অতিথি- কিশোর মুজুমদার (কবি, লিরিসিস্ট, ইউটিউবার)
সাক্ষাৎকার ও অণুলিখন- দীপজ্যোতি গাঙ্গুলি
নেটফড়িং অনলাইন ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে একটি নতুন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কোচবিহার
তথা বাংলার বেশ কিছু মানুষ যারা নিজ নিজ কাজে অত্যন্ত পারদর্শী ও পরিচিত মুখ, তাদের
মুখে তাদের জার্নি শুনে সেটা নেটফড়িং এর পাঠকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। আজ আমাদের সাথে
যেই মানুষটি আছেন তার পরিচিতি সে নিজেই। আমাদের সাথে আজ আছেন, কোচবিহার শহরের সেরা
ইউটিউবার, দ্য ওয়ান এন্ড অনলি কিশোর মজুমদার।
দীপজ্যোতি- প্রথমেই জিজ্ঞেস করবো, লকডাউন কেমন কাটালেন?
কিশোর- সবার প্রথমে নেট ফড়িংকে ধন্যবাদ জানাই এত সুন্দর কাজ করছো তোমরা
তার জন্য । লক ডাউনে মিশ্রভাবে কাটালাম। আমি কাজ পাগল মানুষ । কাজে ডুবে থাকার চেষ্টা
করেছি। কিন্তু চারপাশের পরিস্থিতির জন্য মানসিকভাবে ভালো নেই।
দীপজ্যোতি- শিক্ষকতার পাশাপাশি কোচবিহার শহরের সেরা কবি তথা ইউটিউবারদের
মধ্যে একজন। মানে এটা কিভাবে ম্যানেজ করেন?
কিশোর- সেরা কবি তথা ইউটিউবারদের মধ্যে একজন - এ কথা ঠিক নয়। কোচবিহারে
বিখ্যাত কবি সাহিত্যিক রয়েছেন, যাদের আমি খুব শ্রদ্ধা করি । তাদের কাছে আমি তো নগণ্য।
আর ইউটিউবার ? বাঘা বাঘা ইউটিউবার আছেন আমাদের শহরে । আমার চ্যানেল সেখানে ছোট্ট চারাগাছ
মাত্র।
আর ম্যানেজ করার কথা বলছো । শিক্ষকতার পাশাপাশি আমি সবচেয়ে পড়তে ও লিখতে
ভালোবাসি । আর এখনকার পড়ার বেশিরভাগটাই হচ্ছে অনলাইনে । কিছু কিছু কোর্সও করে নিচ্ছি
। শিখতে বেশি ভালোবাসি বলে আমি নিজেকে এখনো ছাত্রই ভাবি। আর রুটিন করে পড়ি, কবিতা ও
গান লিখি। তিনটি ব্লগ চালাই, যেখানে নিয়মিত লিখে যেতে হয়। সপ্তাহে একটি করে ইউটিউবের
জন্য ভিডিও বানাতে চেষ্টা করি। পুরো কাজগুলি কেমন করে যেন হয়ে যায় । আসলে গভীর ভালোবাসা
থেকেই কাজগুলো আমাকে খুব আনন্দ দেয়।
দীপজ্যোতি- আমার বিগত ছয় বছর থেকে একটা প্রশ্ন আপনাকে জিজ্ঞাসা করার ইচ্ছে
ছিল। আজ সুযোগ পেয়ে করে ফেলি।সেটা হল, আপনি যেটাই করেন, সেটাতেই আপনি সেরা। মানে এই
'ফার্স্ট বয়' হওয়ার পেছনে কি স্ট্র্যাটেজি মেনে চলেন?
কিশোর- হাঃ হাঃ হাঃ । 'সেরা' ব'লো না আমাকে। কিন্তু আমি যে কাজই করি খুব
ভালোবেসেই করি। আর নিজের কাজে যখন পুরোটা উজার ক'রে দিয়ে তার ফল পাওয়া যায় । সেটা যত
যৎসামান্যই হোক না কেন, আমার কাছে ওটাই "সেরা' । বোঝোই তো নিজের সন্তান যেমনই
হোক না কেন সে-ই ভালো ।
দীপজ্যোতি- রাঘব চট্টোপাধ্যায়ের সাথে কাজ করে কেমন লেগেছিল? যদি একটু গল্পটা
শেয়ার করেন।
কিশোর- এই ব্যাপারে আমি একজনের নাম করতে চাই সে হল কোচবিহারের প্রবীর সরকার,
খুব ভালো গান লেখে । প্রবীর আমাকে প্রথম টলিউডে মিউজিশিয়ান শিবশঙ্করদার সঙ্গে পরিচিত
করায়। তারপর ইউফোনি মিউজিক থেকে আমার লিরিক এ রাঘবদা ( রাঘব চট্টোপাধ্যায়) আর অদিতি
মুখার্জীর অ্যালবাম 'আলোর চিঠি' বের হয়।
রেকর্ডিং এর জন্য নির্দিষ্ট তারিখে গেলাম স্টুডিও হারমনিতে । সারাদিন রাঘবদার
সঙ্গে আমরা খুব মজা করে খেলাম, কাজ করলাম । খুব মিশুকে প্রকৃতির মানুষ রাঘবদা। আমার
লিরিকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ । কি বলবো নিজের মুখে। যাকগে। তার আগে একদিন স্কুলে ছুটির
পর ক্যারাম খেলছিলাম । এমন সময় রাঘবদার ফোন পেয়ে চমকে উঠি । খুশিতে ডগমগ হয়ে সেদিনই
টিকিট কাটি। সেখানে গিয়ে বেশ কয়েকজন বিখ্যাত মিউজিশিয়ানের সঙ্গে মেশার সুযোগ পেয়েছি।
দীপজ্যোতি- কোচবিহারের এতো এতো শিল্পীদের সাথে কাজ করলেন। কার কার সাথে
কাজ করে সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে?
কিশোর- দ্যাখো । কোচবিহারে এখন বেশিরভাগ প্রফেশনাল কোয়ালিটির কাজ দিচ্ছে।
কার কথা বলবো । এভাবে বলতে চাই না। সবার সঙ্গেই কাজ করে আমি খুশি। কারণ সবাই আমার পাশে
দাঁড়িয়েছে। আবৃত্তিকার, সংগীতশিল্পী, অভিনয়শিল্পী, আর্টিস্ট, কোরিওগ্রাফার, D.O.P,
অডিও-ভিডিও কাজের সঙ্গে যুক্ত মানুষ সবাই আমার প্রিয়। স্টুডিও-র কথা যদি বলো তাহলে
nexxus studios, Jalsaghor, Audiogear এদের সঙ্গে কাজ করেছি ও করছি । এত এত মানুষের
প্রচেষ্টা আর আদর পেয়ে আমার চ্যানেলটা আমার একার আর নেই । সকলের আপন হয়ে উঠেছে। এখন
আমরা একটা টিমের মতো কাজ করে চলেছি।
দীপজ্যোতি- এই যে আপনার এতো সাকসেস এটা কি আপনার মধ্যে কখনো কোনো নেগেটিভ
প্রেসার তৈরি করে?
কিশোর- এটা খুব মজার প্রশ্ন করেছো । যে কোনো কাজে মাঝে মাঝেই খুব হতাশা
আসতে বাধ্য । কিন্তু আমি জীবনকে অন্যভাবে দেখি । আমার কাছে It's a game, কোনো কাজ একটা
করার পরেই আমার শুরু হয় পরের কাজটা নিয়ে চিন্তা । কীভাবে আগের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা
নিয়ে পরেরটা আরও বেটার করা যায় তার চেষ্টা করি । পুরো টিমকে আমি সর্বদা জাগিয়ে রাখতে
চেষ্টা করি। আমি কিন্তু প্রশংসার চেয়ে নিন্দা থেকেই বেশি শিখতে পারি । তাই প্রশংসা
আমার কাছে নেতিবাচক হয়ে ওঠে না। ভালো কাজের প্রশংসা আমার দায়িত্ব বাড়িয়ে দেয় । তাই
আরও বেশি কাজেই মনোযোগী হতে পারি। সাকসেস তাই আমার কাছে power booster.
দীপজ্যোতি- আজ যারা লেখালেখি করছে তাদের অনেকেরই ইনস্পিরেশন আপনি। ঠিক যেমন
আমার। কিন্তু আমার প্রশ্ন হল, আপনার ইন্সপিরেশন কে?
কিশোর- সেটা এককভাবে কেউই নয় । বিশ্ব জোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র ।
আমি সবার কাছে শিখতে চাই । তুমি দেখবে প্রত্যেকটা মানুষের কাছেই কিছু না কিছু শেখার
আছে । নেতিবাচক দিকগুলো ভুলে তাদের ইতিবাচক দিকগুলো থেকেই ইন্সপিরেশন নিতে চেষ্টা করি।
আর লেখার কথা বলছো । আমি আমার বাবার (স্বর্গীয় সুনীল মজুমদার) কাছে লেখালেখির
আগ্রহ পেয়েছি। বাবা নাটক, গান লিখতেন । আর অনেক বই পড়তেন । এখনো মনে হয় বাবা আমার পাশে
থেকে লিখতে প্রেরণা দিচ্ছেন । আমার " আমিও পারি" কাব্যটি সামনে প্রকাশিত
হবে । এই বইটা আমি বাবাকেই উৎসর্গ করছি ।
দীপজ্যোতি- ২০০৯ সালে আপনি দাদাগিরি সিজন ২ তে গিয়েছিলেন। স্টেজে দাদার
মুখোমুখি কেমন অনুভূতি হয়েছিল ?
কিশোর- ওরে বাবা সে এক অনুভূতি । স্টেজের অভিজ্ঞতার আগে বলে নি। সৌরভের
জ্বর হয়েছিল বলে আমাদের পুরো টিমকে ১৪ দিন থাকতে হয়েছিল । তখন, আমাদের গ্রুমার ছিলেন
মীরাক্কেলের কৃষ্ণেন্দু, সৌরভ পালধি ওরা। ওই ১৪ দিন জীবনে আমার দারুণ একটা প্রাপ্তি
ছিল । আর স্টেজে দাদার মুখোমুখি আমার স্বপ্ন মনে হয়েছিল । আসলে এত আলোর মাঝে, ক্যামেরার
সামনে, আমার অভিজ্ঞতাও কম । একটু নার্ভাস লাগছিল । দাদার সঙ্গে হাত মেলানোর পর কথা
বলার পরে একদম ফ্রি হয়ে গেলাম। এটা দারুণ স্মরণীয় দিন আমার কাছে ।
দীপজ্যোতি- এমন কোনো স্বপ্ন আছে জীবনে, যা কখনো পূরণ হবার মতো না?
কিশোর- মানুষ সব পারে । এমন কোনো স্বপ্ন আমি দেখি না যা পূরণ হবার নয়। আমি
স্বপ্ন যা দেখি সব পূরণ করেই ছাড়বো ।
দীপজ্যোতি- আগামীতে যারা কবি বা লিরিসিস্ট বা একজন সফল ইউটিউবার হতে চায়।
তাদের জন্য কি বার্তা দেবেন?
কিশোর- এটা ব্রড আনসার টাইপ কোশ্চেন । লিরিসিস্ট এর বিষয়ে আমি বিপরীত দুটি
দিক তুলে ধরতে পারি। শিক্ষককে যেমন সবার আগে ছাত্র হতে হয়, তেমনি গীতিকারকে সবার আগে
শ্রোতা হতে হয় । শচীনদেব বর্মণ থেকে শ্রীজাত সবার লেখাই আমি গভীরভাবে অনুভব করতে চেষ্টা
করি । LBW -র আপিল হলে যেমন রিপ্লে দেখে বোঝা যায় বলটা কোন দিকে যাচ্ছে। তেমনি প্রফেশনাল
লিরিসিস্টকেও গানের প্রবাহ অনুভব করতে হয়। আরেকটি দিক হল গীতিকার হবার কোনো গ্রামার
লেসন নেই । লালন ফকির আমার মতে অন্যতম শ্রেষ্ঠ গীতিকার। গান হল হৃদয়ের ছান্দিক অনুভূতির
প্রকাশ । শব্দের উর্ধে সুরের মূর্ছনাই সেখানে প্রধান । তাই নিজেকে ফিল করে যা বেরোবে
তাই গান হয়ে উঠবে । যদি সেই ব্যক্তিক বিষয়টি ব্যষ্টিক হয়ে ওঠার ক্ষমতা রাখতে পারে ।
আর ইউটিউবারদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ চারটি টিপস ।
১। সাফল্যের পেছনে ছুটলে হবে না।
১০০ টা ভিডিও করে তারপরে ফিরে দেখো কী হল । আর প্রতিটি ভিডিও এক একটা শিক্ষা দেবে ।
দুটো চারটা ভিডিও করেই বার বার ভিউজ কত হল দেখলে হবে না । অর্থাৎ চরম ধৈর্য রাখতে হবে
।
২। নিয়মিত ভিডিও আপলোড করতে হবে । নিয়মিত ভিডিও দিলে ইউটিউব তাকে rank দেয়
। আর নির্দিষ্ট দর্শক তৈরি হতে থাকে।
৩। কন্টেন্ট ভালো হতে হবে । যা মানুষের শিক্ষা বা বিনোদনের হবে ।
৪। আর টেকনিক্যাল বিষয়গুলো শিখে নিতে হবে । সেক্ষেত্রে ইউটিউবই হল বেস্ট
টিচার ।
নতুনদের জন্য রইল ভালোবাসা । আর বেস্ট অফ লাক।
দীপজ্যোতি- আপনাকে টলিউডে কাজ করতে আবার কবে দেখবো?
কিশোর- টলিউড বলতে আর কি । পুজোতে একটা কাজ হচ্ছে 'অবশেষে' শিরোনামের গান
। বিক্রম শীল এর গলায় । অভিনয়ে আছে "পরিণীতা" ছবিতে একটা রোল করেছিল সেই
পিহু । আর পুরোটাই প্রায় কলকাতায় কাজ । সিনেমায় কাজের কথা যদি বলো তাহলে বলা খুব মুশকিল
। দু'একটা কাজের কথা চলছে । হলে জানতেই পারবে । সিধুর একটা গানের কাজ শুরু হচ্ছে ।
সেটা Nexxus Studios তে কাজ শুরু হয়ে গেছে । পুজোর পর হয়তো শুনতে পাবে ।
দীপজ্যোতি- আগামীতে কি কি পরিকল্পনা আছে ? মানে আর কি কি নতুন চমক অপেক্ষা
করছে আমাদের জন্য ?
কিশোর- চমক কিনা জানি না । আমার প্রিয় বই এর কাজ শুরু হচ্ছে । ব্লগ এর কাজে
মন দিয়েছি । মানুষের ভালোবাসা পাচ্ছি ও ভবিষ্যতেও পাবো আশা করছি । কয়েকটা দারুণ দারুণ
কাজ আসছে সামনে । কিছু গান ও কবিতা । যারা পিয়াসি চক্রবর্তীর কণ্ঠে 'আমিও পারি' শুনেছেন
ও পছন্দ করেছেন, তাদের জন্য পিয়াসির কণ্ঠে দারুন একটা কবিতার ভিডিও আসছে পুজোর পর।
একটু নতুন ধরনের কাজ । আর নতুন নতুন বেশ কিছু এক্সপিরিমেন্ট চলছে । দেখতেই পাবে । যারা
আমার লেখা গানের ভক্ত তাদের জন্য বলি, শুনলে খুশি হবেন যে 'চিরকূট' নামে একটা গান আসছে
আয়ুব আলীর কণ্ঠে । এবস্ট্রাক্ট আর রিয়েলিটি মিলে অভিনব কাজ ।
এবার একটা র্যাপিড ফায়ার রাউন্ড।
১ কবি কিশোর মজুমদার নাকি লিরিসিস্ট কিশোর মজুমদার
-লিরিসিস্ট কিশোর মজুমদার
২ অডিও অ্যালবাম নাকি ভিডিও অ্যালবাম'
-ভিডিও অ্যালবাম
৩ ট্র্যাডিশনাল না ওয়েস্টার্ন
-ওয়েস্টার্ন
৪ ইউটিউব না ডিভিডি
-ইউটিউব
৫ অনুপম না রনজয়
-অনুপম
৬ ফেসবুক না ইন্সটাগ্রাম
-ফেসবুক
৭ সুবোধ সরকার নাকি শ্রীজাত
-শ্রীজাত
৮ সিনেমা নাকি ওয়েব সিরিজ
-ওয়েব সিরিজ
৯ রাঘব চট্টোপাধ্যায় নাকি অদিতি মুখোপাধ্যায়
-রাঘব দা
১০ কবিতা না গান।
-দুটোই
অনেক ধন্যবাদ জানাই তোমায় কিশোরদা নেট ফড়িং কে এতটা সময় দেওয়ার জন্য। তোমার
আগামী কাজগুলোর জন্য অনেক শুভেচ্ছা রইলো।
(ছবি সৌজন্যে- কোরক মুজুমদার)
0 comments:
Post a Comment