Feb 24, 2022

"ইন্টারোগেশন" - মিলন পুরকাইত

Edit Posted by with 1 comment

 


ইন্টারোগেশন

মিলন পুরকাইত

 

ইন্সপেক্টার দেবেন্দ্র চৌধুরী থানায় ঢুকে প্রথমেই একবার লক-আপের দিকে দৃষ্টি দিলেন। সেখানে কাঁচুমাচু মুখ করে বসে থাকা তিনজন লোকের দিকে ভালো করে তাকালেন। তিনজনকে দেখেই আপাতভাবে গোবেচারা মনে হয়, কিন্তু সত্যিই কি তাই? দেবেন্দ্র চৌধুরী নিজের কেবিনের দিকে পা-বাড়ালেন। নিজের চেয়ারে বসার কয়েক মুহুর্তের মধ্যেই মেজোবাবু সাব-ইনসপেকটার অমল দাস একটা ফাইলসহ এসে তাকে স্যালুট করে দাঁড়ালো। দেবেন্দ্র চৌধুরী মুখ তুলে তাকাতেই অমল দাস বলল, ‘স্যার, মদন সাহার খুনের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এসে গেছে স্যার। ডাক্তার লাহিড়ী যেটা মৌখিকভাবে জানিয়েছিলেন রিপোর্টে লিখিতভাবে সেটাই কনফার্ম করেছেন স্যার। মদন সাহাকে গলা টিপে মারা হয়েছে। তবে গলায় কোনও ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া যায়নি। বুকে ছোরাটা বসানো হয়েছে গলা টিপে মারার পর। সম্ভবত ছোরা যে মেরেছে সে জানত না যে মদনবাবু আগেই মারা গেছেন। রাত এগারোটা থেকে সাড়ে এগারোটার মধ্যে মদনবাবুকে ক্ষুন করা হয়েছে। বুকে ছোরাটা বসানো হয়েছে তার কিছু পরেই। ডাক্তার লাহিড়ীর মতে গলা টিপে মারার মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই বুকে ছোরা বসানো হয়েছে। বডি তখনও গরম ছিল তাই ব্লিডিং-ও বেশী হয়েছে। তবে ছোরাটাতেও কোনও ফিঙ্গার প্রিন্ট পাওয়া যায় নি স্যার’।

দেবেন্দ্র চৌধুরী ভালো করে রিপোর্ট শুনলেন। তারপর হাত বাড়িয়ে অমল দাসের কাছ থেকে ফাইলটা নিলেন, ফাইলটা খুলে পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা বেশ কিছু সময় ধরে দেখে ফাইলটা বন্ধ করে অমল দাসকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওই তিনজন কি বলছে?’

অমল দাস বলল, ‘স্যার, আমি আর গনেশবাবু পালা করে গতরাতে সারা রাত ধরে নানাভাবে ওদের জেরা করেছি। গনেশবাবু তো উদয়কে সঙ্গে নিয়ে তিনজনকে একসময় বেশ উত্তমমধ্যম দিয়েওছেন। কিন্তু তিনজনে একই কথা বলে যাচ্ছে স্যার, যে তারা নির্দোষ, ওরা কেউ কিছু জানে না, ওরা কেউ কিছু করেনি। ভোরবেলায় চা দিতে গিয়ে ওই জগু বলে বেয়ারাটা নাকি বিছানায় মদন সাহার লাশ দেখতে পায়। তখনই সে চেঁচামেচি করে আর তাতেই বাকি দুজন গদাই আর রতন ওই ঘরে এসে পৌছায় আর তারপর তিনজনে মিলে পুলিশে খবর দেয়’।

দেবেন্দ্রবাবু একটু ভাবলেন। তারপর বললেন, ‘আমরা পৌছানোর পর ঘরে কি কি মিসিং ছিল বলত?’

অমল দাস বলল, ‘স্যার কি মিসিং ছিল তা এই তিনচাকরের কেউ বলতে পারেনি। তবে ঘরের আলমারির চাবি মিসিং ছিল। সেই চাবি কনস্টেবল উদয় বাড়ির পেছনের একটা ময়লার ভ্যাটের মধ্যে পায়। আমরা সেই চাবি দিয়ে আলমারি খোলার পর তাতে কোনও টাকাপয়সা বা গয়নাগাটি কিছু পাইনি। এখন আদৌ আলমারিতে সেসব কিছু ছিল কি না জানা যায়নি স্যার। কারণ আলমারিতে তাদের মনিব কি রাখতেন তা তিনচাকরের কেউ বলতে পারছে না স্যার। আলমারির হাতলেও কোনও ফিঙ্গার প্রিন্ট পাওয়া যায়নি স্যার। ফরেনসিক কনফার্ম করেছে। বাড়িতে মনিব আর তার তিন চাকর ছাড়া আর কারও ফুটপ্রিন্ট বা অন্য কোনও প্রমাণের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি স্যার’।

দেবেন্দ্র চৌধুরী এবার চেয়ার ছেড়ে উঠে পাছনের র‍্যাক একটা ফাইল নামিয়ে আনলেন। ফাইল খুলে মদন সাহার ডেডবডির একটা ছবি বের করে ভালো করে দেখলেন। তারপর বললেন, ‘ছোরাটা মারা হয়েছে খুব নৃশংসভাবে। খুব আক্রোশে। একেবারে বুকে সজোরে গেঁথে দেওয়া হয়েছে। আচ্ছা এই মদন সাহার চরিত্র সম্বন্ধে খোঁজখবর করেছ?’

অমল দাস বলল, ‘হ্যাঁ স্যার। পাড়ার লোকেদের অনেককেই ইন্টারোগেট করেছি। বিপত্নীক ছিল স্যার। টাকা পিশাচ লোক ছিল স্যার। মারাত্মক কিপটে। একাই থাকত। খিটখিটে লোক ছিল স্যার। পাড়ার ছেলেরা একাদশী বুড়ো নামে আড়ালে ডাকত। নিজের স্ত্রীর চিকিৎসা পর্যন্ত ভালো করে করায়নি। ব্যাঙ্ক আকাউন্টও গণেশবাবু চেক করেছেন স্যার। বিস্তর টাকা রয়েছে কিন্তু পুজোর চাঁদা থেকে শুরু করে বন্যাত্রাণ কোনও ব্যাপারেই একটা কড়ি পয়সাও পকেট থেকে বের করতেন না। পাড়ার ক্লাবের ছেলেদের সঙ্গে এই নিয়ে বছরদেড়েক আগে একবার ঝগড়াও হয়েছিল। ব্যাপারটা থানা পুলিশ পর্যন্ত এগিয়েছিল। ক্লাবের একটি ছেলের নামে এই থানায় এফআইআর পর্যন্ত করেছিলেন মদনবাবু’।

দেবেন্দ্রবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ‘সেই ছেলেটিকে ধরেছ? সে এখন কোথায়?’

অমল দাস বলল, ‘সেই ছেলেটি আর বেঁচে নেই স্যার। ওই এফআইআরের ভিত্তিতে সেই সময় যিনি এই থানার অফিসার-ইন-চার্জ ছিলেন তিনি ছেলেটিকে এরেস্ট করেছিলেন স্যার। ছেলেটির সেইসময় সদ্য একটি সরকারী চাকরীর পরীক্ষায় পাশ করেছিল স্যার। এই এফআইআর আর গ্রেপ্তারির ফলে কেস কোর্টে ওঠে পুলিশ ভেরিফিকেশনে এই বিষয়টি সামনে আসায় ছেলেটির চাকরী আর হয়নি স্যার। তার চাকরীতে জয়েন করার আগেই প্যানেল থেকে তার নাম বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। ছেলেটি তারপরেই আত্মহত্যা করে। ছেলেটির মা ছিল না স্যার। একমাত্র ছেলের মৃত্যুর পর ছেলেটির বাবাও পঙ্গু হয়ে বিছানা নিয়েছেন। তার এখন চলশক্তি নেই। সম্পূর্ণ বেডরিডেন’।

‘এসব কথা কে বলল?’ জানতে চাইলেন দেবেন্দ্র চৌধুরী।

অমল দাস উত্তর দিল, ‘পাড়ার অনেকেই বলেছে স্যার। তবে বিস্তারিতভাবে জানিয়েছে অনিকেত বসু নামে একজন মেডিকেল স্টুডেন্ট। অনিকেত ওই পাড়াতেই থাকে। যে ছেলেটি আত্মহত্যা করেছে সেই জয়দীপের বেস্ট ফ্রেন্ড এই অনিকেত। কথা বলার সময় দেখলাম অনিকেতের মদন সাহার ওপর আক্রোশ এখনও যায়নি। লোকটা মরার পরও বেশ ক্ষোভ রয়েছে দেখলাম। অবশ্য ক্লাবের ছেলেদের অনেকেরই দেখলাম এই ব্যাপারে একইরকম মনোভাব। ও, আর একটা কথা স্যার, এই তিনজন চাকরের মধ্যে ঐ রতন বলে ছোকরা চাকরটির সঙ্গে জয়দীপের বেশ বন্ধুত্ব ছিল আর জয়দীপের বাবাকেও নাকি ও মাঝেমধ্যে দেখতে যায়। ওষুধপত্র কিছু দরকার হলে বা ডাক্তার ডাকতে হলে ওই রতনকেই ডাকা হয়, সেই ব্যবস্থা করে দেয়। এই নিয়ে মদন সাহা বেশ কয়েকবার রতনকে বকাবকিও করেছিলেন। আর কিছুদিন আগে জগুর সঙ্গে মদন সাহার কোনও ব্যাপার নিয়ে বচসা হয়েছিল। সেকথা পাশের বাড়ির রমাপদবাবু শুনতে পেয়েছিলেন, কিন্তু কারণটা জানতে পারেননি। এদের তিনজনকে সেকথা জিজ্ঞেস করলে এরা কিছু বলছে না। আরেকটা কথা স্যার, মদন সাহা প্রতি মাসে তার একাউন্ট থেকে বিশ হাজার টাকা একসাথে আলাদাভাবে তুলতেন, সেটা তিনি কাকে দিতেন বা কি করতেন সেটা ঠিক পরিষ্কার নয়। এই বিশহাজার টাকা একসাথে তোলা হত। এমনই ব্যবস্থা ছিল ব্যাঙ্কের সঙ্গে। যেরাতে মদন সাহা খুন হন তার আগের দিনই তিনি ওই বিশহাজার টাকা তুলেছিলেন কিন্তু আমরা ওনার বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে খুচরো দেড়হাজার টাকা ছাড়া আর কোনও টাকা খুঁজে পাইনি, কোনও গয়নাগাটিও পাইনি’।

‘হুম’, বলেই দেবেন্দ্র চৌধুরী বললেন, ‘গণেশবাবুকে রেডি হতে বল, ওই তিনজনকে লক-আপ থেকে বের করে পাশের ইন্টারোগেশন রুমে একসাথে নিয়ে এস। তুমি আর গণেশবাবু থাকলেই হবে। এই তিনজনকে আমি নিজে একসাথে এখনই একবার ইন্টারোগেট করব, তুমি হবে ভালোমানুষ আর গণেশবাবু রাগীবাবু আর আমি করব জেরা। দেখা যাক এদেরকে চাপ দিয়ে আসল সত্যিটা বের করতে পারি কি না। চল কুইক, হারি-আপ’।

পনেরো মিনিটের মধ্যেই সব ব্যবস্থা হয়ে গেল। লক-আপের পাশের ইন্টারোগেশন রুমে নিয়ে আসা হল তিনজনকে। স্বল্প আলোর আলো-ছায়া যুক্ত ইন্টারোগেশন রুমের পরিবেশটাই রহস্যময় ভয়াবহ। তার মধ্যে একটা টেবিলের একপাশে একটা বেঞ্চে তিনজনকে পাশপাশি বসানো হয়েছে। প্রথমেই গণেশবাবু ঢুকে একটা মোটা রুল টেবিলের ওপর রেখে নিজের মোটা গোঁফে একটা দিয়ে কটমটে দৃষ্টিতে তিনজনের দিকে তাকিয়ে দাঁড়ালেন। তারপর অমল দাস ঘরে ঢুকে টেবিলের ওপর একটা জলের জগ রাখল। সবশেষে দেবেন্দ্র চৌধুরী ঘরে ঢুকে টেবিলের উল্টোদিকে রাখা একটা কাঠের চেয়ারে বসলেন। জুবুথুবু হয়ে বসে থাকা তিনজনের প্রত্যেকের চোখের দিকে একবার করে সরাসরি তাকিয়ে জগুকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কতবছর চাকরী করছ মদন সাহার বাড়িতে?’

জগু ভয় মেশানো জড়ানো গলায় বলল, ‘আজ্ঞে প্রায় তিরিশ বছর’।

‘তোমার বাবু লোক কেমন ছিলেন?’ জানতে চাইলেন দেবেন্দ্রবাবু।

জগু চুপ করে রইল। গণেশবাবু জগুর ঘাড় পেছন থেকে ধরে বেশ করে ঝাঁকিয়ে দিয়ে বললেন, ‘মুখ না খুললে, মেরে একদম আধমরা করে দেব, স্যার যা জিজ্ঞেস করছেন উত্তর দে’।

দেবেন্দ্রবাবু জগুর চোখে চোখ রেখে বললেন, ‘তোমার সঙ্গে কি নিয়ে মদনবাবুর ঝগড়া হয়েছিল?'

গণেশবাবু রদ্দা তুললেন, জগু গণেশবাবুর মূর্তি দেখে একটু যেন ঘাবড়ে গেল। অমল জলের জগটা জগুর সামনে ধরে বলল, ‘জল খেয়ে নাও, জল খেয়ে সত্যি কথা বলে দাও স্যারকে, নইলে তুমি তো খুনের দায়ে ফাঁসিতে চড়বেই, পুলিশ কিন্তু তোমার পরিবারের লোকজনদেরও ছেড়ে কথা বলবে না’।

জগু যেন আরও ঘাবড়ে গেল, সে জগ থেকে কিছুটা জল ঢকঢক করে খেয়ে নিয়ে বলল, ‘দোহাই বাবু, আ-আমি খুন করিনি। আমি খুন করিনি। গিন্নীমা বেঁচে থাকতে আমার মেয়ের বিয়ে হয়েছিল। বাবুকে বলতে একটা টাকা দিয়েও আমাকে সাহায্য করেননি। গিন্নীমা আমাকে তার গয়নার থেকে দুটো সোনার চুড়ি দিয়েছিলেন আমার মেয়েকে দেওয়ার জন্য। মেয়েকে বিয়ের সময় সেই চুড়ি আমি দিয়েছিলাম। সেদিন হঠাত বাবু বললেন আমি নাকি তখন গিন্নীমার গয়নার বাক্স থেকে সেই চুড়ি চুরি করেছি। সেই চুড়ি দুটো ফেরত না দিলে বাবু আমাকে পুলিশে দেবেন বলে ধমকালেন। আমিও তখন রেগে গিয়ে বলি যে তিরিশ বছর আমি এই বাড়িতে চাকরী করছি। বাবুর কোনও কীর্তিই আমার অজানা নেই। মালতীর সঙ্গে তিনি কি করেছিলেন সেকথা আমি সবাইকে বলে দেব। হরেন মন্ডলকে বাবু কেন এখনও মাসে মাসে বিশ হাজার টাকা করে দেন সেকথাও সবাইকে জানিয়ে দেব। বাবু তারপরে আর একটা কথাও বলেননি। চুপ করে গেছিলেন একদম’।

দেবেন্দ্র চৌধুরী এবারে জগুর মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মালতী, হরেন মন্ডল এরা কারা?’

জগু আবার চুপ করে রইল। গণেশবাবু এবার দেবেন্দ্র চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘স্যার, আপনি একবার শুধু হুকুম করুন, এর মেয়ে-জামাইকে তুলে নিয়ে আসি। ওই চুড়ি এই ব্যাটাই চুরি করেছিল। এর জামাইকে তুলে এনে রগড়ালেই সব সত্যি সুড়সুড় করে বেরিয়ে পড়বে’।

জগু আঁতকে উঠল। অমল দাস তার পিঠে হাত রেখে বলল, ‘আরে করছ কি? গণেশবাবুকে চেন না? তোমার জামাইকে তুলে এনে হয়ত পিটিয়েই মেরে ফেলবেন। এর জন্য গণেশবাবু কতবার সাসপেন্ড হয়েছেন জানো? ওনার চরিত্রের বদল হবে না, তাই তোমার ভালোর জন্যই বলছি, স্যার যা জিজ্ঞেস করছেন তার পরিষ্কার করে উত্তর দাও’।

জগু একটা ঢোঁক গিলে বলতে শুরু করল, ‘প্রায় বছর পঁচিশেক আগের কথা বাবু। মালতী এই বাড়িতে কাজ করত। সে ছিল আমার বন্ধু হরেন মন্ডলের বউ। হরেনটা চিরকালের পাঁড় নেশাখোর মাতাল। কোনও কাজকম্ম করতে না। মালতী আমাকে দাদা বলে ডাকত। আমাকে একটা কাজ জোগাড় করে দেবার কথা বলেছিল। আমি মালতীকে মদন সাহার বাড়িতে কাজে লাগিয়েছিলাম। গিন্নীমা সেইসময় তার বাবার অসুখের খবর পেয়ে বাপের বাড়িতে গিয়েছিলেন। আমিই তাকে রেখে আসতে গিয়েছিলাম। সেসময় বাবু মালতীর সাথে.........’। একটু চুপ করল জগু। তারপর আবার বলতে শুরু করল, ‘এরপর মালতীর পেটে বাচ্চা আসে। হরেনের কোনওদিন নেশা ছাড়া অন্য কোনও দিকে নজর ছিল না। তার সাথে মালতীর কোনও সেরকম সম্পক্ক তৈরিই হয়নি। মালতী ভয়ের চোটে ব্যাপারটা লুকিয়ে গিয়েছিল। পরে যখন তার পেট......তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। বাচ্চা নষ্ট করার আর উপায় ছিল না। আমি মালতী আর হরেনকে ওদের গাঁয়ে পাঠিয়ে দিই। মালতীর ওখানে একটা ছেলে হয়। তবে ছেলের জন্ম দিতে গিয়ে মালতী মারা যায়। তখন সেই সদ্যজাত ছেলেকে নিয়ে এসে হরেন হল্লা শুরু করে। বাবু তখন আমাকে এসে ধরেন। তিনিও জানতেন এ ছেলে তারই। কিন্তু গিন্নীমার সামনে তা স্বীকার করার হিম্মত বাবুর ছিল না। আমিই তখন হরেনের সঙ্গে বাবুর রফাদফা করে দিই। ঠিক হয় ছেলেকে হরেন নিজের পরিচয় দেবে আর বাবু তার জন্য তাকে প্রতিমাসে দুইহাজার টাকা করে দেবেন। সেই টাকা পরে বাড়তে বাড়তে মাসে বিশ হাজারে এসে দাঁড়িয়েছিল। বাবুর জীবনের এই কালো দিকটা আমি জানতাম। কিন্তু কোনওদিন তার জন্য বাবুকে আমি কোনওভাবেই লজ্জায় পড়তে দিইনি। সেই বাবুই কিনা আমাকে চোর সাব্যস্ত করতে চাইলেন। তাই বাধ্য হয়েই আমি হুমকি দিয়েছিলাম। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমার বাবুকে, আমার অন্নদাতাকে আমি খুন করিনি। দোহাই আপনাদের আমার মেয়ে-জামাইকে এর মধ্যে জড়াবেন না’।

হাউহাউ করে কেঁদে উঠল জগু।

দেবেন্দ্র চৌধুরী এবার তার দৃষ্টি দিলেন রতনের দিকে। রতন আর গদাই দুজনেই অল্পবয়সী। দুজনেই কুঁকড়ে বসে রয়েছে। রতনকে উদ্দেশ্য করে দেবেন্দ্রবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুই কত বছর কাজ করছিস ওই বাড়িতে?’

রতন কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ‘বছর চারেক। জগুদা বাড়ির সবকাজ করে আর বেরোতে পারত না, তাই বাইরের কাজ মানে বাজার করা, পোস্ট-অফিসে যাওয়া, বাড়ির নানারকম বিলটিল দেওয়া, লন্ড্রিতে যাওয়া আরও নানা খুচখাচ কাজের জন্য মদনবাবু আমাকে রেখেছিলেন। আমি ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছি, তাই এসব কাজ করতে পারতাম’।

দেবেন্দ্রবাবু বললেন, ‘ওই জয়দীপ ছেলেটার সঙ্গে তোর কি সম্পর্ক ছিল?’

রতন বলল, ‘উনি খুব ভালো ছিলেন। গরীব-দুঃখীর জন্য ওনার মন কাঁদত, বিপদে আপদে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। উনি আর অনিকেতদাদা, ওরা অনেক ভালো কাজ করত। আমাদের জন্য নাইট স্কুলে পড়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। বন্যাত্রাণের চাঁদা তুলতে সেবার ক্লাবের থেকে ওরা এসেছিলেন। বাবু টাকা তো দিলেনই না, উল্টে জয়দীপদাকে বাপ তুলে গালাগালি করলেন। জয়দীপদা মাথা ঠিক রাখতে না পেরে বাবুর ফতুয়ার কলার চেপে ধরেছিল। তারপরেই তো বাবু পুলিশে জয়দীপদার নামে.........’।

দেবেন্দ্র চৌধুরী এবার চাবুকের মত প্রশ্ন করলেন, ‘মদন সাহাকে খুন করলে কে? তুই?’

রতন চুপ করে রইল। দেবেন্দ্র চৌধুরী গণেশবাবুকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘গণেশবাবু ওই অনিকেত বলে ছেলেটিকে তুলে আনুন তো? মনে হচ্ছে এরা সব প্ল্যান করেই খুনটা করেছে। আমিও দেখব ওই অনিকেত কি করে ডাক্তার হয়। জয়দীপের যেমন চাকরী গিয়েছিল তেমনি আমিও দেখব এই অনিকেত কি করে ডাক্তার হয়...’

গণেশবাবু কিছু বলার আগেই হাউমাউ করে উঠল রতন, ‘না স্যার না। না না। অনিকেতদাদাকে কিছু করবেন না। উনি কিছু করেননি। উনি কিচ্ছু জানেন না। আমি শুধু উনার কাছ থেকে একটা ডাক্তারের পড়ার গ্লাভস এনেছিলাম। শুনেছিলাম ওতে নাকি হাতের ছাপ পড়ে না। এছাড়া আর কিচ্ছু না। উনি কিছু জানতেন না। এমনিই একটা কাজে লাগবে বলে চেয়ে এনেছিলাম। আমার মা খুব অসুস্থ বাবু। বাবুর কাছে কিছু আগাম টাকা চাইতে উনি আমাকে টাকা তো দিলেনই না উল্টে ঠাঁটিয়ে চড় মারলেন। আমার জয়দীপদার মুখটা মনে পড়ে গেল। তারপর সেদিন যখন দেখলাম যে বাবু বিশহাজার টাকা আলমারিতে রাখলেন, তখন আর মাথার ঠিক রাখতে পারিনি। বাবুকে মেরে টাকা গয়না চুরি করার মতলব আসে। ওইরকম একটা লোককে মারলে কোনও পাপ হবে না, এটা ভেবেই সেরাতে বাবুর ঘরে রাতের জলের জগ রাখার অছিলাই ঢুকে দেখি খাটের ওপর বাবু ঘুমিয়ে রয়েছেন। আমি সাবধানে গিয়ে অতর্কিতে বাবুর গলা টিপে ধরি। আমার হাতে অনেক জোর স্যার। বুড়ো মানুষ জেগে গেলেও সেভাবে নড়াচড়া করতে পারেননি। আমি তাকে চেঁচাতে দিইনি। মদন সাহাকে মারতে আমাকে বেশী বেগ পেতে হয়নি। আলমারির চাবি থাকত বালিশের নীচে। বাবুর লাশের চোখ বন্ধ করে দিয়ে দেহটাকে খাটে ঠিকঠাকভাবে শুইয়ে দিয়ে আলমারি খুলে টাকা আর গয়নাগুলো বের করে চাবি জানালা দিয়ে নীচে পাশের গলিতে ফেলে দিই। আর টাকা-গয়নার বাক্সও ওই জানালার শিক গলিয়েই নীচে ফেলে দিই। ক্লাবেরই লিটন বলে একটা ছেলেকে আগে থেকে ফিট করে রেখেছিলাম। সে তখন ওখানেই দাঁড়িয়ে ছিল। সে সেগুলো প্ল্যানমাফিক কুড়িয়ে নিয়ে চলে যায়। এখনও সেগুলো ওর কাছেই আছে। ওরও খুব টাকার দরকার। ওর বাবার কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে ওদের চারভাইবোনের রোজ দুবেলার সেদ্ধ ভাত পর্যন্ত জুটছে না’। কথা শেষ করে মুখ ঢেকে হাউহাউ করে কাঁদতে শুরু করল রতন’।

এবারে দেবেন্দ্র চৌধুরী তাকালেন গদাইয়ের দিকে। সে মাথা নীচু করে বসে রয়েছে। দেবেন্দ্র চৌধুরী একবার ভালো করে গদাইয়ের দিকে দেখে নিয়ে জগুর দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি গদাইকে চেনো?’

অবাক দৃষ্টি নিয়ে জগু তাকালো দেবেন্দ্রবাবুর দিকে। দেবেন্দ্র চৌধুরী আবার বললেন, ‘গদাইকে দেখে কিছু মনে হয়নি তোমার? আমার হাঞ্চ কিন্তু বলছে গদাইয়ের আসল পরিচয় তুমি জানো জগু। আর সব জেনেও চুপ করে রয়েছ তুমি’।

জগু চুপ করে রইল। গণেশবাবু টেবিল থেকে রুল তুলে জগুকে মারতে গেলেন। সবাইকে অবাক করে গদাই উঠে দাঁড়িয়ে গণেশবাবুর হাত চেপে ধরল, চোখে তার আগুন ঝরছে। গণেশবাবুও রেগে গিয়ে এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে রুলের এক বাড়ি বসিয়ে দিলেন গদাইয়ের পিঠে। তিনি আবার গদাইকে মারতে যাচ্ছিলেন জগু হাঁ হাঁ করে উঠল, ‘না না বাবু, ওকে মারবেন না, ওকে মারবেন না’।

দেবেন্দ্রবাবু এবার জগুকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘গদাই কে ঠিক করে বল। আমি জানি তুমি জানো’।

জগু বলে উঠল, ‘ওর মুখের আদল অনেকটা ওর মায়ের মত’।

‘মা মানে মালতী, তাই তো?’ দেবেন্দ্রবাবু জানতে চাইলেন।

মুখে কোনও কথা না বলে চোখের জল ফেলতে ফেলতে মাথা নাড়ল জগু।

এবারে দেবেন্দ্রবাবু গদাইয়ের দিকে ফিরে তাকিয়ে বললেন, ‘তার মানে তুই এখানে চাকর সেজে এসেছিলি মদন সাহাকে খুন করবি বলেই। তক্কে তক্কে ছিলিস লোকটা প্রবল কষ্ট দিয়ে মারবার জন্য। ছুরিটা তুই মদনবাবুর বুকে বসিয়েছিস। কিন্তু মদন সাহাকে খাটে শুয়ে থাকতে দেখে তুই বুঝতে পারিসনি তোর আগেই কেউ তাকে গলা টিপে মেরে রেখে গেছে। তুই শেষমেশ নিজের বাবাকেই......’।

দেবেন্দ্র চৌধুরীকে কথা শেষ করতে দিল না গদাই, ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল, ‘বাবা নয়, অভিশাপ, অভিশাপ ওই লোকটা আমার জীবনের। হরেন মন্ডল টাকার লোভে আমাকে তার কাছে রেখেছিল শুধু, ছেলে হিসাবে বড় করেনি। বেজন্মা বলে ডাকত আমাকে। লাথি মেরে মেরে বড় করেছে আমাকে। ছোট বয়সে খুব কষ্ট পেয়েছি আমি। মায়ের স্নেহ, বাবার ভালোবাসা কিচ্ছু পাইনি আমি। কুকুর-বেড়ালের চেয়েও খারাপ জীবন পেয়েছি আমি। বেজন্মা তকমা জুড়ে গিয়েছিল আমার নামের সাথে। বড় হওয়ার পরে একরাতে নেশার ঘোরে আমাকে লাথি মারতে মারতে হরেন মন্ডল আমার আসল পিতৃপরিচয় দিয়ে দেয়। সেইমুহুর্ত থেকে ঠিক করি যে লোকটার জন্য আমার এই জন্ম তাকে আমি শেষ করে দেব। আমার জীবনের একটাই লক্ষ্য ছিল মদন সাহাকে শেষ করা। ওর বুকে ছুরি বসানোয় আমার কোনও আফশোস নেই। শুধু আফশোস একটাই আমি মারার আগেই এই রতন ওকে মেরে ফেলল। আমার হকের শিকারকে ছিনিয়ে নিল রতন। এখন আপনাদের যা ইচ্ছে করতে পারেন। চাইলে আমাকে ফাঁসিতেও চড়াতে পারেন। আমার কিচ্ছু যায় আসে না’।

দেবেন্দ্র চৌধুরী গদাইয়ের ঘাড়ে হাত রেখে বললেন, ‘ফাঁসি তোমার হবে না। কারণ খুনটা তোমার হাতে হয়নি। তবে খুনের চেষ্টাও অপরাধ তো বটেই। তবে তোমার আর রতনের সঙ্গে আমার সহানুভূতি রইল। কিন্তু আইন চলবে আইনের পথে। অমল রতন আর গদাইকে লক-আপে নিয়ে যাও। আর এদের স্বীকারোক্তির বয়ান রেকর্ড করে আজ বিকেলের মধ্যেই চার্জশিট রেডি করবে। আর জগুর ডিটেলস রেজিস্টারে এন্ট্রি করে ওর টিপ সই নিয়ে ওকে ছেড়ে দাও’।

ইন্টারোগেশন শেষে ওই রুম থেকে বেরিয়ে আবার নিজের কেবিনের চেয়ারে ফিরে এলেন অফিসার দেবেন্দ্র চৌধুরী।

 


1 comment: