Aug 24, 2020

"এই তো এভাবেই" - লগ্নজিতা দাশগুপ্ত

Edit Posted by with No comments

 


এই তো এভাবেই

লগ্নজিতা দাশগুপ্ত

ফ্রিজ থেকে গত পরশুর বানানো চিঙড়ির মালাইকারিটা বের করে টেবিলে রাখলো মোহর। তাঁর পর গরম ভাতের সাথে মেখে খাওয়া শুরু করলো। মোহরের শাশুড়ি মা তো অবাক। যে মেয়েকে একদিন মাছ খাওয়াতে তাঁর কালঘাম ছুটেছে সেই মেয়ে কিনা মাছ খাচ্ছে তাও চিংড়ি মাছ, একাদশীর দিন।

"মতি ফিরেছে তবে"...

'পাত্রপক্ষকে আসতে বলে দাও"...

হার্ট এট্যাক আসবে তো এবার আমার, তুই সব শুনছিস আমার কথা।"

"সেইদিন অ্যাকসিডেন্ট এর সময় আলেখ্য সাথে মন্দারমণি থেকে ফেরার পথে ওর পি.এ কাম সুন্দরী বান্ধবীও মারা যায়।"

"বলিনি, তবে কৈফিয়ত হিসেবে যদি বলিস তবে বলবো কেউ না থাকা কষ্টের কিন্তু বিশ্বাসভঙ্গ বেশী ক্ষত তৈরী করে..."

"তবে তুমিও বলোনি..."

"সন্তানের প্ৰিয় জিনিস হারিয়ে গেলে সন্তানের কষ্ট মা সহ্য করে নেয় কিন্তু সেই সন্তানের বিশ্বাস ভাঙলে কিভাবে জোড়া লাগাতে হয় আমার জানা ছিল না রে মা..."

"তুমি মা না হয়ে শাশুড়ি হলেই ভালো হতো আমাকে অন্তত নতুন শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় কাঁদতে হতো না..."

"পাগলী মেয়ে আমার..."

প্রাসাদসম বাড়িটা থেকে বেরিয়ে এলো কেকা। একদিন সাধ করে নিজের ডাক্তারী বিদ্যা, মা-বাবাকে ছেড়ে সৈকত এর হাত ধরে এই বাড়িতে ঢুকেছিল। ওর ডাক্তার বাবা-মা এর সৈকতকে পছন্দ ছিল না কারণ সৈকত এর দাবি ছিল গোল্ড মেডেলিস্ট ডাক্তার কেকা ভট্টাচাৰ্য প্র্যাক্টিস করতে পারবে না কারণ এতে সে সংসার-সন্তানকে সময় দিতে পারবে না। ছোটবেলার থেকে আয়ার কাছে মানুষ হওয়া কেকা রাজি হয়ে গিয়েছিলো। শুধু বাড়ির থেকে বেরোনোর আগে বাবা বলেছিলো "কখনও ফিরতে ইচ্ছে করলে ফিরিস, তোর মা আমি বিনামূল্যে যেখানে চেম্বার করি ওখানেই তুইও রোগী দেখিস"। একবুক স্বপ্ন নিয়ে হাত ধরেছিলো সৈকত এর। সবটা সত্যি হয়েছিল কিন্তু পাপের পাহাড়ের ওপরে দাঁড়িয়ে। তাই নিজেদের অ্যানিভার্সারির রাতে যখন নেশাতুর সৈকত পার্টনার এর সাথে নার্সিংহোমের সমস্ত বেআইনি কাজের আলোচনা করছিল অলক্ষ্যে সবটা শুনে বিদ্রোহ করেছিল কেকার মন। সাতপাঁকের মন্ত্রগুলো খুব ফিকে হয়ে গিয়েছিলো ডাক্তারী ডিএনএ আর ডাক্তার হওয়ার সময় কেকার শপথ বাক্য এর সামনে। তাই আজ প্রমাণ এর সাহায্যে সৈকত ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা জেলে আর কেকার আজ নিজের বাড়ির পথে।

ঘরে ফেরার গান গাইছে যেন কেউ।

সার্টিফিকেটে আর নিজের জমানো অর্থে কেনা কিছু বই নিয়ে বাড়ি ছাড়লো আলোলিকা মুখার্জী। বাবা বললো আমার একটাই পুত্র সন্তান, কন্যাটি আজ থেকে মৃত, জেঠু-কাকা বললো চিরকাল এর জন্য বাড়ির দরজা বন্ধ, দাদা জানিয়ে দিলো ভুলেও এ রাস্তায় পা মারাস না। আর লোকজন বললো স্বার্থপর।

পেছনে পরে রইলো মুখার্জীবাড়ি, আলোলিকার আজন্ম নারী হয়ে জন্মানোর অপরাধে গুমরানো কান্না। লোকে আলোলিকা স্বার্থপর বললো ঠিকই কিন্তু সে নিজে জানে এই সুবিশাল পৃথিবীতে সে সম্মান-ভালোবাসা যদি কখনও কারও কাছে পেয়ে থাকে সেটা শেখর। কিন্তু তাঁদের অপরাধ, শেখর দত্ত কখনও মুখুজ্জ্যদের জামাই হতে পারবে না, একে জাতে নীচু তাঁর ওপর কলেজ এ মাস্টারি করা মেয়ে কিনা নাটক লেখা ছেলেকে বিয়ে করবে। কিন্তু ওই যে বিদ্রোহী মন, আর প্রেমের জন্য তো সে বারবার বিদ্রোহ করেছে। তাই আলোলিকা জীবনে প্রথমবার বিদ্রোহটা করেই বসলো।

এবার আর মা কাকিমার কথা না শুনে নিজের প্ৰিয় আসমানী জামদানীটা পরেই পাত্রপক্ষের সামনে বসবে বলে ঠিক করলো কোপাই। কারণ জানো এবারও রঙের জন্য সে রিজেক্ট হবে। তাঁর ইউনিভার্সিটি কিংবা গান-নাচের ডিগ্রী আর ইউটিউব এ রান্নার চ্যানেল এর সামনে পাহাড়প্রমাণ উচ্চতা নিয়ে দাঁড়াবে তাঁর গায়ের রং। তাই এবার নিজের প্ৰিয় রঙটাই পরলো সে।

কিন্তু চায়ের কাপ নিয়ে পাত্রপক্ষের সামনে ঢুকতেই পাত্রকে দেখে চক্ষুচরক গাছ। সেই হরলিক্স এর বোতল। মানে এই নামেই আলোককে ডাকতো ওদের ক্লাসের মেয়েরা। পড়াশোনায় তুখোড় হলেও এক ক্লাস সিনিয়র আলোকের হাই পাওয়ারি চশমা আর শান্তশিষ্ট আচরণ এর জন্যই তাকে সবাই খ্যাপাতো । ঠিক যেমন কোপাইকে কালা কাক বলতো ওরা সবাই।

আজ রিমলেস চশমার আড়ালে সেই সরস্বতী পুজোয় আসমানী কোপাইকে যে চোখ জোড়া আটকে রাখতো তাকে চিনতে অসুবিধে হলো না কোপাই এর। সে যতই ক্লাস টেনের আলোক আজ ডক্টর আলোক রায় হোক, প্রেমিক এর মন তো তাই ঠিক কোপাই এর তীরে ঠিক চলে এসেছে।

আর ওদিকে একজন ওপর থেকে আসমানী বেনারসী পরা কোপাই এর বিয়ের ফ্রেম সাজাতে ব্যস্ত তখন যখন গোধূলি লগ্নে ছাতে একান্তে আলাপচারিতায় উঠে ছিল আলোক আর কোপাই।

কণে দেখা আলো কী তবে এটাই,কোপাই যে বড়ো লজ্জা পাচ্ছে ক্লাস নাইন এর কিশোরীর মতো।

 

 

প্ৰিয় দক্ষিণী কালো পোশাক আর লাল লিপস্টিকটা ঠোঁটে লাগিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এলো শুভ্রশ্বেতা। অন্তরীক্ষ এর একদম পছন্দ না পশ্চিমী সাজ আর গাড় লিপস্টিক। কিন্তু পশ্চিমী দেশে অর্থ কামাতে যাওয়ার ইচ্ছেটা তাঁর বরাবর এর আছে। তাই সাত বছরের সম্পর্কটাকে বিদায় জানালো শুভ্রশ্বেতা। কারণ এতদিন সে শুধুই সে অন্তরীক্ষ এর জন্য বেঁচেছে, কিন্তু আজ থেকে সে শুধুই নিজের জন্য বাঁচবে। তিলোত্তমায় তাঁর জীবন এর সুর বাজে তাই গানের স্কুল ছেড়ে সে কিছুতেই বিদেশে সংসার পাতবে না।

ট্যাক্সিটাকে ফুচকার দোকানের সামনে দাঁড়াতে বললো মৃণালিনী, অনেকদিন সে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুচকা খায় না সেই স্কুলবেলার মতো। কারণ একটাই ওয়েট মেইনটেইন আর আনহাইজেনিক ওর উচ্চবৃত্ত শ্বশুরবাড়ির স্ট্যাটাস এর সাথে মেলে না। আজ মন ভরে ফুচকা খেলো সে, এইসময় নাকি টক খেতে ভালো লাগে। পাশের দোকান থেকে এক প্যাকেট বিরিয়ানিও নিয়ে নিলো। রাতে হোস্টেল এ গিয়ে প্রথম দিন আর কোথায় খাওয়ার আনতে যাবে এত দিন শুধুই স্যালাড আর জুস খাইয়ে রাখতো ওর শাশুড়ি কারণ বডি ফিটনেস। আজ অনেকদিন পর সে মন ভরে খাবে।

ও হ্যাঁ বলা হয়নি আজ মৃণালিনী সেন থুড়ি মৃণালিনী গুহ উচ্চবৃত্ত শ্বশুরবাড়ি ছেড়েছে। শ্বশুরবাড়ির লোকের কোনো দোষ নেই, সব অপরাধ মৃণালিনীর। কারণ একে তো গর্ভে কন্যাসন্তান তায় সে গর্ভপাত করতে রাজি হয়নি। তাই আজ গার্লস হোস্টেলমুখী মৃণালিনী। আবৃত্তির স্কুলটা নতুন করে শুরু করবে সে।

আট বছরের সম্পর্কটা থেকে বেরিয়ে এলো শুদ্ধসত্তা। বিশেষ কিছুই না সংসার করতে হলে ওর সাধের ঘুঙুরগুলোকে ছাড়তে হবে, এমনটাই শর্ত ছিল রণিত এর মায়ের। নির্লিপ্ত ছিল রণিত। কারণ ভদ্র বাড়ির মেয়ে বউরা নাচে না। কিন্তু আঠারো বছরের ছন্দময় সম্পর্কের সামনে আট বছরের সম্পর্ক এর তাল কেঁটে গেলো।

ডিভোর্স পেপারে সই করে কোর্ট থেকে বেরিয়ে এলো মুকুলিকা। রণর দোষ বিশেষ কিছুই ছিল না শুধুই রাগের মাথায় ফুলদানি ছুঁড়ে মেরেছিল মুকুলিকার দিকে আর কপালটা একটু ফেঁটে গিয়েছিলো মুকুলিকার। দাগটা মিশে গেছে কিন্তু বুকের ভেতরের ক্ষতটা সারেনি। মা-শাশুড়ি মা বলেছিল পুরুষ মানুষের অমন একটু-আধটু রাগ থাকেই বাপু, তাই একটু মানিয়ে নিতে হয়। কিন্তু না মুকুলিকা এই পুরুষমানুষের একটু-আধটু রাগ মেনে নিতে পারেনি। কারণ তাঁর কাছে পুরুষ ওর মতোই মানুষ সিংহ নহে।

 


0 comments:

Post a Comment