ভয়ের আয়না
মিলন পুরকাইত
সেদিন অফিস থেকে বাড়ি ফেরার সময় বাস থেকে নেমে সঞ্জয় হাঁটছিল। উদ্দেশ্যহীন
ভাবেই ও হাঁটছিল তখন। বাড়ি তে ফেরার সময় এই রাস্তাটুকু অলসভাবে উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাঁটতে
ওর বেশ ভাল লাগে। এমনিতেই অফিসের কাজ, কাজের চাপ নিয়ে ও ভীষণ ভাবে জর্জরিত, তাই এই
সময়টুকু ও শুধু নিজেকেই উপহার দেয় - রোজ।
সঞ্জয় হাঁটতে হাঁটতে একটা পার্কের একপাশে এসে দাঁড়ায়। ও অবাক হয়ে তাকিয়ে
থাকে ভেতরে, পার্কের দিকে। নিজেকে প্রশ্ন করে: এটা কী? কোথা থেকে এল? আজ সকালেও তো
এটা এখানে ছিল না। আয়নাঘর?
একটা বিশাল বড় রঙিন তাঁবু রাতারাতি যেন তৈরি হয়ে গেছে ওই পার্কের মাঝে।
সেখানে সামনে বড় বড় করে লেখা আয়নাঘর। একজন দাঁড়িয়ে আছে ওই তাঁবুর সামনে - ঢোকার মুখে।
সঞ্জয়ের ভীষণ কৌতূহল হল হঠাৎ করেই। হাতঘড়িটা উল্টে দেখল। সবে ছটা বাজে।
মনে মনে ও হিসেবে করে নেয়। মাধুরীর তো কিটি থেকে আসতে এখনও ঘন্টাখানেক বাকি। ছেলেটাও
টিউশনি সেরে আসতে আসতে আরও দেড় ঘন্টা। বাড়িতে গিয়ে এখন চুপ করে বসে থেকে টিভি দেখে
আর কী হবে! তার থেকে এখানেই একটু ঢুঁ মেরে দেখে এলে হয়। নতুন কিছু হলে, পরে মাধুরী
আর জোজো কে সাথে করে নিয়ে আসব।
এই ভেবে সঞ্জয় এগিয়ে গেল তাঁবুর দিকে। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটির দিকে তাকিয়ে
জিজ্ঞেস করে: কী আছে ভেতরে?
আয়না স্যার। আজ সকালেই আমরা তৈরি করেছি এই আয়নাঘর। একবার ঘুরে আসুন। খুব
ভাল লাগবে।
আয়না? আয়না দেখে কী করব? জিজ্ঞেস করে সঞ্জয়।
লোকটা দেঁতো হাসি হেসে বলে: এ যে সে আয়না নয় স্যার। এটা দেওয়ালে টাঙিয়ে
রাখা ছোট খাটো আয়না নয়। এ হচ্ছে বিশাল বড় বড় আয়না। ওপরে, নিচে, পাশে, ডানে, বামে চারদিকে
শুধুই আয়না। নানান রকমের। একবার ঢুকেই দেখুন না স্যার! এক ঘন্টার জন্য মাত্র একশো টাকা।
সঞ্জয় পকেট হাতড়ে একশো টাকা বের করে লোকটার হাতে ধরিয়ে দিয়ে তাঁবুর সামনে
টাঙানো ভারী পর্দাটা সরিয়ে ভেতরে ঢুকে যায়। ভেতরে ঘন অন্ধকার। বেশ কিছুটা সময় ও ওখানেই
দাঁড়িয়ে থাকে। তারপরেই হঠাৎ ওর চোখের সামনে আলো ভেসে আসে। ধীরে ধীরে ঘরের ভেতরে চারদিক
থেকে আলো জ্বলে ওঠে। আর সেই আলোর সাথে কোথা থেকে ভেসে আসে ঠান্ডা হিমেল স্রোত। তারপরেই
সঞ্জয়ের চোখে পড়ে তাঁবুর ভেতরের দেওয়ালগুলো।
ঘরজুড়ে কেবল আয়না। লম্বা, গোল, বাঁকা, ভাঙাচোরা, স্বচ্ছ - প্রতিটি দেওয়ালে,
প্রতিটি কোণে ঝুলছে অসংখ্য আয়না। অনেক আয়না নেমে এসেছে ছাদ থেকে। ওপরের দিকে তাকায়
সঞ্জয়। আয়নাগুলো কি হাওয়াতে ভাসছে? কীভাবে ঝুলে আছে ওগুলো? কোনো তার বা চেন, কিছুই
তো দেখতে পাচ্ছি না। ধীরে ধীরে সঞ্জয় এগোতে থাকে সামনের দিকে।
প্রথমে ওর খুব হাসি পেল। নিজের মুখ বারবার ভেসে উঠছে। নানান আয়নাতে। নানান
ভাবে। ও এমনকী ভাল করে নিজের পেছন দিকটাও দেখতে পেল এবার। মাথার পেছনে হাত দিয়ে ও মনে
মনে বলল: কী অবস্থা। আমার মাথার পেছনের চুপ এত পাতলা হয়ে গেছে? কয়েক মাস পরেই তো টাক
পড়ে যাবে। আর চুলগুলো এত সাদা কবে হয়ে গেল?
আরো নানান ভাবে সঞ্জয় নিজেকে দেখতে থাকে। হাসতে থাকে নিজেকে নানান ভঙ্গিতে
দেখে। কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ভয়ে ওর হাত পা কাঁপতে শুরু করে। ভেতরের প্রচন্ড
ঠান্ডার মধ্যেও ও ঘামতে শুরু করে - দরদর করে।
কারণ ধীরে ধীরে প্রতিটি আয়নায় ওর এক এক রকম রূপ ফুটে উঠতে শুরু করে।
একটা আয়নায় ও দেখতে পায় নিজেকে - অফিস থেকে বাড়ি ফিরে অফিসের ব্যর্থতার
রাগ দেখাচ্ছে ও ছেলে আর বৌয়ের ওপরে। রেগে জোজোর গায়ে হাত তুলছে।
আর একটা আয়নায় ও নিজেকে দেখতে পায়, তবে সেটাতে ওর বয়স অনেকটা কম - গ্র্যাজুয়েশন
পরীক্ষার সময় পকেট থেকে ছোট কাগজ বের করে নকল করছে। তারপরে পাশের বন্ধুর খাতা থেকে
উত্তর নকল করে পাস করছে। তার পরেও যাতে বেশি নম্বর পেতে পারে তাই জন্য কলেজের ইউনিয়নে
গিয়ে সেখানে হাজার দশেকটাকা ঘুষ দিয়েছিল ও।
আবার একটা আয়নায় ও দেখতে পায় নিজেকে, তবে অন্য একটা সময়ে - বাবার ওপরে চেঁচামিচি
করছে ও। কারণ বাবা ওকে ওর পড়াশোনা নিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছিল। সেদিন সঞ্জয় ওর অল্পশিক্ষিত
বাবার ওপরে ঘরভর্তি লোকজনের সামনে এই বলে চেঁচিয়ে উঠেছিল যে তুমি চুপ করে থাকো। কিছুই
তো জানো না। বোঝো না। পড়াশোনা তো আর বেশি করো নি। কী করে বুঝবে?
তারপরেই আর একটা আয়নায় সঞ্জয় দেখতে পায় ওর ছোটবেলার আর একটা ছবি - ছোট্ট
সঞ্জয় একটা পুঁচকে ছোট বেড়ালছানা কে ধরে হাসতে হাসতে তাকে ড্রেনে আছড়ে ফেলছে। আর মজা
দেখছে।
ও দুহাতে মাথা চেপে ধরে।
চোখ সরাতে যায়। কিন্তু ওর চারদিকে তখন শুধুই আয়নাগুলো ঝকঝক করছে। আর প্রতিটি
আয়নাতে ভেসে উঠছে ওর এক একটা করা ভুল। ওর মনে হচ্ছিল প্রতিটি প্রতিচ্ছবি চিৎকার করে
বলছে - এটাই তো তুমি।
সঞ্জয় দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। দৌড়ে গেল ও এক কোণায়। কিন্তু সেখানেও
অন্য আর একটি আয়না।
এবার সঞ্জয় দেখল বছর কুড়ির আগের এক ঘটনা - বছর কুড়ি আগে, যখন কলেজ শেষে
ওর তিন বছরের প্রেমিকা কেঁদে ওর সামনে ওকে বারবার অনুরোধ করেছিল, তখন নির্মমভাবে সঞ্জয়
ওকে প্রত্যাখ্যান করে। বলেছিল, তোর মত মেয়েদের সাথে প্রেম করা যায়। তার বেশি কিছু না।
কী আছে তোর কাছে? তোর বাবার কাছে? তোদের তো না আছে কোনো সম্পত্তি, নিজেদের বাড়িটাও
নেই। তুই আমার সাথে থাকবি? আমাকে ধরে ওপরে উঠতে চাইছিস? সরে যা আমার কাছ থেকে। সরে
যা!
সঞ্জয় কেঁপে উঠল। জোরে চেঁচিয়ে বলল: না, এসব তো কেটে গেছে। সেই সব সময় আমি
কাটিয়ে চলে এসেছি অনেক দূরে। আমি সব কিছুই ভুলে গেছি। সব।
সঞ্জয় কাঁপা কাঁপা গলায় ফিসফিস করে যেন নিজেকেই প্রশ্ন করল : আমি যদি এবার
থেকে অন্যরকম হয়ে যাই? যদি সব ঠিক করার চেষ্টা করি?
আয়নাটা যেন হেসে উঠল। কাচের ফাঁক দিয়ে ফিসফিস করে কিছু কথা ভেসে আসে।
নিজের প্রতিচ্ছবি থেকে কি কখনও মুক্তি সম্ভব? অতীত থেকে কি পালিয়ে যাওয়া যায়?
সঞ্জয় হঠাৎ সেই সময়েই বুঝল : ভয়ের আসল উৎস ভূত বা ঘোরতর অন্ধকার নয়।
ভয়ের আসল উৎস হল নিজের জীবন। জীবনের যেখানে যত গোপন দোষ, গোপন করে রাখা কথা, সবকিছুই
আমাদের মনের আয়নাতে জ্বলজ্বল করতে থাকে সবসময়।
তারপরেই সঞ্জয়ের সামনে তাঁবু থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর্দাটা হঠাৎ সরে যায়।
সেই লোকটা কোথা থেকে ছুটে আসে। জিজ্ঞেস করে: স্যার, কেমন লাগল?
সঞ্জয় কিছু বলল না। চলে গেল। মাথা নিচু করে। যাওয়ার সময় বিড়বিড় করে বলতে
শুরু করে: আমি আর আয়নার দিকে কোনোদিন তাকাতে পারব না। কোনোদিন না। বাবা একবার বলেছিল,
সঞ্জু, নিজেকে চেনাটা খুব দরকার। নিজেকে বোঝাটা সবথেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। নিজেকে জানলে
তুই প্রকৃত শিক্ষিত হতে পারবি।
সঞ্জয় দুদিকে মাথা নেড়ে বলতে থাকে, আমি পারি নি বাবা। আমি শিক্ষিত হতে পারি
নি। নিজেকে চিনতেও পারি নি। নিজেকে জানতেও পারি নি, বুঝতেও পারি নি।
তখন'ই একটা পাগল পাশ থেকে হঠাৎ এসে ফিসফিস করে বলে: রোজ নিজেকে আয়নায় দেখ
রে পাগলা, দিনের শেষে, ঘুমের আগে। সব হবে। সব হবে। তারপরেই সে ভীষণ জোরে জোরে হেসে
দৌড়ে চলে যায়। মিলিয়ে যায়, মিশে যায় ভিড়ের মধ্যে।
0 comments:
Post a Comment