খেদ
আবদুস সাত্তার বিশ্বাস
এক বুক দুঃখ নিয়ে বেঁচে আছে অঙ্কিতা। স্বামীর প্রচুর অর্থ সম্পদ থাকলেও
তার মতো নিঃস্ব এই মুহূর্তে পৃথিবীতে কেউ নেই। কোনো নারী নেই। অঙ্কিতার তাই ভগবানের
প্রতি ক্ষোভেরও শেষ নেই। যেকারণে ভগবানকে সে আর কোনদিন ডাকবেনা। কিছু চাইবেনা। সে বুঝে
নিয়েছে যে, ভগবানের কাছে দেওয়ার মতো কিছু নেই। মানুষ শুধু ভগবান ভগবান করে ডাকে তাই।
ভগবানকে ডেকে ডেকে বিফল হয়ে সে সেটা বুঝেছে। ভগবান বলে কেউ নেই। কিছু নেই। আর থাকে
যদিওবা সেটা কাল্পনিক একটা নাম মাত্র। তাছাড়া কিছু না। তার কোনো অস্তিত্ব নেই। মানুষই
তার অস্তিত্ব। মানুষ মনে করে তাই সে আছে। মানুষ মনে না করলে নেই। অতএব সে আর ডাকবেনা।
কখনো, কোনোদিন ডাকবে না। ডেকে যদি ফল না হয় তো ডাকবে কেন?
অঙ্কিতারা দুই বোন এক ভাই। ভাইটা সব ছোট। বাবা নেই। অনেক দিন আগে সে যখন
ক্লাস এইটের ছাত্রী ছিল সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। তারপর তার মায়ের কাছে তারা তিন ভাইবোন
মিলে মানুষ হয়েছে। দৈবাৎ তার বিয়েটা হয়ে গেলেও তার বোনের বিয়ে হয়নি। দেখতে সে তার থেকেও
বেশি সুন্দরী। তবু তার বিয়ে না হওয়ার জন্য তার মায়ের মনে দুশ্চিন্তার শেষ নেই। বিয়ে
ঠিকই হতো। লোকে যে তার বাবা না থাকার দরুণ তার মায়ের চরিত্র
টেনে এনে ভেংচি দেয়। বিয়ে অমনি ভেঙে যায়। বাস্তবে
যদিও তার মায়ের চরিত্রে সেরকম কোনো কলঙ্কের দাগ নেই। না, অঙ্কিতা ভগবানকে এরজন্য কোনোদিন ডাকেনি।
অঙ্কিতা তখন কলেজের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী। বাড়ি থেকে সে কলেজে যাওয়ার জন্য
সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে গেলেও কোনোদিন সাইকেল নিয়ে কলেজ যেতো না। অঙ্কিতার
পক্ষে যে তিরিশ কিলোমিটার রাস্তা সাইকেল ছোটানো সম্ভব ছিল না। যেকারণে সে সাইকেলটা মোড়ে রেখে বাসে চেপে যাতায়াত করত। যে রাস্তাটা ধরে অঙ্কিতা বাড়ি থেকে সাইকেলে করে যাতায়াত করত
ওটা এখন পাকা রাস্তা হলেও তখন কিন্তু ওটা একটা কাঁচা রাস্তাই ছিল।
অঙ্কিতা সেদিন কলেজ থেকে বেরনোর পর আকাশে মেঘের কোনো চিহ্ন মাত্র ছিল না। বাস থেকে নেমে মোড়ে সাইকেল চাপার সময়ও না।ফলে অঙ্কিতা ওই কাঁচা
রাস্তা ধরে সোজা বাড়ি চলে আসছিল। আসতে আসতে কিছুদূর
আসার পর আকাশ মেঘে ছেয়ে গিয়েছিল। ও গুড়গুড় করে মেঘ
ডাকতে শুরু করেছিল। অঙ্কিতার সঙ্গে সেদিন
ছাতা ছিল না। যেকারণে সে ভিজে যাওয়ার ভয় করেছিল। আর সে তখন তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছনোর জন্য পায়ের সমস্ত শক্তি প্যাডেলে
প্রয়োগ করে সাইকেলের গতি বাড়িয়েছিল। কিন্তু তাতে তার
বিশেষ লাভ হয়েছিল না। বৃষ্টি তক্ষুনি ঝেঁপে
শুরু হয়ে গিয়েছিল। একটা দোতলা পাকা বাড়ি ছাড়া দাঁড়ানোর
মতো ওখানে আর কোনো বাড়ি ছিল না। অঙ্কিতা কিছু ভেবে
না পেয়ে বাড়িটার ভিতর ঢুকে গিয়েছিল। ঢুকতে গিয়ে সে যেটার
ভয় করেছিল সেটাই হয়েছিল। ঝমঝম বৃষ্টিতে ভিজে
গিয়েছিল। ভিতরে একটা বুড়ি মেয়ে তাকে দেখে তখন
বলেছিল,"তুমি কে গো মেয়ে,চিনতে পারলাম না।"
"আমায় চিনতে পারবেন না।আমি এ গ্রামের নই।"
"তবে তুমি কোন গ্রামের?"
"আমি কালীপুর গ্রামের।"
"এদিকে কোথায় এসেছিলে?"
অঙ্কিতা বলেছিল, "আমি কলেজ থেকে
বাড়ি ফিরছিলাম। ফিরতে ফিরতে হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয়ে
গেল।আপনাদের বাড়ি তাই উঠলাম।"
"ভালো করেছ। তা তুমি তো ভিজে
গেছো। শরীরের সঙ্গে ভিজে জামা একেবারে লেপ্টে রয়েছে
দেখতে পাচ্ছি। তোমাকে একটা গামছা এনে দেব? গা মুছবে?"
"গামছা লাগবে না। রুমাল আছে। "অঙ্কিতা বলেছিল।
বুড়ি মেয়েটা বলেছিল, "এত ভিজে গেছো! রুমালে কি মোছা হবে?"
"হবে।"
"বেশ,মোছো তাহলে।আমি ততক্ষণ একটা তোমার জন্য চেয়ার বের করে আনি ঘর
থেকে।"
অঙ্কিতা রুমালে তার ভিজে গা মুছতে মুছতে একটা চেয়ার নিয়ে সে চলে এসেছিল। অঙ্কিতা চেয়ারে বসেছিল। সে
তখন অঙ্কিতার সুন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, "তুমি
দেখতে কি সুন্দরী! তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে।তোমার নামটা কি?"
অঙ্কিতা মিত্র। সে তার পুরো নাম বলেছিল।
"বা:,খুব সুন্দর নাম তো তোমার।"তারপর জিজ্ঞেস করেছিল,"তোমরা
ভাইবোন ক'টা?"
অঙ্কিতা তার ভাইবোনের সংখ্যা বলেছিল।বললে পরে সে তাকে জিজ্ঞেস করেছিল,"তুমি
কত নম্বর?"
অঙ্কিতা বলেছিল,"আমি প্রথম।"
"তোমার বাবার নাম কি?"
"অমল মিত্র।"
"বাবা বেঁচে আছেন তো?"
"না,মারা গেছেন।"
"আর মা?"
"মা আছে।"
"কালীপুরে তোমাদের বাড়িটা কোন জায়গায়?"
অঙ্কিতা বলেছিল,"ক্লাবটা চেনেন?"
"হ্যাঁ,চিনি।"
"ওই ক্লাবের কাছে আমাদের বাড়ি।"
বুড়ি মেয়েটা এবার বলেছিল,"বেশ,তোমাদের বাড়ি বেড়াতে যাবো।"
অঙ্কিতা বলেছিল,"যাবেন।"তারপর জানতে চেয়েছিল,"কবে যাবেন,বলুন!"
সে বলেছিল,"কবে যাবো সেটা বলতে পারছিনা। তবে খুব তাড়াতাড়িই যাবো।তোমার
বিয়ের ব্যাপারে তোমার মায়ের সঙ্গে কথা বলতে। আমার
একটা নাতি রয়েছে।তার বিয়ে দেবো তো মেয়ে পাচ্ছি না। মেয়ে
আবার পাবোনা? পাচ্ছি। কিন্তু
পছন্দ হচ্ছে না। তোমার মতো দেখতে সুন্দরী মেয়ে পাচ্ছি
না। মাস্টার মানুষের বউ যেমন তেমন নিলে কি চলবে? আমি তো আগেই বলেছি,তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে।তাই আমার নাতির
সঙ্গে বিয়ের জন্য তোমার মায়ের কাছে প্রস্তাব নিয়ে যাবো।তোমার মা তোমার এখন বিয়ে দেবে
তো?"
অঙ্কিতা বলেছিল,"আমি জানিনা।"
"গিয়ে জানব।"
"সেটা জানতে পারেন। কিন্তু আপনাদের চাহিদা
পূরণ করবার মতো শক্তি কি আমার মায়ের আছে? আমার মা যে ভীষণ
গরিব।"
সে বলেছিল, "হলই বা।তা তে কি হয়েছে? তোমার মায়ের কাছে
আমাদের কোনো চাহিদা থাকবেনা। শুধু আমাদের তোমাকে চাই, ব্যস।"
অঙ্কিতা তখন উত্তরে বলেছিল, "এখন হয়তো মুখে
বলছেন। পরে এই নিয়ে কোনো অশান্তি করবেন না তো?"
বুড়ি মেয়েটা বলেছিল, "তুমি আমাদের
চেনোনা তাই এ ধরনের কথা বলছো। আমরা কি রকম গ্রামের মানুষের কাছে একবার জেনে নিও।"
অঙ্কিতা এবার বলেছিল, "বলছেন যখন
মা'র কাছে গিয়ে জানবেন তাহলে।"
"অবশ্যই গিয়ে জানব। তুমি আজ থাকো। আমার নাতি আসুক। তার সঙ্গে তোমার
আলাপ করিয়ে দেবো। কাল সকালে উঠে চলে যেও।"
অঙ্কিতা বলেছিল, "না, থাকা যাবে না। মা বাড়িতে তাহলে খুব চিন্তা করবে। মাকে
না জানিয়ে একা কোনোদিন কোথাও রাত কাটাই নি।"
"তাহলে তো কিছু বলার নেই।"
এরপর বৃষ্টির ফোঁটা কমতে কমতে এক সময় একেবারে কমে গিয়েছিল।অঙ্কিতা তখন উঠে
পড়েছিল,"চলি।"
"আচ্ছা,এসো।আর হ্যাঁ,দেখেশুনে যেও।"
এইসময় ঠিক অঙ্কিতার মায়ের বয়সী একটা মেয়ে উপর থেকে নিচে নেমে এসেছিল।বুড়ি
মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করেছিল,"মেয়েটা কে,মা?"
বুড়ি মেয়েটা বলেছিল,"মেয়েটার কালীপুরে বাড়ি। তোমার সুজয়ের জন্য আর
কোত্থাও মেয়ে দেখতে হবেনা।এই মেয়ের সঙ্গেই আমি সুজয়ের বিয়ে দেবো।মেয়ে দেখে আমার খুব
পছন্দ হয়েছে।..."
এরপর মাত্র মাসখানেকের মধ্যে দেখাশোনা সেরে সুজয় মিত্রের সঙ্গে তার বিয়ে
হয়ে যায়।ফাইনাল পরীক্ষাটা সে বিয়ের পরেই দেয়।এবং ভালো রেজাল্টও করে।সেবছরই আবার তার
পেটে সন্তান আসে।কিন্তু তিন মাসের মাথায় পেটেই সেটা নষ্ট হয়ে যায়।পরে আবার এলে সেটাও
নষ্ট হয়ে যায়।পরে আবারও আসে।সেটা এবার একটা কন্যা সন্তান রূপ নিয়ে পৃথিবীতে আসে।কিন্তু
পৃথিবীতে সেটা বেশিদিন থাকেনা।মাত্র দেড় বছর।তারপর সেটাও মারা যায়।পরপর তিনটে সন্তান
অঙ্কিতার এইভাবে নষ্ট হয়ে যায়।অঙ্কিতার মনে তখন আক্ষেপের কোনো শেষ থাকেনা। তিনটে সন্তানের
একটাও বেঁচে থাকল না।এতবড় বাড়িতে একটা সন্তান নেই।সন্তানহীন বিরাট বাড়িটা সবসময় কেমন
খাঁ খাঁ করে। যাইহোক, অঙ্কিতার
পেটে চতুর্থবার ফের সন্তান আসে। আগের বারের মতো অঙ্কিতা এবারও ভগবানকে ডাকতে শুরু করে,"ভগবান,আমার
পরপর তিনটে সন্তান নষ্ট হয়ে গেছে।লজ্জায় আমি মানুষের সামনে মুখ দেখাতে পারিনা।আমি নাকি
সন্তান খাকি একটা মেয়ে।সবাই বলে।আমার নাকি কোলের দোষ আছে।কোনো মা কি তার নিজের সন্তান
খেতে পারে?সন্তানের জন্য কি আমার কষ্ট হয় না?তাহলে আমি সন্তান খাকি একটা মেয়ে হলাম
কি করে? সমাজে কত মানুষ কত রকম পাপ করে। কারও পাপ ধরা পড়ে কারও পাপ ধরা পড়েনা। তবু সেইসব মানুষদের চরিত্রে কলঙ্কের কোনো দাগ নেই। মানুষের সামনে মুখ দেখাতে তবু তাদের লজ্জা নেই। আর আমি জীবনে কোনো পাপ বা কলঙ্কের কোনো কাজ না করেই হলাম কলঙ্কিনী। মনুষ্য সমাজে মুখ দেখাতে লজ্জা পাই।প্রভু,তাই তুমি আমার মরণ
করো অথবা আমার প্রতি তুমি করুণা করো। আমাকে আর সন্তানহীনা
করে রেখো না।বিয়ের পরে সন্তান না থাকলে স্ত্রী জাতির যে কোনো মূল্যই নেই সমাজে। সমাজের
কাছে তুমি আমাকে আর ছোট করোনা। সুস্থ,সবল,সুন্দর,সাহসী এবং মেধাবান্ একটা পুত্র সন্তান
দাও।এবং তাকে পূর্ণ আয়ু দান করো। ভিটেয় প্রদীপ হয়ে সে যেন সারাজীবন জ্বলজ্বল করে জ্বলে।...."
একেবারে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত অঙ্কিতা ভগবানের কাছে এই প্রার্থনাই
করে এবং পরে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় হলে সত্যি সত্যি একটা পুত্র সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়।অঙ্কিতা
ভগবানকে খুব খুশি হয়ে ধন্যবাদ দেয়,"তোমাকে
ধন্যবাদ ভগবান,তোমাকে ধন্যবাদ।"
এরপরও যদি কোল শূন্য হয়ে যায় সে ঠিক থাকে কি করে!
0 comments:
Post a Comment