আলোকোজ্জ্বল আকাশ
অমিতাভ দত্ত
বাউরী পাড়ায় কলতলের ঝগড়ায় ঘুম ভেঙেছে, এই সবেমাত্র জল এসেছে কলে। যত রাজ্যের
নতুন নতুন গাল, একটিও অভিধানে স্থান পাইনি। অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে চরম প্রতিবাদের
ভাষা গায়ের ঝাল-ঝাড়ার ভাষা। "মন্সা থানকে চল, কিড়া খা, তব্কে জাইনব-কার পালি ছিল।
বাপ্ ভাতারি, তুর মুখে পোকা পইড়ব্যেক" ইত্যাদি ইত্যাদি আরো কতো। মদন বাসে কাজ
করে। গতরাতে গাড়ির কাজ করিয়ে, শুতে-শুতে ওর রাত বারোটা বেজে গিয়েছিল। মদনের বউ তুলুসী,
ওকে এক ডোল জল দিয়ে চলে গেল লাইনের ধারে। মদনের তিন বছরের বাচ্চাটা, তখনো ওঠেনি। মুখ
ধুয়ে, ঘরের শিকলটা তুলে, মদন চলে গেল কাজে। আসবে সেই রাত দশটা সাড়ে দশটার সময়। পাড়ার
মোড়ের ফেলুদার চায়ের দোকান তখনো খোলেনি। মদন ভাবলো, বাস-ষ্ট্যান্ডে গিয়েই খেয়ে নেবে
আজ। ভোর পাঁচটা চারে, মদনের বাসের ফার্স্ট ট্রিপ। রাস্তায় কারখানার মোড়ে নিজামের সাথে
দেখা হয়ে গেল। নিজাম অন্য বাসের ড্রাইভার। মদন খালাসীতে কাজ করে।
এদিকে মদনের বউ ফিরে এসে দেখে, ঘরে শিকল চাপানো, আর, বাচ্চাটা দম ফাটিয়ে
কাঁদছে। এটা অবশ্য নতুন কোনো ঘটনা নয়, এরকম প্রায়ই হয়। মদনের বউ তুলুসী কাঠগাদা থেকে,
কাঠ বার করে, চুলাটা ধরিয়ে দিল। সেই ফাঁকে মোবিলের জ্যারক্যানটা কলতলায় রেখে এলো। তারপর
লাল চা বানালো। তখন কারখানার শেষ ঘন্টা হয়ে গেছে।
মদন আর তুলুসীর বাচ্চাটা খুউব ভালো। কোনো জ্বালাতন করে না। এই সবে সাড়ে
তিন চার বছরের হবে। লাল চা আর মুড়ি খেয়ে, বেড়িয়ে গেল খেলতে। বাচ্চাটার নাম রেখেছে ওরা
লাদু। ছেলেটার পেট ভর্তি থাকলে, আর কিছুই চাই না, কোনো বায়না নেই।
বাস লাইনে কাজ করা স্টাফদের বেশিরভাগটাই কিন্তু নেশাগ্রস্থ। মদনও খুব মদ
খেত। এক তো, দারিদ্র্যের সংসার, আর, তার উপরে মদের নেশা। সব মিলিয়ে গোদের ওপরে, বিষ
ফোঁড়া। মদনের সাথে বাসেই কাজ করে সিরাজ ও প্রায়ই আসত মদনের বাড়িতে। সিরাজ তখনও বিয়ে
করেনি। ওদের কষ্টের সংসার জীবন দেখে, কিছু কিছু সাহায্যও করত। দরিদ্র খেটে খাওয়া বস্তিবাসীদের
এসব নিয়ে বিশেষ সমস্যা নেই। যা কিছু সমস্যা, তা
মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত, মোছে ঘীয়ের গন্ধ লাগা, পরনিন্দা পরচর্চা করা
বাবুদের।
বাউরী পাড়ার থেকে বেরিয়েই, মূল রাস্তায় এক নতুন পরিবার ভাড়া এসেছে, ইতিকা
যূথিকাদের বাড়িতে। ওরা দুই বোন এক ভাই। পাড়াতে ভাইয়ের নাম মনু। আসল নামটা পাড়াতে বেশিরভাগ
লোকই জানতো না। যিনি ভাড়া এসেছেন, তাঁর নাম বিশ্বনাথ হাজরা। উনার বউটিও পরোপকারী, এছাড়াও
একটি
ভালো মন আছে। সবাইকেই বেশ আপন করে নিতে পারে। নাম হলো গিয়ে আলোকি। বড়ো জোর
মাস দু’য়েক হলো এসেছে। এরই মধ্যেই গোটা পাড়ার, আলোবৌদি। এরকম যাদুমন্ত্র অবশ্য, কারো
কারো থেকে থাকে। কিছু দিন পরেই ওদের বাড়িতে আরেকটি মেয়ে দেখলো পাড়ার লোকে। মেয়েটির
নাম গায়ত্রী। সে দিদির কাছে থেকেই বোটানিটা পড়বে ঠিক করেছে। গ্রামের বাড়ি থেকে কলেজ
দূরে, যেতে আসতেই দিন শেষ। দিদির গুণগুলি সবই আছে। ওরকম মেয়ে পাড়াতে আর একটিও নেই।
পাড়ার গরীব ছেলেমেয়েদের সপ্তাহে চারদিন পড়িয়েদেয়। সবার মুখে মুখে নাম ছড়িয়ে পড়লো পাড়ায়।
গায়ত্রীদি নামেই সবাই ডাকতে লাগলো। মদনের বউ
একদিন নিয়ে এলো, ওর ছেলেটাকে, গায়ত্রীদির কাছে পড়াতে দেবে বলে। মেনী, তারি,
সাজনা, সাবি তখন তুলুসীকে জিজ্ঞেস করলো, ' হঁ রে তুলুসী,
ছেইল্যাটকে টাই্নত্যে টাই্নত্যে, কুথায় যেছিস?
বোলিহারী ব্যেটিস্ তুঁই ত! কলে ল্যে ক্যানে।' তুলুসী
লাদুকে কোলে তুলে বললো,– "গ্যেই্দে জ্বালাইচ্ছ্যে
গ, তাতেই পোইড়ত্যে দিব। গায়ত্রীরি দিদিমণির কাছক্যে। হঁ বুন তুরা কুথাক্যে
যেছিস? ওরা বললো,– "পোখুরধারক্যে, তুঁই যাবিকি? যা তাইলে
আয়গা। আমরা দাঁড়াইচ্ছি।"
গায়ত্রীদের দরজায় উঠতে যাবে, আর ঠিক সেই মূহুর্তেই, একটা মোটর সাইকেলে সিরাজ
সহ আরো দু’জন এসে বললো, "জানো বৌদি মদনদার গাড়ি পাল্টি মেরেছে। মদনদা নাই।"
আলোবৌদি, গায়ত্রী দিদিমণি কান্নার শব্দে বেরিয়ে এলো বাইরে। ঠিক তখনই বাউরী
পাড়ার ধারে, রেল লাইনের উপর দিয়ে দ্রুতগতিতে ছুটে চলে গেল একটা রেলগাড়ি।
সব কাজটাজ পেরিয়ে যাওয়ার পর, সিরাজ তুলুসীকে বিয়ে করেছে। স্ত্রীর মর্যাদা
দিয়েছে, আর মদনের ছেলেটাকে গায়ত্রীদিদিমণিই পড়াচ্ছে।
0 comments:
Post a Comment