Oct 3, 2020

"হৃদয় আনন্দে নেচে ওঠে" - আবদুস সাত্তার বিশ্বাস

Edit Posted by with No comments


 

হৃদয় আনন্দে নেচে ওঠে

আবদুস সাত্তার বিশ্বাস

 

স্কুল করে এসে ফ্রেশ হয়ে এক কাপ চা খেয়ে পুলক এখন বাড়িতে রয়েছে। একটা পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যায় তার একটা গল্প বেরিয়েছে সেটা দেখছে।

এইসময় তার ফোনটা হঠাৎ বেজে ওঠে।ও থেমে যায়। তারমানে মিসডকল!

পুলক তখন গল্পটা দেখা বন্ধ করে ওই নম্বরটা বের করে কল করে। ওখান থেকে সে তখন একটা নারী কণ্ঠ শুনতে পায়,"হ্যালো!"

পুলক সরাসরি জিজ্ঞেস করে তাকে,"কে বলছেন?"

"আমি একটা নারী বলছি। আপনার পরিচিতা একটা নারী। "নারী কণ্ঠটা বলে।

"কি নাম আপনার? নাম বলুন! নাহলে ওভাবে বললে তো চিনতে পারবো না।"

কিন্তু কণ্ঠটা নাম বলে না। পুলক তখন ফোন রেখে দেওয়ার হুমকি দেয়।

কণ্ঠটা তখন পুলককে ফোন রাখতে নিষেধ করে। তার সঙ্গে যে তার অনেক কথা আছে। অনেক দরকার আছে সেটা বলে।

তবু পুলক হুমকি দেয়।

কণ্ঠটা তখন পুলকের দোহাই দেয়। "আপনার দোহাই লাগে ফোন রাখবেন না!"

পুলক আর ফোন রাখেনা, "বেশ,কি কথা আছে বলুন!"

কণ্ঠটা তখন আর 'আপনি' নয়। 'আপনি' থেকে এক লাফে 'তুমি'তে নেমে চলে আসে। "তুমি আমাকে চিনতে পারছো না, পুলক? আমি তোমার অতি পরিচিতা একটা নারী গো! তবু তুমি চিনতে পারছ না...!"

পুলক তবু চিনতে পারে না।

কণ্ঠটা তখন বলে, "চিনতে না পারারই কথা। কেননা পঁচিশ বছর সময় তো আর কম নয়। অনেক দীর্ঘ সময়। সুতরাং অত বছর আগের একটা মেয়েকে চিনতে না পারারই কথা।..."

কণ্ঠটার এখান থেকে পুলক তখন একটা ক্লু পেয়ে যায়। আর সে সেই পঁচিশ বছর আগে চলে যায়। যখন সে ভগীরথপুর স্কুলের উচ্চ-মাধ্যমিকের ছাত্র আর তার দৃপ্ত যৌবন সেই পঁচিশ বছর আগে।

অনেক দিন আগে এই ভগীরথপুরে জমিদারদের বাস ছিল। সেই সূত্রে ভগীরথপুর খুব নাম করা জায়গা। এখানে যে জায়গাটায় তারা বাস করত ওটা 'বাবুপাড়া'। জমিদারদের আরেক নাম 'বাবু'। তাই 'বাবুপাড়া'

পুলক একদিন ওই বাবুপাড়া ঘুরতে যায়। গিয়ে বাবুদের বাড়িগুলো ঘুরে দেখে বাড়িগুলোর কি করুণ অবস্থা! পরিচর্যার অভাবে বাড়িগুলো ভেঙে ভেঙে পড়ছে। জনমানবহীন বাড়িগুলো জঙ্গলে ভরে গেছে। পলেস্তারা খসে খসে পড়ছে। ইটের পাঁজর বেরিয়ে গেছে। মানুষের বদলে বাড়িগুলো এখন সাপ খোপের আস্তানা। কিছু কিছু বাড়ি আবার ভৈরবের ভাঙন ধারে পড়ে ভেঙে গেছে। ও কিছু বাড়ি ঝুলছে। যে বাড়ি গুলো ভাঙেনি অর্থাৎ ভাঙন ধার থেকে কিছুটা দূরে রয়েছে সেগুলোও একদিন ভেঙে যাবে। নদীতে পড়ে হারিয়ে যাবে। নদী গর্ভে তলিয়ে যাবে। বাবুপাড়া সেদিন আর বাবুপাড়া থাকবে না। বাবুরা যেমন নেই বাবুদের পাড়াটাও নেই হয়ে যাবে।

এই বাবু পাড়াতেই পুলকের সেদিন একটা মেয়ের সঙ্গে আলাপ হয়।

এখানে পরি ছাপানো একটা বাড়ি রয়েছে। পুলকের লোক মুখে শোনা আছে, এই বাড়িটা বাবুদের সেসময় রং মহল ছিল। অর্থাৎ নাচ, গান, আড্ডা, তামাশা এসবই এখানে হতো।

পুলক বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে ছাপানো পরিটা দেখে। কি সুন্দর পরিটা! যেন ডানা মেলে উড়ছে। ছাপানো তা মনে হয় না।

ঠিক এইসময় এখানেই পুলকের মেয়েটার সঙ্গে আলাপ হয়।

সে-ও বাবুপাড়া ঘুরতে এসেছে এবং ঘুরতে ঘুরতে এখানে এসে পুলকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে আলাপ হয়। মেয়েটার নাম পারুল। নদীর পারে তুলসিপুর গ্রামে তার বাড়ি। সে-ও ভগীরথপুর স্কুলের ক্লাস টেনের ছাত্রী।

আলাপ সেরে পরে তারা বাড়িটির ভিতর ঢুকে যায়। এই বাড়িটির ভিতর দেখলে তাদের সব দেখা হবে।

ভিতরে দেখবার মতো কোন জিনিসই নেই। আগাছার জঙ্গল আর ভাঙা ইট, কাঠের টুকরো ছাড়া। ঢুকেছে যখন সে সবই তারা ঘুরে দেখে। দেখতে দেখতে এক সময় একটা জায়গা থেকে পারুল হঠাৎ দৌড়ে পালিয়ে আসে, "ও বাবা গো! মরেছি গো!" চিৎকার করতে করতে এসেই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে পুলককে।

পুলক জিজ্ঞেস করে, "কি হল? কি দেখলে?"

পারুলের চোখ বন্ধ। মুখেও কোন কথা নেই। কোন সাড়া না পেয়ে পুলক তাই ফের জিজ্ঞেস করে, "কি হল? কি দেখলে?"

তবু সাড়া মেলে না পারুলের। পুলক তাই আবারও জিজ্ঞেস করে, "কি হল, কি দেখলে, বলো...."

পারুলের সাড়া মেলে এবার। "বিরাট একটা সাপ দেখলাম!"

সাপের কথা শুনে পুলক আঁতকে উঠে, "সাপ দেখলে!"

"হ্যাঁ।"

"কোথায়?"

"ওখানে।"

"ওখানে কোথায়?"

"যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম ওখানে।"

পুলক অমনি পারুলের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। "ছাড়ো পারুল, কি সাপ দেখে আসি। ছাড়ো!"

পারুল ছাড়ে না। একই রকম ভাবে সে তাকে ধরেই থাকে। পুলকেরও আর ওখানে সাপ দেখতে যাওয়া হয় না। কিন্তু সাপটা কি সাপ দেখার আগ্রহে পুলক ওদিকে চেয়েই থাকে। ও তাই তো! এই মোটা আর এই বড় একটা সাপ ইটের ফাঁক দিয়ে চলে যাচ্ছে। সাপটা দেখতে পেলেও সাপটা কি সাপ পুলক ভালো মতো চিনতে পারেনা। তবে সাপটার গায়ের কালো রং আর ডোরাকাটা কালো দাগ দেখে সাপটা যে কাল খরিশ হবে পুলক সেটা অনুমান করে নেয়। এই ধরনের সাপ খুব বিষধর আর বিষাক্ত হয়।মানুষকে কামড়ালে মানুষ বাঁচে না। যাইহোক, সাপটাকে সঠিকভাবে চেনার জন্য পুলক ছটফট করতে থাকে, "ছাড়ো পারুল, সাপটা চলে যাচ্ছে। কি সাপ একবার দেখে আসি। ছাড়ো....!"

কিসে কি! পারুল ছাড়ে না। ছাড়ে না তো ছাড়ে না। বরং আগের থেকে আরও শক্ত করে চেপে ধরে।

তার ওই রূপ চেপে ধরা দেখে পুলক বলে, "কি হল,এত শক্ত করে ধরছ কেন?"

পারুল চুপ থাকে।

পুলক শুধায়, "সাপে কামড়ায়নি তো তোমাকে?"

সাপে তাকে যে কামড়ায়নি সেটা বোঝাতে পারুল দুই দিকে মাথা নাড়ে।

পুলকের তখন খেয়াল হয় যে, পারুলের ডালিম্ব সম স্তন দুটি তার বুকের সঙ্গে একেবারে ঠেসে রয়েছে। আর তার হাত দুটি তার দুই ঘাড় ধরে রয়েছে। আর তার পাতলা ঠোঁট পুলকের ঠোঁটে ঠেকছে। খেয়াল হওয়া মাত্র পুলকের শরীরে হঠাৎ বিদ্যুৎ প্রবাহ হতে শুরু করে। পুলকের শীতল শরীর উষ্ণ হতে থাকে ও শিহরণ খেলে যায় দুজনের শরীর-মনে। ভালোবাসার সমুদ্রে দুজনেই নিমজ্জিত হয়ে ধীরে ধীরে অতলে তলিয়ে যায়। এরপর চৈতন্য ফিরলে দু-জনেই ভীষণ লজ্জা পায়। তারপর এভাবে তারা দেখা করতে থাকে।

পঁচিশ বছর আগে তাদের দেখা হওয়ার প্রথম দিনটির কথা মনে পড়ে যায় পুলকের। বুকের ভিতরটা তারপর হঠাৎ তার কেমন করে ওঠে। এই নারী কণ্ঠটাই কি তাহলে পঁচিশ বছর আগের সেই পারুল? এরকম মনে হলে পরে পুলক বলে, "তুমি কি পারুল?"

হাউমাউ করে অমনি কেঁদে ফেলে কণ্ঠটা, "হ্যাঁ গো, আমি পারুল। পঁচিশ বছর আগে যার সঙ্গে তোমার পরি বাড়িটির ভেতর...

আমি সেই পারুল।"

হঠাৎ পারুলের এহেন কান্নায় পুলক থতমত খেয়ে যায়। ফলে তার স্বাভাবিক হতে কিছুটা সময় লাগে। পরে স্বাভাবিক হয়ে সে বলে, "এ কি! তুমি কাঁদছ কেন? কান্না থামাও!"

পুলক কান্না থামাতে বলায় পারুল চুপ করে যায়। গিয়ে সে বলে, "অনেক দিন বাদে তোমার সঙ্গে কথা বলছি তো তাই আবেগে কান্না চলে এল। কান্না রুখতে পারলাম না।"

পুলকের এরপর আপনি মনে পড়ে যায়, পরি বাড়িটির ভিতর সেদিন তাদের আকস্মিকভাবে মিলন ঘটে যাওয়ার পর পারুল মাত্র দেড় মাস মতো স্কুল আসে। তারপর তার কি যে হয় স্কুল আসা বন্ধ করে দেয়। তারপর আর কোনদিন তার সঙ্গে দেখা নেই।

কেন স্কুল আসা বন্ধ করে দেয় পুলক এখন তাকে সেটা জিজ্ঞেস করলে পরে পারুল বলে যে, সে স্কুল আসা বন্ধ করবে কেন? তার বাড়ি থেকে বন্ধ করে দেয়। কারণ ঘটনাটা বাড়িতে জানাজানি হয়ে যায়। মেনকা নামে তাদের পাড়ার একটা মেয়েকে কথাটা সে একদিন কথায় কথায় বলে ফেলে। আর মেনকা বাড়িতে বলে দেয়। বাড়িতে কথা শুনতে হবে এই ভয়ে বর্ধমানে তার মামার বাড়ি পালিয়ে যায়। তারপরই স্কুল, পড়া সব বন্ধ।

পুলকের মুখ থেকে চরম আফসোসে তখন আপনি বেরিয়ে যায়, "ইস, কি ভুল করেছিলে গো! কি ভুল করেছিলে!" তারপর বলে, "এতবড় ভুল কাজ কেউ করে?"

"ও যে বলে দেবে সেটা কি আমি জানতাম?" পারুল তারপর বলে, "তবু আমি চুরি করে একদিন স্কুল আসি। তোমার সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু তুমি স্কুল আসোনি। আমিও আর বাড়ি ফিরে যাই না। বাবা-দাদা তাহলে যে আমাকে ধরে মেরে মেরে ফেলবে। আমি তখন করি কি, বাসে চেপে সোজা বহরমপুর চলে আসি। এসে এখানে বাসস্ট্যান্ডে একটা বিধবা মেয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। নাম নমিতা। তার সন্তানাদি কেউ নেই। একটা বাড়িতে একা থাকে। কান্দি মহকুমার 'নব দূর্গা' গ্রামে। মেয়েটা আমার সমস্ত কথা শোনে। শোনার পর আমাকে তার বাড়ি নিয়ে চলে আসে। আমি ছোট বোনের মতো তার আশ্রয়ে থাকতে শুরু করি এবং আমার একমাত্র মেয়েটাকে নিয়ে এখনও আছি।"

"তোমার বিয়ে?"

"বিয়ে করিনি।"

"তাহলে মেয়ে পেলে কোথায়?"

"বলবো। তার আগে তোমাকে একটা খুশির খবর শোনাই। সেটা হল, আমার মেয়ের একটা হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে চাকরি হয়েছে। আজকেই জয়েন করে এল।"

"শুনে খুব খুশি হলাম। কোন স্কুল?"

"সরস্বতী উচ্চ বিদ্যালয়।"

নামটা শুনে পুলক চমকে যায়, "কোন স্কুল বললে!"

"সরস্বতী উচ্চ বিদ্যালয়।"

পুলক তখন বলে, "আমি তো ওই স্কুলেরই শিক্ষক।"

"আমি তা জানি। তোমাদের বানিয়াখালি গ্রামের হরিচরণবাবু নামে এক ভদ্রলোক এখানে চাকরি করেন। আমার মেয়ে তাঁর ছাত্রী। এস এস সি পরীক্ষায় মেয়ে পাশ করলে উনি একদিন বাড়িতে বেড়াতে আসেন। কথায় কথায় ওনাকে তোমার কথা জিজ্ঞেস করলে ওনার মুখ থেকেই সেটা জানতে পারি। তাই তো মেয়েকে আজ বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় বারবার করে বলে দিই যে, সে যেন তোমার ফোন নম্বরটা অবশ্য অবশ্যই চেয়ে একটা কাগজে লিখে আনে এবং কাগজটা আমাকে দেয়। এইভাবে আমি তোমার ফোন নম্বর সংগ্রহ করি।"

"তারমানে মাধবী তোমার মেয়ে!"

"আমার একার নয়, তোমারও।"

"আমারও!"

"হ্যাঁ, তোমারও।"

"কি করে আমারও!"

মালতি ওদের ভালোবাসার ফসল। সুতরাং মালতি তার একার নয়, তারও।

পুলকের মুখ থেকে তখন আপনি বেরিয়ে যায়, "উফ, গড!"

তারপর কারো মুখে কোন কথা নেই কিছুক্ষণ। কিছুক্ষণ বাদে পারুল বলে, "তুমি আজো বিয়ে করোনি?"

"না।"

"করবে না?"

"করবো।"

"কাকে?"

পুলকের মুখ থেকে তখন যে কথাটা বের হয় পারুলের হৃদয় আনন্দে নেচে ওঠে তাতে। যা পঁচিশ বছরে কোনদিন নাচে নি।

0 comments:

Post a Comment