দ্বিতীয় বসন্ত
অভ্রতনু গাঙ্গুলী
আজ ১০ই ফাল্গুন, মঙ্গল বার। নতুন বসন্তের আগমনে আকাশ-বাতাস বিভোর।পড়ন্ত
গোধুলির শেষ আলোটা, ছুঁয়ে যাচ্ছে
তেতলার খোলা ছাদের ঈশান কোণে মাথা নাড়াতে থাকা ঐ রুদ্রপলাশ গাছটিকে। আলো-আঁধারি, ফুলের গন্ধ, রক্তাক্ত পলাশ আর ঝরা পাতার খস্-খস্ আওয়াজ যেন, রচনা করছে এক ব্রাহ্ম মুহূর্ত।
খানিকক্ষণ বাদেই ঘটল ছন্দপতন!! হঠাৎ
তেতলার চিলেকোঠার ঘরের পাশের টিনের দরজায় এক জোড় ধাক্কার আওয়াজ। তার পর ২-৩ সেকেন্ডের বিরতি, ফের হঠাৎ কানে ভেসে এল এক বিকট গোঙানির আওয়াজ আর একটি
মেয়ের ভয়ার্ত আর্তচিৎকার মিশ্রিত ক্রন্দন ধ্বনি।সাথে কিসের একটা যেন 'ছম্- ছম্' আওয়াজ। টিনের দরজায় বার দু-তিনেক ধরাস-ধরাস আওয়াজের পর, বেরিয়ে এল সে- 'ঠুমরী'
বয়স ১৮। গায়ের রঙটা একটু চাপা। চোখ
দুটো দেখলে মনে হয় সে যেন এ যুগের কৃষ্ণকলি। মাথা ভর্তি খোলা চুল তবে অগোছালো, এলোমেলো। দেখলে মনে হচ্ছে কেউ বোধহয় তার চিরুনিটিকে বেশ
কিছুদিন হল লুকিয়ে রেখেছে। গায়ে একটা
নোংরা ফ্রক।শীতের শুষ্কতা ছাপ ফেলেছে তার হাত-পায়ে।
তখন যে বলছিলাম ঐ ছম্-ছম্ আওয়াজটার
কথা,
ওটা হল ঠুমরীর ডান পায়ে বাঁধা ঘুঙ্গুরের আওয়াজ। ঘুঙ্গুরের পরে সে হাঁটতে- হাঁটতে চলে গেল ছাদের ঐ ঈশান কোণে
দাঁড়িয়ে থাকা রুদ্রপলাশ গাছটির নীচে।
হাঁটার নির্দিষ্ট কোনো ছন্দ নেই কারণ ওর বাঁ পা টি ছিল ডান পা এর তুলনায় অনেকটাই
ছোটো। তবুও গুটিগুটি পায়ে মাথা নাড়তে-নাড়তে ঠিকই এগিয়ে যাচ্ছে তার গন্তব্যের
দিকে। গাছটা ঠুমরীর বাড়ির দেওয়াল লাগোয়া জায়গায়। এতটাই লম্বা যে তার মাথায়
ধরা রক্তাক্ত রুদ্রপলাশ গুলি গা এলিয়ে যেন রক্তবর্ষণ করছে ঐ তেতলার খোলা ছাদে।এই
বসন্তে রোজ পড়ন্ত গোধুলির ম্লান আলোয়
টলতে-টলতে তেতলার ছাদে উঠে আসে ঠুমরী।রোজ কুড়োয় রুদ্রপলাশ।মাঝেমাঝে আপন খেয়ালে সেগুলোকে ছুঁড়ে দেয় নিজের মাথার
উপর আকাশের দিকে।
সেই ফুলগুলি নীচে পরার সময়, যখন তার শরীর স্পর্শ করে- তখন অনাবিল আনন্দে খিলখিলিয়ে
হেসে ওঠে ঐ অষ্টাদশী তরুণী। সেই অম্লান আনন্দের সাথে একাত্ম হয়ে মিশে যায় তার
কম্পমান পায়ের সেই ঘুঙুরের আওয়াজ।
হ্যাঁ..! আপনারা ঠিকই ধরেছেন ঠুমরী
আমাদের আর পাঁচ জনের চোখে স্বাভাবিক নয়। সে হল "পার্কিনসন্" রোগের
শিকার। অনেকে তাকে বলে পাগল। ওর নাকি
মাথার ব্যামো আছে। ঠুমরী নাচতে বড্ড ভালোবাসে। ঘুঙ্গুরের ছম্-ছম্ আওয়াজে মাতিয়ে রাখে আকাশ-বাতাস। অদম্য
নাচের ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও ভালোভাবে নাচতে পারে না কারণ জন্মের পর থেকেই ওর বাঁ পা
টি বাঁকা।
এদিকে ডান পায়েও রয়েছে দগদগে
পোড়ার ক্ষতচিহ্ন।
কেন??? ঠিক কি হয়েছিল ঠুমরীর সাথে????
আজ থেকে প্রায় তিন মাস আগে 'ঠুমরী'র সাথে বিয়ে হয় 'অনুরণন' এর।বলাইবাহুল্য
একরকম জোর করেই। যেই না মেয়ের আইনত বিয়ের বয়স হল ওমনি বাড়ির লোক, মেয়ের বোঝা কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলার কাজটা সেরে ফেললেন খুব
শীঘ্রই। তা সেই মেয়ে যতই Special child (পড়ুন পাগল)
হোক না কেন...!!! এদিকে শ্বশুড়ের প্রচুর ধন-সম্পত্তি পাবার লোভে অনুরণন এর
পরিবারের লোকেরাও এই প্রস্তাবে এক বারের জন্যও নাক সিঁটকোয় নি। বলেছিল, এমন লক্ষ্মীমন্ত মেয়েকে গড়েপিটে নেবে তারা।
কিছু বোঝার আগেই বিয়ে হয়ে গেল
ঠুমরীর। জীবনে লাগল প্রথম বসন্তের নতুন রঙ। কিন্তু এই সবই তার বোধগম্যতার
ঊর্দ্ধে।এক কথায় বলা যায় জীবন-বসন্তের
প্রথম রঙ যেন ঠুমরীর কাছে ফ্যাকাসে।এদিকে
শ্বশুরের সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি লিখিয়ে নেওয়া হল অনুরণন এর নামে।
কিছু দিনের মধ্যেই ঘটল ভোলবদল।
ইতিমধ্যেই ঠুমরীর আচার ব্যাবহারে বিরক্ত হয়ে উঠল তার শ্বশুড়বাড়ির লোকজন।ঘুঙুরের
আওয়াজ যখন মধ্যদুপুরে তার শ্বাশুড়ির ভাতঘুম এ ব্যাঘাত ঘটাত, তখন তিনি তারস্বরে চিৎকার করে বলে উঠতেন 'আহ্! পাগল মেয়ের
আবার শখ কতো...!!'
এদিকে মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ
অনুরণন ও বেশ বিরক্ত। সারাদিন বাইকে চেপে ডাক্তারদের কাছে ভিজিট করে দিন শেষে
বাড়ি ফিরে বউ এর পুতুল খেলা, ঘুঙুরের আওয়াজ, আর হঠাৎ- হঠাৎ অট্টহাস্য রোজ-রোজ আর সহ্য হচ্ছিল না
তার।কিন্তু অবুঝ ঠুমরী নিজের অভ্যাস বদলাতে নারাজ। তিনমাস হল তার এক নতুন অভ্যাস
হয়েছে। বিয়ের পর ওর মা বার-বার করে বলে দিয়েছিল রোজ স্নানের পর স্বামীর মঙ্গল
কামনায় সিঁথি ভর্তি সিঁদুর পরতে- এটা কিন্তু ঠুমরী ভোলেনি। রোজ এক পায়ে ঘুঙুর
বেঁধে নেচে বেড়ানোর মতো, সিঁদুর পরাটাও এখন
তার নতুন অভ্যাস।
একদিন কি হয়েছিল জানেন??
ঠুমরী বাৎসল্য বশত, কোনো একদিন তার ঐ ঘুঙুরজোড়া অনুরণনের অফিস ব্যাগে পুরেদিয়েছিল।
বলাইবাহুল্য এই কারণে অনুরণন, সেদিন তার কলিগদের
কাছে চরম ঠাট্টার পাত্র রূপে পর্যবশিত হয়েছিল।
রাগ সামলাতে না পেরে রাত্তিরবেলা
ছাইপাঁশ গিলে বাড়ি ফিরে এসে নিজের হাতে সিঁথির সিঁদুর মুছে দিয়েছিল ঠুমরীর।
ঠুমরী তখন শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল। চোখের পলক পরেনি ওর। এমনকি বাড়তি
পাওনা হিসাবে জুটেছিল শ্বাশুড়ির হাতের গরম খুন্তির ছ্যাঁকা। তবুও ঠুমরী সেদিন
কাঁদেনি। পরদিন সকালেই ব্যাগপত্র গুটিয়ে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হয়েছিল
তাকে। সেই ব্যাগের মধ্যে কিন্তু ছিল ওর প্রিয় ঘুঙুরটিও।
এরই মাধ্যমে তিনমাসের
"শ্বশুড়বাড়ি" জীবনের পাঠ চুকে গেল ঠুমরীর।
এখন বাপেরবাড়িই ঠুমরীর Permanent
address.. ঐ ঘটনার পর থেকে অনুরণনরা আর কোনো
যোগাযোগ রাখার প্রয়োজন বোধ করেনি।
তবে, আজ ঠিক ৩ মাস ১২ দিন পর, নব-বসন্তের হঠাৎ
দমকা হাওয়ার মত ঠুমরীর বাড়ির সদর দরজায় কড়া নাড়ল অনুরণন, সঙ্গে তার মা। দরজা খুলে আঁতকে উঠল ঠুমরীর মা।
---একি অবস্থা অনুরণনের!!
হুইল চেয়ারে বসে আছে সে! সারা শরীরে
বাঁধা ব্যান্ডেজ ।
ওর মার সাথে কথা বলে জানা গেল, গত এক সপ্তাহ আগে ডাক্তারের চেম্বার ভিজিট করে ফেরার পথে
বাইক অ্যাক্সিডেন্ট হয় অনুরণনের। ভেঙে যায় ডান হাত, ক্ষত-বিক্ষত হয় পা, চোট লাগে বুকের পাঁজরে।ডাক্তার বলেছে
পাঁজরের চোট পুরোপুরি ভাবে সারবে না কোনো দিনও। কিন্তু এই চরম অসুস্থতার মধ্যে
কেনো এসেছে সে? উত্তরে জানা গেল, পরশু রাতের থেকে অনুরণন চোখ বুঁজে শুধু একটা নামই
আওরাচ্ছিলল সেটা হল 'ঠুমরী'।অনুরণন ম্লান গলায় বলেছে, কেন জানি ঠুমরীকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে! গত তিনমাস তো কাজের চাপে ঠুমরীকে
সেভাবে সময় দিতে পারেনি সে। কিন্তু গত পরশু থেকে এই তীব্র যন্ত্রণার মধ্যেও কেন
যেন চোখ বুঁজলে শুধু ঠুমরীকেই দেখতে পায়। তাই শারীরিক যন্ত্রণার পাহাড়কে অতিক্রম
করে সে ছুটে এসেছে ঠুমরীকে দেখতে। অন্তত একবার চোখের দেখা-একবার..!!
তাই হাজার অনিচ্ছা সত্ত্বেও জামাই এর
এই শারীরিক অবস্থা দেখে মুখ ফেরাতে পারলেন না ঠুমরীর বাবা।স্ত্রীকে বললেন
"যাও, ডেকে নিয়ে এসো মেয়েকে।"
সেই পড়ন্ত বিকেলে তেতলার খোলা ছাদে
ফুল কুড়োতে থাকা ঠুমরীকে ডাকতে গেল তার মা। গম্ভীর কণ্ঠে ঠুমরীর উদ্দেশ্যে বললেন
" এই মুখপুড়ি, তোর বর এসেছে।
একবার তোকে দেখতে চায়।"
এই কথা শোনামাত্রই তার সকল
প্রতিবন্ধকতা জয় করে, ঘুঙুর পরা ডান
পায়ে ভর দিয়েই তিনতলার ছাদ থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নেমে আসল ঠুমরী, হাতে একখানা রুদ্রপলাশ।
ঘুঙুর পায়ে সিঁড়ি ভাঙার ছম্-ছম্
শব্দের ছন্দপতন ঘটল, অনুরণনকে দেখা
মাত্রই। হঠাৎ চারিদিকটা কেমন যেন থমথমে হয়ে গেল।তারা একে অপরের দিকে
তাকালো।প্রথমে সেটা খানিকটা মন থেকে না চেয়েই। পরক্ষণেই তারা দৃষ্টিক্ষেপের
মাধ্যমে একে অপরের সাথে দীর্ঘ তিন মাসের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব কষে নিল।
অনুরণন দেখল, ঘুঙুর পরা পায়ে, এলোমেলো চুলে, একটি রুদ্রপলাশ
হাতে তার দিকে টলতে-টলতে এগিয়ে আসছে ঠুমরী। আর মুখে একটা অদ্ভূত গোঙানির আওয়াজ।
এদিকে হুইল চেয়ারে বসে থাকা অনুরণনের
ব্যান্ডেজ বাঁধা ডান পায়ের ফাঁক দিয়ে চোঁয়াচ্ছে রক্ত। কিন্তু ঠুমরীর আচরণ দেখে
থম্ মেরে গেল অনুরণন। মেয়েটা আগের চেয়ে কেন যেন অনেক শান্ত হয়ে গেছে।চোখের
ভাষায় সে যেন কিছু বলতে চায়, কিন্তু কি?
- সেটা অনুরণন বুঝতে পারল না।কিছু ঠাহর
করার আগেই তার হুইলচেয়ারে ঝোলানো পা এর সামনে ধপ্ করে বসে পড়ল ঠুমরী।
হঠাৎ ঠুমরী তার হাতের রুদ্রপলাশটিকে
অনুরণনের পায়ের চুঁইয়ে পরা রক্তে ভিজিয়ে, সেটা দিয়ে রাঙিয়ে তুলল তার তিন মাস ধরে ফাঁকা পরে থাকা সিঁথি।সেই সিঁথি যার
সিঁদুর নিজের হাতে মুছে দিয়েছিল অনুরণন।বিগত তিন মাস কোনো লাল রঙ স্পর্শ করেনি এই
সিঁথিকে।
তারপর রক্তে রঙা লাল সিঁথি নিয়ে
অনুরণনের ব্যান্ডজ বাঁধা পায়ে নতশিরে প্রণাম ঠুকে, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাততালি দিতেদিতে চলে গেল তেতলার ঐ ছাদে আর অস্ফুটে যেন
বলে গেল-
" নক্ষত্রের ভালবাসা কে চায়?
পুড়ে গেলে ছাই নামে যেন!
সকলেই নিজের মতো বাঁচতে চায়,
তা সে যতই বিকৃত হোক না
কেন..!!"
চারিদিকে নামল নিস্তব্ধতা। ঠুমরীর
প্রণাম অনুরণনের মনে দোলা দিল, যেন তা 'দগ্-দগে ক্ষতে নিরাময়ের প্রলেপ'।
বাকরুদ্ধ অনুরণনের চোখ দিয়ে ঝড়ছে
নোনতা আশ্রুধারা।
থমথমে নিশ্চুপ পরিবেশের মধ্যে
ঠুমরীর ঘুঙুরের আওয়াজ আর হাততালির শব্দ
যেন রচনা করল এক নতুন বসন্ত। এই বসন্তই ঠুমরীর জীবনের "দ্বিতীয় বসন্ত"
- যেখানে থাকবে না কারো কথা রাখার প্রতিশ্রুতি, সে বাঁচবে নিজের জন্য।
এবার থেকে ঠুমরীর সিঁথিতেই বাঁচবে
অনুরণন,
সাথে নয়।
এদিকে নিশ্চুপে নতশিরে ধীরেধীরে
বাড়ি ফিরে গেল অনুরণন ও তার মা। ঠুমরী ততক্ষণে খোঁড়াতে- খোঁড়াতে আবার পৌছে গেছে
তার আপন রাজত্ত্বে- তেতলার ঐ ছাদে।
হঠাৎ শোনা গেল ছাদ এর থেকে বিশাল
জোরে কিছু একটা পরার আওয়াজ।
এখন পুরো ছাদ ফাঁকা, শুধু ছাদের এক কোণে মুখবুজে পড়ে রয়েছে কিছু রুদ্রপলাশ আর
ঠুমরীর পায়ের ঐ ঘুঙুরটি। কোকিলের ডানায় ভর দিয়ে সূর্য গেছে অস্তাচলে। ঘরে ঘরে
বেজে উঠছে শঙ্খধ্বনি। দূর থেকে ভেসে আসছে
মৃদু গানের সুর-
" অকাল বোধনে বসন্ত এল,
কৃষ্ণচূড়া অবনত হল কোলে,
চরাচর জুড়ে, এল হাওয়া উত্তাল;
নাচে ধমনীতে শোণিতের স্রোতে,
উদ্দাম মহাকাল...!!!"
0 comments:
Post a Comment