ভ্রূণকন্যা
ধ্রুবজ্যোতি সরকার
তখন শেষ বিকেল। দুই রাস্তার মোড়ে একটি একতলা
সাজানো গোছানো সুন্দর বাড়ি। রাস্তাদুটির একটি সোজা চলে গেছে
"দিগন্ত" বৃদ্ধাশ্রমের দিকে। বাড়িটির সামনে
একটি ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে। গাড়ির পেছন
সিটে একজন বৃদ্ধ
ও বৃদ্ধা বসে। কারও
জন্য হয়তো অপেক্ষা করছে । বাড়ি থেকে
এক যুবক গাড়িতে উঠতেই গাড়িটি ছেড়ে
দেয়। যুবক বৃদ্ধ-বৃদ্ধার ছেলে হবে সম্ভবত ।
গাড়ি এগিয়ে চলে দিগন্তের রাস্তা ধরে। বৃদ্ধ উদাস
মনে পেছন দিকে
চেয়ে থাকে। বৃদ্ধের নাম অনুভব। অনুভব একটি
বেসরকারি অফিসে চাকরি
করতো । অনেক কষ্টে
টাকা জমিয়ে বাড়িটি তৈরি করেছিল সে। কষ্টের চেয়েও বেশি জড়িয়ে
আছে তার স্বপ্ন। ইট দিয়ে নয় স্বপ্ন দিয়েই সেটা নির্মাণ করা। দেখতে দেখতে
অনেক দূরে সরে যায় তারা, ঝাপসা
হয়ে আসে বাড়িটি। তার নিজের আবাস এভাবে
কোনোদিন ছেড়ে দিতে
হবে তা স্বপ্নেও কল্পনা করেনি। অনুভবের কিছু
বলার ছিল না । তাদের ছেলে
রুপ পরের দিনের
ফ্লাইটেই কানাডা চলে যাচ্ছে। কে দেখবে
এখন তাদের।
অন্যদিকে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে চোখ বন্ধ আসে বৃদ্ধার। সেই অনেক
বুঝিয়ে অনুভবকে রাজি
করিয়েছে, প্রথম প্রথম
তো আসতেই চাইছিল না । একাকী জীবনের শেষ সময়টার কথা কল্পনা করে মাথা
ধরে আসে তার,
একটু পরে হয়ত ঘুমিয়েও পরে।
গাড়ি পৌঁছে যায় দিগন্তের গেটে। হটাৎ দেখা
যায় অঞ্জলী দাঁড়িয়ে। অঞ্জলী তাদের প্রথম সন্তান । তাকে একপ্রকার না জানিয়েই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে
। 'ড্রাইভার গাড়ি ঘোরাও' বলতেই রূপের
সাথে তার বিবাদ
লেগে যায়। রূপ বাড়িতে ফিরিয়ে নিতে অস্বীকার করলে অবশেষে ঠিক হয় বৃদ্ধ-বৃদ্ধা মেয়ের বাড়িতেই থাকবে। অঞ্জলী নিজে স্কুল শিক্ষিকা তাছাড়া বরও চাকুরীজীবী, বাড়িতে এক মেয়ে
সুতরাং কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। ট্যাক্সির গতিপথ আবার পাল্টে যায়।
গল্পের শেষটা বোধহয় এমনি
প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু না, শেষটা আর এরকম
হয় না। অঞ্জলীকে যে জন্মাতেই দেওয়া হয়নি। এসেছিল অঞ্জলী ঠিকই কিন্তু তাকে পৃথিবীর আলো আর দেখতে দেওয়া
হয়নি। জন্মাবার আগেই তাকে মরে যেতে
হয়েছে। সিদ্ধান্তটা অনুভবের ছিল। অঞ্জলী কন্যা ভ্রূণ শনাক্ত হওয়ার পর প্রথমে রাজি না হলেও
পরে রাজি হয়ে যেতে হয় বৃদ্ধাকেও। কন্যা ভ্রূণের জন্য আজ এতদিন বাদে বুকটা
মুষড়ে ওঠে বৃদ্ধার।
ট্যাক্সি দিগন্তের সামনে তাদের
নামিয়ে দিয়ে ফিরে
যায় । তারা 'দিগন্তের'র গেট পেরিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে
সামনের দিকে। তখন সূর্য
ডুবু ডুবু। শেষ বিকেলের ম্লান আলো আকাশে
ছড়িয়ে গেছে। এক বুক অসহায়তা চোখের জলের
সঙ্গে মিশে নদী বইয়ে দেয় দিগন্তের বুকে। দুজন একে অপরের হাত ধরে কাঁপা কাঁপা পায়ে
এগোতে থাকে। দূর থেকে
পড়ন্ত রোদের আলো তখন অঞ্জলীর হাসির
সঙ্গে মিশে অস্তের দিকে।
0 comments:
Post a Comment