Aug 19, 2020

"স্বীকারোক্তি" - সময়ীতা ঘোষ

Edit Posted by with No comments

 

স্বীকারোক্তি

            সময়ীতা ঘোষ            

"পলাশবাবু আপনার কী মনে হয়, সে রাতে কে এসেছিল? লতিকাদেবীর সাথেই বা তার কীসের শত্রুতা? আপনার ছেলের মুখে শুনলাম সে রাতে তিনি বাড়িতে ছিল না। উনি মাঝরাতে দরজাটা হয়তো ছেলে এসেছে ভেবেই খুলেছিলেন।"

"আমি কিচ্ছু জানি না স্যার। আমি খবরটা পেয়েই কলকাতা ফিরলাম। আপনি অপরাধীকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খুঁজে বের করুন। লতুর যে এই অবস্থা     করেছে তার যেন শাস্তি হয়।"

"না" বলে চিৎকার করে উঠলাম আমি। আমি নিজেই যে দায়ী আমার এই অবস্থার জন্য। জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে আমার মনে হয়েছিল আমিই ঠিক কিন্তু সত্যিটা উপলব্ধি করাও জরুরী ছিল।

বসুধা'র কথা আজ ভীষণ মনে পড়ছে। তোমার মনে আছে পলাশ, সেদিন আমাদের ঠিক কতটা অপমানিত হতে হয়েছিল? তুমি ঠিকই বলেছিলে শুধুমাত্র জন্ম দিলে মা হওয়া যায় না। তখন অভিমান করে কতদিন তোমার সাথে বলিনি কিন্তু তুমি ভুল কিছু তো বলোনি। সেবার আমার ম্যালেরিয়া না হলে হয়তো তখন'ই পথ দুটো আলাদা হয়ে যেত।

"রিদমকে বোঝাও লতু। এভাবে গুরুজনদের সাথে কথা বলা যায় না। তোমার ছেলের জন্য আমার লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে।"

"ভুল কি বলেছে? আমরা ভদ্রতার খাতিরে যা বলতে পারিনা বাবু সেটাই খুব সহজে বলে দিয়েছে। ভুল কিছু তো করেনি।"

"তুমি পাগল হয়ে গেছো লতু, অন্ধ হয়ে গেছো তুমি।"

তুমি সেদিন ঠিকই বলেছিলে পলাশ। আমি সারাজীবন যা ঠিক মনে হয়েছে তাই করেছি। আমি ভালো স্ত্রী, ভালো মা দুটোর কোনোটাই হয়ে উঠতে পারিনি।

তোমার নীলের কথা মনে আছে পলাশ? সেবার যখন বাবু নীলের মাথা ফাটিয়ে দেয়, রক্তিমাদে  বী বলেছিলেন আমি একজন মা হিসেবে ব্যর্থ; আমি পারিনি আমার সন্তানকে মানুষ করতে। কিন্তু পলাশ তুমি'ও যে ব্যর্থ বাবা হিসেবে। যখন তোমার আমাদের ছেলের পাশে থাকা উচিত ছিল, বাবুকে বোঝানো উচিত ছিল তখন শুধুমাত্র তোমার খ্যাতি ধূলিসাৎ হয়ে যাওয়ার ভয়ে তুমি আমাদের থেকে অনেক দূরে সরে গেলে। তুমি বদলি নিয়ে চলে গেলে উত্তরবঙ্গে। ডিভোর্সটা দাওনি সেটাও হয়তো তোমার ভয়ের কারণেই।

তোমায় আমি কখনো কিছু বলিনি কিন্তু আজ সব বলবো। বাবু ধীরে ধীরে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল, পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছিল। তোমার মনে আছে আমরা চাইতাম বাবু বড় হয়ে মস্ত বড় ডাক্তার হোক? কিন্তু... বাবু সারাদিন ওই ঘরের মধ্যেই পড়ে থাকতো। বেশীরভাগ দিন খেতো না। আমার সাথে কথা বলা প্রায় ছেড়ে দিয়েছিল। ওর বন্ধুরা সঠিক সময়ে ঠিক যেভাবে তুমি সরে গিয়েছিলে সেভাবেই সরে গিয়েছিল। কিন্তু আমি পারিনি সরে যেতে, আমি তো মা, আমার সাথে তো বাবুর নাড়ির টান। সত্যি কথা বলতে কখনো চেষ্টাও করিনি। কিন্তু বাবু'ই আমায় শাস্তি দিতে অনেক অনেক দূরে পাঠিয়ে দিল। তবে আমি জানি এটাই আমার প্রাপ্য ছিল।

সেদিন বাবু হঠাৎ করে এসে বললো কিছু টাকা লাগবে, হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছো, নেশা করার জন্যেই। টাকা থাকলে হয়তো দিয়ে দিতাম কিন্তু টাকা ছিল না। এ'মাসের বাজারটা করার জন্যেও আমায় বৌদির কাছে হাত পাততে হয়েছিল। তুমি মনে করে বৌদিকে টাকাটা দিয়ে দিও।

জানো তো পলাশ, ছেলেটা আমার ভীষণ কাঁদছিল। বারবার ভগবানকে ডাকছিল। আমি জানি এতক্ষণ আমি যা যা বললাম তুমি তার কিছুই শুনতে পাওনি। একদিন শুনতে চেয়েছিলে কিন্তু আমি বলিনি। জানি তোমাদের মাঝে একটা অদৃশ্য দেওয়াল রয়েছে, সেই দেওয়ালটা তোমার ভালোবাসা দিয়ে ভেঙে ফেলো। ভালো থেকো পলাশ; দেখে রেখো বাবুকে।


0 comments:

Post a Comment