পর এক বিছানায় আমরা। খুব ক্লান্ত
ছিলাম তাই বিছানাতে মাথা রাখতেই ঘুমিয়ে পড়ি। পরে সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখি মাঝে তিন্নি
নেই চলে গেছে ঠাম্মা আর ঠাকুরদার কাছে, বিছানায় ছিলাম শুধু আমি আর ও। উঠে পড়লাম দেরি
না করে আর শুরু একই সেই সময়তালিকা হিসেবে কাজ করা। আজ রাত থেকে তিন্নি ঘুমাতো না আমাদের
সাথে, শুধু আমি আর ওই শুতাম একসাথে। এই ভাবেই দিনগুলো পেরোতে থাকলো, একদিন, দুইদিন,
তিনদিন করে এক সপ্তাহ। রোজ ভোরে ওঠা, সবার জন্য কাজ করা আর ক্লান্ত হয়ে বিছানায় পড়ে
যাওয়া। খুব বিষণ্ণ লাগতো মাঝে মাঝে। আর বুঝলাম আস্তে আস্তে এই কিছুদিনেই আমার এই অবস্থা
আর মানুষটা তো কতো বছর থেকে এই সব করছে আর সাথে নিজের চাকরিটাও সামলাচ্ছে। জানেন সেদিন
থেকে একটা আলাদা শ্রদ্ধা জন্মালো ওর প্রতি। সেই যে আমাদের কলেজের অপরিপক্ক ভালোবাসাটা
ছিলো, তারপর বিয়ে তারপর সেইভাবে সম্পর্কটাকে সময়টাই দিয়ে ওঠা হয়নি পূর্ণতা পাওয়ার,
যদিও বেশিরভাগ দোষটা আমারই ছিল, সেই সময়টা মনে হলো যেন সম্পর্কটা এখন পূর্ণতা পাচ্ছিলো।
দিন পেরোতে থাকলো আর তার প্রতি ভালোবাসাটা যেন ফিরে ফিরে আসছিল আমার মনে।
সেই দিনগুলো, সেই সময়গুলো ভেসে আসছিলো যখন ভালোবাসায় মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছিলাম
দু’জনে। মনে মনে ঠিক করলাম ফিরবো না নয়েডাতে আর। ওই কাজটা ছেড়ে, কলকাতাতেই কোনো কাজ
খুঁজে নেবো। সময় লাগবে একটু আর বেতনটাও হয়তো মনের মতন পাবো না, তাও যেটুকু ব্যাংকের
খাতায় আছে সেটুকুতে চলে যাবে। আর এই লকডাউন এটাও শিখিয়েছে যে আমাদের রোজকার জীবিকাতে
জরুরি জিনিসগুলোর আর্থিক মূল্য যথেষ্ট কম, অর্থ তো আমরা খরচ করি নিজেদের সদাম্ভিক জীবিকার
সামগ্রীগুলোতে। এটা মনে ভেবে রাখলাম তবে ওকে বলার সাহসটা জোগাতে সময় লেগেছে অনেক।
ভালোবাসা যখন ছিল না এই ভয়টাও ছিল না আর এখন ভয়টা এসেছে কারণ ভালোবাসাটা ফিরে পেয়েছি।
ভয়টা ওর থেকে না, ওকে হারানোর ভয় এটা।
দেখতে দেখতে ঠিক হয়ে গেল ও। এখন যথেষ্টই ভালো, নিজের সব কাজ আবার সামলে
নিচ্ছে, তবুও যেটুকু পারি হাতে হাতে ওকে সাহায্য করি, ও মানা করে তবে এই সাহায্যের
ছলেই হোক, ওর কাছাকাছি থাকতে পারি আর ওর কিছুটা আরাম হয় তাই করি। এখনো এক সাথেই শুই।
হঠাৎ একদিন শোয়ার সময় আর নিজের মনের কথা আটকাতে পারলাম না, ভেঙ্গে পরলাম, কেঁদে ফেললাম,
আর আমার চোখে জল দেখে জড়িয়ে ধরলো ও আমাকে, জিজ্ঞেস করলো "কি হয়েছে ? কাঁদছো
কেন এভাবে হঠাৎ?" আমি বললাম "আর পারছি না, তোমাকে ছেড়ে, তোমার পাশে থেকেও
তোমার থেকে কতো দূরে সরে গেছি আমি নিজের ভুলে। পারছি না আর।" আমার মাথায় হাত
বুলিয়ে বললো "তোমার জীবন, তুমি যেভাবে চাও বাঁচতেই পারো, তুমি বিয়ে করেছ বলেই
যে আমার সাথে সারাজীবন থাকতে হবে সেটাতো জরুরি না, তুমি আলাদা হতে চাও আলাদা হয়ে যেতেই
পারো। সেটা তো দোষের কিছু না।" ওর কথাগুলো শুনে যেন আরো ভেঙ্গে পড়লাম, নিজেকে
আরো ছোটো মনে হল এই মানুষটার কাছে। শেষে বললাম ওকে "আমি তোমাদের সাথে থাকবো, চাইনা
আমার ডিভোর্স, চাইনা টাকা, শুধু তোমাদের নিয়ে থাকতে চাই। এখানেই একটা কাজ খুঁজে থেকে
যাবো। একসাথে থাকবো, বলো রি তুমি থাকবে তো আমার সাথে ?" এটা শুনেই ও আমায় ছেড়ে
একটু দূরে সরে বসলো। ওর চোখটাও ভেজা তবে মুখে কিছুই বললো না। জিজ্ঞেস করলাম আবার
"বলো না রি তুমি থাকবে তো আমার সাথেই?" কিছুক্ষণ পর উত্তর দিলো "না।
আমি থাকতে পারবো না তোমার সাথে।" আমি কারণটা জিজ্ঞেস করতেই বলে উঠলো "তুমি
যা বলেছ, যেই নির্ণয় নিয়েছো এই সম্পর্কটা নিয়ে নিজের ব্যাপারে ভেবে আমি সেটাতেই রাজি
ছিলাম। আর আজ আমি নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি আর আমি চাই না এই সম্পর্কটা
রাখতে। আশা করি তুমিও জোর করবে না আমায়।" এই কথাটা শুনে আর কি বা বলতাম ওকে আমি।
ঠিকই তো বলছে ও, আমার জীবনের সিদ্ধান্তগুলো নেওয়ার অধিকার আমার থাকলে ওরও অধিকার আছে
নিজের জীবনের সিদ্ধান্তগুলো নেওয়ার। যদিও জানি ও খুব অভিমান করে আছে আমার ওপর, এটাও
হতে পারে যে ওর আত্মমর্যাদাতে অনেকখানি আঘাত লেগেছে আমার কথায় অথবা ওর আমার প্রতি
ভালোবাসাটা আজ কোথাও হারিয়ে গিয়েছে। কারণটা যেটাই হোক, অসম্মান করবো না ওর কথার আমি
শুধু প্রার্থনা করছি ওর আমার সাথে থেকে যাওয়ার। আর যদি না থাকে তাহলে এই লকডাউনটা
যতদিন আছে, নিজের এই সুবর্ণ মুহূর্তগুলো উপভোগ করে নেই। শেষে কি হবে এই সম্পর্কটার
পরিণতি আমি জানি না তবে ঋতিকাকে আজীবন ভালোবেসে যাবো আর থাকবো ওর আশেপাশেই, নিজের সব
দায়িত্বগুলো পালন করবো ওর প্রতি। ভালো রাখবো ওকে।
0 comments:
Post a Comment