Nov 6, 2020

"রহস্যময়ী ডাউহীল" - সৌমেন ভাদুড়ী

Edit Posted by with No comments

রহস্যময়ী ডাউহীল

সৌমেন ভাদুড়ী

 

আজ আমি নিয়ে যাবো এক ঐতিহাসিক পাহাড়ে, যা পৃথিবী বিখ্যাত ভৌতিক ঘটনার জন্য।

সালটা ১৮৭০ এর আশেপাশে হবে, ইংরেজ শাসকরা নব্য ক্রিশ্চানদের দলে দলে নিয়ে আসছে আশপাশের থেকে, আসানসোলে। সেখানে ওনারা প্রতিষ্ঠা করেছেন ইন্ডিয়ান থিয়লজিক্যাল সোসাইটি যার কাজ নব্য খৃষ্টদের পাদ্রী বানানো (নানটা সঠিক কিনা জানিনা)।

এই সময়েই বাংলায় ব্রাহ্ম সমাজের খুব বোলবালা। ১৮৭৮ সালে নব্য ব্রাহ্ম কেশব সেনের মেয়ে সুনীতিদেবীর সহিত কোচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণের বিবাহ হয়। কোচবিহারের রাজাদের নিকটবর্ত্তী পর্বতে অনেক জায়গা জমি ছিল।

ব্রাহ্ম সমাজের সহিত তদানীন্তন ব্রিটিশ সাহেবদের সখ্যতাও বেশ ভালোই ছিলো।

এই যোগাযোগের ফলস্বরুপ ইন্ডিয়ান থিওলজিকাল সোসাইটি পাহাড়ে লোকচক্ষুর আড়ালে গিয়ে সেন্ট মেরীস সেমেটারি তৈরি করেন এবং সেখানে দর্শনার্থীদের ভ্রমণে নিসেধাজ্ঞা জারি করেন, যা আজও বলবৎ।

আর ওদিকে বাংলার তদানীন্তন লে.গভঃ এসল্যে ইডেন সেন্ট মেরীর কাছেই ভিক্টোরিয়া স্কুল খোলেন। প্রথমে তার উদ্দেশ্য এক হলেও পরবর্তীতে পাল্টে যায়।

যাইহোক এই ঘটনার প্রায় ১৩৫ বছর পরে আমি আমার সহকর্মীদের নিয়ে কলেজের কাজের পরে এক বাল্যবন্ধুর আমন্ত্রণে ওই পান্ডব বর্জিত (টুরিস্ট এলাউড না) রেঞ্জার্স কলেজে (সেন্ট মেরীর বর্তমান নাম) নিশিযাপনের উদ্দেশ্যে পৌছাই। ঘন পাইন বা স্থানীয় ধূপী গাছে ঘেরা এই সুপ্রাচীন ব্রিটিশ স্থাপত্য ও মুহুর্মুহ মেঘের আনাগোনা আমাদের মতো শহুরে সমতলের লোকেদের মোহিত করে তোলে। বিকেলের আলোয় পাহাড়ের ঠান্ডা পরিবেশের সাথে নিজেদের মানিয়ে নিতে নিতে আমরা ব্রিটিশদের তৈরি করা শতাব্দী প্রাচীন গথিক নির্মাণশৈলী বিষ্ময়ের সাথে ঘুরে দেখার সাথে সাথে প্রাচীন ইতিহাস ও রহস্যের সাথেও পরিচিত হবার সুযোগ পেলাম ওখানকার এক খ্রিষ্টান কর্মচারী ও বাল্যবন্ধুর মাধ্যমে। তবে প্রচন্ড জোঁকের উপদ্রবে আমরা সন্ধ্যা নামার আগেই মূল বিল্ডিংয়ে প্রবেশ করি এবং জানতে পারি সেখানেই আমাদের রাত্রিবাস করতে হবে, এতে আমার সহকর্মীরা ভীত হলেও আমি মনে মনে আনন্দিত হয়ে উঠি।

সবাই চারিদিক ঘুরে দেখার সময়ে জানতে পারে যে ক্যান্টিনে যারা খাবার বানাবেন তা তারা আগেই বানিয়ে ক্যাসারোলে করে ডাইনিং টেবিলে রেখে যাবেন। আর ওনারা বিকালের পরে তেঁনাদের ভয়ে কেউ ওখানে থাকেন না। শুনেই আমার সাথীরা নিজ নিজ ঘরের অন্তরালে গিয়ে সুরা মৌতাতে এই আধিভৌতিক পরিবেশ থেকে নিজেদের সাবধানে সরিয়ে নেয়।

কিন্তু আমার উদ্দেশ্য একদম আলাদা, অবশ্য সাথে পেলাম সেই খ্রিষ্টান কর্মচারী জোসেফকে। ততক্ষণে আমার বাল্যবন্ধু আমার সাথীদের সাথে গিয়ে ভিড়েছে।

এবার আমি জোসেফকে নিয়ে এই শতাব্দী প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাসের অনুসন্ধানে বের হলাম বিল্ডিংয়ের ভিতরেই, সাথে অফুরন্ত ভৌতিক ঘটনার বিবরণ। তবে সবচেয়ে যেটা অবাক করা ব্যাপার জানলাম আজ থেকে প্রায় ১৫০ বছর আগে ব্রিটিশ ফাদাররা নিজেদের বিদ্যুতের প্রয়োজন মেটানোর জন্য একটি ছোট জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ওখানে বসিয়েছিলেন, ভারতবর্ষে সম্ভবত প্রথম, যদিও তার সব চিহ্ন কোন অজানা কারণে বর্তমান মেঝের নীচে মোটা সিমেন্টের চাদরে ঢাকা।

এই সময় আমি উনাকে পটিয়ে মূল বিল্ডিংয়ের বাইরে নিয়ে আসি। জানতে পারি, যে সমস্ত খ্রিষ্টানরা ফাদার হওয়ার কঠোর পরিশ্রম করতে পারতো না তাদের কিভাবে তিলে তিলে শেষ করে দেওয়া হতো। যদিও আজ সেগুলো সব পুরু সিমেন্টের চাদরে ঢাকা। হয়তো বা সেই অতৃপ্ত আত্মারাই এই ডাউ-হিলের আতঙ্ক।

এর পরে আমরা আবার ফিরে আসি ডিনারের জন্য। সবাইকে ডেকে নিয়ে ক্যান্টিনে খেতে যাই। এতো সুন্দর রান্না, কিন্তু ভয়ে কেউ ভালো করে খেলোই না, তার কারণ আমার এক সহকর্মীর ক্যামেরায় এক মনুষ্যাবয়বের কারো ছবি ধরা পড়ে, যা আমরা অনেকেই দেখেছি। কিন্তু ক্যান্টিনের টেবিলের ওখানে কেউ ছিল না আর সেটা দেখার জন্য যখন আবার ক্যামেরাটা অন করা হয়, সেখানেও না, অত্যন্ত রহস্যজনক।

এবার আমি আর জোসেফ মিলে আমার বাল্যবন্ধুকে তার কোয়ার্টার এ ছেড়ে আসার কথা বললাম, কিন্তু আমার সহকর্মীরা একা থাকার ভয়ে জোসেফকে ছাড়তে ভরসা পাচ্ছিল না। কিন্তু আমি একা ফিরব বলে ওরা জোসেফকে এলাউ করলো। তখন রাত প্রায় ৯টা বাজে, পাহাড়ে কিন্তু মনে হবে মধ্যরাত।

বন্ধুকে তার কোয়ার্টারে ছেড়ে দেওয়ার পরে জোসেফ আমাকে সামনের এক জঙ্গল দেখিয়ে বললো, এটাই কুখ্যাত ডাউহিল ফরেষ্ট, এই রাস্তায় কিছুটা গেলেই ভিক্টোরিয়া স্কুল, যদি জোঁকের ভয় না পান তো চলুন ঘুরে আসি। তার বিশ্বাসে আমি যেহেতু সিংহ রাশির লোক তাই আমার দেখার সম্ভাবনা খুবই কম। বন জঙ্গলের পথে আমরা ঘন্টাখানেক ঘুরলাম কবন্ধকাটা বা নেপালীবুড়ী দেখার জন্য। কিন্তু আমি সমতলের মানুষ, দম কমে যাওয়ায় আর সিংহ রাশির খটকার জন্য জোসেফকে বললাম চলো ফিরে যাই, তোমাকেও ঘুমাতে হবে।

কলেজে ফিরে আসার পরে দেখি সবাই দরজা লাগিয়ে ঘুমাচ্ছে। জুনিয়রদের রুমে ধাক্কা দিয়ে ওদের জাগালাম, ওরা বললো কোথায় গেছিলে, আমি বললাম বাথরুমে, পেটটা প্রব্লেম দিচ্ছে দরজাটা খালি ভেজিয়ে রাখলেই হবে, আধা ঘুমে হ্যাঁ বলেই তারা আবার ঘুমিয়ে পড়ল।

আর এদিকে আমি দুপেগ হাল্কা করে বানিয়ে ক্যামেরা নিয়ে খালি পায়ে বিল্ডিংয়ের ভিতরে ঘুরতে বেড়ালাম, রাত তখন প্রায় ২টো। খালি পায়ে নিশব্দে আমি প্রায় ভোর ৪টা পর্যন্ত তেনাদের খুঁজে বেড়ালাম। ক্লান্ত হয়ে এসে শুয়ে পড়লাম কারণ রাত পাতলা হওয়ার সময় হয়ে আসছে।

পরের দিন আরো অনেক কিছু দিনের আলোয় দেখে কুয়াশের চারা নিয়ে দুপুরের মধ্যেই শিলিগুড়ি ফিরে এলাম।

তবে ভূত বা ভৌতিক বা পরাবাস্তবতা যাই বলুন না কেনো, আমার যা মনে হয়েছে সেটাই আপনাদের কাছে জানাতে চাই। পাহাড়ের মানুষ বিকাল ৪/৫ কেই রাত্রি মনে করে শুয়ে পড়ে, তার উপরে ভৌতিক পরিবেশ আর সেই নিশব্দ পাহাড়ে হাওয়ার ঘনত্বের কারণে বহু দূরের শব্দকেও কাছের মনে হয়। এর আর একটা কারণ বলি বিল্ডিংয়ে মধ্যরাতে কাঠের মেঝেতে খালি পায়ে যখন হাটছিলাম তখন অনেক রকম শব্দ শোনা যাচ্ছিল, এমনকি নিজের টিপে টিপে চলা পায়ের শব্দতেও মাঝে মাঝে চমকে উঠছিলাম। তাই আমার মনে হয় এই নৈশব্দের নিস্তব্ধতাই এক পরাবাস্তবতার জন্ম দেয়, তাকেই আমরা সরল ভাষায় ভূত বলি। অবশ্য আর একটা কারণও আমার মনে হয়েছে, তা হলো ওখানকার শতাব্দী প্রাচীন দুর্মূল্য বইগুলি, ওগুলো পাচারের জন্যও মানুষের তৈরী কোন মানুষ ভূত থাকলেও থাকতে পারে।



ছবি- সৌজন্যে লেখক

0 comments:

Post a Comment