খাঁচা
বাসুদেব দাস
কাল একটা রাত গেছে বটে, এ তল্লাটে কজন ঠিক করে ঘুমিয়েছে - বলতে পারো !
চারপাশে যেমনি শোরগোল তেমনি বিয়ে দেখবার জন্য ঝুঁকে পড়া ভিড়। দেখলে হবে - আমাদের
সুহাসিনীর বিয়ে যে। এ ছেলে ও ছেলে করতে করতে শেষমেষ পাগলীটার জন্য জুটেই গেলো পাত্তর।
ঢ্যাম-কুড়-কুড় বাদ্য, চিকন সুরের সানাই আর পাড়াশুদ্ধ সব মেয়ে-বউদের সে কি উত্তাল
নাচন। প্যান্ডেলে উপচে পড়া ভিড়, গেটের সামনে হালোজেনের তীব্র আলোটা শীতের রাতে দিয়ে
যায় অতি আদুরে এক উষ্ণ স্পর্শ। গোটা চার কলাগাছকে ঘিরে জমেছে অন্তত একশত নারীপুরুষ।
সবাই হাসছে, কেউ মুখ ঢেকে কেউ বা হো হো করে। মাঝে মাঝে ঢেউয়ের মত উলুধ্বনি উঠছে একের
পর এক। কলাতলায় ঘোমটার নীচ দিয়েই একেকবার চঞ্চল ভাবে এদিক-ওদিক চোখ ঘোরাচ্ছে সুহাসিনী,
আবার পরক্ষণে অতিভদ্র শিশুর মতোই প্রথম প্রথম নামতার বই পড়ার ছলে পুরোহিতের বলা মন্ত্র
উচ্চারণ করে চলছে অনায়াসে। সুহাসিনীর ডাকনাম কুন্তী।
কুন্তী বাড়ির একেবারে ছোট মেয়ে। ওর যে তিনজন দাদা আছেন তার মাঝে মেজদা
ছাড়া বাকি দুজন ইতিমধ্যেই দাম্পত্য জীবনের সুখ অনেকটাই আস্বাদন করে ফেলেছে। বিয়ে
ছিল গোধূলি লগ্নে। কাল যখন কাকিমা, জেঠিমা, বৌদিরা মিলে বিয়ের পর নব-দম্পতি কে নানান
বিধি-আচারে শাখ বাজিয়ে ঘরে তুলছিল তখন বাইরে ঘটে গেছে একটা ছোট্ট দুর্ঘটনা। কুন্তীর
পোষা বেড়ালটা প্যান্ডেলের তলা দিয়ে ঢুকে পড়েছে বাঁশ খাটানো বড় হেঁশেলে। গরম কড়াই
থেকে ভেসে আসা টগবগে মাংসের ঝোলের গন্ধে, মেঝেতে রাখা শ খানেক মাছের টুকরোর লোভে নির্ঘাত
ভিরমি খেয়ে গেছিলো ওই কালো সাদা ছোট্ট প্রাণীটা। অবশেষে মচমচে একটা ল্যাজা তুলে নিয়ে
এদিক ওদিক দেখে দৌড় দেবার পালা...!
পান্ডা ব্যাটা বড় অলস। একটা বড়ো চেয়ারে বসে সিগারেট ফোঁকে আর আঙুল ঘুরিয়ে
কর্মচারীদের এটা ওটা নির্দেশ দেয় সারাক্ষণ... "এটাতে নুন দে, ওটাতে হলুদ, ওখানে
খুন্তি চালাতে থাক কিছুক্ষণ..."! ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বেড়ালটার ধীর পলায়ন তার
চোখে পড়ে। একটা বিদ্রুপের হাসি দিয়ে আঙুল তুলে বলে "ধর ওটাকে" । লোক ছোটে
পেছনে। খাবারে বিড়াল মুখ দিয়েছে শুনলে মালিকের রাগের সীমা থাকবে না, ওটাকে ধরতেই
হবে। মিনিট তিনেক দৌড় ঝাঁপ করে ধরা গেলো। লুকোচুরি করার সময় কর্মচারীর হাতে নখের
আঁচড় দিয়ে রক্ত বের করে দিয়েছে অনেকটা। এবার অবোলাটার ওপর সবার রাগ বেড়ে গেছে দ্বিগুণ।
বাড়ির পেছন দিকটায় নিয়ে গিয়ে লম্বা মোটা ডাবু হাতার এক ঘায়ে মাথাটা থেতলে গেলো
ওর। শেষবার কুই করে উঠেছিল। বাজনার মুহুর্মুহু উচ্ছ্বাসে একটা প্রাণীর আর্তনাদ হারিয়ে
গেলো। তাড়াহুড়ো করে লুকিয়ে ফেলার জন্য ওই নিথর দেহের ওপর একটা বেতের খাঁচা এসে পড়ল।
এ এক অনন্য মুক্তি, আবদ্ধ মুক্তি!
এখন ভোর চারটে, পাত্র-পাত্রীকে ললেন গুড়ের পায়েস আর রসগোল্লা দিয়ে জলযোগ
করিয়েছে কুন্তীর মা। চাঁদরের গাটছড়া অক্ষুণ্ণ রেখে উঠোনে এক একজন গুরুজনদের পদধূলি
মাথায় করছে দু’জনেই। আমার মনে কষ্টের মেঘ ফিনকি দিয়ে উঠছে ওই আবদ্ধ নির্জীবটার জন্য।
বাকি সবাই কাদঁছে, কুন্তীর জন্য। আমি সামলে নিচ্ছি। আর ভাবছি সকাল-দুপুর-রাত্তির যে
জীবটা কুন্তীর ঘাড়ে পিঠে কোলে খেলে বেড়ালো সেটা আর নেই।
বাড়ির সামনে বরের গাড়ি এসেছে। আমি দরজাটা খুলে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। কুন্তী
আমাকে জড়িয়ে ধরলো, আমি ওর প্রণাম নিই নি আজীবন। আজও ব্যতিক্রম হলো না। আমার জন্য
যত শ্রদ্ধা যত ভালোবাসা ছিল মিনিট দুয়ের অবিরাম কান্নায় তার ছাপ সে রেখে গেলো। ও
আরো বেশি কাদঁছে। আমি ইতস্তত করছি, ও তো কাদঁছেই, সেই কথাটাও বলে দিই। বেচারী কেঁদে
নিক একবারে। ঠোঁট খুলে বলতে যাবো অমনি মা চোখ টিপে দিলো... বুঝলাম ওর কান্নাটা পরিণয়ের,
তার সাথে প্রাণ-বিয়োগের কোনো সম্পর্ক তৈরি করা একেবারে বেমানান। ন্যাড়া শিমুলের মাথায়
ভোরের কাক বসেছে একদল। কা... কা... উদাস করা স্বরে ভরিয়ে দিচ্ছে চারপাশ। মা বলতো কাক
ডাকলে বিপদ, ওরা সব টের পায়। কুন্তী ওদিকেই তাকিয়েছে, মা এক ধমকে বললো ওটা ওদের বাসা,
সকাল হলো তাই ডাকছে। কান্নার মাঝেও ওর ঠোঁট দুটো লজ্জায় কেঁপে উঠলো। কিন্তু ওর মনের
গহনে অনেক মেঘ জমেছে এতক্ষণে, ওই মেঘের নাম দুশ্চিন্তা নাকি ভয় সেটা কিছুতেই বুঝে
উঠতে পারছে না কুন্তী।
পাত্র-পাত্রী চেপে বসলো গাড়িতে। উলুধ্বনির ভিড়ে কান্না ফিকে হয়ে এলো।
কাকের দল অনবরত ঘুরছে বাড়ির ওপর। একটা বিশ্রী অপরাধ বোধ খেলে যাচ্ছে আমার ভেতর। ওর
বর ব্যবসা করে। তবুও ভাবছি, গোটা পাড়া জুড়ে তিনবেলা কারণে অকারণে ঘুরে বেড়ানো মেয়েটাও
আজ কোনো খাঁচায় গিয়ে পড়ছে না তো। বাবা কান্না থামিয়ে দীর্ঘশ্বাস নিচ্ছে। চোখ মানছে
না, হাত নাড়ছি। গাড়ি এগিয়ে চললো। অল্প দূরে গিয়ে জানালা গলিয়ে কুন্তী চিৎকার করে
আমাকে বললো, " আমার বেড়ালটাকে দেখে রাখিস, মেজদা" !
0 comments:
Post a Comment