Jul 17, 2021

"ছায়া এবং একটা অস্বস্তি" - সায়নী দাস

Edit Posted by with No comments

 


ছায়া এবং একটা অস্বস্তি

সায়নী দাস

 

একসপ্তাহ হলো রোহিণী সোনারপুরের এই নতুন ফ্ল্যাটে এসে উঠেছে। ফ্ল্যাটটা বিলাসবহুল। দু’পাশে দুটো বেডরুম। মাঝে ডাইনিং স্পেস। একদিকে কিচেন। দুটো রুমে অ্যাটাচড্ ওয়াশরুম। ডাইনিংয়ের একপাশের দেওয়ালটা পুরো কাঁচের স্লাইডিং, ওটা পেরোলে একটা ব্যালকনি। যেখানে দারুণ সুন্দর গার্ডেনিং করা হয়েছে। এক কথায় সিনেমায় দেখানো ফ্ল্যাটের মতো সুন্দর রোহিণীর এই ফ্ল্যাটটা। কিন্তু এখানে আসার পর প্রতিরাতেই ও খেয়াল করে দেখছে ঠিক রাত আড়াইটে বাজলেই ওর ঘুম ভেঙে যায়। যতই গভীর ঘুম হোক না কেনো ! একাই থাকে ও। বুধবার অফিসের কাজে একটু চাপ ছিল। তাই ও রাত জেগে কাজ করছিল। হঠাৎ মনে হলো একটা ছায়া সরে গেলো পেছন থেকে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো সেখানে অভিমন্যু আর ওর দেওয়াল ছবিটা ছাড়া আর কিছুই নেই। রাশভারী মেয়েটা একটু যে ভয় পায়নি তা নয়, কিন্তু এসবে পাত্তা দিলেই বাড়ি ফিরে যেতে হবে। আর বাড়ি ফিরলেই... ভাবলেই মাথার মধ্যে বিস্ফোরণ আর একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে যাচ্ছে ওর শিরদাঁড়া বরাবর। ঠিক কি কারণে রোহিণী এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ?

রোহিণী আর অভিমন্যু প্রেম করে বিয়ে করেছিল। অভিমন্যুর বাড়ি থেকে এই বিয়েটা মেনে নেয়নি কারণ রোহিণীর মা ছিল মুসলিম, আর ওরা ব্রাহ্মণ। একে তো বিধর্মী, তার উপর অব্রাহ্মণ ! ওরা ভেবেছিল একটা বাচ্চা এলে হয়তো সবটা ঠিক হয়ে যাবে। রোহিণী যখন তিন সপ্তাহের প্রেগনেন্ট তখনই ঘটলো এই ভয়ঙ্কর ঘটনা। অভিমন্যুর ঠাকুমা শেষ বয়সে নাতিকে না দেখতে পেয়ে দুঃখ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন। এটাই হলো কাল ! রোহিণীরা যে বাড়িতে থাকতো সেই বাড়ির ছাদে ওঠার সিঁড়িটা ছিল প্যাঁচানো। পুরোনো দিনের সিঁড়ির মতো। অভির ঠাকুরদা এটা বানিয়েছিলেন। বর্ধমানের এই বাড়িতে অভির ছোটবেলাটা কেটেছে। বড়ো হবার পর ওরা কলকাতায় চলে যায়। আবার ফিরে আসে বিয়ের পর। মাঝে এই বাড়িতে কেউ থাকেনি। রোহিণীকে এই বাড়ির গল্প বলতে বলতে একদিন ছাদে নিয়ে গেল ও। চারপাশে প্রায় ফাঁকাই, বাড়ি কম। রোহিণী একমনে ঘুরে ঘুরে দেখছিল, পুরোনো বাড়ির গন্ধটা প্রাণ ভরে নিচ্ছিল। অভি সাথেই ছিল। হঠাৎ ওর মনে হলো নীচে সদর দরজার বাইরে একটা গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে। ভাবলো হয়তো ওদের এখানে আসার রোহিণীর প্রেগনেন্সির খবর পেয়ে বাড়ি থেকে দেখা করতে এসেছে। রোহিণীও মনে হয় গাড়ির শব্দ শুনতে পেয়েছিল। ও বললো, "তুই দরজাটা খোল, আমি নীচে নামছি।" ওকে আস্তে আস্তে নামার সাবধানবাণী শুনিয়ে অভি নীচে নামছে, ঠিক সেই মুহুর্তে ওর মনে হলো ঠাকুমা সিঁড়ির নীচে দাঁড়িয়ে আছে। ও একমুহুর্তে ভুলে গেল ঠাকুমা আর বেঁচে নেই। তরতরিয়ে নামতে গিয়ে পড়লো মুখ থুবড়ে। রক্তে ভেসে গেল চাতালটা। গোঙাতে গোঙাতে কোনোমতে রোহিণীকে জানাতে পেরেছিল ওর পড়ে যাবার কথাটা। এই সমস্ত সিচুয়েশন রোহিণী খুব মাথা ঠাণ্ডা করে সামলায়। একা হাতেই ওকে কাছের হসপিটালে নিয়ে গেল। অভির অবস্থা ক্রিটিক্যাল থাকায় ডাক্তার বললেন ওকে এখন ভর্তি থাকতে হবে। রোহিণী ফিরে এলো। কমলাদি রাতের খাবার করে দিয়ে গেছে। সেটা খেয়ে শুয়ে পড়লো। মাঝরাতে বাথরুমে যাবে বলে উঠে ওর মনে হলো পাশে অভি শুয়ে। নাইট ল্যাম্পের আলোয় স্পষ্ট বুঝতে পারলো ওর মুখ। চমকে উঠলো ও ! অনেকগুলো স্টিচ পড়েছে মুখে। স্বাভাবিক। মুখটা তো ফেটেই গেছিল। সেই নিয়েই অভি একটা ওষুধ আর এক গ্লাস জল এগিয়ে দিল রোহিণীর দিকে। রোহিণী জিজ্ঞেস করলো, "তুই এলি কিভাবে এখানে ? তোকে তো ডাক্তার…"। ওকে শেষ করতে না দিয়ে অভি বলে উঠলো, "ডাক্তার ছেড়ে দিয়েছে, আমি ভালো হয়ে গেছিলাম।" কিন্তু গলাটা একদমই অভির গলার মতো নয়। বরং একসাথে দুটো গলার আওয়াজ যেমন শোনায়, অনেকটা সেরকম ! আর অভির গলা খুব একটা ভারী নয়, তাহলে এটা কার সাথে কথা বলছে ও ? হাতটা এগিয়ে এলো ওকে ওষুধ খাওয়াতে। খেয়ে নিল ও। ও ভাবলো ওকে ডাক্তার যে ওষুধগুলো খেতে দিয়েছিল সেটাই অভি খাওয়ালো ওকে।

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলো হসপিটাল থেকে আসা ফোনে। ওরা জানালো অভি আজ ভোরে মারা গিয়েছে। তিন ঘণ্টা অবজার্ভ করার পরে ওকে খবরটা দেওয়া হলো। তাহলে কাল রাতে যে ওকে ওষুধ খাওয়ালো সেটা কে ?!

পাশের টেবিলে যেখানে ওষুধ, জল, টেবিল ল্যাম্প রাখা থাকে সেখানে চোখ পড়তেই ও দেখলো যে ওষুধটা ওকে খাওয়ানো হয়েছে সেটা আসলে অ্যাবর্শনের ওষুধ ! গা গুলিয়ে উঠলো ওর। বাথরুমে যেতেই দেখলো এক দলা রক্ত লেগে গেছে ওর জামাকাপড়ে ! ওর বুঝতে বাকি থাকলো না আর কি হতে চলেছে! এক মুহুর্ত আর এখানে থাকা চলবেনা। অভির সৎকার করে সেদিনই কলকাতায় ফিরে এলো ও। সোনারপুরের এই ফ্ল্যাটটা ওকে ওর বাবা দিয়ে গেছিল। সব হারিয়ে একাই এসে উঠলো এখানে। ওর মা'ও গত হয়েছে এক বছর হলো। বিয়ের পর পর বাবাকেও হারিয়েছে। এখন স্বামীর সাথে সন্তানকে হারিয়ে একদম একা হয়ে পড়েছে মেয়েটা। শুধু থেকে থেকে খেয়াল করে ফোনের বা ল্যাপটপের স্ক্রিনে একজোড়া চোখ ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। কেউ যেন পেছন থেকে সরে যায়। এই চোখজোড়া ওকে কোনোদিন একা থাকতে দেবে না। নতুন করে আর শুরু করতে দেবেনা। যে কদিন বেঁচে থাকবে একটা অস্বস্তিতে রেখে দেবে ওকে !


0 comments:

Post a Comment