Nov 7, 2020

"এক চিলতে রোদ" - রাজর্ষি পাল

Edit Posted by with No comments

 


এক চিলতে রোদ

রাজর্ষি পাল

কাঁচের ওপার থেকে দুপুরের তীব্র রোদের থাবা টেবিলের প্রায় পুরোটাই উত্তপ্ত করে তুলেছে। ঘন্টাখানেক হবে, বৃষ্টিটা থেমেছে। অঝোর বর্ষার পর, তাই রোদের এই থাবা টা মোলায়েম পরশের মতন লাগছে। বুধবার কাজের দিন বলেই, ক্যাফেতে ভিড় কম। নেই বললেই চলে। শেষের ডান দিকের কোনায় এক তরুণী বসে। বোধহয় কলেজ ফেরতা। সাথে bag, মোবাইলে নিমগ্ন। কারোর অপেক্ষারত হবে। কাউন্টারের গাঁ ঘেঁষা টেবিলটায় এক মাঝবয়সী couple, শপিং থেকে ফিরছে বোধহয়। ঘড়ির কাঁটা বলছে বেলা দেড় টা। পনেরো মিনিট হবে espresso এর order টা নিয়ে গেছে। ফাঁকা cafe, তবুও এখনো দিয়ে যায়নি। ওরাও অবসরের আমেজ নিতে ব্যস্ত বোধহয়। রোদটা ধিরে ধিরে পুরো টেবিল টাই গ্রাস করতে চাইছে। একটু একটু করে এগোচ্ছে পুরবীর দিকে। ক্যাফে এর চারিদিক কাঁচে মোড়া, তবুও বৃষ্টির পরের সোঁদা গন্ধটা কোনো ফাঁক দিয়ে গলে ঢুকে গেছে ঠিক। পূরবী রাস্তার গাঁ ঘেঁষা টেবিল এই বসে প্রতিবার। বাইরে দেখতে পায় কিভাবে অসংখ্য রক্ত মাংসের দলা এই মানুষগুলো ছুটে চলেছে সব না পাওয়া, ব্যর্থতা, তিরস্কার, অপমান এসব ঢোক গিলে, একটু শান্তির আশায়। কুকুরের লেজের মতন। বারবার বিফল হয়েও, সেই ছুটেই চলেছে মানুষ। এক মরীচিকার হাতছানি তে। কাঁচে এখনো যে জলের ফোঁটা গড়াচ্ছে, আর তার ওপর সদ্য মেঘের আড়াল হতে উকি দেওয়া রোদ এক অদ্ভুত মায়ার প্রতিফলন তৈরি করেছে। ac এর শোঁ শোঁ আওয়াজ টা কানে খুব লাগলেও, এই নিস্তব্ধ পরিবেশে যেন ছুটির ঘন্টার মতন লাগছে পুরবীর। নিজের ভাবনাই যে কিছু মানুষের সবচেয়ে বড় দুঃসহ যন্ত্রনা হতে পারে, তা পুরবীর চেয়ে ভালো আর কেউ জানেনা।

মোবাইল বের করে একবার দেখল পূরবী,

রঞ্জিতদার কোনো message এলো কিনা। এতো দেরি কখনো করেনা রঞ্জিতদা। কলেজে সবার আগে উনিই ঢোকেন। কোনো ক্লাসে দেরি করে পৌঁছোন না। আর সেই মানুষ আজ এক ঘন্টা হল পাত্তা নেই। যদিও বৃষ্টির মধ্যে পুরবীরও দেরি হয়েছে আসতে। শুক্রবার দুপুরের ফ্লাইট এর কথাটা এখনো জানায়নি রঞ্জিতদা কে। চার দিন হলো কলেজে আসছেন না, বাড়িতে কাজ আছে বলে।

বছরে sick leave ছাড়া আর কোনো ছুটি না নেওয়া মানুষটার যে কি এমন কাজ কে জানে। এবার সত্যিই বিরক্তি ধরছে পুরবীর। একবার ফোনও করেছিল সে, ধরেন নি।

"Mam, আপনার espresso, আর কিছু অর্ডার করবেন।"

সামনে tray তে সাজানো কফি mug থেকে উঠে আসে স্বর্গীয় ধোঁয়াটা শরীরে ঢুকতেই, একটু যেন বিরক্তি কাটল পুরবীর।

"না। আর কিছু লাগবে না। thank you।"

কফি mug টা হাতে নিয়ে বড়ো একটা চুমুক দিল পূরবী। তার বহু একলা সন্ধ্যার, নির্জন দুপুরের সাথী এই কফি। শেষবারের মতন উপভোগ করতে চাইল পূরবী। ইচ্ছে হলো কানে কানে জানাতে, যে নতুন এক শুরুর হাতছানি তে সে এবার পাড়ি দেবে। হয়তো সেখানেও কোনো একলা বিকেলে, আবার সাথী হবে এই কফি।

ধরাম করে একটা আওয়াজ হলো দরজায়। তাকিয়েই দেখে, রঞ্জিতদা ঢুকছে। ভেতরে ঢুকে পড়েছেন ছাতা নিয়েই, তাই দেখে কাউন্টার এর লোক ক্ষেপে গেছে। কোনো মতে ছাতাটা বন্ধ করল রঞ্জিতদা। পূরবী দূর হতে হাতের ইশারায় ডাক দিল রঞ্জিতদা কে। যদিও উনি জানেন যে পূরবী কোথায় বসে। আধ ভেজা জামা আর প্যান্ট পরেও মুখে সেই হাসিটা লেগেই আছে তার।

"আর বৃষ্টিতে দেরী হয়ে গেল রে। আরেকটা কাজ ছিল, সেটায় সময় লেগে গেল।"

পূরবী খেয়াল করল রঞ্জিতদা যেন একটু পাল্টে গেছে। দাড়ি কাটেনি সপ্তাহ খানেক হবে। চুল ও আচড়াননি ঠিক মতন। জামার হাতা, গোটানো অসমান ভাবে। জামায় দাগ দেখে মনে হচ্ছে দু তিন দিন ধরে পড়ছেন।

"আপনি ঠিক আছেন তো রঞ্জিত দা? বৌদি ভালো আছে তো?"

-আমার আবার নতুন করে কি হবে। আর তোর বৌদি ও আছে ওই ভালো। তা হঠাৎ এখানে আসতে বললি যে?

-আমি কই বললাম। আপনিই তো বললেন যে কলেজে কবে যাব ঠিক নেই। বাইরে বলিস কি বলবি। তাই তো বললাম এখানে আসতে।

-তা ঠিক। তা তোর সেই ইন্টারভিউ এর রেজাল্ট এলো কি? Fellowship টা পাক্কা তাহলে next year

-ওটাই বলার ছিল রঞ্জিতদা তোমায়। আসলে ওরা full fellowship grant সাথে faculty position ও অফার করেছে। তুমি তো জানোই আমি এই শহরের গোলকধাঁধায় আর থাকতে চাইনা। তাই হ্যাঁ করে দিয়েছি। সোমবার joining পরশু flight book করেছি। আমি আর পাখি যাবো। মা পরে যাবে।

বৃষ্টির ধারা আবার জোরে বইতে শুরু করেছে।

কাঁচের ওপর ফোঁটা গুলোর ভিড় বাড়ছে। বাইরের কিছুই আর দেখা যাচ্ছে না। shopping ফেরত সেই couple বেরিয়ে গিয়েছে কিছুক্ষন হলো। দূরের মেয়েটা এখনো মোবাইলে নিমগ্ন। মেঘের কম্বল জড়িয়ে রোদ বোধহয় আবার ঘুম দিয়েছে। বাইরের রোদ আর পড়ছে না টেবিলে। একটা আলো আঁধারির খেলা যেন চলছে ক্যাফের ভেতরে। খয়েরি রঙের দেওয়ালে হলুদ বাল্ব এর আলো যেন গোধূলির সময়ে দিগন্তের রাঙা আকাশ মনে করাচ্ছে।

পূরবী দেখল রঞ্জিতদা হাতটা টেবিলের ওপর থেকে নামিয়ে নীচে রাখলেন। কিছুক্ষণ মুখটা নীচু করে টেবিলের পায়ার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর কাঁচের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষন। পূরবী কি বলবে বুঝে উঠতে পারলো না। রঞ্জিতদার কোনো কিছুই সে কোনোদিন বুঝে উঠতে পারেনি। কষ্ট পাবেন তার চলে যাওয়ার কথা শুনে, এটা সে জানত, কিন্তু এভাবে এক মিথ্যা প্রহেলিকায় কতদিন বাঁচবে সে। একবার ভাবলো রঞ্জিতদার হাতটা ধরে ক্ষমা চেয়ে নেবে। কিন্তু না, তাকে তো যেতে হতই, আজ বা কাল।

-ওঃ। তুই যাচ্ছিস? ভালো কথা তো। আমি ভাবলাম আরো জরুরি কিছু। এটা ফোনে বললেই পারতিস।

শুধু শুধু ভেজালি। তা এসেই যখন গেছি, এক কাপ কফি খাওয়া।

রঞ্জিতদার কথা শুনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো পূরবী। ভাগ্গিস কোনো scene তৈরি করেনি। বরাবরই খুব emotional মানুষ উনি। যাই হোক, তার জন্য irish অর্ডার করল পূরবী। এই irish কফি হাতে নিয়ে প্রতিবার রঞ্জিতদা তার কথার ঝাঁপি খুলতেন, আর সেই ঝাঁপি তে প্রতিবার হারিয়ে যেত পূরবী,

তার বুকে জমে জমে পাথর হওয়া কান্নাগুলো সেই ঝাঁপির উষ্ণ আমেজে কখন যে গলে যেত টেরই পেতনা সে নিজেও।

-পাখি যে যাবে, adjust করতে পারবে ওখানে? একটু তাড়াহুড়ো করছিস না তো?

-তুমিই না বলতে রঞ্জিতদা, যে আমরা তো কিছুই শিখে জন্মাইনা। adjust টাও শিখতে হয়। পাখিও শিখবে। আর সত্যি বলতে এই শহরে দমবন্ধ হয়ে আসে আমার। তুমি ছাড়া আর কারোর সাথে সেরম যোগাযোগ ও রাখিনা। কিন্তু এভাবে কতদিন বাঁচবো বলো। একটা নতুন শুরু করতে চাই।

-হ্যাঁ সেই ভালো। তোর এতো ভালো academic qualifications। ভালো একটা জায়গা তুই deserve করিস। তবে দেখিস হারিয়ে ফেলিস না ভিড়ে নিজেকে।

বর্ষার তীব্রতাটা কমে এসেছে আবার। বাইরে চেয়ে রয়েছেন রঞ্জিতদা। কষ্ট যে পুরবীর হচ্ছেনা তা নয়। বিগত তিরিশ বছরে, একমাত্র এই মানুষটাই তার থেকে পরিবর্তে কিছুই চায়নি। অনিকেতের সাথে divorce টা ফাইনাল হতে যখন কলেজে ঢুকেছিল তখন ভেবেছিল সব আবার নতুন করে সাজাবে। কিন্তু না, ওতো সোজা নয়। ঘর পাল্টানোর মতো মন পাল্টানো যে ওতো সহজে যায়না তখন বুঝেছিল। আরো গুটিয়ে গিয়েছিল ভেতরে দিন দিন। রঞ্জিতদা একমাত্র তার কষ্টটা বুঝতে পারতেন। কান্নাহীন চোঁখের জলটা যেন হাত না লাগিয়েই মুছিয়ে দিতেন। পারতেন বোধহয় কারণ নিজেও যে ভাবে বারবার ভেঙে গিয়েও উঠেছেন, সেটা ওনার মতন নরম মানুষ বলেই পেরেছেন।যারা সহজে আঘাত পায়,তারাই আবার সহজে উঠে দাঁড়ায়।পাথরে আঘাতের দাগ সহজে মেটে না আর মাটির দাগ বারবার তৈরি হয়,আবার মুছেও যায়।

-মা কেও নিয়ে যাবি বললি।আর কি তাহলে ফিরবি না?

-জানিনা।কোনোদিন ছেড়ে যাব এ শহর,সেটাও তো ভাবিনি।আজ খুশি হয়েই যাচ্ছি।তবে ওখানেও একই ভাবে তিরষ্কৃত হলে ফিরে আসবো। এখানে অন্তত তুমি তো আছ।

-আর আমার কথা।আকাশের বুকে যেমন মেঘ বয়ে যায়,মানুষের জীবনেও তেমন চরিত্রের পর চরিত্র আসে।ছাড় এসব,বাকি সব গোছানো শেষ তোর?

-তা প্রায় শেষ।তবে যা একদম না নিলেই নয়,সেসব ই নিচ্ছি।পুরোনো কিছুই আর বইতে চাইনা।হাল্কা হতে চাই।শুধু তোমার দেওয়া বইগুলি সাথে নিয়ে যাচ্ছি।অবসরে পড়ব।

-তা বেশ।মাটির টান ধরে রাখা ভালো।তবে ওখানে আবার সেই আগের মতন নিজের মনটাকে আবর্জনার স্তুপ করে তুলিসনা যেন।ওসব বাজে খেয়াল আর মনে আস্তে দিসনা।

-তুমি ছিলে বলেই সামলাতে পেরেছিলাম নিজেকে। এবার আর হয়তো তোমায় হাত ধরতে হবেনা। আর যদি হয়ও, আমি জানি,তোমায় না চাইতেই কাছে পাবো।

কথা গুলো বললো খুবই সাবলীল ভাবে পূরবী।যেন কোনো এক পুরোনো বন্ধুর সাথে বিচ্ছেদের আগের নিয়মমাফিক স্তুতিপর্ব।কিন্তু সেটা যে নয়,গোলায় জমে থাকা চাপা কান্না বুঝিয়ে দিলো পূরবী কে।রঞ্জিতদা যে শুধু তার সহকর্মী,সহমর্মী বা শুভকাঙ্খী তা তো নয়,উনি তার জীবনে যেন একটা সূর্য। অত্যাচার অবহেলা এর বিষধারায় নিজেকে হারাতে হারাতে,তাকে বাঁচিয়েছেন উনি।

-এবার তাহলে আমার হাতে অনেক সময়।আর ঘাটে গিয়েও বসবো না,বা পার্কে গিয়েও ধর্ণা দেবনা।উফফ,বাঁচালি তুই আমায়।

"Sir, আপনার কফি।"

গরম irish কফি টা হাতে নিয়ে এক বড়ো চুমুক দিলেন রঞ্জিতদা।একদৃষ্টি টে চেয়ে রইলো পূরবী।বুঝতে চাইলো গভীর ওই কালো দুই চোখের তল কোথায়।এভাবেই কফি তে বড়ো চুমুক দিয়ে কথা শুরু করতেন,আর শুধু শুনেই যেত পূরবী।কারোর কথা শুনেও যে এতো নেশা হয় তা আগে কখনো বোঝেনি সে। সত্যি সেই বিকেল গুলো বড্ড মনে পড়বে তার।সেই একলা বিকেল গুলো,যখন নির্জন ঘাটের এক কোণে বসে,রঞ্জিতদা তাকে কবিতা পড়ে শোনাতেন। বিকেলের ক্লান্ত হাওয়া জলের ওপরে যেন এক পায়েলের মুর্চ্ছনার মতন আওয়াজ সৃষ্টি করতে। গাছের পাতা গুলো যেন সেই কবিতা শুনে নড়ে উঠতো।

-এমন ভাবে বলছো যেন আমি জোর করতাম তোমায়।আমি কতবার বলেছি ওসব আমি বুঝিনা।সত্যি বলতে আমি আজও বুঝিনা তোমার সব।

-আর বুঝে কাজ নেই।নতুন জায়গায় যাচ্ছিস।এবার একটু নিজেকে নিয়ে স্বার্থপর হওয়া শেখ।

খালি কফি mug টা সরিয়ে রেখে,ওঠার জন্য তৈরি হলেন রঞ্জিতদা। মনে মনে একটু রাগ হলো পুরবীর। সে চলে যাবে পরশু। আর কবে দেখা হবে ঠিক নেই, অথচ রঞ্জিতদার যেন কোনো উত্তাপ নেই।  এখান থেকে বেরোতে পারলে বাঁচেন। অন্যদিন কথাই ফুরায়না তার,আর আজকে যেন তাকাতেও চাইছেন না তার দিকে।

-কিরে ওঠ।যাবিনা?চল,তোকে উঠিয়ে দিয়ে আসি বাসে।আমার একটু অন্য কাজ আছে।দেরি হবে ফিরতে বাড়ি।

কিছুটা রাগ নিয়েই মানা করল পূরবী।বললো তারও কিছু কাজ আছে।একটু পরে বেরোবে। ভেবেছিল হয়তো তার অভিমান টা বুঝবেন রঞ্জিতদা।হেসে হয়তো আবার বসবেন।কিন্তু না। "তাহলে বস,আমি বেরোলাম।" বলে চলে গেলেন। নিজেকে প্রতাড়িত মনে হতে লাগলো পুরবীর। নিথর ভাবে চেয়ে রইলো দরজাটার দিকে। জানলার দিকে তাকিয়ে চোঁখের কোনার জলটুকু ঢাকার চেষ্টা করল।সে হয়তো থেকে যেতনা,কিন্তু একবারও কি রঞ্জিতদা বলতে পারতোনা তাকে থেকে যাওয়ার কথা।এতটা পাথর কৰে কিভাবে হলো মানুষটা। নাকি নিজের কষ্ট টা কঠিন বাস্তবের মোড়কে লুকিয়ে রাখলেন। এ শহর তাকে শেষ অবধি ও আঘাত দিতে ছাড়লোনা।

ভিসিটিং hours বিকেল 5টা অব্দি। ক্যাফে থেকে বেরোনোর সময়, বাজছিল 2টো। রঞ্জিত একাই auto রিজার্ভ করল, নয়তো visiting hours পার হয়ে যাবে। ইঞ্জেকশন টা খুঁজতে অনেক দেরি হয়ে গেল। প্রায় 10টা দোকানে খুঁজে তারপর পেল। বাকি ওষুধ সকালেই নিয়ে নিয়েছিল সব, জানত পুরবীর সাথে সময় লাগবে।

Auto এসে থামল নার্সিং হোমের গেটের একদম মুখে।ভেতরে যাবেনা আর।50টাকার নোট টা বাড়িয়ে দিয়ে দৌড়ালো গেটের দিকে রঞ্জিত।বাকি টাকা ফেরত নেওয়ার সময় নেই।reception কাউন্টারে নাম লিখিয়ে লিফ্টের দিকে এগোলো।বর্ষার তোড়ে গরমটা কমেছে।তবুও হেটে হেটে এতগুলো ওষুধের দোকানে ঘুরে,ঘামে ভিজে গিয়েছে জামা,তবুও ভ্রুক্ষেপ নেই রঞ্জিতের। লিফ্ট ঢুকে একবার পকেটে হাত দিলো, রুমাল টা খোঁজার জন্য।কিন্তু না,আজ সেটাও ভুলে গেছে। ডুবতে চলা জাহাজের মতন,তার জীবনের সবকিছুই যেন দূরে চলে যাচ্ছে।চোখ বন্ধ করল রঞ্জিত।একরাশ বিরক্তি আর নিজের প্রতি তীব্র ধিক্কার ঘনিয়ে উঠল তার মনে।এইটুকু অব্দি তার মনে নেই।নীলিমা বলেছিল আজ আসার সময় কাগজে করে কয়েকগাছা কৃষ্ণচূড়া নিয়ে আসতে। বাড়ির সামনের ছোট্ট একচিলতে জায়গাটা যেন নিজের সংসারের মতোই গুছিয়েছিল নীলিমা। ছারখার হওয়া জীবন টার অপূর্ণতা ওই গুটিকয়েক গাছের মধ্যে দিয়ে পূরণ করেছিল সে।তার বড়ই সাধের এই কৃষ্ণচূড়া। বলেছিল কাগজে মুড়িয়ে বালিশের পাশে রেখে সবে।কিন্তু সেটাও মনে নেই রঞ্জিতের। নিজের প্রতি এক ভয়ংকর রাগ অনুভব হলো তার। কোনো সুখ শান্তি দিতে পারেনি নিষ্পাপ মেয়েটাকে সারাজীবন,এই টুকু শেষ আবদার ও মেটাতে পারলোনা তার।আসলে কাল বিকেলে পুরবীর ফোনটা পাওয়ার পর থেকেই অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল।অদ্ভুত ভাবে ছটফট করছিল ক্যাফে তে আসার জন্য। লিফ্টর দরজা খুলতে চোখ মেলে তাকালো রঞ্জিত। কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল।

জানালার একপাশ খোলা। ভেতরে বৃষ্টির জলের ঝাপটা ঢুকে ভিজিয়ে দিয়েছে দেওয়ালের খানিকটা।ওপরের কার্নিশ বেয়ে ছাদ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে এক অদ্ভুত শান্ত সুর করে,যেন দূরে কেউ বাঁশি বাজাচ্ছে। ৫*৪ এর ঘরের পশ্চিম কোনে এক চিলতে জানলা। আর পূর্বদিকের দেওয়াল ঘেঁষে, বেদে শুয়ে আছে নীলিমা। দেওয়ালের দিকে মুখ করে শুয়েছে।রঞ্জিত ঢুকলেও,টের পায়নি বোধহয়। শীতল হাওয়ার পরশ ছোট্ট রুমটার দেওয়ালে যেন খেলা করছে। বৃষ্টির জন্য বোধহয় একটু ঘুমোতে পেরেছে নীলিমা। জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো একবার রঞ্জিত। পরিষ্কার আকাশের বুকে ছবির মতো কিছু মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে, আর তার আড়াল হতে মিঠে রোদ যেন তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। নীচে বারিস্নাত জনারণ্যে একবার তাকালো রঞ্জিত। খুঁজতে চাইল নিজের মতোই কাওকে,আসন্ন ঝড় যার শেষ খড়কুটোটাকেও উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। বেডের পাশের টেবিলটায় ওষুধ আর ইঞ্জেকশনটা রেখে নীলিমার পাশে বসল। টেবিলের ওপর অঙ্কুরের শেষ জন্মদিনে তোলা ছবিটা রাখা। ওদের জীবনের বাগানের একমাত্র ফুল টা হারিয়ে যাওয়ার শোক কোনোদিনই কাটিয়ে উঠতে পারেনি নীলিমা। accident এর খবর টা যেদিন এলো, সেদিন সে বাইরে গিয়েছিল। কনফারেন্স attend করতে।যখন ফিরে এলো,তার ফেলে যাওয়া জীবনটা তছনছ হয়ে গেছে। অঙ্কুরের বিরহ বেদনা সহ্য করতে পারলেও, যেভাবে নীলিমা এক অন্ধকার অতলে হারিয়ে ফেলছিল নিজেকে তা সহ্য করতে পারেনি সে। ছবিটার হাতে নিয়ে একবার মুছল রঞ্জিত। অঙ্কুরের মুখটাও আর তার ভালোমতো মনে পড়েনা। আট বছর হতে চলল সেই অভিশপ্ত দিনের। নিজেকেই সে দায়ী মনে করে তার জীবনের এই পরিণতির জন্য। নিজের জীবন, নিজের শিক্ষকতা,নিজের ভালো লাগা এসব নিয়েই থেকেছে চিরকাল। বড়ই স্বার্থপরের মতন কাটিয়েছে জীবনটা। নিজের প্রয়োজনই সবার আগে রেখেছে বরাবর। নীলিমা কে বিয়ের পর হতেই বড্ড অবহেলা করেছে সে। কখনো এই মেয়েটাকে বুঝতে চাইনি, কখনো কাছেও টেনে নেয়নি। তবুও মেয়েটা কোনোদিন কিছুই চাইনি। আর যখন চাইল, হতভাগ্য সে সেটাও এনে দিতে পারলো না তাকে। অঙ্কুরের মৃত্যু যেন তাকে আরো জোরে ধাবিত করল নিজের দুনিয়ার দিকে। ঘরের এক কোনে নীলিমা তার অন্ধকার মনের অতলে যে কিভাবে বেঁচে ছিল, এসবের খোঁজ কোনোদিন নিতে যায়নি সে।ভাবতো সেও তো ব্যাথায় কাতরাচ্ছে,আবার নিজেই সামলেছে নিজেকে,তাহলে নিলিমাও পারবে।

ফটোটা রেখে,নীলিমার দিকে ঘুরে বসল। আওয়াজে বোধহয় ঘুম ভাঙল এবার নীলিমার। আস্তে করে ফিরে তাকালো। চোখ দুটো ফ্যাকাশে হয়ে এসেছে, চোখের পাতা খোলা রাখাটাও যেন দুঃসহ মনে হচ্ছে।

"ও। তুমি এসছো। কখন এলে? টের পেলাম না তো।"

-এই তো এখনই এলাম। তুমি একটু ঘুমাচ্ছিল দেখলাম।তাই ডাকিনি।

-ও। অনেকদিন পর চোখটা লেগে এলো একটু তাই। এনেছো ফুলটা।

রঞ্জিত কিভাবে বলবে যে সে তার এই তুচ্ছ আবদার টাও রাখতে পারেনি, বুঝে উঠতে পারলোনা।কিছুক্ষন চেয়ে রইলো মেঝের দিকে।

-কাল এনে দেব তোমায়।

নীলিমার চোঁখের দিকে তাকাবার সাহস টুকু নেই আর তার। আবার পাশ ফিরে শুল নীলিমা।

-একটু কথা বলে নিও নীচে।কিছু একটা বলছিল ওরা।দেরি করলে আজ আসতে?

-ওই একটু কাজে আটকে গেছিলাম। কলেজের একটা ব্যাপারে। কি বলছিল ডাক্তার?

-জানিনা। তুমি শুনে নিও। কালকে কখন operation করবে এসব নিয়ে কিছু হবে।

-আচ্ছা।তুমি ঘুমও।আমি আছি।

নীলিমা পাশ ফেরাতে কিছুটা সহজ হলো রঞ্জিত। অপরাধীর চোখ নিয়ে কি করে তাকাবে ওর দিকে। সে চাইলেই পারতো ওর জীবনে কিছুটা হলেও আসার আলো নিয়ে আসতে।কিন্তু নিজের তৈরি পৃথিবীর নেশাতে সে এতই বুঁদ থাকত,যে এই নিষ্পাপ মেয়েটার চিৎকার সে কোনোদিন শুনতে পায়নি। তার সারাজীবনের স্বার্থপরতার ফল এখন প্রকৃতি তাকে হয়তো ফিরিয়ে দিচ্ছে। এক এক করে সব কটা মানুষ তাকে একা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে। অঙ্কুর,পূরবী, নীলিমা।

মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠলো হঠাৎ করে।হুশ ফিরল রঞ্জিতের।তাড়াতাড়ি বের করল মোবাইলটা।এসময় কে ফোন করতে পারে কেজানে।নীলিমার ঘুম না ভেঙে যায় আওয়াজে তাই জানলার দিকে এগোলো মোবাইলটা বের করতে করতে।বেরকরে দেখে পুরবীর ফোন। খুব অবাক হল রঞ্জিত।আর কি কথা থাকতে পারে ওর বলার। চলে যাচ্ছে, সেটা জানিয়ে দিয়েছে। এমনত নয় যে সে বললে থেকে যেত ও।silent এই বোতাম টা টিপে বাইরে তাকালো একবার। সোনালী রঙের ছটা ধীরে ধীরে আকাশের বুকে ছড়াতে শুরু করেছে।ঠিক যেমন অঙ্কুর রং খাতার একধার হতে পেন্সিল দিয়ে রঙ ভরতো। আবার বেজে উঠল phone টা।আবারও silent করল রঞ্জিত।না,তার আর কিছু শোনার ও নেই,বলার ও নেই।ওর প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছে,তাই চলে যাচ্ছে। আর সত্যি বলতে,রঞ্জিতের এখন মনে হয় তার কাছে এই জীবনটারই প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছে।call কেটে গেলে মোবাইল টা switch off করে দিল রঞ্জিত।

ঘড়ির কাটা বলছে 5টা বাজতে 10 মিনিট বাকি। একটু পরেই বেরোতে হবে।ভিসিটিং hours শেষ। টেবিলে phone টা রেখে নীলিমার পাশে এসে বসল রঞ্জিত। খুব ক্লান্ত লাগছে নিজেকে।সকাল হতে ঘুরে বেড়াচ্ছে এই রোদ বৃষ্টির লুকোচুরির মাঝে। ঘামে ভিজে গিয়েছে জামা টা। ছোট্ট বেডের বাকি অল্প জায়গায় এলিয়ে দিল শরীর টাকে।নীলিমার বালিশের কিছুটা ফাঁকা ছিল,ওটায় মাথা দিল রঞ্জিত। নীলিমার দিকে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। ওর নিঃশাস পড়ার আওয়াজ কানে এলো। কাল জীবনমরণের অপারেশন হতে চলেছে তবুও কোনো তাপ-উত্তাপ নেই মেয়েটার।

জীবনের ভারে সেও ঔ বোধহয় ক্লান্ত। এই ভার থেকে মুক্তি পেলেই বোধহয় বাঁচবে সে। শুধু অবহেলা আর বিচ্ছেদ ছাড়া সেও তো কিছু পাইনি। নীলিমার আগোছালো চুল টার ওপর দিয়ে হাত বুলিয়ে দিল রঞ্জিত, ঠিক যেমন রাতে অঙ্কুর এর ঘুম না এলে করতে। একটু তেই ঘুমিয়ে পড়তো অঙ্কুর। আজ নীলিমা ও একটু ঘুমোক।


0 comments:

Post a Comment