Nov 7, 2020

"বোঝা" - অবাস্তব ডায়েরী

Edit Posted by with No comments


 

বোঝা

অবাস্তব ডায়েরী

 

বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে সমস্ত দায়িত্ব চলে এল পঞ্চকের কাঁধে। পঞ্চক ছাড়াও ওর পরিবারে মা আর ছোট ভাই আছে। তাই কিছুটা বাধ্য হয়ে মাঝপথে পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে কুলিমজুরের কাজ বেছে নিল ও। ক্লাস ৬ পাশ করা পঞ্চককে এর থেকে ভালো কাজ কেউ দেবে না। তাও সুধীরকাকা ছিল বলে রক্ষে, নইলে কে তাকে আর কাজ দিত। যাইহোক দুবেলা দুমুঠো অন্ন তো পরিবারের মুখে তুলে দিতে পারবে।

একটু বড় হতে বেশি টাকা পাবার আশায় শহরে পাড়ি দিল সে। যে টাকা হাতে পায় নিজের জন্যে প্রায় কিছু না রেখে ভাইয়ের কাছে পাঠিয়ে দেয়। নিজে অভুক্ত থাকলে ক্ষতি নেই ভাই আর মা তো খেয়ে বাঁচবে।

দেখতে দেখতে ৩৫ বছর কেটে গেছে। মা মারা গেছে অনেকদিন হল। ভাইয়েরও বিয়ে হয়ে গেছে। পরিবারের ভার সামলে বিয়ে আর করা হয়ে ওঠেনি পঞ্চকের। একটা দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হয়ে তার একটা পা বাদ চলে গেছে। তাই দেশের বাড়িতে ফিরে এসেছে সে, যাক ভাই তো ভালোই কাজকর্ম করে তাকে নিশ্চই অবহেলা করবে না।

কিন্তু ভুল ভাঙলো সেদিন রাতে পাশের ঘরে থাকা ভাইয়ের কথাবার্তা শুনে। ভাই তার স্ত্রী কে বলছে “খেয়ে দেয়ে কাজ নেই , একেই আমার কাজকর্মের এই অবস্থা, তার ওপর পা হারিয়ে দাদা জুটেছে সংসারে। কতদিন এই বোঝা টানতে হবে কে জানে।” ভাইয়ের কথা শুনে পঞ্চকের মনে হল “সত্যি পরিবারের বোঝা টানতে টানতে কখন যে নিজেই বোঝা হয়ে গেছে তা বুঝতেই পারেনি।”

Nov 6, 2020

"রহস্যময়ী ডাউহীল" - সৌমেন ভাদুড়ী

Edit Posted by with No comments

রহস্যময়ী ডাউহীল

সৌমেন ভাদুড়ী

 

আজ আমি নিয়ে যাবো এক ঐতিহাসিক পাহাড়ে, যা পৃথিবী বিখ্যাত ভৌতিক ঘটনার জন্য।

সালটা ১৮৭০ এর আশেপাশে হবে, ইংরেজ শাসকরা নব্য ক্রিশ্চানদের দলে দলে নিয়ে আসছে আশপাশের থেকে, আসানসোলে। সেখানে ওনারা প্রতিষ্ঠা করেছেন ইন্ডিয়ান থিয়লজিক্যাল সোসাইটি যার কাজ নব্য খৃষ্টদের পাদ্রী বানানো (নানটা সঠিক কিনা জানিনা)।

এই সময়েই বাংলায় ব্রাহ্ম সমাজের খুব বোলবালা। ১৮৭৮ সালে নব্য ব্রাহ্ম কেশব সেনের মেয়ে সুনীতিদেবীর সহিত কোচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণের বিবাহ হয়। কোচবিহারের রাজাদের নিকটবর্ত্তী পর্বতে অনেক জায়গা জমি ছিল।

ব্রাহ্ম সমাজের সহিত তদানীন্তন ব্রিটিশ সাহেবদের সখ্যতাও বেশ ভালোই ছিলো।

এই যোগাযোগের ফলস্বরুপ ইন্ডিয়ান থিওলজিকাল সোসাইটি পাহাড়ে লোকচক্ষুর আড়ালে গিয়ে সেন্ট মেরীস সেমেটারি তৈরি করেন এবং সেখানে দর্শনার্থীদের ভ্রমণে নিসেধাজ্ঞা জারি করেন, যা আজও বলবৎ।

আর ওদিকে বাংলার তদানীন্তন লে.গভঃ এসল্যে ইডেন সেন্ট মেরীর কাছেই ভিক্টোরিয়া স্কুল খোলেন। প্রথমে তার উদ্দেশ্য এক হলেও পরবর্তীতে পাল্টে যায়।

যাইহোক এই ঘটনার প্রায় ১৩৫ বছর পরে আমি আমার সহকর্মীদের নিয়ে কলেজের কাজের পরে এক বাল্যবন্ধুর আমন্ত্রণে ওই পান্ডব বর্জিত (টুরিস্ট এলাউড না) রেঞ্জার্স কলেজে (সেন্ট মেরীর বর্তমান নাম) নিশিযাপনের উদ্দেশ্যে পৌছাই। ঘন পাইন বা স্থানীয় ধূপী গাছে ঘেরা এই সুপ্রাচীন ব্রিটিশ স্থাপত্য ও মুহুর্মুহ মেঘের আনাগোনা আমাদের মতো শহুরে সমতলের লোকেদের মোহিত করে তোলে। বিকেলের আলোয় পাহাড়ের ঠান্ডা পরিবেশের সাথে নিজেদের মানিয়ে নিতে নিতে আমরা ব্রিটিশদের তৈরি করা শতাব্দী প্রাচীন গথিক নির্মাণশৈলী বিষ্ময়ের সাথে ঘুরে দেখার সাথে সাথে প্রাচীন ইতিহাস ও রহস্যের সাথেও পরিচিত হবার সুযোগ পেলাম ওখানকার এক খ্রিষ্টান কর্মচারী ও বাল্যবন্ধুর মাধ্যমে। তবে প্রচন্ড জোঁকের উপদ্রবে আমরা সন্ধ্যা নামার আগেই মূল বিল্ডিংয়ে প্রবেশ করি এবং জানতে পারি সেখানেই আমাদের রাত্রিবাস করতে হবে, এতে আমার সহকর্মীরা ভীত হলেও আমি মনে মনে আনন্দিত হয়ে উঠি।

সবাই চারিদিক ঘুরে দেখার সময়ে জানতে পারে যে ক্যান্টিনে যারা খাবার বানাবেন তা তারা আগেই বানিয়ে ক্যাসারোলে করে ডাইনিং টেবিলে রেখে যাবেন। আর ওনারা বিকালের পরে তেঁনাদের ভয়ে কেউ ওখানে থাকেন না। শুনেই আমার সাথীরা নিজ নিজ ঘরের অন্তরালে গিয়ে সুরা মৌতাতে এই আধিভৌতিক পরিবেশ থেকে নিজেদের সাবধানে সরিয়ে নেয়।

কিন্তু আমার উদ্দেশ্য একদম আলাদা, অবশ্য সাথে পেলাম সেই খ্রিষ্টান কর্মচারী জোসেফকে। ততক্ষণে আমার বাল্যবন্ধু আমার সাথীদের সাথে গিয়ে ভিড়েছে।

এবার আমি জোসেফকে নিয়ে এই শতাব্দী প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাসের অনুসন্ধানে বের হলাম বিল্ডিংয়ের ভিতরেই, সাথে অফুরন্ত ভৌতিক ঘটনার বিবরণ। তবে সবচেয়ে যেটা অবাক করা ব্যাপার জানলাম আজ থেকে প্রায় ১৫০ বছর আগে ব্রিটিশ ফাদাররা নিজেদের বিদ্যুতের প্রয়োজন মেটানোর জন্য একটি ছোট জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ওখানে বসিয়েছিলেন, ভারতবর্ষে সম্ভবত প্রথম, যদিও তার সব চিহ্ন কোন অজানা কারণে বর্তমান মেঝের নীচে মোটা সিমেন্টের চাদরে ঢাকা।

এই সময় আমি উনাকে পটিয়ে মূল বিল্ডিংয়ের বাইরে নিয়ে আসি। জানতে পারি, যে সমস্ত খ্রিষ্টানরা ফাদার হওয়ার কঠোর পরিশ্রম করতে পারতো না তাদের কিভাবে তিলে তিলে শেষ করে দেওয়া হতো। যদিও আজ সেগুলো সব পুরু সিমেন্টের চাদরে ঢাকা। হয়তো বা সেই অতৃপ্ত আত্মারাই এই ডাউ-হিলের আতঙ্ক।

এর পরে আমরা আবার ফিরে আসি ডিনারের জন্য। সবাইকে ডেকে নিয়ে ক্যান্টিনে খেতে যাই। এতো সুন্দর রান্না, কিন্তু ভয়ে কেউ ভালো করে খেলোই না, তার কারণ আমার এক সহকর্মীর ক্যামেরায় এক মনুষ্যাবয়বের কারো ছবি ধরা পড়ে, যা আমরা অনেকেই দেখেছি। কিন্তু ক্যান্টিনের টেবিলের ওখানে কেউ ছিল না আর সেটা দেখার জন্য যখন আবার ক্যামেরাটা অন করা হয়, সেখানেও না, অত্যন্ত রহস্যজনক।

এবার আমি আর জোসেফ মিলে আমার বাল্যবন্ধুকে তার কোয়ার্টার এ ছেড়ে আসার কথা বললাম, কিন্তু আমার সহকর্মীরা একা থাকার ভয়ে জোসেফকে ছাড়তে ভরসা পাচ্ছিল না। কিন্তু আমি একা ফিরব বলে ওরা জোসেফকে এলাউ করলো। তখন রাত প্রায় ৯টা বাজে, পাহাড়ে কিন্তু মনে হবে মধ্যরাত।

বন্ধুকে তার কোয়ার্টারে ছেড়ে দেওয়ার পরে জোসেফ আমাকে সামনের এক জঙ্গল দেখিয়ে বললো, এটাই কুখ্যাত ডাউহিল ফরেষ্ট, এই রাস্তায় কিছুটা গেলেই ভিক্টোরিয়া স্কুল, যদি জোঁকের ভয় না পান তো চলুন ঘুরে আসি। তার বিশ্বাসে আমি যেহেতু সিংহ রাশির লোক তাই আমার দেখার সম্ভাবনা খুবই কম। বন জঙ্গলের পথে আমরা ঘন্টাখানেক ঘুরলাম কবন্ধকাটা বা নেপালীবুড়ী দেখার জন্য। কিন্তু আমি সমতলের মানুষ, দম কমে যাওয়ায় আর সিংহ রাশির খটকার জন্য জোসেফকে বললাম চলো ফিরে যাই, তোমাকেও ঘুমাতে হবে।

কলেজে ফিরে আসার পরে দেখি সবাই দরজা লাগিয়ে ঘুমাচ্ছে। জুনিয়রদের রুমে ধাক্কা দিয়ে ওদের জাগালাম, ওরা বললো কোথায় গেছিলে, আমি বললাম বাথরুমে, পেটটা প্রব্লেম দিচ্ছে দরজাটা খালি ভেজিয়ে রাখলেই হবে, আধা ঘুমে হ্যাঁ বলেই তারা আবার ঘুমিয়ে পড়ল।

আর এদিকে আমি দুপেগ হাল্কা করে বানিয়ে ক্যামেরা নিয়ে খালি পায়ে বিল্ডিংয়ের ভিতরে ঘুরতে বেড়ালাম, রাত তখন প্রায় ২টো। খালি পায়ে নিশব্দে আমি প্রায় ভোর ৪টা পর্যন্ত তেনাদের খুঁজে বেড়ালাম। ক্লান্ত হয়ে এসে শুয়ে পড়লাম কারণ রাত পাতলা হওয়ার সময় হয়ে আসছে।

পরের দিন আরো অনেক কিছু দিনের আলোয় দেখে কুয়াশের চারা নিয়ে দুপুরের মধ্যেই শিলিগুড়ি ফিরে এলাম।

তবে ভূত বা ভৌতিক বা পরাবাস্তবতা যাই বলুন না কেনো, আমার যা মনে হয়েছে সেটাই আপনাদের কাছে জানাতে চাই। পাহাড়ের মানুষ বিকাল ৪/৫ কেই রাত্রি মনে করে শুয়ে পড়ে, তার উপরে ভৌতিক পরিবেশ আর সেই নিশব্দ পাহাড়ে হাওয়ার ঘনত্বের কারণে বহু দূরের শব্দকেও কাছের মনে হয়। এর আর একটা কারণ বলি বিল্ডিংয়ে মধ্যরাতে কাঠের মেঝেতে খালি পায়ে যখন হাটছিলাম তখন অনেক রকম শব্দ শোনা যাচ্ছিল, এমনকি নিজের টিপে টিপে চলা পায়ের শব্দতেও মাঝে মাঝে চমকে উঠছিলাম। তাই আমার মনে হয় এই নৈশব্দের নিস্তব্ধতাই এক পরাবাস্তবতার জন্ম দেয়, তাকেই আমরা সরল ভাষায় ভূত বলি। অবশ্য আর একটা কারণও আমার মনে হয়েছে, তা হলো ওখানকার শতাব্দী প্রাচীন দুর্মূল্য বইগুলি, ওগুলো পাচারের জন্যও মানুষের তৈরী কোন মানুষ ভূত থাকলেও থাকতে পারে।



ছবি- সৌজন্যে লেখক

Nov 4, 2020

"অবসাদ " - দেবপ্রিয়া পাল

Edit Posted by with 1 comment

 


অবসাদ

দেবপ্রিয়া পাল

 

সকাল থেকেই মাথাব‍্যাথাটা বেশ জোরালো পাখির। মোটা ফ্রেমের বাইরে অঙ্ক বইটা ঝাপসা দেখে সে। তারপর কী যেন আপনমনে বিড়বিড় করে ওপর দিকে তাকিয়ে।

যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে সে বিছানায় শুয়ে চাদরটাকে খামচে ধরে থাকে।

বাবা রুমে ঢোকামাত্রই ঝাঁঝিয়ে ওঠে "থাক শুয়েই থাক সারাটাজীবন... কিসসু হবে না আর তোর দ্বারা"

মাও তাতে সায় দিয়েই বলেন "পড়াশোনায় তো বিন্দুমাত্র মন নেই তোর... সারাদিন পাগলের মত কী বিড়বিড় করিস "।

আর পেরে ওঠে না পাখি, সহ‍্য হয় না কথাগুলো, জগতটাকে অস্বস্তিকর দুর্বিষহ বলে মনে হয় তার। চোখের জ্বলন্ত শিখার নীচে কালি পড়েছে বহুকাল, পিঠ ঠেলে কুঁজও বেরিয়েছে, ওজন বেড়ে ৭১, সামনেই JEE-Mains তার...

মেজাজ চরমে পৌছায় এবার কোনোমতে উঠে টেবিল থেকে বইগুলো ছুড়ে ফেলে দেবার জন‍্য। কিন্ত পা বাড়াতেই অজ্ঞান হয়ে পরে যায় সে।

দীর্ঘ ৫ ঘন্টা পর জ্ঞান ফেরে তার কিন্তু অপলক চোখে তাকিয়ে থাকে সে আর কি যেন বিড়বিড় করে। মা-বাবা স্পষ্ট দেখতে পায় তাদের চোখের সামনে আস্ত পাখিটাকে গিলে খাচ্ছে রাক্ষুসে অবসাদ।


"এবিসিডি" - অগ্নিমিত্র

Edit Posted by with No comments

 


এবিসিডি

অগ্নিমিত্র

 

এক অদ্ভুত জায়গায় কাজ করতে এসেছি আমি। একটা ফাইল এ ঘর থেকে ও ঘরে যেতে দু মাস লাগে, কখনো বা তারও বেশি। আমারও একটা ফাইল আটকে গেল। ভাবি, কী করা !?

করণিকদের জিজ্ঞাসা করলাম, কী ব্যাপার ! তারা তো নেতাগিরি নিয়ে ব্যস্ত। সব অ্যাসোসিয়েশন করে কিনা। তাই তেমন সুরাহা হলো না।

ক্যাশ কাউন্টারে বসা এক ভদ্রলোক বললেন - 'এখানে তো এই রকমই। আসলে ফাইল তাড়াতাড়ি চলতে গেলে একটু নীলচে কিছু তার সাথে জুড়ে দিতে হয়।'

ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে একশো টাকা ঘুষ চাইছেন এমন ভাবে, যে কষ্ট হল।

এক অভিজ্ঞ পুরনো করণিক ছিল, নাম মুখার্জি । সে বললো- 'আরে স্যার, এখানে তো সবাই এবিসিডি করে। '

'এবিসিডি !? সে কেমন ?' অবাক হই ।

'ও মা, জানেন না ! দেখুন, এ মানে avoid, যতটা পারে আজ হবে না, কাল হবে করে কাজটা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা।'

'হুম। আর বি দিয়ে?'

'ওটা সোজা। বাইপাস । এই তুই করে দে, ও করে দেবে বলে বাইপাস করা। তারপর সি। সি দিয়ে confuse। এটাতে এই চিঠি লাগানো নেই, এই ডকুমেন্ট নেই, এটার নিয়ম নেই বলে confuse করা।'

'আচ্ছা। আর শেষে ডি !?'

'হুম। ওটাই মর্মান্তিক। ডি দিয়ে delay, এই করতে করতে কাজটা দেরী হয়ে পন্ড হয়ে যায়। আপনারটাও হবে।'

আমি শঙ্কিত, বিচলিত হই। কী যে করবো !?

এই এবিসিডির চাপে ছোটবেলায় শেখা এবিসিডিই না ভুলে যাই !!


"সেদিন রাতে" - মনামী সরকার

Edit Posted by with No comments

 


সেদিন রাতে

মনামী সরকার

 

এই রাতটার কথা দীপা হয়তো তার জীবনে কোনদিনও ভুলতে পারবে না। এই রাতের বিভীষিকা কাটিয়ে ওঠা তার পক্ষে সত্যি খুব কঠিন। দীপার বয়স ত্রিশের কাছাকাছি হবে। দীপা পেশায় একজন নার্স। দেড় বছরের মেয়ে আর স্বামীকে নিয়ে তাঁর ছোট সংসার। এই করোনাকালে অন্যান্য যোদ্ধাদের মত সেও প্রতিদিন মৃত্যুভয় কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে লড়ে যাচ্ছে এই ভয়াবহ পরিস্থিতির সাথে। সেবা করে যাচ্ছে হাজারো অসুস্থ মানুষের। সে জানে যেকোনো মুহূর্তে সে নিজেও করোনা আক্রান্ত হয়ে যেতে পারে, তার সাথে ওর মেয়ে আর স্বামী। তবু সে স্বার্থপর হয়নি, যথাযথ নিয়ম-বিধি মেনেই সে দিন রাত সেবা করে যাচ্ছে মুমূর্ষু রোগীদের। বিভিন্ন ওয়ার্ডেই ঘুরে ঘুরে ওদের ডিউটি পড়তো। এবার দীপার ডিউটি পড়েছে আইসোলেশন ওয়ার্ডে। এই বিভাগে করোনায় আক্রান্ত ও করোনা আক্রান্ত হয়ে যাদের খুব খারাপ অবস্থা সেই সমস্ত রোগীরাই ভর্তি থাকে। তাই এই ওয়ার্ডে ডিউটি করার সময় সরকারিভাবেই নার্স, ডাক্তারদের জন্য আলাদা থাকার ব্যবস্থা করা হয়। এই সময়ে তারা বাড়ি থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকে। ৭ দিনে ডিউটি করার পর প্রত্যেক স্টাফের করোনা পরীক্ষা করা হয় এবং তারপর আরো ৭ দিন তাদের আইসোলেশন এ রাখা হয়। তারপর তারা নিজের বাড়িতে ফিরে আসে। মোট ১৪ দিন তাদের পরিবার পরিজন ছেড়ে একলাই থাকতে হয়।

দীপাও আজ ব্যাগপত্র নিয়ে চলে এসেছে। তার দেড় বছরের মেয়ে আর স্বামীকে ছেড়ে। ওদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে একটা চারতলা ভবনে। বিশাল ভবন কিন্তু এখন ওখানে ওরা মাত্র চার জনই আছে। আগে যারা ছিল তারা ১৪ দিন কমপ্লিট করে বাড়ি চলে গেছে। আজ দীপা নতুন একাই এসেছে। ওর সাথে যাদের ডিউটি পড়েছে তারা বেশিরভাগই স্টাফ কোয়ার্টারে থাকে। একাই থাকে বলে তারা আর ভবনে থাকছে না। দীপার সাতদিন ডিউটি হয়ে গেছে, আজ ওর করোনা টেস্ট হলো। এখন আরো সাত দিন ওকে আইসোলেশন এ থাকতে হবে। গত সাত দিনে ফোন আর ভিডিও কলিং-ই ছিল মেয়ে আর স্বামীর সাথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। এভাবে আরো ৫ দিন কাটলো। ওর সাথে ভবনে আর যে তিনজন ছিল একে একে ওদের সবার ১৪ দিন পূরণ হয়ে গেছে, ওরা যে যার বাড়ি চলে গেছে। আজ পুরো ভবনে দীপা একা। তাই সকাল থেকে দীপার মনটা বেশ খারাপ, বাড়ি ছেড়ে থাকলেও ওরা চারজন মিলে এই কটা দিন বেশ হইহই করে কাটাচ্ছিল। দিন গড়িয়ে বিকেল হল দীপার একটু একটু করে ভয় লাগতে শুরু করলো, এত বড় ভবনে ও একা। ভরসা বলতে  এক বয়স্ক চৌকিদার। ওই ভবনের নীচতলার একটা কোণার ঘরে উনি থাকে। আইসোলেশন বিনা অপরাধে এমন একটা শাস্তি যেখানে চাইলেও কেউ তোমার কাছাকাছি আসতে পারবে না। না তুমি জনসংযোগে যেতে পারবে। এই নিয়ম-বিধি না মানলে জেনে বুঝেই আপনজনদের বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া হবে। তাই দীপাও নিরুপায়। যে করেই হোক ওকে একাই এই দুটো দিন কাটাতে হবে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো। চৌকিদার ভাই দীপা কে ডেকে বলল, দিদি আপনি তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ুন আমি গেটে তালা দিয়ে দিয়েছি। ভয় পাবেন না আমি নীচেই আছি। আজ যেন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতটাও তাড়াতাড়ি হয়ে গেল। ন’টার মধ্যে দীপা খাওয়া-দাওয়া শেষ করে দরজায় ছিটকিনি দিয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু ঘুম কি আর আসে, চারিদিক নিস্তব্ধ নিঝুম। নিজের নিঃশ্বাসের শব্দ যেন নিজে শুনতে পাচ্ছে। ভবনটা একটু ফাঁকা জায়গায় ছিল, আশেপাশে সেরকম বাড়িঘর নেই বললেই চলে। সবই একটু দূরে দূরে। তাই নিস্তব্ধতা গাঢ় হয়ে আসছিল। রাস্তা দিয়ে মাঝে মাঝে দু-একটা গাড়ি চলার শব্দ আসছিল। বিছানায় বসে কিছুক্ষণ মোবাইলে ভিডিও কলিং এ মেয়ে আর স্বামীর সাথে কথা বললো। তারপর কিছুক্ষণ সোশ্যাল সাইট গুলোতে ঘুরে বেড়ালো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে এতক্ষণে সবে এগারোটা বেজেছে। রাতটাও যেন আজকে আর কাটতে চাইছে না। লাইটটা অফ করে এবার ও শুয়ে পড়ল। গা-টা একটু ছমছম করছিল ঠিকই, নাইট ডিউটি করে আর গত চার মাসে মৃত্যুকে প্রতিনিয়ত সাক্ষাৎ করে ভয়টা যেন আর সাধারণের থেকে ওর অনেকটা কমে গেছিল। বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছে কিছুতেই ঘুম আর আসে না। শেষে মোবাইলে একটা সিনেমা চালায়। ওটা দেখতে দেখতেই কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল দীপা। হঠাৎ একটা বিকট শব্দে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। উঠে বসে মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখল তখন রাত প্রায় আড়াইটা বাজে। মোবাইলে সময়টা দেখতে দেখতে চার্জ শেষ হয়ে মোবাইলটা অফ হয়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যে চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেল। দীপা ভালই বুঝতে পারছে ভবনের নিচের তলার ঘরগুলোতে তখন কয়েকজন মিলে ভাঙচুর করছে। ভালো করে কান পেতে শুনে বুঝতে পারলো শব্দটা ক্রমশ উপরের দিকে উঠে আসছে। ভয়ে বুকটা শুকিয়ে আসছে। মনে, মনে ভাবছে চিৎকার করবে। কিন্তু কে-ই বা এখানে ওর চিৎকার শুনবে? আস্তে আস্তে সেই ভাঙচুর এর শব্দ আরো কাছে চলে আসতে থাকে। ও বুঝতে পারে কারা যেন ওর সামনে করিডর দিয়ে হাঁটাচলা করছে। একের পর এক ঘরগুলোর দরজা লাথি মেরে ভাঙছে। শব্দটা কাছে আস্তে আস্তে একদমই কাছে চলে এলো। হয়তো বা পরের দরজাটা ওর-ই ছিল, কিন্তু হঠাৎই পুলিশ পেট্রোলিং ভ্যানের শব্দ, ভবনের ভেতরের ভাঙচুরের শব্দ বন্ধ হয়ে গেল। দীপা আস্তে করে খাটের থেকে নেমে জানলার কাছে গিয়ে দেখল পুলিশ ভ্যানটা ভবনটার থেকে মাত্র ঢিল ছড়া দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে। ও চিৎকার করে ডাকতে যাবে ঠিক তখনই ভ্যানটা সামনের দিকে এগিয়ে চলে গেল। রক্ষা পাওয়ার শেষ ভরসাটাও শেষ হয়ে গেল। বুক ফেটে কান্না আসছে ও দুই হাতে নিজের মুখ চেপে ধরে। পাছে কেউ ওর কান্নার শব্দ শুনে ফেলে, বুঝতে পারে যে ঘরে কেউ আছে। পুলিশের গাড়ি চলে যাওয়ার শব্দের পর, ভাঙচুরের শব্দটাও থেমে যায়। কারা যেন ফিসফিস করে কথা বলছে। আস্তে আস্তে সেই শব্দটা দূরে চলে যেতে থাকে ও চুপ করে এসে খাটে বসে। ঘামে ভিজে গেছে ওর সারা শরীর। হাত-পা গুলো অসাড় হয়ে গেছে। ওর মাথা আর কোন কাজ করছে না। কোনভাবে খাটের এক কোনায় গিয়ে গুটিসুটি মেরে অন্ধকারে বসে থাকল। ওখানে বসে থাকতে থাকতেই কখন যেন ওর চোখটা লেগে এসেছিল। হঠাৎ দরজায় ধাক্কা দেওয়ার শব্দ ও চমকে ওঠে, চোখ খুলে দেখে বাইরে ভোরের আলো ফুটছে। দরজায় আবার ধাক্কা পারে। দীপা ভয় পেয়ে যায় ও চুপ করে থাকে। এবার দরজার ওপাশ থেকে শুনতে পায় কেউ বলছে দিদিমণি আমি রামপ্রসাদ দারোয়ান, দরজাটা খুলুন। ভয় পাবেন না ওরা চলে গেছে। এটা শুনে দীপা মনে হয় প্রাণে একটু জল পেল। আস্তে আস্তে উঠে গিয়ে দরজাটা খুলল। দেখে সত্যিই দারোয়ান দাঁড়িয়ে আছে। ওর মাথাটা ফেটে গেছে। কপাল গরিয়ে রক্ত পড়ছে। দীপা তাড়াতাড়ি করে ওর মাথায় ব্যান্ডেজ করে দেয়। দারোয়ান ওকে জানায় গতরাতে ৫ জন দুষ্কৃতী ঢুকে পড়েছিল ভবনে। ভবনের বেশকিছু সম্পত্তি ওরা লুট করে নিয়ে যায়। বাধা দিতে গিয়েছিল বলে ওরা ওকে মারধর করে। দারোয়ান বলে দিদিমণি আমি ওদের বলিনি আপনি এখানে আছেন। বলেছি পুরো ভবনটি ফাঁকা। নইলে ওরা যদি আপনার কোন ক্ষতি করে দিত। তবু মনে মনে ভয় পাচ্ছিলাম আর ঈশ্বরকে ডাকছিলাম ওরা যেন কোনভাবেই আপনার পর্যন্ত পৌঁছাতে না পারে। ঈশ্বর আমার কথা রেখেছেন। এতটা সময় অব্দি দীপার একটা ঘোরের মধ্যে কাটছিল। এবার নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে ও মোবাইলটা চার্জে দিয়ে বাড়িতে ফোন করলো এবং লোকাল থানায় পুরো বিষয়টা জানালো। সকাল সাড়ে নটা নাগাদ ওর করোনা টেস্টের রিপোর্ট এলো। রিপোর্ট নেগেটিভ। ওর স্বামী সঙ্গে করে ওকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলো। তারপর বহু রাত কেটে গেছে দীপা দু'চোখের পাতা এক করতে পারেনি। ওই রাতের বিভীষিকা ওকে তাড়া করে বেড়াতো। করোনার মতো ভয়াবহ মারণ রোগের বিরুদ্ধে নির্ভীকভাবে লড়াই করে চলেছে যেই মেয়েটা, মানুষের তৈরি সন্ত্রাস তাকে ভেতর থেকে একেবারে ভেঙে দিয়েছিল।


Nov 1, 2020

নেট ফড়িং সংখ্যা- ১৬৫

Edit Posted by with No comments

Oct 24, 2020

নেট ফড়িং সংখ্যা- ১৬৪

Edit Posted by with No comments

Oct 20, 2020

ফড়িং সাক্ষাৎ

Edit Posted by with No comments

 


অতিথি- কিশোর মুজুমদার (কবি, লিরিসিস্ট, ইউটিউবার)

সাক্ষাৎকার ও অণুলিখন- দীপজ্যোতি গাঙ্গুলি


নেটফড়িং অনলাইন ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে একটি নতুন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কোচবিহার তথা বাংলার বেশ কিছু মানুষ যারা নিজ নিজ কাজে অত্যন্ত পারদর্শী ও পরিচিত মুখ, তাদের মুখে তাদের জার্নি শুনে সেটা নেটফড়িং এর পাঠকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। আজ আমাদের সাথে যেই মানুষটি আছেন তার পরিচিতি সে নিজেই। আমাদের সাথে আজ আছেন, কোচবিহার শহরের সেরা ইউটিউবার, দ্য ওয়ান এন্ড অনলি কিশোর মজুমদার।

 

দীপজ্যোতি- প্রথমেই জিজ্ঞেস করবো, লকডাউন কেমন কাটালেন?

কিশোর- সবার প্রথমে নেট ফড়িংকে ধন্যবাদ জানাই এত সুন্দর কাজ করছো তোমরা তার জন্য । লক ডাউনে মিশ্রভাবে কাটালাম। আমি কাজ পাগল মানুষ । কাজে ডুবে থাকার চেষ্টা করেছি। কিন্তু চারপাশের পরিস্থিতির জন্য মানসিকভাবে ভালো নেই।

দীপজ্যোতি- শিক্ষকতার পাশাপাশি কোচবিহার শহরের সেরা কবি তথা ইউটিউবারদের মধ্যে একজন। মানে এটা কিভাবে ম্যানেজ করেন?

 

কিশোর- সেরা কবি তথা ইউটিউবারদের মধ্যে একজন - এ কথা ঠিক নয়। কোচবিহারে বিখ্যাত কবি সাহিত্যিক রয়েছেন, যাদের আমি খুব শ্রদ্ধা করি । তাদের কাছে আমি তো নগণ্য। আর ইউটিউবার ? বাঘা বাঘা ইউটিউবার আছেন আমাদের শহরে । আমার চ্যানেল সেখানে ছোট্ট চারাগাছ মাত্র।

আর ম্যানেজ করার কথা বলছো । শিক্ষকতার পাশাপাশি আমি সবচেয়ে পড়তে ও লিখতে ভালোবাসি । আর এখনকার পড়ার বেশিরভাগটাই হচ্ছে অনলাইনে । কিছু কিছু কোর্সও করে নিচ্ছি । শিখতে বেশি ভালোবাসি বলে আমি নিজেকে এখনো ছাত্রই ভাবি। আর রুটিন করে পড়ি, কবিতা ও গান লিখি। তিনটি ব্লগ চালাই, যেখানে নিয়মিত লিখে যেতে হয়। সপ্তাহে একটি করে ইউটিউবের জন্য ভিডিও বানাতে চেষ্টা করি। পুরো কাজগুলি কেমন করে যেন হয়ে যায় । আসলে গভীর ভালোবাসা থেকেই কাজগুলো আমাকে খুব আনন্দ দেয়।

দীপজ্যোতি- আমার বিগত ছয় বছর থেকে একটা প্রশ্ন আপনাকে জিজ্ঞাসা করার ইচ্ছে ছিল। আজ সুযোগ পেয়ে করে ফেলি।সেটা হল, আপনি যেটাই করেন, সেটাতেই আপনি সেরা। মানে এই 'ফার্স্ট বয়' হওয়ার পেছনে কি স্ট্র্যাটেজি মেনে চলেন?

কিশোর- হাঃ হাঃ হাঃ । 'সেরা' ব'লো না আমাকে। কিন্তু আমি যে কাজই করি খুব ভালোবেসেই করি। আর নিজের কাজে যখন পুরোটা উজার ক'রে দিয়ে তার ফল পাওয়া যায় । সেটা যত যৎসামান্যই হোক না কেন, আমার কাছে ওটাই "সেরা' । বোঝোই তো নিজের সন্তান যেমনই হোক না কেন সে-ই ভালো ।

দীপজ্যোতি- রাঘব চট্টোপাধ্যায়ের সাথে কাজ করে কেমন লেগেছিল? যদি একটু গল্পটা শেয়ার করেন।

কিশোর- এই ব্যাপারে আমি একজনের নাম করতে চাই সে হল কোচবিহারের প্রবীর সরকার, খুব ভালো গান লেখে । প্রবীর আমাকে প্রথম টলিউডে মিউজিশিয়ান শিবশঙ্করদার সঙ্গে পরিচিত করায়। তারপর ইউফোনি মিউজিক থেকে আমার লিরিক এ রাঘবদা ( রাঘব চট্টোপাধ্যায়) আর অদিতি মুখার্জীর অ্যালবাম 'আলোর চিঠি' বের হয়।

রেকর্ডিং এর জন্য নির্দিষ্ট তারিখে গেলাম স্টুডিও হারমনিতে । সারাদিন রাঘবদার সঙ্গে আমরা খুব মজা করে খেলাম, কাজ করলাম । খুব মিশুকে প্রকৃতির মানুষ রাঘবদা। আমার লিরিকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ । কি বলবো নিজের মুখে। যাকগে। তার আগে একদিন স্কুলে ছুটির পর ক্যারাম খেলছিলাম । এমন সময় রাঘবদার ফোন পেয়ে চমকে উঠি । খুশিতে ডগমগ হয়ে সেদিনই টিকিট কাটি। সেখানে গিয়ে বেশ কয়েকজন বিখ্যাত মিউজিশিয়ানের সঙ্গে মেশার সুযোগ পেয়েছি।

দীপজ্যোতি- কোচবিহারের এতো এতো শিল্পীদের সাথে কাজ করলেন। কার কার সাথে কাজ করে সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে?

কিশোর- দ্যাখো । কোচবিহারে এখন বেশিরভাগ প্রফেশনাল কোয়ালিটির কাজ দিচ্ছে। কার কথা বলবো । এভাবে বলতে চাই না। সবার সঙ্গেই কাজ করে আমি খুশি। কারণ সবাই আমার পাশে দাঁড়িয়েছে। আবৃত্তিকার, সংগীতশিল্পী, অভিনয়শিল্পী, আর্টিস্ট, কোরিওগ্রাফার, D.O.P, অডিও-ভিডিও কাজের সঙ্গে যুক্ত মানুষ সবাই আমার প্রিয়। স্টুডিও-র কথা যদি বলো তাহলে nexxus studios, Jalsaghor, Audiogear এদের সঙ্গে কাজ করেছি ও করছি । এত এত মানুষের প্রচেষ্টা আর আদর পেয়ে আমার চ্যানেলটা আমার একার আর নেই । সকলের আপন হয়ে উঠেছে। এখন আমরা একটা টিমের মতো কাজ করে চলেছি।

দীপজ্যোতি- এই যে আপনার এতো সাকসেস এটা কি আপনার মধ্যে কখনো কোনো নেগেটিভ প্রেসার তৈরি করে?

কিশোর- এটা খুব মজার প্রশ্ন করেছো । যে কোনো কাজে মাঝে মাঝেই খুব হতাশা আসতে বাধ্য । কিন্তু আমি জীবনকে অন্যভাবে দেখি । আমার কাছে It's a game, কোনো কাজ একটা করার পরেই আমার শুরু হয় পরের কাজটা নিয়ে চিন্তা । কীভাবে আগের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে পরেরটা আরও বেটার করা যায় তার চেষ্টা করি । পুরো টিমকে আমি সর্বদা জাগিয়ে রাখতে চেষ্টা করি। আমি কিন্তু প্রশংসার চেয়ে নিন্দা থেকেই বেশি শিখতে পারি । তাই প্রশংসা আমার কাছে নেতিবাচক হয়ে ওঠে না। ভালো কাজের প্রশংসা আমার দায়িত্ব বাড়িয়ে দেয় । তাই আরও বেশি কাজেই মনোযোগী হতে পারি। সাকসেস তাই আমার কাছে  power booster.

দীপজ্যোতি- আজ যারা লেখালেখি করছে তাদের অনেকেরই ইনস্পিরেশন আপনি। ঠিক যেমন আমার। কিন্তু আমার প্রশ্ন হল, আপনার ইন্সপিরেশন কে?

কিশোর- সেটা এককভাবে কেউই নয় । বিশ্ব জোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র । আমি সবার কাছে শিখতে চাই । তুমি দেখবে প্রত্যেকটা মানুষের কাছেই কিছু না কিছু শেখার আছে । নেতিবাচক দিকগুলো ভুলে তাদের ইতিবাচক দিকগুলো থেকেই ইন্সপিরেশন নিতে চেষ্টা করি।

আর লেখার কথা বলছো । আমি আমার বাবার (স্বর্গীয় সুনীল মজুমদার) কাছে লেখালেখির আগ্রহ পেয়েছি। বাবা নাটক, গান লিখতেন । আর অনেক বই পড়তেন । এখনো মনে হয় বাবা আমার পাশে থেকে লিখতে প্রেরণা দিচ্ছেন । আমার " আমিও পারি" কাব্যটি সামনে প্রকাশিত হবে । এই বইটা আমি বাবাকেই উৎসর্গ করছি ।

দীপজ্যোতি- ২০০৯ সালে আপনি দাদাগিরি সিজন ২ তে গিয়েছিলেন। স্টেজে দাদার মুখোমুখি কেমন অনুভূতি হয়েছিল ?

কিশোর- ওরে বাবা সে এক অনুভূতি । স্টেজের অভিজ্ঞতার আগে বলে নি। সৌরভের জ্বর হয়েছিল বলে আমাদের পুরো টিমকে ১৪ দিন থাকতে হয়েছিল । তখন, আমাদের গ্রুমার ছিলেন মীরাক্কেলের কৃষ্ণেন্দু, সৌরভ পালধি ওরা। ওই ১৪ দিন জীবনে আমার দারুণ একটা প্রাপ্তি ছিল । আর স্টেজে দাদার মুখোমুখি আমার স্বপ্ন মনে হয়েছিল । আসলে এত আলোর মাঝে, ক্যামেরার সামনে, আমার অভিজ্ঞতাও কম । একটু নার্ভাস লাগছিল । দাদার সঙ্গে হাত মেলানোর পর কথা বলার পরে একদম ফ্রি হয়ে গেলাম। এটা দারুণ স্মরণীয় দিন আমার কাছে ।

দীপজ্যোতি- এমন কোনো স্বপ্ন আছে জীবনে, যা কখনো পূরণ হবার মতো না?

কিশোর- মানুষ সব পারে । এমন কোনো স্বপ্ন আমি দেখি না যা পূরণ হবার নয়। আমি স্বপ্ন যা দেখি সব পূরণ করেই ছাড়বো ।

দীপজ্যোতি- আগামীতে যারা কবি বা লিরিসিস্ট বা একজন সফল ইউটিউবার হতে চায়। তাদের জন্য কি বার্তা দেবেন?

কিশোর- এটা ব্রড আনসার টাইপ কোশ্চেন । লিরিসিস্ট এর বিষয়ে আমি বিপরীত দুটি দিক তুলে ধরতে পারি। শিক্ষককে যেমন সবার আগে ছাত্র হতে হয়, তেমনি গীতিকারকে সবার আগে শ্রোতা হতে হয় । শচীনদেব বর্মণ থেকে শ্রীজাত সবার লেখাই আমি গভীরভাবে অনুভব করতে চেষ্টা করি । LBW -র আপিল হলে যেমন রিপ্লে দেখে বোঝা যায় বলটা কোন দিকে যাচ্ছে। তেমনি প্রফেশনাল লিরিসিস্টকেও গানের প্রবাহ অনুভব করতে হয়। আরেকটি দিক হল গীতিকার হবার কোনো গ্রামার লেসন নেই । লালন ফকির আমার মতে অন্যতম শ্রেষ্ঠ গীতিকার। গান হল হৃদয়ের ছান্দিক অনুভূতির প্রকাশ । শব্দের উর্ধে সুরের মূর্ছনাই সেখানে প্রধান । তাই নিজেকে ফিল করে যা বেরোবে তাই গান হয়ে উঠবে । যদি সেই ব্যক্তিক বিষয়টি ব্যষ্টিক হয়ে ওঠার ক্ষমতা রাখতে পারে ।

আর ইউটিউবারদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ চারটি টিপস ।

১।  সাফল্যের পেছনে ছুটলে হবে না। ১০০ টা ভিডিও করে তারপরে ফিরে দেখো কী হল । আর প্রতিটি ভিডিও এক একটা শিক্ষা দেবে । দুটো চারটা ভিডিও করেই বার বার ভিউজ কত হল দেখলে হবে না । অর্থাৎ চরম ধৈর্য রাখতে হবে ।

২। নিয়মিত ভিডিও আপলোড করতে হবে । নিয়মিত ভিডিও দিলে ইউটিউব তাকে rank দেয় । আর নির্দিষ্ট দর্শক তৈরি হতে থাকে।

৩। কন্টেন্ট ভালো হতে হবে । যা মানুষের শিক্ষা বা বিনোদনের হবে ।

৪। আর টেকনিক্যাল বিষয়গুলো শিখে নিতে হবে । সেক্ষেত্রে ইউটিউবই হল বেস্ট টিচার ।

নতুনদের জন্য রইল ভালোবাসা । আর বেস্ট অফ লাক।

 

দীপজ্যোতি- আপনাকে টলিউডে কাজ করতে আবার কবে দেখবো?

কিশোর- টলিউড বলতে আর কি । পুজোতে একটা কাজ হচ্ছে 'অবশেষে' শিরোনামের গান । বিক্রম শীল এর গলায় । অভিনয়ে আছে "পরিণীতা" ছবিতে একটা রোল করেছিল সেই পিহু । আর পুরোটাই প্রায় কলকাতায় কাজ । সিনেমায় কাজের কথা যদি বলো তাহলে বলা খুব মুশকিল । দু'একটা কাজের কথা চলছে । হলে জানতেই পারবে । সিধুর একটা গানের কাজ শুরু হচ্ছে । সেটা Nexxus Studios তে কাজ শুরু হয়ে গেছে । পুজোর পর হয়তো শুনতে পাবে ।

দীপজ্যোতি- আগামীতে কি কি পরিকল্পনা আছে ? মানে আর কি কি নতুন চমক অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য ?

কিশোর- চমক কিনা জানি না । আমার প্রিয় বই এর কাজ শুরু হচ্ছে । ব্লগ এর কাজে মন দিয়েছি । মানুষের ভালোবাসা পাচ্ছি ও ভবিষ্যতেও পাবো আশা করছি । কয়েকটা দারুণ দারুণ কাজ আসছে সামনে । কিছু গান ও কবিতা । যারা পিয়াসি চক্রবর্তীর কণ্ঠে 'আমিও পারি' শুনেছেন ও পছন্দ করেছেন, তাদের জন্য পিয়াসির কণ্ঠে দারুন একটা কবিতার ভিডিও আসছে পুজোর পর। একটু নতুন ধরনের কাজ । আর নতুন নতুন বেশ কিছু এক্সপিরিমেন্ট চলছে । দেখতেই পাবে । যারা আমার লেখা গানের ভক্ত তাদের জন্য বলি, শুনলে খুশি হবেন যে 'চিরকূট' নামে একটা গান আসছে আয়ুব আলীর কণ্ঠে । এবস্ট্রাক্ট আর রিয়েলিটি মিলে অভিনব কাজ ।

এবার একটা র‍্যাপিড ফায়ার রাউন্ড।

 

১ কবি কিশোর মজুমদার নাকি লিরিসিস্ট কিশোর মজুমদার

-লিরিসিস্ট কিশোর মজুমদার

 

২ অডিও অ্যালবাম নাকি ভিডিও অ্যালবাম'

-ভিডিও অ্যালবাম

 

৩ ট্র্যাডিশনাল না ওয়েস্টার্ন

-ওয়েস্টার্ন

 

৪ ইউটিউব না ডিভিডি

-ইউটিউব

 

৫ অনুপম না রনজয়

-অনুপম

 

৬ ফেসবুক না ইন্সটাগ্রাম

-ফেসবুক

 

৭ সুবোধ সরকার নাকি শ্রীজাত

-শ্রীজাত

 

৮ সিনেমা নাকি ওয়েব সিরিজ

-ওয়েব সিরিজ

 

৯ রাঘব চট্টোপাধ্যায় নাকি অদিতি মুখোপাধ্যায়

-রাঘব দা

 

১০ কবিতা না গান।

-দুটোই

 

অনেক ধন্যবাদ জানাই তোমায় কিশোরদা নেট ফড়িং কে এতটা সময় দেওয়ার জন্য। তোমার আগামী কাজগুলোর জন্য অনেক শুভেচ্ছা রইলো।

 

(ছবি সৌজন্যে- কোরক মুজুমদার)


Oct 18, 2020

নেট ফড়িং সংখ্যা- ১৬৩ (পূজা সংখ্যা- ২০২০)

Edit Posted by with 2 comments

Oct 11, 2020

নেট ফড়িং সংখ্যা- ১৬২

Edit Posted by with No comments

Oct 4, 2020

নেট ফড়িং সংখ্যা- ১৬১

Edit Posted by with No comments

Oct 3, 2020

"হৃদয় আনন্দে নেচে ওঠে" - আবদুস সাত্তার বিশ্বাস

Edit Posted by with No comments


 

হৃদয় আনন্দে নেচে ওঠে

আবদুস সাত্তার বিশ্বাস

 

স্কুল করে এসে ফ্রেশ হয়ে এক কাপ চা খেয়ে পুলক এখন বাড়িতে রয়েছে। একটা পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যায় তার একটা গল্প বেরিয়েছে সেটা দেখছে।

এইসময় তার ফোনটা হঠাৎ বেজে ওঠে।ও থেমে যায়। তারমানে মিসডকল!

পুলক তখন গল্পটা দেখা বন্ধ করে ওই নম্বরটা বের করে কল করে। ওখান থেকে সে তখন একটা নারী কণ্ঠ শুনতে পায়,"হ্যালো!"

পুলক সরাসরি জিজ্ঞেস করে তাকে,"কে বলছেন?"

"আমি একটা নারী বলছি। আপনার পরিচিতা একটা নারী। "নারী কণ্ঠটা বলে।

"কি নাম আপনার? নাম বলুন! নাহলে ওভাবে বললে তো চিনতে পারবো না।"

কিন্তু কণ্ঠটা নাম বলে না। পুলক তখন ফোন রেখে দেওয়ার হুমকি দেয়।

কণ্ঠটা তখন পুলককে ফোন রাখতে নিষেধ করে। তার সঙ্গে যে তার অনেক কথা আছে। অনেক দরকার আছে সেটা বলে।

তবু পুলক হুমকি দেয়।

কণ্ঠটা তখন পুলকের দোহাই দেয়। "আপনার দোহাই লাগে ফোন রাখবেন না!"

পুলক আর ফোন রাখেনা, "বেশ,কি কথা আছে বলুন!"

কণ্ঠটা তখন আর 'আপনি' নয়। 'আপনি' থেকে এক লাফে 'তুমি'তে নেমে চলে আসে। "তুমি আমাকে চিনতে পারছো না, পুলক? আমি তোমার অতি পরিচিতা একটা নারী গো! তবু তুমি চিনতে পারছ না...!"

পুলক তবু চিনতে পারে না।

কণ্ঠটা তখন বলে, "চিনতে না পারারই কথা। কেননা পঁচিশ বছর সময় তো আর কম নয়। অনেক দীর্ঘ সময়। সুতরাং অত বছর আগের একটা মেয়েকে চিনতে না পারারই কথা।..."

কণ্ঠটার এখান থেকে পুলক তখন একটা ক্লু পেয়ে যায়। আর সে সেই পঁচিশ বছর আগে চলে যায়। যখন সে ভগীরথপুর স্কুলের উচ্চ-মাধ্যমিকের ছাত্র আর তার দৃপ্ত যৌবন সেই পঁচিশ বছর আগে।

অনেক দিন আগে এই ভগীরথপুরে জমিদারদের বাস ছিল। সেই সূত্রে ভগীরথপুর খুব নাম করা জায়গা। এখানে যে জায়গাটায় তারা বাস করত ওটা 'বাবুপাড়া'। জমিদারদের আরেক নাম 'বাবু'। তাই 'বাবুপাড়া'

পুলক একদিন ওই বাবুপাড়া ঘুরতে যায়। গিয়ে বাবুদের বাড়িগুলো ঘুরে দেখে বাড়িগুলোর কি করুণ অবস্থা! পরিচর্যার অভাবে বাড়িগুলো ভেঙে ভেঙে পড়ছে। জনমানবহীন বাড়িগুলো জঙ্গলে ভরে গেছে। পলেস্তারা খসে খসে পড়ছে। ইটের পাঁজর বেরিয়ে গেছে। মানুষের বদলে বাড়িগুলো এখন সাপ খোপের আস্তানা। কিছু কিছু বাড়ি আবার ভৈরবের ভাঙন ধারে পড়ে ভেঙে গেছে। ও কিছু বাড়ি ঝুলছে। যে বাড়ি গুলো ভাঙেনি অর্থাৎ ভাঙন ধার থেকে কিছুটা দূরে রয়েছে সেগুলোও একদিন ভেঙে যাবে। নদীতে পড়ে হারিয়ে যাবে। নদী গর্ভে তলিয়ে যাবে। বাবুপাড়া সেদিন আর বাবুপাড়া থাকবে না। বাবুরা যেমন নেই বাবুদের পাড়াটাও নেই হয়ে যাবে।

এই বাবু পাড়াতেই পুলকের সেদিন একটা মেয়ের সঙ্গে আলাপ হয়।

এখানে পরি ছাপানো একটা বাড়ি রয়েছে। পুলকের লোক মুখে শোনা আছে, এই বাড়িটা বাবুদের সেসময় রং মহল ছিল। অর্থাৎ নাচ, গান, আড্ডা, তামাশা এসবই এখানে হতো।

পুলক বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে ছাপানো পরিটা দেখে। কি সুন্দর পরিটা! যেন ডানা মেলে উড়ছে। ছাপানো তা মনে হয় না।

ঠিক এইসময় এখানেই পুলকের মেয়েটার সঙ্গে আলাপ হয়।

সে-ও বাবুপাড়া ঘুরতে এসেছে এবং ঘুরতে ঘুরতে এখানে এসে পুলকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে আলাপ হয়। মেয়েটার নাম পারুল। নদীর পারে তুলসিপুর গ্রামে তার বাড়ি। সে-ও ভগীরথপুর স্কুলের ক্লাস টেনের ছাত্রী।

আলাপ সেরে পরে তারা বাড়িটির ভিতর ঢুকে যায়। এই বাড়িটির ভিতর দেখলে তাদের সব দেখা হবে।

ভিতরে দেখবার মতো কোন জিনিসই নেই। আগাছার জঙ্গল আর ভাঙা ইট, কাঠের টুকরো ছাড়া। ঢুকেছে যখন সে সবই তারা ঘুরে দেখে। দেখতে দেখতে এক সময় একটা জায়গা থেকে পারুল হঠাৎ দৌড়ে পালিয়ে আসে, "ও বাবা গো! মরেছি গো!" চিৎকার করতে করতে এসেই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে পুলককে।

পুলক জিজ্ঞেস করে, "কি হল? কি দেখলে?"

পারুলের চোখ বন্ধ। মুখেও কোন কথা নেই। কোন সাড়া না পেয়ে পুলক তাই ফের জিজ্ঞেস করে, "কি হল? কি দেখলে?"

তবু সাড়া মেলে না পারুলের। পুলক তাই আবারও জিজ্ঞেস করে, "কি হল, কি দেখলে, বলো...."

পারুলের সাড়া মেলে এবার। "বিরাট একটা সাপ দেখলাম!"

সাপের কথা শুনে পুলক আঁতকে উঠে, "সাপ দেখলে!"

"হ্যাঁ।"

"কোথায়?"

"ওখানে।"

"ওখানে কোথায়?"

"যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম ওখানে।"

পুলক অমনি পারুলের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। "ছাড়ো পারুল, কি সাপ দেখে আসি। ছাড়ো!"

পারুল ছাড়ে না। একই রকম ভাবে সে তাকে ধরেই থাকে। পুলকেরও আর ওখানে সাপ দেখতে যাওয়া হয় না। কিন্তু সাপটা কি সাপ দেখার আগ্রহে পুলক ওদিকে চেয়েই থাকে। ও তাই তো! এই মোটা আর এই বড় একটা সাপ ইটের ফাঁক দিয়ে চলে যাচ্ছে। সাপটা দেখতে পেলেও সাপটা কি সাপ পুলক ভালো মতো চিনতে পারেনা। তবে সাপটার গায়ের কালো রং আর ডোরাকাটা কালো দাগ দেখে সাপটা যে কাল খরিশ হবে পুলক সেটা অনুমান করে নেয়। এই ধরনের সাপ খুব বিষধর আর বিষাক্ত হয়।মানুষকে কামড়ালে মানুষ বাঁচে না। যাইহোক, সাপটাকে সঠিকভাবে চেনার জন্য পুলক ছটফট করতে থাকে, "ছাড়ো পারুল, সাপটা চলে যাচ্ছে। কি সাপ একবার দেখে আসি। ছাড়ো....!"

কিসে কি! পারুল ছাড়ে না। ছাড়ে না তো ছাড়ে না। বরং আগের থেকে আরও শক্ত করে চেপে ধরে।

তার ওই রূপ চেপে ধরা দেখে পুলক বলে, "কি হল,এত শক্ত করে ধরছ কেন?"

পারুল চুপ থাকে।

পুলক শুধায়, "সাপে কামড়ায়নি তো তোমাকে?"

সাপে তাকে যে কামড়ায়নি সেটা বোঝাতে পারুল দুই দিকে মাথা নাড়ে।

পুলকের তখন খেয়াল হয় যে, পারুলের ডালিম্ব সম স্তন দুটি তার বুকের সঙ্গে একেবারে ঠেসে রয়েছে। আর তার হাত দুটি তার দুই ঘাড় ধরে রয়েছে। আর তার পাতলা ঠোঁট পুলকের ঠোঁটে ঠেকছে। খেয়াল হওয়া মাত্র পুলকের শরীরে হঠাৎ বিদ্যুৎ প্রবাহ হতে শুরু করে। পুলকের শীতল শরীর উষ্ণ হতে থাকে ও শিহরণ খেলে যায় দুজনের শরীর-মনে। ভালোবাসার সমুদ্রে দুজনেই নিমজ্জিত হয়ে ধীরে ধীরে অতলে তলিয়ে যায়। এরপর চৈতন্য ফিরলে দু-জনেই ভীষণ লজ্জা পায়। তারপর এভাবে তারা দেখা করতে থাকে।

পঁচিশ বছর আগে তাদের দেখা হওয়ার প্রথম দিনটির কথা মনে পড়ে যায় পুলকের। বুকের ভিতরটা তারপর হঠাৎ তার কেমন করে ওঠে। এই নারী কণ্ঠটাই কি তাহলে পঁচিশ বছর আগের সেই পারুল? এরকম মনে হলে পরে পুলক বলে, "তুমি কি পারুল?"

হাউমাউ করে অমনি কেঁদে ফেলে কণ্ঠটা, "হ্যাঁ গো, আমি পারুল। পঁচিশ বছর আগে যার সঙ্গে তোমার পরি বাড়িটির ভেতর...

আমি সেই পারুল।"

হঠাৎ পারুলের এহেন কান্নায় পুলক থতমত খেয়ে যায়। ফলে তার স্বাভাবিক হতে কিছুটা সময় লাগে। পরে স্বাভাবিক হয়ে সে বলে, "এ কি! তুমি কাঁদছ কেন? কান্না থামাও!"

পুলক কান্না থামাতে বলায় পারুল চুপ করে যায়। গিয়ে সে বলে, "অনেক দিন বাদে তোমার সঙ্গে কথা বলছি তো তাই আবেগে কান্না চলে এল। কান্না রুখতে পারলাম না।"

পুলকের এরপর আপনি মনে পড়ে যায়, পরি বাড়িটির ভিতর সেদিন তাদের আকস্মিকভাবে মিলন ঘটে যাওয়ার পর পারুল মাত্র দেড় মাস মতো স্কুল আসে। তারপর তার কি যে হয় স্কুল আসা বন্ধ করে দেয়। তারপর আর কোনদিন তার সঙ্গে দেখা নেই।

কেন স্কুল আসা বন্ধ করে দেয় পুলক এখন তাকে সেটা জিজ্ঞেস করলে পরে পারুল বলে যে, সে স্কুল আসা বন্ধ করবে কেন? তার বাড়ি থেকে বন্ধ করে দেয়। কারণ ঘটনাটা বাড়িতে জানাজানি হয়ে যায়। মেনকা নামে তাদের পাড়ার একটা মেয়েকে কথাটা সে একদিন কথায় কথায় বলে ফেলে। আর মেনকা বাড়িতে বলে দেয়। বাড়িতে কথা শুনতে হবে এই ভয়ে বর্ধমানে তার মামার বাড়ি পালিয়ে যায়। তারপরই স্কুল, পড়া সব বন্ধ।

পুলকের মুখ থেকে চরম আফসোসে তখন আপনি বেরিয়ে যায়, "ইস, কি ভুল করেছিলে গো! কি ভুল করেছিলে!" তারপর বলে, "এতবড় ভুল কাজ কেউ করে?"

"ও যে বলে দেবে সেটা কি আমি জানতাম?" পারুল তারপর বলে, "তবু আমি চুরি করে একদিন স্কুল আসি। তোমার সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু তুমি স্কুল আসোনি। আমিও আর বাড়ি ফিরে যাই না। বাবা-দাদা তাহলে যে আমাকে ধরে মেরে মেরে ফেলবে। আমি তখন করি কি, বাসে চেপে সোজা বহরমপুর চলে আসি। এসে এখানে বাসস্ট্যান্ডে একটা বিধবা মেয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। নাম নমিতা। তার সন্তানাদি কেউ নেই। একটা বাড়িতে একা থাকে। কান্দি মহকুমার 'নব দূর্গা' গ্রামে। মেয়েটা আমার সমস্ত কথা শোনে। শোনার পর আমাকে তার বাড়ি নিয়ে চলে আসে। আমি ছোট বোনের মতো তার আশ্রয়ে থাকতে শুরু করি এবং আমার একমাত্র মেয়েটাকে নিয়ে এখনও আছি।"

"তোমার বিয়ে?"

"বিয়ে করিনি।"

"তাহলে মেয়ে পেলে কোথায়?"

"বলবো। তার আগে তোমাকে একটা খুশির খবর শোনাই। সেটা হল, আমার মেয়ের একটা হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে চাকরি হয়েছে। আজকেই জয়েন করে এল।"

"শুনে খুব খুশি হলাম। কোন স্কুল?"

"সরস্বতী উচ্চ বিদ্যালয়।"

নামটা শুনে পুলক চমকে যায়, "কোন স্কুল বললে!"

"সরস্বতী উচ্চ বিদ্যালয়।"

পুলক তখন বলে, "আমি তো ওই স্কুলেরই শিক্ষক।"

"আমি তা জানি। তোমাদের বানিয়াখালি গ্রামের হরিচরণবাবু নামে এক ভদ্রলোক এখানে চাকরি করেন। আমার মেয়ে তাঁর ছাত্রী। এস এস সি পরীক্ষায় মেয়ে পাশ করলে উনি একদিন বাড়িতে বেড়াতে আসেন। কথায় কথায় ওনাকে তোমার কথা জিজ্ঞেস করলে ওনার মুখ থেকেই সেটা জানতে পারি। তাই তো মেয়েকে আজ বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় বারবার করে বলে দিই যে, সে যেন তোমার ফোন নম্বরটা অবশ্য অবশ্যই চেয়ে একটা কাগজে লিখে আনে এবং কাগজটা আমাকে দেয়। এইভাবে আমি তোমার ফোন নম্বর সংগ্রহ করি।"

"তারমানে মাধবী তোমার মেয়ে!"

"আমার একার নয়, তোমারও।"

"আমারও!"

"হ্যাঁ, তোমারও।"

"কি করে আমারও!"

মালতি ওদের ভালোবাসার ফসল। সুতরাং মালতি তার একার নয়, তারও।

পুলকের মুখ থেকে তখন আপনি বেরিয়ে যায়, "উফ, গড!"

তারপর কারো মুখে কোন কথা নেই কিছুক্ষণ। কিছুক্ষণ বাদে পারুল বলে, "তুমি আজো বিয়ে করোনি?"

"না।"

"করবে না?"

"করবো।"

"কাকে?"

পুলকের মুখ থেকে তখন যে কথাটা বের হয় পারুলের হৃদয় আনন্দে নেচে ওঠে তাতে। যা পঁচিশ বছরে কোনদিন নাচে নি।