সিঁদুর শোভা
ফুল ভৌমিক
অধ্যাপক শৈবাল চক্রবর্তী। বাড়ির ভিতর থেকে বেরিয়ে গেটের কাছে একজন ভিক্ষুক
লোককে দেখতে পেলেন। পেয়ে তিনি তাকে বাড়ির ভিতর নিয়ে গিয়ে পাখার তলায় বসালেন। বসিয়ে
তাকে দেখিয়ে পরমপূজনীয়া মা মীনাক্ষী দেবীকে বললেন, "মা, একে কিছু খেতে দাও!"
তাঁর কথায় মীনাক্ষী দেবী তাকে কিছু খেতে দিলেন। ও তিনি অন্য ঘরে গিয়ে বসলেন।
এরপর ভিক্ষুক লোকটার খাওয়া শেষ হলে পরে অধ্যাপক চক্রবর্তী তাকে পকেট থেকে একটা পাঁচশো
টাকার নোট বের করে দিয়ে বললেন, "তোমাকে তোমার মতো একটা মানুষের ছবি দেখাবো। তুমি
তাকে দেখে চিনতে পারবে?"
"কেমন ছবি দেখান দেখি!"
তিনি মোবাইলে তোলা ছবিটা তখন বের করে দেখালেন। দেখিয়ে বললেন, "এই ছবিটা।
দেখে চিনতে পারছ !"
"চিনতে পারছি।" ছবিটা দেখে ভিক্ষুক লোকটা বলল।
"পারছ!"
"হ্যাঁ, পারছি।"
তিনি তখন বললেন, "লোকটা কোথায় থাকে বলতে পারো? লোকটাকে আমার খুবই দরকার।"
ভিক্ষুক লোকটা তখন বলল যে, সে যে লোকের ছবি দেখল সে লোক আর নেই।
"নেই মানে!" তিনি চমকে উঠলেন।
"মারা গেছে।"
"মারা গেছে!"
"হ্যাঁ, মারা গেছে। মারা যাওয়া তা-ও এদিকে অনেক দিন হয়ে গেল।"
"কিভাবে মারা গেছে?"
"ভিক্ষা করে ফিরছিল। সেইসময় একটা লরির সাথে ধাক্কা লেগে।"
"ইস্!" সঙ্গে সঙ্গে তিনি চোখ বন্ধ করে ফেললেন। তারপর চোখ খুলে
পরে বললেন, "তুমি এসো!" তিনি তাকে আসতে বললেন।
দুই
খবরটা শোনার পর হঠাৎ বিষণ্নতায় তাঁর মনটা কেমন মরে গেল। চেয়ারে বসেছিলেন
বসেই রইলেন। উঠলেন না। মীনাক্ষী দেবী তখন ঘর থেকে বেরিয়ে এসে তাঁকে দেখার পর বললেন,
"কি রে, ভিক্ষুকটা চলে যাওয়ার পর তুই ওভাবে মন খারাপ করে বসে রইলি কেন? কি হয়েছে?"
মীনাক্ষী দেবীর প্রশ্নের উত্তরে তিনি তখন বললেন, "মা, আমি একটা লোককে
অনেক দিন ধরে খুঁজছিলাম। এই ভিক্ষুকটার মুখে আজ শুনলাম যে, সেই লোক আর নেই। মারা গেছে।
হঠাৎ তার এই মৃত্যু সংবাদটা শোনার পর মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেল। তাই এইভাবে আমি বসে
রয়েছি।"
মীনাক্ষী দেবী জিজ্ঞেস করলেন, "লোকটা কে?"
তিনি বললেন, "এই ভিক্ষুকটার মতো সে-ও একটা ভিক্ষুক। তা হলেও ভিক্ষুকটার
কথা আমি কোনোদিন ভুলব না। সারাজীবন ভিক্ষুকটা আমার মনে বেঁচে থাকবে। ভিক্ষুকটা যদি
বেঁচে থাকত আর আমি যদি তাকে পেতাম তাহলে আমার বাড়িতে এনে তাকে স্থান দিতাম। হ্যাঁ
মা, সত্যি বলছি। আমি বাড়িতে এনে তাকে স্থান দিতাম।"
মীনাক্ষী দেবী তখন বললেন, "ওই ভিক্ষুকটা তোর জন্য কি এমন মহৎ কাজ করেছে
যার জন্য তুই ভিক্ষুকটার প্রতি এতটা উদার মনোভাব দেখাতে চাইছিস!"
তিনি এর উত্তরে তখন বললেন যে, তিনি যেদিন চাকরির পরীক্ষা দিতে বাড়ি থেকে
কলকাতা গিয়েছিলেন সেদিন বাসস্ট্যান্ডে ওই ভিক্ষুকটাকে তিনি দেখেছিলেন। খালি গায়ে ভিক্ষুকটা
সেদিন ভিক্ষা করছিল। তবে লজ্জা স্থান ঢাকার জন্য পরনে তার শত ছিন্ন একটা গেরুয়া কাপড়
পরা ছিল। ভিক্ষুকটাকে দেখে প্রথমে তাঁর কিছুটা পাগল পাগল বলে মনে হলেও সে যে আসলে পাগল
ছিল না পরে সেটা বোঝা গিয়েছিল। আর হ্যাঁ, বাসস্ট্যান্ডে তখন অনেক ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা
দাঁড়িয়েছিল। তাদের কাছে ভিক্ষুকটা ভিক্ষা করছিল। "একটা পয়সা দেবে! একটা পয়সা দেবে!..."
কিন্তু একটা পয়সা কোনো ভদ্রলোক অথবা ভদ্রমহিলা তাকে ভিক্ষা দিয়েছিল না। উপর দেখে চকচক
করা মানুষ গুলোর হৃদয়ে ভিক্ষুকটার জন্য একটুও সহানুভূতি বা দয়া জাগ্রত হয়েছিল না। বরং
ভিক্ষুকটার সঙ্গে তাদের মধ্যে অনেকে চাতুরী করেছিল।
"চাতুরী করেছিল!" মীনাক্ষী দেবী শুনতে শুনতে হঠাৎ প্রশ্ন করলেন।
"হ্যাঁ, চাতুরী করেছিল। চাতুরী নয়তো কি! পয়সা দেবেনা কিছু না পকেটে
শুধু হাত ঢুকিয়ে বলেছিল, "খুচরো পয়সা নেই গো!"এটাকে চাতুরী ছাড়া কি বলবে
বলো?"মীনাক্ষী দেবীর প্রশ্নের ওই উত্তর দেওয়ার পর তিনি এবার বললেন, "তাদের
ওই চাতুরী দেখে সেদিন আমার খুবই খারাপ লেগেছিল। খুবই খারাপ লেগেছিল। একি! ভিক্ষা দিবি
না দিবি না। তোদের স্বভাব কেন এরকম। একটা অসহায় ভিক্ষুকের সঙ্গে এত চাতুরী কেন!"
"তুই ভিক্ষা দিয়েছিলি?"
"হ্যাঁ, দিয়েছিলাম। শহরের বাবুদের বাড়ি বাসন ধোওয়ার তুমি তখন কাজ
করতে। আমার সব কথা মনে আছে, মা। সব কথা মনে আছে। কিচ্ছু ভুলিনি। বাবা ছিলেন না বলে
তুমি ওই কাজ করেই আমাকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করেছ। তোমার মতো মাকে পেয়েছিলাম
বলেই আজ আমি অধ্যাপক। হ্যাঁ মা,ফলে আমাদের জীবনে তখন খুব দারিদ্র্য ছিল। কষ্ট ছিল।
দুঃখ ছিল। আর অভাব ছিল। এসব ছিল বলে তুমি সেদিন আমাকে আমার যাতায়াতের জন্য খুব বেশি
পয়সা দিতে পেরেছিলে না। দেওয়ার হয়তো তোমার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু উপায় ছিল না বলে দিতে
পেরেছিলে না। শুধু রাস্তা খরচটা দিয়েছিলে। আর খিদে পেলে সস্তার হোটেল থেকে যাতে দু-বার
ডাল ভাত খাওয়া যায় তার জন্য আলাদা কিছু পয়সা দিয়েছিলে। কয়েন পয়সা। ভাগ্যিস আমার ধূমপানের
নেশা ছিল না। তাহলে কিন্তু ওই পয়সায় হতো না। যাইহোক। আমি পয়সা গুলো আলাদা করে আলাদা
পকেটে ভরে রেখেছিলাম। কিন্তু অসহায় ভিক্ষুকটা যখন আমার কাছে এসে হাত পেতেছিল আমি তাকে
আর সবার মতো শূন্য হাতে ফিরিয়ে দিতে পেরেছিলাম না। তার করুণ মুখটা দেখে আমার খুব মায়া
হয়েছিল। আমার পরনের ফুল প্যান্টের বাম পাশ পকেট থেকে আমি তখন তাকে একটা পাঁচ টাকার
কয়েন বের করে দিয়ে বলেছিলাম, "এত মানুষের মধ্যে কেউ তোমাকে একটা পয়সা দিল না!
আমি তোমাকে একটা পয়সা দিলাম। নাও! "ভিক্ষুকটা তখন পয়সাটা বারকয়েক কপালে ঠেকিয়ে
তার ঘাড়ের মলিন ঝোলাটার ভিতর ভরে নিয়ে আমার গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেছিল,
"তোর মনটা খুব বড় রে! তোর মনটা খুব বড়! "তারপর বলেছিল, "যা তুই একদিন
খুব বড় দরের মানুষ হবি! খুব বড় দরের মানুষ হবি!" ও উপরে চোখ তুলে ভগবানের উদ্দেশ্যে
বলেছিল, "ভগবান, তুমি একে একদিন একটা মানুষ বানিয়ে দিও। খুব বড় দরের একটা মানুষ
বানিয়ে দিও।" এরপর বাসস্ট্যান্ডে একটা বাস চলে এলে হুড়মুড় করে সবাই বাসে উঠে পড়েছিল।
ভিক্ষুকটার আশীর্বাদ গায়ে মেখে আমিও বাসে উঠে পড়েছিলাম। আমিও বাসে উঠে..."বলতে
বলতে ছবিটা তিনি দেখালে পরে মীনাক্ষী দেবী চমকে উঠে কাঁদতে লাগলেন। কারণ পেশায় ইঞ্জিনিয়ার
এই মানুষটার স্মৃতি আঁকড়ে ধরেই তিনি বেঁচে আছেন। মানুষটা ছিলেন বাউণ্ডুলে। পেশার প্রতি
তিনি কোনোদিনই খুব একটা যত্নবান ছিলেন না। সাধু সন্ত ও ফকির দরবেশদের সঙ্গেই তিনি মেলামেশা
করতে বেশি পছন্দ করতেন। শেষের দিকে সেটা যখন খুব বেশি হয়ে গেল তিনি আর বাড়িতে থাকলেন
না। বাড়ি থেকে হঠাৎ একদিন কোথায় উধাও হয়ে গেলেন। গেলেন তো গেলেনই। ঘরে আর ফিরলেন না।
অনেক খোঁজাখুঁজি করে তাঁরাও আর তাঁর সন্ধান করতে পারলেন না।পারলেন না তো আজও পারলেন
না। আজও না। একমাত্র ছেলেটা তখন কোলে ছিল।...
পুনশ্চঃ মীনাক্ষী দেবীর সিঁথিতে আর সিঁদুর শোভা কোনোদিনই পাবেনা। আজ থেকে
সেটা বন্ধ হল।
0 comments:
Post a Comment