বিদ্যাচুরি
মনামী সরকার
অনেককাল আগের কথা। অবোধ কুমার নামে এক রাজকুমার ছিল। পড়াশোনায় অবোধ কুমারের
একেবারেই মন ছিল না। সারাদিন খেলাধুলা আর দুষ্টামি করে সে দিন পাত করত। তার সহপাঠী
ছিল গ্রামের গরীব ব্রাহ্মণের ছেলে বিদ্যাধর। ছোট থেকেই তার ধ্যান-জ্ঞান ছিল পড়াশোনা।
পাঠশালার অন্যান্য বাচ্চারা যখন খেলাধুলা করত, বিদ্যাধর তখন একের পর এক পুঁথি মুখস্ত
করে চলত। তাতে কুমার বেশ বিরক্ত বোধ করত। তাই নানান কৌশলে বিদ্যাধার কে বিপদে ফেলার
চেষ্টা করত। নানা কৌশলে তার বিদ্যাচর্চায় ব্যাঘাত ঘটাত। স্কুলের মাস্টার মশাইরা সবটা
বুঝতে পেরেও রাজার ছেলে বলে চুপ করে থাকতো। আর যদিও বা কেউ সাহস করে রাজামশাই এর কাছে
ছেলের নামে নালিশ করত, তাহলে উল্টে রাজামশাই তাকে শাস্তি দিতেন। বাবার আশকারায় কুমার
দিনে দিনে অবাধ্য হয়ে উঠেছিল। একটা সময় এলো যখন রাজামশাই নিজেও আর ছেলেকে সামলাতে
পারছিলেন না। ওর যা চাই সেটা যদি বাবা না দিত তাহলে সেটা হয় জোর করে না হয় চুরি করে
নিজের কুক্ষিগত করত। এদিকে বিদ্যাধর বিদ্যা অর্জন করে জ্ঞানী ও চরিত্রবান হয়ে উঠেছে।
রাজ্যে চারিদিকে সবাই তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তাই দেখে কুমারের খুব হিংসে হতো। সে মনে
মনে ভাবল রাজপুত্র আমি, আর জ্ঞানী হবে ওই গরিব ব্রাহ্মণের ছেলেটা ? লোকে ওর প্রশংসা
করবে এটা কিছুতেই হতে দেওয়া যায় না। তাই সে মনে মনে ঠিক করল যে করেই হোক বিদ্যাধর
এর সমস্ত জ্ঞান বুদ্ধি সে কুক্ষিগত করবে। কিন্তু কিভাবে সে সেটা করবে কিছুতেই বুঝে
পাচ্ছিল না। বন্ধুরা বুদ্ধি দিল, বিদ্যাধর এর বাড়িতে যে বইগুলি আছে সেগুলো যদি কোনভাবে
নিয়ে আসা যায় তাহলেই কুমারও জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান হতে পারবে। যেমন কথা তেমন কাজ। একদিন
রাতে কুমার বিদ্যাধর এর বাড়ির সমস্ত বই চুরি করে নিজের বাড়িতে নিয়ে এলো, আর মনে
মনে ভাবল এবার সে জ্ঞানী হয়ে উঠবে। সে বইগুলো নিজের বাড়ির আলমারিতে তালা বন্ধ করে
রেখে দিল। বেশ কিছুদিন কেটে গেল, কিন্তু কুমার কোন বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে পারল না।
কুমার খুব চিন্তায় পড়ে গেল। বিদ্যাধর এর বাড়ি থেকে সমস্ত বইতে চুরি করে নিয়ে এসেছে,
তবু কেন বিদ্যাধর কে জ্ঞানশূন্য করতে পারল না ? এবার আরেক বন্ধু বলল শুনেছি পন্ডিতের
বুদ্ধি নাকি তার টিকির মধ্যে থাকে। একদিন রাত্রিবেলা কুমার বিদ্যাধর এর টিকিটা কেটে চুরি করে নিয়ে এল।
লাভ তাতেও কিছু হলো না। বিদ্যাধর এর জ্ঞানের এতটুকুও কমতি হলোনা তাতে। এবার আরেক বন্ধু
বলল সব জ্ঞান বুঝি ব্যাটা মাথার ভিতরে লুকিয়ে
রেখেছে। রাজকুমারের এবার বিদ্যাধরের মাথাটাই চাই। ও ভাবল বিদ্যাধরের মাথা কেটে ফেললেই
ও সর্বজ্ঞানী হয়ে উঠবে। বিনা অপরাধে বিদ্যাধরের মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হলো। বিদ্যাধর মনে
মনে বিষয়টি বুঝতে পারল। রাজার সেপাই বিদ্যাধর কে ধরে নিয়ে এলো। পরদিন বিদ্যাধর কে
মৃত্যুদণ্ড দেবার আগে কুমার বলল তোমার শেষ ইচ্ছা কিছু থাকলে বলতে পারো। বিদ্যাধর বলল
আমি কটা কথা বলতে চাই। তাকে অনুমতি দেওয়া হল। বিদ্যাধর বলল কে যেন আমার সমস্ত বই চুরি
করে নিয়ে গেছে এমনকি আমার টিকিটাও। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমাকে জ্ঞানশূন্য করতে পারেনি।
তাহলে কি আমার প্রাণনাশ করে সেটা করা সম্ভব ? কারণ পৃথিবীতে জ্ঞান এমন একটা জিনিস যা
কেউ কারো থেকে চুরি করতে পারে না। এটা শুধুমাত্র অধ্যবসায় দ্বারা অর্জন করা যায়।
আর একবার এটা অর্জন করে নিলে সারা জীবন কেউ এটাকে আপনার থেকে আলাদা করতে পারবে না।
কেউ চুরি করেও নিতে পারবে না। বিদ্যাধর এর কথা শুনে আবোধ কুমারের বোধোদয় হল।
0 comments:
Post a Comment