সেদিন রাতে
মনামী সরকার
এই রাতটার কথা দীপা হয়তো তার জীবনে কোনদিনও ভুলতে পারবে না। এই রাতের বিভীষিকা
কাটিয়ে ওঠা তার পক্ষে সত্যি খুব কঠিন। দীপার বয়স ত্রিশের কাছাকাছি হবে। দীপা পেশায়
একজন নার্স। দেড় বছরের মেয়ে আর স্বামীকে নিয়ে তাঁর ছোট সংসার। এই করোনাকালে অন্যান্য
যোদ্ধাদের মত সেও প্রতিদিন মৃত্যুভয় কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে লড়ে যাচ্ছে এই ভয়াবহ
পরিস্থিতির সাথে। সেবা করে যাচ্ছে হাজারো অসুস্থ মানুষের। সে জানে যেকোনো মুহূর্তে
সে নিজেও করোনা আক্রান্ত হয়ে যেতে পারে, তার সাথে ওর মেয়ে আর স্বামী। তবু সে স্বার্থপর
হয়নি, যথাযথ নিয়ম-বিধি মেনেই সে দিন রাত সেবা করে যাচ্ছে মুমূর্ষু রোগীদের। বিভিন্ন
ওয়ার্ডেই ঘুরে ঘুরে ওদের ডিউটি পড়তো। এবার দীপার ডিউটি পড়েছে আইসোলেশন ওয়ার্ডে।
এই বিভাগে করোনায় আক্রান্ত ও করোনা আক্রান্ত হয়ে যাদের খুব খারাপ অবস্থা সেই সমস্ত
রোগীরাই ভর্তি থাকে। তাই এই ওয়ার্ডে ডিউটি করার সময় সরকারিভাবেই নার্স, ডাক্তারদের
জন্য আলাদা থাকার ব্যবস্থা করা হয়। এই সময়ে তারা বাড়ি থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকে।
৭ দিনে ডিউটি করার পর প্রত্যেক স্টাফের করোনা পরীক্ষা করা হয় এবং তারপর আরো ৭ দিন
তাদের আইসোলেশন এ রাখা হয়। তারপর তারা নিজের বাড়িতে ফিরে আসে। মোট ১৪ দিন তাদের পরিবার
পরিজন ছেড়ে একলাই থাকতে হয়।
দীপাও আজ ব্যাগপত্র নিয়ে চলে এসেছে। তার দেড় বছরের মেয়ে আর স্বামীকে
ছেড়ে। ওদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে একটা চারতলা ভবনে। বিশাল ভবন কিন্তু এখন ওখানে
ওরা মাত্র চার জনই আছে। আগে যারা ছিল তারা ১৪ দিন কমপ্লিট করে বাড়ি চলে গেছে। আজ দীপা
নতুন একাই এসেছে। ওর সাথে যাদের ডিউটি পড়েছে তারা বেশিরভাগই স্টাফ কোয়ার্টারে থাকে।
একাই থাকে বলে তারা আর ভবনে থাকছে না। দীপার সাতদিন ডিউটি হয়ে গেছে, আজ ওর করোনা টেস্ট
হলো। এখন আরো সাত দিন ওকে আইসোলেশন এ থাকতে হবে। গত সাত দিনে ফোন আর ভিডিও কলিং-ই ছিল
মেয়ে আর স্বামীর সাথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। এভাবে আরো ৫ দিন কাটলো। ওর সাথে ভবনে
আর যে তিনজন ছিল একে একে ওদের সবার ১৪ দিন পূরণ হয়ে গেছে, ওরা যে যার বাড়ি চলে গেছে।
আজ পুরো ভবনে দীপা একা। তাই সকাল থেকে দীপার মনটা বেশ খারাপ, বাড়ি ছেড়ে থাকলেও ওরা
চারজন মিলে এই কটা দিন বেশ হইহই করে কাটাচ্ছিল। দিন গড়িয়ে বিকেল হল দীপার একটু একটু
করে ভয় লাগতে শুরু করলো, এত বড় ভবনে ও একা। ভরসা বলতে এক বয়স্ক চৌকিদার। ওই ভবনের নীচতলার একটা কোণার
ঘরে উনি থাকে। আইসোলেশন বিনা অপরাধে এমন একটা শাস্তি যেখানে চাইলেও কেউ তোমার কাছাকাছি
আসতে পারবে না। না তুমি জনসংযোগে যেতে পারবে। এই নিয়ম-বিধি না মানলে জেনে বুঝেই আপনজনদের
বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া হবে। তাই দীপাও নিরুপায়। যে করেই হোক ওকে একাই এই দুটো দিন
কাটাতে হবে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো। চৌকিদার ভাই দীপা কে ডেকে বলল, দিদি আপনি তাড়াতাড়ি
খেয়ে শুয়ে পড়ুন আমি গেটে তালা দিয়ে দিয়েছি। ভয় পাবেন না আমি নীচেই আছি। আজ যেন
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতটাও তাড়াতাড়ি হয়ে গেল। ন’টার মধ্যে দীপা খাওয়া-দাওয়া শেষ করে
দরজায় ছিটকিনি দিয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু ঘুম কি আর আসে, চারিদিক নিস্তব্ধ
নিঝুম। নিজের নিঃশ্বাসের শব্দ যেন নিজে শুনতে পাচ্ছে। ভবনটা একটু ফাঁকা জায়গায় ছিল,
আশেপাশে সেরকম বাড়িঘর নেই বললেই চলে। সবই একটু দূরে দূরে। তাই নিস্তব্ধতা গাঢ় হয়ে
আসছিল। রাস্তা দিয়ে মাঝে মাঝে দু-একটা গাড়ি চলার শব্দ আসছিল। বিছানায় বসে কিছুক্ষণ
মোবাইলে ভিডিও কলিং এ মেয়ে আর স্বামীর সাথে কথা বললো। তারপর কিছুক্ষণ সোশ্যাল সাইট
গুলোতে ঘুরে বেড়ালো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে এতক্ষণে সবে এগারোটা বেজেছে। রাতটাও
যেন আজকে আর কাটতে চাইছে না। লাইটটা অফ করে এবার ও শুয়ে পড়ল। গা-টা একটু ছমছম করছিল
ঠিকই, নাইট ডিউটি করে আর গত চার মাসে মৃত্যুকে প্রতিনিয়ত সাক্ষাৎ করে ভয়টা যেন আর
সাধারণের থেকে ওর অনেকটা কমে গেছিল। বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছে কিছুতেই ঘুম আর
আসে না। শেষে মোবাইলে একটা সিনেমা চালায়। ওটা দেখতে দেখতেই কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল
দীপা। হঠাৎ একটা বিকট শব্দে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। উঠে বসে মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখল তখন
রাত প্রায় আড়াইটা বাজে। মোবাইলে সময়টা দেখতে দেখতে চার্জ শেষ হয়ে মোবাইলটা অফ হয়ে
গেল। মুহূর্তের মধ্যে চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেল। দীপা ভালই বুঝতে পারছে ভবনের
নিচের তলার ঘরগুলোতে তখন কয়েকজন মিলে ভাঙচুর করছে। ভালো করে কান পেতে শুনে বুঝতে পারলো
শব্দটা ক্রমশ উপরের দিকে উঠে আসছে। ভয়ে বুকটা শুকিয়ে আসছে। মনে, মনে ভাবছে চিৎকার
করবে। কিন্তু কে-ই বা এখানে ওর চিৎকার শুনবে? আস্তে আস্তে সেই ভাঙচুর এর শব্দ আরো কাছে
চলে আসতে থাকে। ও বুঝতে পারে কারা যেন ওর সামনে করিডর দিয়ে হাঁটাচলা করছে। একের পর
এক ঘরগুলোর দরজা লাথি মেরে ভাঙছে। শব্দটা কাছে আস্তে আস্তে একদমই কাছে চলে এলো। হয়তো
বা পরের দরজাটা ওর-ই ছিল, কিন্তু হঠাৎই পুলিশ পেট্রোলিং ভ্যানের শব্দ, ভবনের ভেতরের
ভাঙচুরের শব্দ বন্ধ হয়ে গেল। দীপা আস্তে করে খাটের থেকে নেমে জানলার কাছে গিয়ে দেখল
পুলিশ ভ্যানটা ভবনটার থেকে মাত্র ঢিল ছড়া দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে। ও চিৎকার করে ডাকতে
যাবে ঠিক তখনই ভ্যানটা সামনের দিকে এগিয়ে চলে গেল। রক্ষা পাওয়ার শেষ ভরসাটাও শেষ
হয়ে গেল। বুক ফেটে কান্না আসছে ও দুই হাতে নিজের মুখ চেপে ধরে। পাছে কেউ ওর কান্নার
শব্দ শুনে ফেলে, বুঝতে পারে যে ঘরে কেউ আছে। পুলিশের গাড়ি চলে যাওয়ার শব্দের পর,
ভাঙচুরের শব্দটাও থেমে যায়। কারা যেন ফিসফিস করে কথা বলছে। আস্তে আস্তে সেই শব্দটা
দূরে চলে যেতে থাকে ও চুপ করে এসে খাটে বসে। ঘামে ভিজে গেছে ওর সারা শরীর। হাত-পা গুলো
অসাড় হয়ে গেছে। ওর মাথা আর কোন কাজ করছে না। কোনভাবে খাটের এক কোনায় গিয়ে গুটিসুটি
মেরে অন্ধকারে বসে থাকল। ওখানে বসে থাকতে থাকতেই কখন যেন ওর চোখটা লেগে এসেছিল। হঠাৎ
দরজায় ধাক্কা দেওয়ার শব্দ ও চমকে ওঠে, চোখ খুলে দেখে বাইরে ভোরের আলো ফুটছে। দরজায়
আবার ধাক্কা পারে। দীপা ভয় পেয়ে যায় ও চুপ করে থাকে। এবার দরজার ওপাশ থেকে শুনতে
পায় কেউ বলছে দিদিমণি আমি রামপ্রসাদ দারোয়ান, দরজাটা খুলুন। ভয় পাবেন না ওরা চলে
গেছে। এটা শুনে দীপা মনে হয় প্রাণে একটু জল পেল। আস্তে আস্তে উঠে গিয়ে দরজাটা খুলল।
দেখে সত্যিই দারোয়ান দাঁড়িয়ে আছে। ওর মাথাটা ফেটে গেছে। কপাল গরিয়ে রক্ত পড়ছে।
দীপা তাড়াতাড়ি করে ওর মাথায় ব্যান্ডেজ করে দেয়। দারোয়ান ওকে জানায় গতরাতে ৫ জন
দুষ্কৃতী ঢুকে পড়েছিল ভবনে। ভবনের বেশকিছু সম্পত্তি ওরা লুট করে নিয়ে যায়। বাধা
দিতে গিয়েছিল বলে ওরা ওকে মারধর করে। দারোয়ান বলে দিদিমণি আমি ওদের বলিনি আপনি এখানে
আছেন। বলেছি পুরো ভবনটি ফাঁকা। নইলে ওরা যদি আপনার কোন ক্ষতি করে দিত। তবু মনে মনে
ভয় পাচ্ছিলাম আর ঈশ্বরকে ডাকছিলাম ওরা যেন কোনভাবেই আপনার পর্যন্ত পৌঁছাতে না পারে।
ঈশ্বর আমার কথা রেখেছেন। এতটা সময় অব্দি দীপার একটা ঘোরের মধ্যে কাটছিল। এবার নিজেকে
কিছুটা সামলে নিয়ে ও মোবাইলটা চার্জে দিয়ে বাড়িতে ফোন করলো এবং লোকাল থানায় পুরো
বিষয়টা জানালো। সকাল সাড়ে নটা নাগাদ ওর করোনা টেস্টের রিপোর্ট এলো। রিপোর্ট নেগেটিভ।
ওর স্বামী সঙ্গে করে ওকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলো। তারপর বহু রাত কেটে গেছে দীপা দু'চোখের
পাতা এক করতে পারেনি। ওই রাতের বিভীষিকা ওকে তাড়া করে বেড়াতো। করোনার মতো ভয়াবহ
মারণ রোগের বিরুদ্ধে নির্ভীকভাবে লড়াই করে চলেছে যেই মেয়েটা, মানুষের তৈরি সন্ত্রাস
তাকে ভেতর থেকে একেবারে ভেঙে দিয়েছিল।
0 comments:
Post a Comment