Apr 5, 2021

"পরিণীতা" - শৌভিক রায়

Edit Posted by with No comments

 


পরিণীতা

শৌভিক রায়

 

জীবনের ক্যানভাস জুড়ে কতো স্বপ্নেরা জোনাকির আলোর মতো কতো রঙের খেলায় আঁকিবুঁকি কাটে। তাদের পাখায় ভর দিয়ে ইচ্ছেরা ডানা মেলে। তাদের মৃদু আলোয় অনেক স্মৃতিতে ভরা রূপকথার গল্পেরা ফুটে ওঠে বাস্তবের পটে। আলো-আঁধারির বুকে তারা এঁকে চলে বিচিত্র রঙের আলপনা। মনের মাধুরী মেশা কল্পনায় তারা ফুটে ওঠে আলোর পালক হয়ে। এমনই রঙিন প্রেম-কাহিনী ছিল টিকলি আর বাপ্পার। কিন্তু, এই মধুর প্রেমের এমন করুণ পরিণতি হবে তা কে জানতো!

ভালোবেসে কি তবে ভুল করেছিলো টিকলি !

কিন্তু ভুলটা ঠিক কোন জায়গায় ছিল তা কখনো স্পষ্ট করে বোঝাতে পারেনি বাপ্পা। আজ প্রায় আট বছর হয়ে গেলো ওদের সম্পর্কের। এই আট বছরে বাপ্পার ভালোবাসা টিকলির জীবনকে করেছে পরিপূর্ণ। কিন্তু এই আট বছর পর বাপ্পার এই কঠিন সিদ্ধান্ত টিকলিকে করেছে দিশেহারা।

টিকলির ভাই পিকলুকে পড়াতো বাপ্পা। সেই সূত্রে আলাপ হয় দুজনের। ধীরে ধীরে একটা সুন্দর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে ওদের। কিন্তু সেই বন্ধুত্ব খুব বেশীদিন কেবলমাত্র বন্ধুত্বের জায়গায় সীমাবদ্ধ রইলোনা। টিকলি আর বাপ্পার বন্ধুত্বের সম্পর্ক কখন কিভাবে যে প্রণয়ের বন্ধনে জড়িয়েছিল তা বোঝেনি দুজনের কেউই। সম্পর্কের কয়েকমাসের মধ্যেই বাপ্পা অনুভব করতে থাকে যে তার এবং টিকলির জীবনশৈলির মধ্যে বিস্তর ফারাক। প্রথমদিকে এই তফাৎগুলো কখনো ধরা পড়েনি। তখন কেবলই মিলগুলিই চোখে পড়েছিল। যেগুলি বেঁধেছিল দুজনের দুটি মনকে। ক্রমে যতই অমিলগুলি ধরা পড়তে লাগলো, সেই পার্থক্যগুলোকে বাপ্পা কখনোই মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। সে সবসময় এই সম্পর্কে একটা হীনমন্যতা অনুভব করতো। তার নিজেকে কেবলই টিকলির অযোগ্য মনে হতে লাগলো। সে চেয়েছিল এই সম্পর্কের ইতি টানতে কিন্তু টিকলি বাঁধা দিয়েছিলো বারবার। বাপ্পাকে ছাড়া বেঁচে থাকা তার পক্ষে অসম্ভব। আর বেঁচে থাকলেও সেই বাঁচার অর্থ হবে একটা মৃত মন নিয়ে বেঁচে থাকা। টিকলির মনে তিলতিল করে জন্ম নেওয়া একরাশ স্বপ্নের হত্যাকারী হতে চায়নি বাপ্পা। বহুবার বহুভাবে চেষ্টা করেছে সে এই সম্পর্ক ভেঙ্গে বেড়িয়ে আসতে। টিকলিকে চরম মানসিক যন্ত্রণা দিয়েছে। সেই যন্ত্রণা থেকে শারীরিকভাবে দুর্বল ও অসুস্থ হয়ে পড়েছে টিকলি। ভালোবাসার মানুষকে কি ঘৃণা করা যায়? তার থেকে দুরে চলে গিয়ে তাকে চিরতরে ভুলে থাকা যায়? নাহ, পারেনি দুজনের কেউই একে অপরকে ছেড়ে থাকতে। অনেক ঝগড়া হয়েছে দুজনের। আবার তারা সেসব মিটিয়েও নিয়েছে। আসলে বাপ্পা একটু মাথাগরম প্রকৃতির হলেও টিকলি ছিল ভারী মিষ্টি আর শান্ত স্বভাবের মেয়ে। টিকলি বাপ্পাকে অনেক বুঝিয়ে সবকিছু সামলে নিতো। বাপ্পার অনেক অপমান সহ্য করেও টিকলির মন থেকে ভালোবাসা একচুল পরিমাণও কমেনি। তবে বাপ্পা টিকলির অনেক ইচ্ছেপুরণ করতো। ওকে শহরের অনেক সুন্দর সুন্দর জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যেত। ছোট ছোট অনেক ইচ্ছে পূরণ করতো। টিকলির খুব খেয়াল রাখতো। খুব আগলে রাখতো টিকলিকে। কোনোদিন টিকলির অযত্ন করেনি বাপ্পা। টিকলির অনেক সময় রাতে ঘুম না এলে বাচ্চাদের মতো গল্প বলে, গান করে ঘুম পাড়িয়ে দিতো। টিকলি বলতো যে ওর মায়ের পর কেউ যদি ওকে সবচেয়ে ভালো বোঝে, সবচেয়ে ভালো বন্ধু হয় আর সব বাচ্চামো সহ্য করে তবে সে হলো একমাত্র বাপ্পা। টিকলি ছবি তুলতে খুব ভালোবাসতো। কোথাও ঘুরতে গেলে ছবি তুলতে বলে পাগোল করে দিতো বাপ্পাকে। তবে বাপ্পা পরম ধৈর্য সহকারে তার সব ছেলেমানুষি সহ্য করতো। কখনো রাগতো না। আবার অনেকসময়ে টিকলির কিছু ভুলের জন্য সাংঘাতিক রেগে যেত বাপ্পা। কথা বলা বন্ধ হয়ে যেতো বেশ কিছুদিন। আবার সব ঠিক হয়ে যেত ধীরে ধীরে। এইভাবেই সুখে-দুখে, ঝগড়ায়-ভালোবাসায়, শাসনে-সোহাগে কেটে গেল আট আটটা বছর।

এই আট বছরে কোন চাকরী জোটাতে পারেনি বাপ্পা। প্রতিষ্ঠিত না হয়ে কি করে সংসার করবে টিকলিকে নিয়ে ? কিছু ঘর বাঁধার স্বপ্ন অপূর্ণই থেকে যায়। বাপ্পা পারেনি টিকলিকে তার স্ত্রীর মর্যাদা দিতে। এক আকাশ ভালোবাসা দিতে পারলেও এক ছাদের নীচে একটা ছোট্ট সংসার দিতে সে ব্যর্থ। বাপ্পার মনের কিছু জটিল ভাবনা এর জন্য দায়ী। যার কাছে হার মানতে বাধ্য হলো টিকলির সংসার করার ইচ্ছে। মনের মিল থাকলেও ওদের মতের অমিল ছিল মাত্রাছাড়া। তাছাড়া, টিকলির বেশ কিছু সখ, অভিরুচি ও মনোভাব বাপ্পার খুব অপছন্দ ছিল। সেগুলো সে কখনো মন থেকে মেনে নিতে পারেনি, আবার ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হবে ভেবে কখনো বাঁধাও দিতে পারেনি টিকলিকে। তাই প্রণয় কখনো পরিণয়ের রূপ পেল না ওদের। প্রেয়সী হয়েও টিকলি আজীবন বাপ্পার অপরিণীতা হয়ে রইলো।

কিন্তু, এখানেই এই গল্পের শেষ নয়।

এক বছর বাদে বাপ্পা হঠাৎ জানতে পারলো টিকলির শরীরে বাসা বেঁধেছে এক দূরারোগ্য ব্যাধি।। টিকলির হাতে সময় মাত্র কয়েক মাস। টিকলি চলে যাওয়ার আগে বাপ্পাকে জানায় তার শেষ ইচ্ছা, সে চায় তাদের ভালোবাসা পূর্ণতা পাক। টিকলির শেষ ইচ্ছে রাখতে বদ্ধপরিকর বাপ্পা কারণ টিকলি যে তার প্রাণাধিক প্রিয়।

অবশেষে সেই মধুর ক্ষণ উপস্থিত। কোন জাঁকজমক নেই, আড়ম্বর নেই, আছে শুধু সীমাহীন অপেক্ষা আর ভালোবাসা। লাল বেনারসি আর চন্দনে খুব সুন্দর করে সেজেছে টিকলি, কিন্তু মারণ রোগের কাছে হার মেনেছে তার সৌন্দর্য, তবুও সে বাপ্পার কাছে অপরূপা। এই প্রথম বার কনের সাজে টিকলিকে দেখে বাপ্পা যেন চোখ সরাতে পারছে না। পানপাতা সরিয়ে টিকলির ওই ম্লান, বিবর্ণ মুখ দেখেও মোহিত বাপ্পা, সে চোখ সরাতে পারছে না। ক্রমে ক্রমে সব রীতি পালন করা হল। অপেক্ষার অবসান হল। টিকলি আর বাপ্পার জীবনের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত। বাপ্পা রাঙিয়ে দিল টিকলির সিঁথি। কিছুটা সিঁদুর এসে পড়েছে টিকলির নাকের উপর। কথায় বলে সিঁদুর নাকে পড়লে নাকি বর একটু বেশিই ভালোবাসে। টিকলি তো জানতোই বাপ্পা তাকে কতটা ভালোবাসে। লজ্জাবস্ত্রের আড়ালে টিকলির সিঁদুরে রাঙা মুখটা দেখার বড্ড লোভ হচ্ছে বাপ্পার। নিজের ইচ্ছে সম্বরণ করতে না পেরে লজ্জাবস্ত্র সরিয়ে যেই মুহুর্তে টিকলিকে দেখতে গেল অমনি টিকলি লুটিয়ে পড়ল বাপ্পার গায়ে।

আজ টিকলির জীবনে সবচেয়ে সুখের দিন। আজ সে বাপ্পার স্ত্রী। শেষবারের মতো বাপ্পার হাত দুটো ধরে টিকলি বাপ্পাকে বলল, "তোমায় যে বড্ড ভালোবাসি গো। আজ যে স্বীকৃতি তুমি আমায় দিলে তা আমার জীবনে পাওয়া তোমার তরফ থেকে শ্রেষ্ঠ উপহার"। টিকলি চোখ বুজলো। বাপ্পার কোলে মাথা রেখে সে চলে গেলো চিরনিদ্রার দেশে।

আজ এই ফেলে আসা দীর্ঘ সময়ের ভাবনারা বাপ্পার চেতনাকে রাতদুপুর আচ্ছন্ন করে রাখে। সেই স্মৃতিরা তাকে তাড়া করে ফেরে। টিকলির পায়ের পরিচিত নুপূরধ্বনি অনুরণিত হয় বাপ্পার মস্তিষ্কের অন্তঃপুরে। ভোরবেলা যখন রবির কিরণ পৃথিবীর বুকে এসে পড়ে, তখন সচকিতে ঘুম ভেঙে সে চেয়ে দেখে সেই এলোমেলো সপ্নিল রঙের আঁকিবুঁকি তেমনিই আছে তার কল্পনায়। কেবল তার মনের ডায়েরীর পাতা থেকে সেই অফুরন্ত প্রেমের অগণিত শব্দভাণ্ডার হারিয়ে গেছে বাপ্পার হৃদয়ের পটে চিরবিচ্ছেদের ছবি এঁকে। তারা অলীক আবেশে বাপ্পার মনকে সাময়িক ভুলিয়ে রাখলেও সে ভালো করেই জানে যে ওই স্মৃতির রাশি আর কখনো ফিরবেনা বলেই নিরুদ্দেশের পথে, না ফেরার দেশে হারিয়ে গেছে চিরতরে। আজও বাপ্পার রুদ্ধপ্রাণের বোবাকান্না ওইসব স্মৃতিগুলিকে খুঁজে মরে পরিচিত শহরের পথে পথে। তাদের একসাথে কাটানো মুহূর্তেরা টিকলির স্মৃতির ছুরিকাঘাতে বাপ্পার হৃদয়কে পূর্ণ ও পরিতৃপ্ত করে বিরহবেদনার অজস্র ক্ষতচিহ্নে।

তবে বাপ্পার আর কখনো মনে হবে না যে সে টিকলির স্বপ্নের হত্যাকারী। কারণ, টিকলি শেষপর্যন্ত হতে পেরেছিল বাপ্পার পরিণীতা ।।


0 comments:

Post a Comment