পুরনো ডায়েরি
পার্থসারথি
জাফর সাহেব তার পুরনো বাড়ির পেছনের দিকের একটি ভাঙা ঘরে কিছু পুরনো জিনিসপত্র খুঁজতে গিয়েছিলেন। ঘরটা অনেকদিন ধরে বন্ধ ছিল, ধুলো আর মাকড়সার জালে ভর্তি। একটা পুরনো সিন্দুকের মধ্যে তিনি একটি ডায়েরি খুঁজে পেলেন। ডায়েরিটা বহু পুরনো, পাতাগুলো হলুদ হয়ে গেছে আর বাঁধাই প্রায় খুলে এসেছে।
ডায়েরিটা খুলতেই একটা ঠান্ডা স্রোত তার শরীরে অনুভূত হল। তিনি প্রথমে পাত্তা দেননি, ভেবেছিলেন বদ্ধ ঘরের বাতাস। কিন্তু যখন তিনি ডায়েরির পাতা উল্টাতে শুরু করলেন, ঠান্ডা অনুভূতিটা আরও বাড়তে লাগল। ডায়েরির লেখাগুলো আবছা, পুরনো দিনের বাংলা হরফে লেখা।
প্রথম কয়েক পাতা পড়ার পরেই জাফর সাহেবের শরীরে কাঁপুনি ধরল। ডায়েরিটা এক মহিলার, যিনি এই বাড়িতেই থাকতেন এবং ভয়ানক কষ্টের মধ্যে জীবন কাটিয়েছেন। তার স্বামী তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করত। দিনের পর দিন তার আর্তনাদ আর কষ্টের কথা ডায়েরির পাতায় লেখা ছিল। শেষ কয়েক পাতায় লেখা ছিল তার আত্মহত্যার কথা, বিষ খেয়ে তিনি মুক্ত হতে চেয়েছিলেন।
জাফর সাহেব ডায়েরিটা বন্ধ করে ফেললেন। তার মনে হল যেন সেই মহিলার কষ্টগুলো তিনি নিজের শরীরে অনুভব করছেন। ঘর থেকে বের হতে গিয়ে তিনি পিছন ফিরে তাকালেন। আবছা অন্ধকারে মনে হল যেন কেউ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে তার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে আছে। ভয়ে তার গলা শুকিয়ে গেল, তিনি দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।
রাতে বিছানায় শুয়েও জাফর সাহেবের ঘুম আসছিল না। সেই মহিলার কষ্টের কথা তার মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল। হঠাৎ তিনি শুনতে পেলেন কেউ যেন ফিসফিস করে কাঁদছে। আওয়াজটা খুব দুর্বল, যেন অনেক দূর থেকে আসছে। তিনি কান খাড়া করে শুনলেন, আওয়াজটা যেন সেই ভাঙা ঘরটা থেকেই আসছে।
সাহস করে তিনি ঘর থেকে বের হলেন এবং টর্চলাইট হাতে সেই ভাঙা ঘরের দিকে গেলেন। দরজা খুলে ভেতরে আলো ফেলতেই সবকিছু চুপ হয়ে গেল। ঘরটা যেমন ছিল তেমনই, শুধু ধুলো আর মাকড়সার জাল। কিন্তু জাফর সাহেবের মনে হচ্ছিল যেন কিছুক্ষণ আগেই এখানে কেউ কাঁদছিল।
পরের কয়েক রাত জাফর সাহেব ঘুমাতে পারলেন না। প্রতি রাতেই তিনি সেই কান্নার আওয়াজ শুনতে পেতেন। কখনও আওয়াজটা খুব কাছে মনে হত, কখনও আবার অনেক দূরে। তিনি বুঝতে পারছিলেন, সেই অভাগী মহিলার আত্মা এখনও শান্তি পায়নি এবং তার কষ্টগুলো যেন এই বাড়ির বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে।
0 comments:
Post a Comment