May 8, 2020

হৃদয়ের এ কূল ও কূল

Edit Posted by with No comments


হৃদয়ের এ কূল ও কূল         
দ্বীপজ্যোতি গাঙ্গুলি

                                        
     "খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি আমার মনের ভিতরে।
          কত রাত তাই তো জেগেছি বলব কী তোরে॥
     প্রভাতে পথিক ডেকে যায়, অবসর পাই নে আমি হায়--
            বাহিরের খেলায় ডাকে সে, যাব কী ক'রে॥"

থেমে গেলি কেন মোহর? কি সুন্দর গাইছিলি। পুরো অন্য দুনিয়ায় চলে গিয়েছিলাম।
ওই ছেলেটাকে দেখনা রে। বেশ অনেকক্ষণ থেকে আমাদের ফলো করছেI চিনিস তুই ছেলেটাকে?
 ওকে তো এর আগেও দেখেছি। তোকে সারাক্ষণ লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে।  গণযোগাযোগ এর ছাত্র। আমাদের সমবয়সী। নাম ধাম জানিনা। যাবি কথা বলতে? কি সুদর্শন!
বাব্বাহ পৃথা! গণযোগাযোগ! সুদর্শন! তুই ই যোগ্য বাংলা বিভাগের স্টুডেন্ট রে। সে যতই সুদর্শন হোক, আমার খুব বিরক্ত লাগে। চল এখান থেকে।
এই মোহর চলনা একটু ঘেটে দেখি ছেলেটাকে। একটু ক্যাবলা ক্যাবলা আছে। দেখবি একটুতেই ঘাবড়ে যাবে। চল চল এই সুযোগে নাম ধাম ও শুনে নেওয়া যাবে।
না রে এতো রস নেই আমার। আর তুই তো জানিস আমি এসব পছন্দ করিনা। কে না কে চিনিনা জানিনা। তোর ইচ্ছে হলে তুই যা আমাকে এসবে টানবিনা।
তুই না মোহর এক্কেরে আটপৌরে। তোর দ্বারা কিচ্ছু হবেনা। এভাবে একটা ছেলে পিছু নিচ্ছে আর মহারাণী ফুটেজ নিচ্ছেন। কাকুকে বলিস রবীন্দ্রনাথের সাথে বিয়ে দিতে। তাছাড়া তো আর কারোর প্রেমে তুই পড়বিনা!
বেশি বাজে না বকে চল এখান থেকে। ছেলেটা এখনো এইদিকেই দেখছে। চলে না আসে আবার। তার চেয়ে বরং ক্লাসে চল।
আচ্ছা চল। আর কি করা যাবে। তোর যখন এতই আপত্তি তখন তো আর জোর করে লাভ নেই। চল।
এই যে শুনছেন। মোহার। হ্যালো। মিস মুখার্জী। দু মিনিট সময় হবে?
                                            
না মানে ইয়ে আই মিন টু সে দ্য থিং ইস দ্যাট.......
দ্য থিং ইস দ্যাট ইউ আর ওয়েস্টিং ইওর টাইম। কারণ তুমি এমন একটা মেয়েকে ভালোবেসে ফেলেছো যার সাথে তোমার কালচারের কোনো মিল নেই। একটা মেয়েকে সম্পূর্ণভাবে চিনলেই না তার ভালো লাগা খারাপ লাগা জানলে না। সোজা এসে প্রপোজ করে দিলে হাউ ফুল!
মোহার আমি অবাঙালী হলেও আমি ক্যালকাটায় জন্মেছি। আর আমি কিন্তু বাংলা বলতে পারি। আর আমি এও জানি যে তুমি রবীন্দ্রনাথের খুব বড়ো ফ্যান।
হা হা হা। ২০০১ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ক্যালকাটা নাম পরিবর্তন করে কলকাতা করে দিয়েছিলেন। সেটা হয়তো তোমার জানা নেই। আর দেখো তোমার আর আমার কালচারের অনেক ফারাক। তোমরা পুরোদস্তুর নিরামিষাশী আর আমাদের ডিসে অ্যাকোয়ারিয়াম।
না না মোহার আমি নন ভেজ খাই তো। আর আমি মাছ খেতে ভালোবাসি। হিলসা , রোহু সব। আর আমি সত্যজিৎ রবীন্দ্রনাথ সব পড়েছি।
অনুবাদের রবীন্দ্রনাথ পড়ে বাঙালী হওয়া যায়না মিস্টার পৃথ্বী রাই। আর ওগুলো হিলসা রোহু না ওগুলোর নাম ইলিশ আর রুই। সে সব না হয় পরে খাবে। কিন্তু এখন তুমি যেরকম ঘাবড়ে আছো তাতে আর কিছুক্ষণ পর এই ঠাণ্ডাতেও ঘাম ঝরবে। তাই মেঘ না চাইতেই এই নিন জল। আর প্রেম অনেক দূরের কথা আমাদের গল্প বন্ধুত্ব অবধিও এগোবেনা। তাই
এসব ছাড়ো আর ক্লাসে মন দাও।
মোহার প্লিজ একটা সুযোগ দাও। দেখো আমি তোমার কালচার আর আমার কালচার মিলিয়ে দেব।
ওহ তাই! সত্যি! প্রথমত আমার নাম মোহার না মোহর। আর যদি তুমি সত্যিই কোনোদিন ও আমাদের কালচার মিলিয়ে দিতে পারো। তাহলে সেদিন এসো ভেবে দেখবো। তার আগে প্লিজ ডিস্টার্ব করোনা।
                                             
তিন বছর পর,
                মাল্য যে দংশিছে হায়
              তব শয্যা যে কণ্টকশয্যা
                       মিলনসমুদ্রবেলায়
              চির- বিচ্ছেদজর্জর মজ্জা
                 প্রাণ চায় চক্ষু না চায়......
                   সুন্দর এসে ফিরে যায়
            তবে কার লাগি মিথ্যা এ সজ্জা
                    প্রাণ চায় চক্ষু না চায়
                 মরি একি তোর দুস্তরলজ্জা
                      প্রাণ চায় চক্ষু না চায়
আপনারা শুনছিলেন রবি ঠাকুরের আরো একটি অসাধারণ গান কিন্তু এবার আমাদের বিদায় জানানোর সময় এসে গিয়েছে। আবার ফিরে আসবো আগামী রবিবার সাথে নিয়ে রবি অন এয়ার উইথ আর জে মোহর অনলি অন টিংগো রেডিও। টিল দেন স্টে টিউনড। গুড নাইট শুভ রাত্রি।
মোহর ম্যাডাম আপনার সাথে দেখা করতে কয়েকজন লোক এসেছেন। বলছেন রুলিং পার্টি কিশলয় থেকে এসেছেন।
আমার সাথে দেখা করতে? আচ্ছা বেশ আমার চেম্বারে পাঠাও ওনাদের.
ম্যাডাম আমার নাম শম্ভু। আর এরা আমার দলের লোক। আমি শুনলাম আপনার শো এখন খুব জনপ্রিয়। আমরা চাই আপনি আপনার শো এ আমাদের পার্টির হয়ে প্রচার করবেন। বুঝতেই তো পারছেন সামনেই ইলেকশন। গত বিশ বছর ধরে আমাদের সরকার রয়েছে পশ্চিমবাংলায়, আমরা চাই এবারেও যেন। তাই আর কি। আপনাকে আমরা এর জন্য হিউজ এমাউন্ট দেব।
আচ্ছা সেসব ঠিক আছে। কিন্তু আমি যেই শো টা অপারেট করি সেটা রবীন্দ্রনাথের গানের উপর সেখানে রাজনীতির আলোচনা অবান্তর আর আমি সেটা কখনই করবো না। তাই আমায় মাফ করবেন। আপনারা আমার কাছে এসেছেন এতে আমি খুবই খুশি। কিন্তু আমি আপনাদের সাহায্য করতে পারবোনা, সরি।
আরো একবার ভেবে দেখুন। আপনার যত টাকা দরকার আমরা তত টাকা দেব। শুধু আপনি একবার প্রচার করবেন।
না দাদা। আমি ভেবে নিয়েছি। এরকম একটা শো এর মাঝে এমন একটা প্রচার করলে খুব বোকা বোকা শোনাবে।
আপনি কাজটা ভালো করলেন না। রুলিং পার্টিকে মুখের উপর না করে দিলেন। দেখবেন আবার পরে পচতাতে না হয়।চলি ম্যাডাম।
সেদিন রাতে,
কিরে মোহর তুই ঠিক আছিস তো? তোর বাবার কাছে কার যেন একটা কল এসেছিল। বললো তোকে সাবধানে সামলে রাখতে।
                                              
ডাক্তারবাবু মেয়েটা বেঁচে যাবে তো?
দেখুন। খুব বাজে ভাবে এক্সিডেন্ট হয়েছে। অপারেশন সাকসেসফুল, কিন্তু ৭২ ঘন্টা অবসার্ভাশনে রাখতে হবে। তার আগে কিছু বলা যাচ্ছেনা। মুখের কিছুটা অংশ জ্বলে গিয়েছে। ওটা আর ঠিক হবেনা। কিন্তু খুবই অল্প অতো বোঝা যাবেনা আশা করি।
মোহর মুখার্জীর বাড়ি থেকে কে আছেন? ডক্টর এই জিনিস গুলো ইমিডিয়েট নিয়ে আসতে বলেছেন। আর হসপিটালের বাকি পেমেন্ট গুলোও মেনশন করা আছে।
হ্যাঁ হ্যাঁ এই যে দিন। এক্ষুণি এনে দিচ্ছি সব। জ্ঞান ফিরেছে ওর?
এখনো না। কিন্তু আশা করছি খুব তাড়াতাড়ি জ্ঞান ফিরে আসবে। আপনারা আর দেরী করবেননা দয়া করে।
নার্স চলে যাবার পর, ভৈরব বাবু পকেট থেকে চশমাটা বের করে চোখে লাগালেন।
মাথায় আঠারোটা সেলাই, বাঁ চোখটা বেশ খানিকটা চোট পেয়েছে, চোয়ালের হাঁড় ভেঙেছে আর মাথায় কিছুটা ইন্টারনাল ব্লিডিং।
ডাক্তার বেশ কিছু জিনিস আনতে বলেছিলেন। ভৈরববাবু ইতিমধ্যে সেসব এনে দিয়েছেন। কিন্তু প্রায় ষোলো ঘন্টা হয়ে গেল এখনো জ্ঞান ফেরেনি মোহরের।
"মিস্টার মুখার্জী" নার্স ডাকলো ভৈরব বাবুকে, "আমাদের ব্লাড ব্যাংকে যা বি নেগেটিভ ব্লাড ছিল তা প্রায় শেষের দিকে। ডক্টর বলেছেন ইমিডিয়েট ব্লাড জোগাড় করতে। আর হার্ডলি দু বোতল এফোর্ড করা যাবে আমাদের ব্লাড ব্যাংক থেকে।"
"কিন্তু এখন তো ভোর পাঁচটা এতো সকালে কি করে আর আমাদের দুজনেরই তো বি পজিটিভ।"
"মিস্টার মুখার্জী" আওয়াজ টা শুনেই পিছনে ঘুরে তাকালেন ভৈরববাবু। একটা অল্পবয়সী ছেলে। চোখে কালো চশমা, পরনে ডেনিম জিন্স আর কালো শার্ট। ছেলেটা সামনে এসে দাঁড়ালো।
"বেশ অনেকক্ষণ থেকে আপনাকে বেশ চিন্তিত দেখছিলাম। তাই পুরোটা খোঁজ করে জানলাম ব্যাপারটা। চিন্তা করবেন না, সকালের মধ্যেই জ্ঞান ফিরে আসবে। যদি কিছু মনে না করেন একটা কথা বলি?"
কথা গুলো শুনে কিছুটা থেমে ভৈরববাবু বললেন, "হ্যাঁ হ্যাঁ বলো তুমি। আসলে এমন সময় রক্তের দরকার পড়লো। খুব চিন্তায় পড়ে গিয়েছি।"
"কাকু আমি পেশায় সাংবাদিক। আপনি যদি চান তাহলে আমি আমার বেশ কিছু সোর্স কাজে লাগিয়ে বি নেগেটিভ রক্তের জন্য আবেদন করতে পারি। অনেক লোকের কাছে খবর পৌঁছলে আমরা অবশ্যই রক্তের জোগাড় করতে পারবো।"
"অনেক ধন্যবাদ তোমাকে। তুমি এভাবে আমাদের সাহায্য করতে এলে।"
" না না কাকু। এসব বলবেন না। আপনি ভগবান কে ডাকুন। দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে। আর ভয় পাবেন না। রবি ঠাকুর বলেছেন,
           বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা–
             বিপদে আমি না যেন করি ভয়।
           দুঃখতাপে ব্যথিত চিতে নাই-বা দিলে সান্ত্বনা,
              দুঃখে যেন করিতে পারি জয়।।
দু দিন পর,
মিস মোহর মুখার্জীর বাড়ি থেকে কে আছেন? ওনার জ্ঞান ফিরে এসেছে। এখন অনেকটা স্টেবল। আপনারা যে কেউ
দুজন গিয়ে দেখে আসতে পারেন।
কিছুটা নিদ্রাচ্ছন্ন ভৈরব বাবু কথাটা শুনেই এক লাফে সোজা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন," কত নম্বর কেবিন এ?"
আই. সি.ইউ এর বেড এ শুয়ে মোহর। অক্সিজেন মাস্ক সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভেতরটা শীততাপ নিয়ন্ত্রিত। মোহরের চোয়ালের অংশটা প্লাস্টার করা, বাঁ পাশের দিকে কিছুটা অংশ ড্রেসিং করা, বাঁ চোখটা এখনো বন্ধ হয়ে ফুলে রয়েছে।
"কিরে মা এখন কেমন লাগছে?" ভৈরববাবু জিজ্ঞেস করলেন।
মোহর ঘাড় নাড়িয়ে কিছু একটা বোঝাতে চাইলো।
এখন মাস খানেক কথা বলতে পারবেনা ও। যতদিন না অবধি প্লাস্টার খোলা হয়।
ভৈরববাবু বললেন, "জানিস মা, একটা ছেলে খুব সাহায্য করলো রে আমাদের। নাহলে যা বিপদে পড়েছিলাম। রক্ত জোগাড় করা ওষুধ আনা, ও না থাকলে যে কি হতো! খুব ভালো ছেলেটা। বললাম তোর সাথে দেখা করতে, করলো না। শুধু বললো এই রবিবার তোকে টিংগো রেডিওটা শোনাতে।"
মোহর বেশ কিছুটা অবাক হলো। মনে মনে ভাবলো, রবিবারের শো তো ও নিজে কন্ডাক্ট করতো। ওটা কেন শুনতে বলল? কি হবে ওই শো তে।
নার্স এসে চলে যেতে বলল ভৈরববাবুকে।মোহরের ঘুমানো দরকার।
সেই রবিবার,
আমি আকাশে পাতিয়া কান
শুনেছি শুনেছি তোমারি
গান,
আমি তোমারে সঁপেছি
প্রাণ ওগো বিদেশিনী।
ভুবন ভ্রমিয়া শেষে আমি
এসেছি নূতন দেশে,
আমি অতিথি তোমারি
দ্বারে ওগো বিদেশিনী॥

আমি চিনি গো চিনি
তোমারে ওগো বিদেশিনী।।

আপনারা শুনছেন রবি অন এয়ার উইথ আর জে পৃথ্বী। হ্যাঁ বিশেষ কারণ বশতঃ আজ আর জে মোহর এর জায়গায় আমি আর জে পৃথ্বী সাথে নিয়ে রবি ঠাকুরের বেশ কিছু অনবদ্য সৃষ্টি।
                                              
মাস দেড়েক পর,
"ম্যাডাম, আসতে পারি?"
নিজের ঘরের বিছানায় শুয়ে আছে মোহর। একটা সাদা আলোর পি এল জ্বলছে। আওয়াজটা শুনেই  দরজার দিকে তাকালো ও।
"তুমি! মানে আপনি! কি দরকার?"
"এখানে দাঁড়িয়েই বলবো?"
"না মানে আসুন ভেতরে। টিউব লাইট টা...."
"আমি জ্বালিয়ে নিচ্ছি। তুমি বেশি নড়াচড়া করোনা। এখনো মাস খানেক লাগবে বলেছে ডাক্তার।" এই বলে ছেলেটা টিউবলাইট টা জ্বালিয়ে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বিছানার পাশে গিয়ে বসলো।
"এখন কেমন অবস্থা শরীরের? কথা বলতে অসুবিধা হচ্ছে না তো?"
"আগের থেকে অনেকটা বেটার। কিন্তু ওই একটু তো কষ্ট হচ্ছেই কথা বলতে।"
"তাহলে আর কিছু বলতে হবেনা। আমি বলছি তুমি শোনো।" এই বলে একটানা কথা গুলো বলতে থাকলো ছেলেটা।
"দু দিন আগে স্টুডিওতে এসে থ্রেট, তারপর উড়ো ফোন করে বাড়িতে থ্রেট, আর তার দু দিন পর রোড এক্সিডেন্ট। পুরো ঘটনাটা লিঙ্কড কিনা জানার জন্য আমি বেশ কিছুদিন থেকে বেশ কিছু খোঁজ চালাচ্ছিলাম। আর এই কয়েকদিনে আমার হাতে এসে পৌঁছেছে একটা সি সি টিভি রেকর্ডিং, যেটা এক্সিডেন্ট স্পট এর সামনের বাড়ির সি সি টিভি থেকে পেয়েছি। যেটা তে গাড়িটা স্পষ্ট কিন্তু অন্ধকার থাকায় নাম্বার প্লেট বোঝা যাচ্ছেনা। আর উড়ো ফোনের ফোন নাম্বার ট্রেস করা হয়েছে। আরো বেশ কিছু তথ্য আছে। যেটা আমাদের উকিল মিস্টার রক্ষিতের কাছে পৌঁছে গিয়েছে।"
"কিন্তু তুমি এত কিছু হঠাৎ কেন আর কিভাবেই বা...." মোহরের কথা শেষ করতে দিলোনা ছেলেটা বলল,
"বলেছি না তুমি কিছু বলবেনা। এবার সময় এসে গিয়েছে। লড়াইটা শুরু করার। তৈরি তো?"
মোহর ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।
ছেলেটা বলল, "আচ্ছা বেশ! এখন তাহলে চলি। আবার একটু অফিস ঢুকতে হবে। তোমার জন্য বেশ কিছু বই দিয়ে যাবো। পড়ে দেখো, সময় কাটবে।"
মোহরের চোখের কোণের জল চিকচিক করে উঠলো। ও বলল, "বাংলার উচ্চারণ একদম স্পষ্ট দেখছি। তো কোন কাগজে আছেন মিস্টার পৃথ্বী"
আবারও কথাটা শেষ করতে দিলোনা ছেলেটা। বললো "দিনের খবর পত্রিকা। আর কথা বলোনা। এখনো সম্পূর্ন সুস্থ হওনি কিন্তু। গান শুনবে?"
মোহর আবার ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।
পৃথ্বী ঘর থেকে বের হবার আগে হোম থিয়েটারটা চালিয়ে দিলো।
গান বাজতে থাকলো রবি ঠাকুরের,
                  " মুখে হাসি তবু চোখে জল না শুকায় রে
                              হায় ভীরু প্রেম হায় রে।
                    জয় করে তবু ভয় কেন তোর যায়না
                               হায় ভীরু প্রেম হায় রে।"

আর চোখ দিয়ে অঝোরে জল ঝরতে থাকলো মোহরের।
                                                
"মোহর মা, জেগে আছিস? দেখ কে এসেছেন তো সাথে দেখা করতে!" ভৈরব বাবু মোহরের ঘরে ঢুকে টিউবলাইটটা জ্বালালেন। সাথে এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক, চোখে রিমলেস চশমা আর গায়ে কালো ব্লেজার।
"ও মিস্টার রক্ষিত আপনি! আসুন প্লিজ।"
"তুমি আমায় এক দেখায় চিনে গেলে? কিভাবে?"
"হা হা। একচুয়ালি পৃথ্বী আপনার ফটো দেখিয়ে বলেছিল আপনি আসবেন। কেসটা নিয়ে আলোচনা করতে। তাই আর কি!" সামান্য হেসে বললো মোহর।
"ওহ! তাই বলি। তো এখন শরীর কেমন আছে তোমার?"
 "ওই আর কি আছে এক রকম। আগের চেয়ে অনেকটা বেটার।"
"আজ মঙ্গলবার। আগামী শুক্রবার আমাদের কোর্টের প্রথম ডেট। তুমি জানো তো তোমাকে কি কি বলতে হবে? তুমি তোমার স্টেটমেন্টে স্টেবেল থেকো। বাকি আমি সামলে নেবো।"
সেই শুক্রবার,
"সেদিনের ঘটনায় যে ফুটেজ গুলো পাওয়া গিয়েছে সেগুলির কোনোটিতেই আমার মক্কেল শম্ভু মন্ডলের কোনো চিহ্ন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তারপর ও কিভাবে....."
"অবজেকশন মাই লর্ড। এই ফুটেজগুলো থেকে গাড়ি ছাড়া আর কিছুই বোঝা যাচ্ছেনা। আর গাড়ির ভেতরে যদি কেউ থাকেও তাহলে সেটা কালো কাঁচের ভেতর দিয়ে কোনো ভাবেই বোঝা সম্ভব নয়। আর পুলিশের জেরায় তো শম্ভু নিজেই স্বীকার করেছে যে গাড়িতে ও-ই ছিল।"
"নো মাই লর্ড। আমার মক্কেল পুলিশের থার্ড ডিগ্রির চাপ নিতে পারেনি। তাই ওই সব বলেছে।"
নিজের উকিলের কথার সাথে সম্মতি জানায় শম্ভু।
"শম্ভু মন্ডলের ফোন ট্রেস করে জানা যায় সে সময় উনি ঘটনার স্পটেই ছিলেন। আমি মহামান্য আদালতকে তার চার্ট আগেই জমা করে দিয়েছি।" মিস্টার রক্ষিত বললেন।
আজকের আদালত এখানেই স্থগিত থাকলো।
মোহর বাইরে বেরিয়ে গাড়িতে গিয়ে উঠলো। পৃথ্বী আসেনি আজ। "আসলো না কেন আজ? কি প্রমাণ করতে চাইলো না এসে?" মনে মনে খুব রাগ রাগ হলো ওর।
গাড়ি চলতে শুরু করলো। মিউজিক প্লেয়ারে গান চালিয়ে বাইরে তাকালো ও। গান বাজতে থাকলো। রবি ঠাকুরের গান,

            হৃদয়ের এ কূল, ও কূল, দু কূল ভেসে যায়
                    হায় সজনি, উথলে নয়নবারি
             হৃদয়ের এ কূল, ও কূল, দু কূল ভেসে যায়
                    হায় সজনি, উথলে নয়নবারি

                                         
ছয় মাস পর,
"সকল সাক্ষ্য প্রমাণ থেকে আজকের আদালত এই সিদ্ধান্তে এসেছে যে, মোহর মুখার্জীকে হত্যার চেষ্টা করার জন্য আদালত দোষী শম্ভু মন্ডলকে আই. পি. সি সেকশন ৩০৭ এর আওতায় রেখে দশ বছরের কারাদন্ড আর পঁচিশ হাজার টাকা জরিমানা দেওয়ার আদেশ জানালো।"
ভৈরব বাবু আনন্দে জড়িয়ে ধরলেন মোহরকে। টানা ছয় মাসের লড়াইয়ের পর অবশেষে জয়।
"কাকু চলুন আপনাদের বাড়িতে ড্রপ করে দেই।" ভৈরববাবুকে বলল পৃথ্বী।
"আচ্ছা বেশ। কিন্তু আজ কিন্তু খেয়ে যেতে হবে।"
"না কাকু। আজ না।  আবার তো আসবোই। একটা জরুরী কাজ আছে।"
"আবার কি কাজ?" ভৈরববাবু বেশ চিন্তিত ভাবে বললেন।
"আছে। ওটা সারপ্রাইজ।"
গাড়িতে উঠেই মোহর এফ এম চালাতে গেল। পৃথ্বী বাঁধা দিলো। বললো,
"গাড়ির গ্লোভ বক্সটা খুলে দেখো একটা গিফ্ট আছে।"
মোহর গ্লোভ বক্সটা খুললো। একটা সিডি। নির্বাচিত রবীন্দ্র সঙ্গীত। মোহর চালালো সিডিটা। গাড়ি চলতে থাকলো, সাথে রবি ঠাকুরের গান,
                 আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে,
                  আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ঘাসে ঘাসে॥
             দেহ মনের সুদূর পারে হারিয়ে ফেলি আপনারে,
                গানের সুরে আমার মুক্তি উর্ধ্বে ভাসে॥
তিন দিন পর,
কলিং বেল বাজলো।
"নমস্কার। আমার নাম প্রীতিনাথ রায় চৌধুরী।"
"আরেহ! আসুন আসুন ভেতরে আসুন।" ভৈরববাবু বললেন।
"এতো কিছু আনার কি দরকার ছিল। আপনারা তো নিজের লোকই।"
"কি যে বলেন। আপনারা আপন তার সাথে মিষ্টির কি সম্পর্ক। একটা সম্পর্কের সূচনা মিষ্টি দিয়েই তো করা উচিত।"
"ঠিক বুঝলাম না দাদা। সম্পর্কের সূচনা বলতে?"
"আমার ছেলে পৃথ্বীরাজ আপনার মেয়েকে ভালোবাসে। যদি আপনি সম্মতি দেন তো একটা শুভ দিন দেখে...."
"অবশ্যই। আমরা তো রাজি। পৃথ্বী আমাদের জন্য যা করেছে। ও তো আমাদের ছেলের মতো। আপনি শুভ দিন দেখুন।"
"বাহ! তাহলে তো হয়েই গেল। কিন্তু ওরা একবার নিজেদের মতো কথা বলে নিক"
মোহর এতক্ষণ স্থির হয়ে ছিল। কি হচ্ছে ওর কিছুই মাথায় ঢুকছিলনা। এবার মনে মনে ভাবলো, যাক এবার সবটা খোলসা করবে।
ওদেরকে মোহরের ঘরে পাঠিয়ে দিলো ভৈরববাবু।
"কি ব্যাপার? এসব কি? পৃথ্বী রাই থেকে পৃথ্বীরাজ রায় চৌধুরী! কি হচ্ছে কিছুই তো বুঝতে পারছিনা।
"তখন যদি বলতাম আমি সম্ভ্রান্ত বনেদি বাঙালি পরিবারের ছেলে তাহলে এই পাগলী মেয়েটার কথার দৃঢ়তাই তো বুঝতে পারতাম না। জানো সেদিন তোমার ওই কথা গুলো আমাকে আরো বেশি করে বাধ্য করেছিল তোমাকে ভালোবাসতে।"
"তাহলে মাঝে এত বছর কোথায় ছিলে তুমি? তখন কেন এলেনা?"
"কলেজ পাশ করে আমি চলে গিয়েছিলাম ফ্রাঙ্কফুর্ট, জার্মানি।  ওখান থেকে যখন ফিরে আসি দেশে তখন তুমি রেডিওতে কাজ করছো। ভেবেছিলাম আসবো। সব ঠিক ও করে ফেলি আর তখনই এক্সিডেন্ট।"
"যাহ! আমি আরো ভাবলাম সকালে উঠে ধোকলা খেতে পারবো। সেই অ্যাকোয়ারিয়ামে ডুবেই মরতে হবে।" মুখ টিপে হাসলো মোহর।
"ইন্ডিয়ান সাউথ ইন্ডিয়ান বা বিদেশী সব ডিশ বানানোর সম্পূর্ণ স্বাধীনতা আছে। বানিয়ে নিয়ো। হা হা হা।"
"তাহলে বিয়েটা করতেই হবে? আচ্ছা বেশ তাহলে ভালোভাবে প্রপোজ করো।"
"আচ্ছা বেশ তাই সই।" মোহরের সামনে এসে ওর হাতটা ধরলো পৃথ্বী। তারপর বলল,
"পথ বেঁধে দিলো বন্ধনহীন গ্রন্থি। আমরা দুজন চলতি হওয়ার পন্থী।"
"এ আবার কেমন প্রপোজাল! হঠাৎ শেষের কবিতা কেন?"
পৃথ্বী একটানে মোহরকে নিজের একদম কাছে টেনে নিলো। তারপর কানে কানে বলল,
"শেষ থেকে শুরু করবো বলে...."
                                      ।।।সমাপ্ত।।।

(গল্পের সমস্ত ঘটনাই কাল্পনিক। বাস্তবের সাথে কোনো মিল থাকলে তা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত।)




লেখক- দ্বীপজ্যোতি গাঙ্গুলি

0 comments:

Post a Comment